Ajker Patrika

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে বিশ্বের ওপর কী প্রভাব পড়বে

ইয়াসিন আরাফাত, ঢাকা 
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪: ৫৮
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে বিশ্বের ওপর কী প্রভাব পড়বে

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলছে চরম উত্তেজনা। এতে শঙ্কায় পড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ইউক্রেনীয়। তবে রাশিয়া হামলা চালালে এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বেও। বিশ্লেষকেরা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এই যুদ্ধ পূর্ব ইউরোপে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি করবে। সরবরাহ শৃঙ্খল এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে ব্যাহত করবে। ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব তো অবশ্যম্ভাবী, যা পশ্চিমাদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারে। 

তবে এই শঙ্কা এখনো এড়ানো যেতে পারে। ইউক্রেন সরকার পুরোদস্তুর যুদ্ধের ঝুঁকি কমানোর জন্য চেষ্টা করছে। এ নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা একটি কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করছে। এদিকে বাইডেন প্রশাসন কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই ভবিষ্যদ্বাণী করছে যে, এই যুদ্ধ খুব শিগগিরই হবে। তবে যুদ্ধ হলে এর রূপ কেমন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ অবস্থায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কী করবেন, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। 

এ নিয়ে ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রাশিয়া ও ইউরেশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো নাইজেল গোল্ড-ডেভিস মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, এই সময়ে যেকোনো যুদ্ধই ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এই ভয়ংকরেরও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। 

বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ হলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আঞ্চলিক সামরিক জোট ন্যাটো। তাদের ওপরই নির্ভর করবে এই যুদ্ধ কত দিন স্থায়ী হবে ও এর প্রভাব কেমন হবে। 

যদিও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ জানিয়েছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালালে কমব্যাট সেনা মোতায়েন করবে না ন্যাটো। তবে তিনি জানিয়েছেন, যুদ্ধ হলে সহযোগী দেশ ইউক্রেনকে সহযোগিতা করবে ন্যাটো। 

যুদ্ধ হলে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা ইউরোপজুড়ে জ্বালানি সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করবে

কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে এটি পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা চরম আকার ধারণ করতে পারে। বলে রাখা ভালো, ন্যাটো প্রধান স্টলটেনবার্গ যে সম্ভাব্য যুদ্ধে সেনা মোতায়েন না করার কথা আগ বাড়িয়ে বলেছেন, তার কারণটি রয়েছে সংকটের প্রেক্ষাপটের ভেতরেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের দিকেই জোর দিচ্ছেন। কারণ, রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য যে কয়টা শর্ত দিয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে ন্যাটো জোটে ইউক্রেনকে যুক্ত না করার বিষয়টি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এই দেশকে তারা কোনোভাবেই ন্যাটো জোটে দেখতে চায় না। এই শর্ত ‘পরিপালনযোগ্য’ নয় বলে এরই মধ্যে পশ্চিমা পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হলেও স্টলটেনবার্গের ভাষ্য বলে দেয়, তারা বেশ সতর্ক। একই সঙ্গে শেষ কথাটি দিয়ে তারা সম্ভাব্য যুদ্ধে তাদের সংযোগের পথটি খোলাই রেখেছে। 

বলা যায় ইউক্রেনকে ঘিরে তৈরি হওয়া সংকটের মধ্য দিয়ে গোটা ইউরোপ সরু সুতার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে বলা যায়। রাশিয়া ও ইউরেশিয়াবিষয়ক গবেষক নাইজেল গোল্ড-ডেভিস যেমনটা বলছেন, গত শতকের ৮০-এর দশকের পর ইউরোপ এবার খুব সহজেই সবচেয়ে ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকটে পড়তে পারে। 

এ নিয়ে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া কর্মসূচির পরিচালক জেমস নিক্সি সিএনএনকে বলেন, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটি কী হবে, তা নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মৌলিক মতবিরোধ রয়েছে। এখন রাশিয়া যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি এমন এক বাস্তবিক সমস্যা, যার বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে। 

ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া একদিকে সেনা বাড়িয়েছে, অন্যদিকে পশ্চিমা নেতাদের উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্যও বাড়ছে। গত ২৩ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সিএনএনকে জানান, যেকোনো হামলার জন্য রাশিয়ার ভয়াবহ পরিণতি হবে। 

এদিকে পূর্ব ইউরোপে সামরিক উপস্থিতি দ্বিগুণ করার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সব মিলিয়ে দুই পক্ষ থেকেই এমন সব বক্তব্য আসছে, যা উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। 

এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলা নিয়ে পুতিনকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই হামলা চালানো হলে বড় মূল্য চোকাতে হবে রাশিয়াকে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ইউক্রেন ইস্যুতে একটি সামরিক ঐক্য তৈরি হচ্ছে ইউরোপে। 

জেমস নিক্সি যেমন বলছেন, এ ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা নির্ভর করছে ইউক্রেনে রাশিয়ার কত সেনা পাঠাবে, তার ওপর। অনেক বিশ্লেষক এখনো আশাবাদী যে, একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। ইউক্রেনে হামলা চালালে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব পড়বে ইউরোপের পূর্বাঞ্চল ও বাল্টিক রাজ্যগুলোয়। 

তবে এই সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে ছাড় দেওয়া উচিত নয় বলেই মনে করেন জেমস নিক্সি। তাঁর মতে, সংকট নিরসনের জন্য রাশিয়াকে যদি আবারও সীমানা পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়, বা এমন আচরণে নিরুৎসাহিত করা না হয়, তবে তারা একেই একটি উপায় হিসেবে বেছে নেবে। তারা তখন খুঁজবে এর পর অনুরূপ পদক্ষেপ কোন অঞ্চলের জন্য নেওয়া যায়। 

একই কথা বলেছেন ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো নাইজেল গোল্ড-ডেভিস। তিনি বলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে ন্যাটোর অনেক দেশের সীমান্ত রয়েছে। এ নিয়ে অনেক উদ্বেগের বিষয় থাকবে। কারণ, যুদ্ধ হলে এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে পড়বে। আর এতে ওই সব দেশের নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হবে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার উদ্দেশে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেনমোদ্দা কথা ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর মুখোমুখি রাশিয়া যেভাবে দাঁড়িয়েছে, তার সমাধান খুব একটা সহজ পথে আসবে না বলেই মনে হচ্ছে। এর সমাধানের পথটি কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে এ বিষয়ে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়ার ওপর। শুরুতেই স্টলটেনবার্গের সর্বশেষ বক্তব্যের সূত্র ধরে, যা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। ন্যাটো জোট বিষয়টি নিয়ে সতর্কাবস্থায় রয়েছে—এটা স্পষ্ট। 

ইউক্রেন ন্যাটোর কোনো সদস্য দেশ নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য ও রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইউক্রেন কয়েক বছর আগে ন্যাটোর সদস্য পদের জন্য আবেদন করে। এর পর থেকেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে উত্তেজনার শুরু। সম্প্রতি ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্যপদ না দিলেও ‘সহযোগী দেশ’ হিসেবে মনোনীত করায় আরও বাড়ে এই উত্তেজনা। তবে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য না হলেও এর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সামরিক জোটের অন্তর্ভুক্ত। আর সেগুলোকে রক্ষার জন্য হলেও পূর্ব ইউরোপে সেনা মোতায়েন করবে ন্যাটো। 

এর ইঙ্গিত অবশ্য গত ২৩ জানুয়ারিই পাওয়া গিয়েছিল। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি সেদিন জানিয়েছিলেন, প্রায় সাড়ে ৮ হাজার সেনা পূর্ব ইউরোপে মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক অবস্থানের কথাও সেদিন জানিয়েছিলেন। এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন মার্কিন কর্মকর্তা পরে সিএনএনকে বলেন, আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরিতে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করতে পারে। 

যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অধ্যয়ন বিভাগের পরিচালক নিল মেলভিনের মতে, ন্যাটোর সামরিক জোটকে এই যুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে হবে। তাদেরকে ঘিরে পুরো যুদ্ধের কৌশল সাজাতে হবে। আর এটি ইউরোপে অনেক বড় পরিবর্তন আনবে। মেলভিনের ধারণা, যুদ্ধ হলে প্রচুর সেনার প্রয়োজন হবে। আর এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন সেনা আনতে হবে, যা ইউরোপে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। 

এ তো জানা কথাই যে, যুদ্ধের পেছন পেছন আসে অর্থনৈতিক সংকট। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে দেশটির কৃষিজাত পণ্য সরবরাহে বাধা তৈরি হবে, যা খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাবে। আর এই সংকটের সঙ্গে ইউক্রেন যেহেতু জড়িয়ে, তখন খাদ্য সংকটের আশঙ্কা আরও বেশি। কারণ, বিশ্বের অন্যতম চারটি শস্য রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে অন্যতম ইউক্রেন। বাজার বিশ্লেষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন্স কাউন্সিলের তথ্যমতে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের ভুট্টা আমদানির ছয় ভাগের এক ভাগই হবে ইউক্রেন থেকে। সুতরাং এই দেশে হামলা চালানো হলে পুরো বিশ্বের খাদ্য সরবরাহেই প্রভাব পড়বে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা। কারণ, ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যে চারটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে, সেগুলো হলো—রাশিয়া, নরওয়ে, আলজেরিয়া ও কাতার। এর মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে আসে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ ও নরওয়ের কাছ থেকে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাকি যেসব দেশ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আসে, তা শতাংশের হিসাবে ১০-এর কম। একই চিত্র অপরিশোধিত তেলের ক্ষেত্রেও। 

এরই মধ্যে কয়েক দিন ধরে আলোচনায় এসেছে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন। রাশিয়া থেকে গ্যাস নিতে এই পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে জার্মানি পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি দুই দেশই বলছে, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে হামলা চালায়, তবে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন চালুর কাজ পিছিয়ে যাবে। 

ফলে জ্বালানি প্রশ্নটি অনেক বড় হয়ে দেখা দেবে। এ বিষয়ে নাইজেল গোল্ড-ডেভিস বলেন, আপনি যদি বিশ্বের অন্যতম জ্বালানি সরবরাহকারী দেশের সঙ্গে বড় সংঘর্ষের কথা ভাবেন, তাহলে বড় কোনো প্রভাব ইউরোপের জ্বালানির বাজারে পড়বে না—এমনটি ভাবা আপনার উচিত নয়। 

বলার অপেক্ষা রাখে ইউরোপের এই জ্বালানি নির্ভরতাকে রাশিয়াও যুদ্ধে কাজে লাগাবে। এরই মধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সেই নির্ভরতাকে কাজে লাগানোর অভিযোগ উঠেছে। প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি গত ২৯ জানুয়ারি জানায়, ইউরোপে রাশিয়া তার গ্যাস রপ্তানি হ্রাস করেছে। এতে ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্যাংক অব আমেরিকার তথ্যমতে, জ্বালানি খরচের মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যে ইউরোপের লাখ লাখ বাড়িতে আঘাত হেনেছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছর একজন ভোক্তাকে অতিরিক্ত ১ হাজার ৭৫ ডলার বেশি খরচ করতে হবে জ্বালানির জন্য। আর পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ হলে বেশ কয়েকটি দেশের জীবনযাত্রার খরচ আরও বাড়বে। 

জ্বালানি এই মুহূর্তে ইউরোপের আরেকটি বড় উদ্বেগ। রাশিয়ার জন্যও হতে পারত। তবে ততটা হচ্ছে না। কারণ, ইউরোপের বাজার নিয়ে সমস্যা হলেও রাশিয়া চীনে জ্বালানি সরবরাহ করে তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবে। সম্প্রতি চীনে রাশিয়ার কয়লা ও গ্যাস সরবরাহও বেড়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি এই সরবরাহ আরও বাড়াবে। অর্থাৎ, রাশিয়া ইউরোপ বিমুখ হয়ে উঠবে। এটা একটা বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেবে। এতে বিপদে পড়বে ইউরোপই। কারণ, তাদের সামনে বিকল্প তৈরির জন্য সময় বেশি থাকবে না। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে নজর যাবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপকে নজর দিতে হলে সংকটে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি করে জড়িয়ে যাবে, যা অবধারিতভাবেই ময়দানে টেনে আনবে চীনকে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোয় চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এখন আর অপ্রকাশ্য কিছু নয়। এরই মধ্যে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বলে জানিয়েছেন এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা। একই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনার কথাও তিনি জানান। 

এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন সেক্টরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকের পর ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে এমনটি জানানো হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইউক্রেনে হামলা চালানো হলে রাশিয়ার ওপর বেশ কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে, যা রুশ ব্যাংগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ছাড়া তাদের তেল, গ্যাস ও প্রযুক্তি খাতেও প্রভাব ফেলবে এই নিষেধাজ্ঞা। তবে এটি শুধু রাশিয়াকে নয়, গোটা ইউরোপের ওপরই প্রভাব ফেলবে। 

এ ক্ষেত্রে মোক্ষম কথাটি বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিভাগের সাবেক আন্ডারসেক্রেটারি নাথান সেলস। তাঁর মতে, যেকোনো সময় আপনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। তবে এতে আপনার নিজের, বন্ধু ও মিত্রদের ক্ষতির ঝুঁকিও রয়েছে। 

বিষয়টি নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী পক্ষও জানে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও সময়ের সঙ্গে এর কড়াকড়ি কমে আসে। কারণ, টিকে থাকার প্রশ্নটি উভয়ের সামনেই রয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে রুশ ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু এখন এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পশ্চিমাদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ সম্পর্ক রয়েছে। অবশ্য এবার যুদ্ধ বাধলে এ সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে, যা উভয় পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুদ্ধের দামামা পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী অনুভূত হবে। কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, রাশিয়া এই যুদ্ধে জয় পেলে অন্যান্য দেশও সীমান্তে একই রকম কৌশল নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলো নিয়ে নতুন ভূরাজনৈতিক ছক সামনে হাজির হতে পারে। সে ছকে নিশ্চিতভাবেই চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থাকতে উল্লেখ করার মতো। 

বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল–জাজিরার নিবন্ধ /ভারতকে একঘরে করতে দক্ষিণ এশিয়ায় নয়া জোটের সন্ধানে পাকিস্তান, সফল হবে কি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ২৮
ভারতকে একঘরে করতে দক্ষিণ এশিয়ায় নয়া জোটের সন্ধানে পাকিস্তান, সফল হবে কি

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা অন্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও ‘বিস্তৃত’ হতে পারে। তিনি গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে বলেন, ‘আমরা শূন্য-সমষ্টিগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছি এবং সংঘাতের বদলে সহযোগিতার আবশ্যকতার ওপর ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়েছি।’

বস্তুত, এই প্রস্তাব দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চীনকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিকল্প জোট তৈরির ইঙ্গিত। বিশেষত এমন এক সময়ে যখন ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে এই অঞ্চলের প্রধান সংস্থা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজওনাল কো-অপারেশন বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা–সার্ক কার্যকারিতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে।

গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, এই সহযোগিতা ‘কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রতি লক্ষ্য করে নয়।’

দারের এই মন্তব্য এমন এক প্রেক্ষাপটে এল, যখন আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে—পাকিস্তান–ভারতের কয়েক দশকের পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী গত মে মাসে চার দিনের যুদ্ধে জড়িয়েছিল, যা সম্পর্ককে আরও টানাপোড়েনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ঢাকা–নয়াদিল্লি সম্পর্কও ব্যাপক খারাপ হয়েছে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান এবং নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়নি। গত নভেম্বরে বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো–সার্কে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান এবং আফগানিস্তান রয়েছে–তারা কি এই নতুন আঞ্চলিক জোটকে মেনে নেবে? মনে হচ্ছে এই জোট ভারতকে বাদ দেওয়ার, কিংবা অন্তত দেশটির প্রভাবকে সীমিত করার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হচ্ছে।

উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে এই ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের লক্ষ্য হলো—অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রগুলোতে ‘পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি’ করা এবং এই ধারণাটি আরও দেশ ও অঞ্চলে ‘বিস্তৃত ও অনুকরণযোগ্য’ হতে পারে। তিনি ইসলামাবাদ কনক্লেভে বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বহুমুখী বাস্তবতা থাকতে পারে।’

তিনি ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজন এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকারগুলো কারও গোঁড়ামির কাছে জিম্মি থাকতে পারে না এবং আপনারা জানেন, আমি কাকে ইঙ্গিত করছি।’ ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যেকার উত্তেজনা প্রসঙ্গে দার উল্লেখ করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘কাঠামোগত আলোচনার’ প্রক্রিয়া ‘১১ বছরের বেশি’ সময় ধরে থমকে আছে। তিনি আরও যোগ করেন, অন্যান্য আঞ্চলিক দেশগুলোরও ‘আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দোদুল্যমান সম্পর্কের’ অভিজ্ঞতা রয়েছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে ‘বিভাজনের’ জায়গায় যোগাযোগ ও সহযোগিতা স্থান নেবে, যেখানে অর্থনীতিগুলো পারস্পরিক সমন্বয়ে বৃদ্ধি পাবে, আন্তর্জাতিক বৈধতা অনুসারে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধের সমাধান হবে এবং যেখানে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে শান্তি বজায় থাকবে। শিক্ষাবিদ রাবিয়া আখতারের মতে, এই পর্যায়ে প্রস্তাবটি ‘কার্যকর হওয়ার চেয়ে আকাঙ্ক্ষামূলক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’

লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের (সিএসএসপিআর) পরিচালক আখতার বলেন, ‘কিন্তু এটি এমন এক সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে বৈচিত্র্যময় করে তোলার ও নতুন করে সাজানোর পাকিস্তানের উদ্দেশ্যকে তুলে ধরেছে, যখন সার্ক স্থবির হয়ে আছে।’

সার্ক ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় একটি শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর সাতটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ ছিল—বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান অষ্টম সদস্য হিসেবে যোগ দেয়। সার্কের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশীয়দের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটানো।

এর মহৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও, সংস্থাটি গত ৪০ বছর ধরেই লক্ষ্য অর্জনে লড়াই করেছে। এর মূল কারণ হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার কয়েক দশকের পুরোনো উত্তেজনা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা এবং উপমহাদেশ বিভাজনের পর এই দুই প্রতিবেশী তিনটি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে ১৯ তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু ভারত শাসিত কাশ্মীরে এক প্রাণঘাতী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

সিএসএসপিআর-এর আখতার বলেন, ‘এই সংস্থাটির কাজ করার জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন, আর দুটি বৃহত্তম সদস্য দেশের কাছ থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ থেকে আলাদা রাখার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সার্ক সামনে এগোতে পারে না।’

আঞ্চলিক এই সংস্থাটির শেষ শীর্ষ সম্মেলন ২০১৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে বিশ্লেষকেরা বলেন, সার্ক নিষ্ক্রিয় থাকলেও এই অঞ্চলের জন্য কাজ করার সম্ভাবনা তার আছে–যদি ভারত ও পাকিস্তান তাদের সেই সুযোগ দেয়। ২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিশ্বের দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ বসবাস করে, যা দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল করে তুলেছে।

তবুও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য খুবই কম, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাণিজ্যের মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের একটি জোট আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ। আসিয়ান জোটের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি।

বিশ্বব্যাংকের অনুমান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি বাণিজ্য বাধাগুলো হ্রাস করে, তাহলে তারা ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিনিময় করতে পারত–যা তাদের বর্তমান বাণিজ্যের তিন গুণ। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য এখনো করুণ। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সাল নাগাদ তা আরও কমে অর্ধেকে অর্থাৎ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। যদিও অন্যান্য দেশের মাধ্যমে পরিচালিত তাদের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের।

আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাবকে এই অঞ্চলের দুর্বল বাণিজ্য সংযোগের একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৪ সালে, এই জোট একটি মোটর ভেহিক্যালস চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ছিল, যার ফলে ইউরোপের মতো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে গাড়ি ও ট্রাক চলাচল করতে পারত। কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তান সেই চুক্তি–এবং আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা সম্পর্কিত একটি পৃথক চুক্তি–আটকে দেয়।

তারপর থেকে এই জোটের একত্রে আসার ক্ষমতা কয়েকটি উপলক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন কোভিড-১৯ মহামারির সময় যখন সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি জরুরি তহবিল গঠন করে এবং জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করার জন্য ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। বিশ্লেষক ফারওয়া আমের বলেন, ‘যদি এই দুটি দেশ (ভারত ও পাকিস্তান) বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে সহযোগিতার সীমিত পথও চিহ্নিত করতে পারত, তাহলে নীতিগতভাবে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা যেত।’

এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের (এএসপিআই) দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক আমের যোগ করেন, ‘তবে, বর্তমান রাজনৈতিক গতিশীলতা বিবেচনা করে, এমন একটি সাফল্য একটি সুদূর সম্ভাবনা বলে মনে হচ্ছে।’

তবে আঞ্চলিক অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে সার্ককে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা পাকিস্তানই প্রথম করছে না। সার্ক একটি আঞ্চলিক পরিবহন চুক্তি অনুমোদন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল–দেশগুলোর আদ্যক্ষর অনুসারে বিবিআইএন নামে একটি জোট তৈরি করে–নিজেদের মধ্যে একই ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আমের উল্লেখ করেন, ভারত অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা, যেমন বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) অংশ। বিমসটেকে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড রয়েছে।

তবুও, আমের সামগ্রিকভাবে বলেন, ‘অল্প বা মাঝারি মেয়াদে’ আঞ্চলিক বহুপাক্ষিকতার চেয়ে ‘দ্বিপক্ষীয় ও ত্রয়ী ব্যবস্থাগুলোই প্রাধান্য’ পাবে। কারণ, এক বা দুটি দেশের সঙ্গে একবারে কাজ করা ‘বেশি নমনীয়তা, পরিষ্কার প্রণোদনা এবং বাস্তব ফলাফল পাওয়ার বৃহত্তর সম্ভাবনা’ দেয়।

এই অবস্থায় পাকিস্তান যে প্রস্তাব দিচ্ছে, নতুন জোটের তা কার্যকর হবে কী—এই বিষয়ে শিক্ষাবিদ আখতার বলেন, ‘প্রস্তাবটি কার্যকর হবে কিনা তা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত, প্রথাগত কাঠামো যখন থমকে আছে, তখন সম্ভাব্য দেশগুলো ছোট, বিষয়-কেন্দ্রিক দলগুলোতে কার্যকরী মূল্য দেখতে পাচ্ছে কিনা এবং দ্বিতীয়ত, এই অংশগ্রহণের কারণে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে কোনো মূল্য দিতে হচ্ছে কিনা।’

আখতার বলেন, বেশ কয়েকটি দক্ষিণ এশীয় দেশ পাকিস্তানের প্রস্তাবিত আঞ্চলিক উদ্যোগে প্রাথমিক আগ্রহ দেখাতে পারে, যদিও আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণের দিকে কোনো পদক্ষেপ সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ এবং হয়তো ভুটানের মতো দেশগুলো অনুসন্ধানী আলোচনায়, বিশেষ করে যোগাযোগ, জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে, খোলা থাকতে পারে।’

তবে আখতার উল্লেখ করেন, ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা এবং পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ‘আসল সদস্যপদ গ্রহণ সতর্কতার সঙ্গে হবে।’ এই বিষয়ে এএসপিআই-এর আমের মনে করেন পাকিস্তানের প্রস্তাবটি ‘কৌশলগতভাবে সুসংগত।’ তিনি বলেন, ‘দেশটি এখন কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে আছে। তারা চীনের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে নতুন ও উন্নত সম্পর্ক তৈরি করেছে।’

আমেরের মতে, ‘এই দ্বৈত-পথের সম্পৃক্ততা ইসলামাবাদকে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অভিনেতা হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়েছে। কার্যত, আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রে একটি আসন ফিরে পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।’

আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিন জানেন—ইউক্রেনের ‘সময় ফুরিয়ে আসছে’, যুদ্ধ শেষের তাড়া নেই

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রুশদের মতে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেন তাদের শর্তগুলো মানতে চাইছে না, সেটাই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে কিয়েভ এবং তার অধিকাংশ ইউরোপীয় মিত্রদের বক্তব্য, এই যুদ্ধবিরতির চুক্তির পথে প্রধান বাধা হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মঙ্গলবার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল মস্কোয় যান। সেখানে পুতিনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়, যা চলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে। এই দলে ছিলেন আমেরিকার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার।

পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ এই বৈঠককে ‘খুবই কাজের এবং গঠনমূলক’ বললেও স্বীকার করেন যে, ‘সামনে অনেক পথ বাকি।’ তিনি বলেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা হলো ‘মূল প্রশ্ন।’ তবে তিনি এটাও মেনে নেন যে, ভূখণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো সমঝোতা হয়নি।

ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা রাশিয়ার অবস্থানকে একেবারেই হাস্যকর মনে করছেন। কারণ, মস্কোই ২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। তাদের ধারণা, ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে লাগাতার বোমা হামলা চলার কারণে পুতিনের আসলে শান্তিতে কোনো প্রকৃত আগ্রহ নেই।

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ভিজিটিং ফেলো ও রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইলিয়া বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘যেমনটা প্রত্যাশা করা গিয়েছিল, এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, আমেরিকান এবং ক্রেমলিনের মধ্যে যা ঘটছে, তা নিয়ে তাদের ধারণা মূলত আলাদা।’ তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রস্তাবের মূল ধারণা হিসেবে আমেরিকানরা ভূখণ্ড বিনিময়ের যে চেষ্টা করেছিল, তাতে পুতিনের বিশেষ আগ্রহ নেই। তিনি আসলে পূর্ব ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তা কাঠামো পাল্টে দিতে আগ্রহী।’

রাশিয়ার অনেকে ক্রেমলিনের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন এবং অনেকটা একই ভাষায় কথা বলেন। মস্কোভিত্তিক থিংক ট্যাংক ডিগোরিয়া এক্সপার্ট ক্লাবের সদস্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্পার্টাক বারানভস্কির মতামত রুশ সরকারের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে কিয়েভ সরকারের ক্রমাগত নাশকতা, তথ্য বিকৃত করা এবং অনিবার্যকে বিলম্বিত করার চেষ্টা আলোচনা প্রক্রিয়াকে অনেক জটিল করে তুলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেনীয় পক্ষ প্রথমে মিনস্ক চুক্তি কার্যকর করতে রাজি হয়নি এবং পরে ইস্তাম্বুলে আলোচনা হওয়া প্রাথমিক শান্তি চুক্তির শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে। এমন এক ভরসা করার অযোগ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে গঠনমূলক আলাপ চালানো সত্যিই কঠিন।’

মিনস্ক চুক্তি ছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সই হওয়া একাধিক চুক্তিমালা, যার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের দনবাসে চলা যুদ্ধ থামানো, যেখানে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছিল। ২০২২ সালের পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে বেলারুশ ও তুরস্কে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই শান্তি আনতে পারেনি।

যদিও মস্কোয় সর্বশেষ বৈঠকে কী আলোচিত হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ফাঁস হয়নি, তবু রাশিয়ায় সামান্য হলেও একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধের শেষ হয়তো কাছাকাছি। সেন্ট পিটার্সবার্গের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী তাতিয়ানা এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকেই দোষ দেন। তবে তিনি মনে করেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররাই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে বাধ্য করছেন।

তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন করেন, ‘এই পরিস্থিতিতে যখন একমাত্র ট্রাম্পকেই কিছুটা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে। যিনি কিনা আবার স্বভাবগতভাবেই সম্পূর্ণ উন্মাদ। তাহলে বুঝুন দুনিয়ার কী হাল হয়েছে?’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি সবার জন্যই আরও খারাপ। একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে স্পষ্টতই রাশিয়ার পাল্লা ভারী, যা আমেরিকান জেনারেলরাও ভালোই বোঝেন।’

গত মঙ্গলবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ঘোষণা করেন, রুশ সৈন্যরা অবশেষে পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখল করেছে। এর ফলে দুই বছরের অবরোধের অবসান ঘটেছে। ইউক্রেন শহর পতনের কথা অস্বীকার করলেও, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রুশদের অগ্রযাত্রা থামাতে তাদের সেনারা বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনকে দনবাস অঞ্চলের যেসব অংশ এখনো রাশিয়ার দখলে যায়নি, সেখান থেকে সেনা সরাতে হবে। ওই এলাকা একটি নিরপেক্ষ নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হবে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে তা রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত হবে। একই সঙ্গে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকস, যা ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া বা রুশ-সমর্থিতদের নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা ৬ লাখের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

এর বিনিময়ে, রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা আর কোনো ইউরোপীয় দেশ আক্রমণ করবে না এবং এই প্রতিশ্রুতি তাদের আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া, যুদ্ধাপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবও আছে। গত সপ্তাহে পুতিন স্বীকার করেন যে এই পরিকল্পনা ‘ভবিষ্যতের চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।’ তবে তিনি যোগ করেন, ‘যদি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা তাদের দখল করা এলাকাগুলো ছেড়ে যায়, তবে আমরা যুদ্ধ থামাব। যদি না যায়, তবে আমরা সামরিকভাবেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ করব।’

সূত্র মারফত জানা যায়, গত সপ্তাহান্তে ইউক্রেনীয় মধ্যস্থতাকারীরা তাদের আমেরিকান প্রতিপক্ষকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে—কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী রুশ অর্থনীতিবিদ ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত নয়, বরং তার শর্তগুলো পূরণ হওয়া পর্যন্ত।’

মঙ্গলবার বৈঠকের আগে, পুতিন ইউরোপকে হুমকি দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি সতর্ক করে দেন যে রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে না, ‘তবে ইউরোপ যদি চায় এবং শুরু করে, আমরা এই মুহূর্তেই প্রস্তুত।’

বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘পুতিন এর জন্যই প্রস্তুতি নেবেন, ঠিক যেমন ২০২২ সালের আগে তিনি বলেছিলেন যে—রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছে না, যা বিপরীতটাই ইঙ্গিত করেছিল।’ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকার পরও ইনোজেমতসেভ এবং বারানভস্কি দুজনেই একমত যে রাশিয়া অনির্দিষ্টকাল ধরে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম। ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘এতটা তীব্রতায় বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মোটেও কোনো সমস্যা নয়।’

তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধের শুরুতে যত সমস্যা ছিল, এখন তার চেয়ে কম। কারণ, শুরুতে আমরা দেখেছি তাদের লোক জড়ো করতে হয়েছিল; এখন তারা বেশ ভালো বেতন দেয় এবং (নতুন স্বেচ্ছাসেবকেরা) ক্রমাগত তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া, তাদের অস্ত্রের সমস্যা ছিল এবং ভাষ্যকাররা লিখেছিলেন যে তিন মাসের মধ্যে তাদের শেল ফুরিয়ে যাবে। বাস্তবে, এখন যুদ্ধের আগের চেয়েও বেশি সক্রিয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে।’

ইনোজেমতসেভ মনে করেন, এখন ‘আমেরিকানরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে—হয় এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে, না হয় ইউক্রেনের প্রতি সব রকম সমর্থন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই বার্তা এখন কিয়েভকে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। আর তাই, ইউক্রেনীয়দের কোনো না কোনোভাবে রাজি করানো হবে...ইউক্রেনীয়রা জানে যে ইউরোপ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। অর্থাৎ, যদি এখন আমেরিকানরা এই প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে দাঁড়ায়, তবে ইউরোপের কাছে বছরের পর বছর ধরে এই কারণকে সমর্থন করার মতো অর্থ বা সংকল্প কোনোটাই থাকবে না।’

ইনোজেমতসেভ উল্লেখ করেন, একটি চুক্তি হলেও তা ইউক্রেনের স্বার্থে আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি তারা নিজেদের সেনাবাহিনীর জন্য ৬ লাখ সৈন্য এবং অন্তত কয়েক বছরের জন্য একটি বিরতি নিশ্চিত করতে পারে, তবে বাস্তবে এটিই সমস্যার সমাধান।’ তিনি বলেন, ‘পুতিন সব সময়ই একটি হুমকি হয়ে থাকবেন এবং তাই পশ্চিমের প্রধান কাজ হলো (৭৩ বছর বয়সী) পুতিনকে উতরে যাওয়া। যদি তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য লড়াইয়ে বিরতি আসে, তবে এটি তার জীবনের শেষের দিকে পৌঁছে যাবে, যা স্বভাবতই তাঁকে কম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।’

এ ছাড়া, যেকোনো সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার রুশ অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে। তবে ইনোজেমতসেভ ও বুদ্রাইৎস্কিস সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, জীবন ২০২২ সালের আগের মতো স্বাভাবিক হবে। তাঁদের অনুমান, সমাজ প্রবলভাবে সামরিক এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘শান্তি আসতে পারে না। এমন এক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ফেরা সম্ভব নয় যেখানে পূর্ণাঙ্গ দমনমূলক সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্রের উপযোগী এই সমস্ত ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে, কারণ আমাদের আর কোনো সরাসরি বাহ্যিক হুমকি নেই।’

তাঁর মতে, ‘এটাই রাশিয়ার পুতিন রেজিমের নকশা। তাঁর ক্ষমতা এভাবেই সাজানো হয়েছে যে, এখানে এক অন্তহীন যুদ্ধ চলবে, যেখানে রুশ অভিজাতরা পতাকার নিচে একত্রিত থাকবে, দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলবে...এগুলো কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চালু করা কিছু অসাধারণ ব্যবস্থা নয়, বরং এভাবেই তিনি শাসন চালিয়ে যাবেন।’

তিনি আরও যোগ করেন, ইউক্রেন, ইউরোপ, বাল্টিক রাষ্ট্র বা ‘যে কারও বিরুদ্ধে যেকোনো রূপে যুদ্ধ’ হলো পুতিন ২০২২ সালের পরে রাশিয়ায় যে ‘স্বাভাবিকতা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার অবিচ্ছেদ্য চালিকাশক্তি। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘সুতরাং, এই রেজিম টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ চলতে থাকবে।’

কিছু রুশ নাগরিক ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতির জন্য নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। মস্কোর গণমাধ্যম সের্গেই কালেনিক বলেন, ‘আমেরিকা যত দিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার না করবে, তত দিন যুদ্ধ শেষ হবে না।’


আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত