Ajker Patrika

মোদির কৌশলে প্রতিবেশীদের কাছে বিপন্ন ভারতের ভাবমূর্তি

আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১৬: ৩০
মোদির কৌশলে প্রতিবেশীদের কাছে বিপন্ন ভারতের ভাবমূর্তি

১০ বছর আগে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন দক্ষিণ এশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এটি তাঁর ‘প্রতিবেশী সবার আগে’—পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন। এই নীতির মূল ভিত্তি—ভারতের ছোট ছোট প্রতিবেশীর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। কিন্তু সীমান্ত বিরোধ, দ্বিপক্ষীয় মতানৈক্য, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দেরি এবং এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে নীতিটি মার খেয়ে যায় শিগগির।  

তারপরও বাংলাদেশে ভারতের এই নীতি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে ভাবা হচ্ছিল। কারণ, টানা ১৫ বছরের অপশাসনে পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে মোদি ঘনিষ্ঠভাবেই কাজ করেছেন। দুই পক্ষের সম্পর্ককে ‘উইন-উইন’ বা ভারসাম্যপূর্ণ বলেই বিবেচনা করা হতো। 

জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যাত্রা শুরুর পর ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার বিপক্ষে জনরোষ বাড়তে থাকে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন তাঁর শাসনের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকে। এই আন্দোলন একপর্যায়ে তাঁর পতনের এক দফায় রূপ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় তিনি ৫ আগস্ট দেশে ছেড়ে যান। 

বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাপক অজনপ্রিয় হওয়ার পরও শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বিষয়টি ভারতের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা মহলকে ব্যাপক ধাক্কা দেয়। শেখ হাসিনা যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, ভারত তত দিনই তাঁকে সমর্থন দিয়েছে। এই সময়ে নয়াদিল্লি অন্য অংশীদারদের উদ্বেগ এমনকি বাংলাদেশের জনগণকেও উপেক্ষা করেছে। মোদির শাসনামলে ভারত অন্যান্য ছোট প্রতিবেশীর বেলায়ও একই ধরনের নীতি গ্রহণ করে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি বরণ করেছে। 

এটি স্পষ্ট যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের এই নীতিগত ব্যর্থতা কেবল বাহ্যিক ঘটনাবলি বা প্রভাবকের কারণে নয়, এগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলনও বটে। কূটনীতিকে কেবল নিরাপত্তাকেন্দ্রিক করা থেকে শুরু করে মোদির ‘লৌহমানব’ ভাবমূর্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের উদারনৈতিক চিত্রের মুখোশ খসে পড়েছে। শেখ হাসিনার মতো সরকারগুলো মোদির অনুগ্রহধন্য ব্যবসায়িক বিভিন্ন স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যকে আরও সন্দেহপূর্ণ করে তোলে। 

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার পেছনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দুত্ববাদের প্রতি পক্ষপাত বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর নির্যাতিত নাগরিকদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়ন করেছিল, সেখানে বিদেশ থেকে আসা মুসলমানদের বাদ দেওয়া হয়। এটি বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। কেবল তা-ই নয়, ভারতে মুসলিমদের প্রতি বিজেপি সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণও দেশের বাইরে মোদিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় মোদিকে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়। 

শেখ হাসিনার পদত্যাগ ভারত সরকারকে আত্মসমালোচনার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু দেশটি নীতি সংশোধনের মতো জায়গায় যেতে পারেনি বলেই মনে হয়। বাংলাদেশে ভারতের কলঙ্কিত ভাবমূর্তি দক্ষিণ এশিয়ায় মোদি সরকারের প্রথম বড় ব্যর্থতা নয়, শেষও নয়। একটি প্রকৃত ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নীতি বা দর্শন অনুসরণ কেবল ভারতের জন্যই ক্ষতিকর নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও তা বিপর্যয়কর ফল বয়ে আনবে। 

শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর। তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন ভারতে আশ্রয় নেন। তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। মাঝে এক মেয়াদ বিরতির পর ২০০৯ সালে আবারও ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। ২০১৪ সালের পর থেকে তাঁর শাসন ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক এবং অধিকারকর্মীদের কঠোর হস্তে দমন করতে থাকেন। 

বিরোধী দলগুলোর মতোই শেখ হাসিনা সরকার দেশের কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করে। তিনি ভারতের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়া থেকে দূরে রাখেন। বিপরীতে ভারত শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত সমর্থন দিতে থাকে। দেশটির কর্মকর্তাদের যুক্তি, শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারালে বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হবে। কেবল তা-ই নয়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হওয়ার পর ভারত বাইডেন প্রশাসনের কাছে লবিং করে, যেন গণতন্ত্র ইস্যুতে শেখ হাসিনাকে চাপ না দেওয়া হয়। 

 শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির নেতৃত্ব দিয়েছেন, সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে ভারত ধরেই নিয়েছিল, চলমান আন্দোলনের চাপের পরও তিনি টিকে যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে বলার পর ভারত বিশাল ধাক্কা খায়। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য বিরাট গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা। কোনো পশ্চিমা দেশই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। 

শেখ হাসিনার ওপর ভারতের নিঃশর্ত সমর্থনের মাধ্যমে কূটনীতির ক্ষেত্রে ‘অতি নিরাপত্তাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ই প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত, ভূতাত্ত্বিক এবং অর্থনৈতিক উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত এই প্রতিফলন ছিল দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে। প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। দেশটি এরই মধ্যে এই অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে সংযোগ হারিয়েছে এবং দেশটির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরও অবনমন হয়েছে। 

উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। মিয়ানমারে ভারত গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে জান্তা সরকারের পক্ষ নিয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে ঐতিহাসিক আফগান জাতীয়তাবাদীদের বাদ দিয়ে। বাংলাদেশে অতি নিরাপত্তাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সীমান্তে ব্যাপক শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছে ভারত; যা হিতে বিপরীত হয়েছে। 

মোদির ‘লৌহমানব’ রাজনৈতিক কৌশল ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতির গতিপথও বদলে দিয়েছে। চীন-ভারত সীমান্তের বেইজিংয়ের বিপরীতে চুপ থাকলেও ছোট প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে ভারত শক্তি প্রদর্শনের কৌশল নিয়েছে। ২০১৫ সালে ভারত মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অভিযান চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দোহাই দিয়ে। একই বছরে নেপাল নিজেদের সেক্যুলার ঘোষণার পর ভারত দেশটির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। মালদ্বীপের মন্ত্রীরা মোদির সমালোচনার পর তাঁর সমর্থকেরা মালদ্বীপ বয়কটের ধুয়ো তোলে। 

সীমান্তে কঠোর অবস্থান, পানিবণ্টন, ট্রানজিট সুবিধা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ইস্যুতে ভারতের অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের জনগণকে খেপিয়ে তুলেছিল। যার প্রকাশ ঘটেছে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর জনগণের তীব্র ক্ষোভের মাধ্যমে। 

ভারতের রাজনৈতিক বিরোধীরা নিয়মিতই মোদির সমালোচনা করেছেন; বিশেষ করে আদানির মতো ধনকুবেরদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা সরব ছিলেন। স্বার্থান্বেষী পুঁজিপতিদের সঙ্গে মোদি সরকারের এমন সম্পর্ক প্রতিবেশী দেশেও প্রভাব ফেলেছে। গত বছর গৌতম আদানি ও শেখ হাসিনার একটি ছবি সামনে আসে। সে সময় জানা যায়, গৌতম আদানি বাংলাদেশে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। বাংলাদেশিরা বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। মূলত সরকার অতিরিক্ত দামে এই বিদ্যুৎ কিনছিল, যা কেবল আদানির পকেটকেই ভারী করবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিজের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য মোদিসংশ্লিষ্টদের সমর্থন শেখ হাসিনার প্রয়োজন ছিল। 

জনতুষ্টিবাদ, কর্তৃত্ববাদ ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিই বাংলাদেশে ভারতকে বিপদে ফেলেছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে মোদি সরকার যে হিন্দুত্ববাদী নীতি গ্রহণ করেছে, তা আরও বেশি ক্ষতিকর। ২০১৯ সালে ভারত যে সিএএ আইন করেছিল, তার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দুরা। এই আইনের অঘোষিত মূল লক্ষ্য হলো—হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা (সে সময় ভারত বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড ভরা আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করায় শেখ হাসিনার মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন)। সে সময় বিষয়টি বাংলাদেশ ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দেয়। সে সময় মোদির ডান হাত বলে খ্যাত ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের উইপোকা, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিজেপি নেতাদের এ ধরনের মন্তব্যও এই মনোভাবের আগুনে ঘি ঢালে। 

বিজেপি সরকার সিএএ আইন চালু করার আগে, ভারতের বিচার বিভাগ আসামে নাগরিকদের নথিভুক্ত করার জন্য এবং বাংলাদেশি অভিবাসীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি কঠোর জরিপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সমালোচকেরা এই নির্দেশকে অনথিভুক্ত ভারতীয় মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করার একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করেছিলেন, সিএএ ও এনআরসি লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারে। যদিও সিএএ এখনো সেই অর্থে কার্যকর হয়নি। 

এদিকে যতই দিন যাচ্ছিল, শেখ হাসিনা সরকার এই ধারণাই পোক্ত করছিল যে তারা দিল্লি থেকে আদেশ নেয়। ২০২২ সালে বিজেপির মুখপাত্র মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করার পর এ বিষয়ে বাংলাদেশের মুসলিমরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও শেখ হাসিনা সরকার বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যায়। ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বিজেপি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতের বিরোধী মনোভাবকেই আরও উসকে দেয়। চলতি বছর নির্বাচনের সময় মোদি মুসলিম বিরোধিতাকে প্রচারণার হাতিয়ার করেন। গত বছর ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র যুক্ত করে (যেখানে সব ছোট প্রতিবেশী দেশকে ভারতের বলে দেখানো হয়) প্রতিবেশী দেশগুলোতে ক্ষোভ আরও উসকে দেন। 

সর্বশেষ ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি বলেন, ভারতের ১৪০ কোটি নাগরিক বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। এটি মূলত ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপনের সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা। তাঁর এই প্রচেষ্টা ভারতের বহুজাতিক ও বহু সংস্কৃতির দেশ হওয়ার যে ঐতিহ্য, সেটাকেই নাকচ করে, যা হাজার বছর ধরে চলে আসছে। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হয়েছে। এর কারণ মূলত মোদি সরকারের সমর্থক ও গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশে হিন্দুদের হামলা হওয়া নিয়ে ব্যাপক অপতথ্য প্রচার করেছে। কিন্তু মোদি সরকার এই বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি বা ব্যবস্থা নেয়নি। তবে এটি মোটেও অবাক করা কোনো বিষয় নয়। 

এ মুহূর্তে মোদি সরকারের আত্মসমালোচনার সক্ষমতা সামান্যই বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘটনার জন্য পাকিস্তান, চীন বা ইসলামপন্থীদের দোষারোপ করার পরিবর্তে ভারতের স্বীকার করা উচিত, প্রতিবেশী দেশের নাগরিকেরা তাদের স্বকীয়তা ফিরে পেতে পারে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারে। যদিও বিশ্ব পরিমণ্ডলে ভারতকে একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসেবে সমাদৃত করা হয়, তারপরও দেশটিকে প্রতিবেশীরা তুলনামূলকভাবে দুর্বল শক্তি হিসেবে দেখে। ভূতত্ত্বের অলঙ্ঘনীয় নিয়মানুযায়ী, ছোট প্রতিবেশীদের অবশ্যই ভারতের সঙ্গে মিলেই কাজ করতে হবে। তবে এখন দেখার বিষয়, নয়াদিল্লি বিষয়টি কীভাবে সামলায়। 

ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত