Ajker Patrika

নিজ অহমিকার মূল্য চোকাতে কতটা প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র

ফজলুল কবির
আপডেট : ০৮ মে ২০২২, ১৪: ২৬
নিজ অহমিকার মূল্য চোকাতে কতটা প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র

শত বছর আগে চাণক্য বলে গেছেন, ‘অহংকারের মতো শত্রু আর হয় না।’ অবশ্য চাণক্য এ কথা বিশেষভাবে বলে না গেলেও হতো। এ সত্য তো সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই জানে। ব্যক্তি দিয়ে যেহেতু সমাজ-দেশ ইত্যাদি তৈরি হয়, সেহেতু দেশ বা রাষ্ট্রেরও তো এ কথা জানা থাকার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের কি জানা ছিল না? প্রশ্নটি উঠছে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের অবস্থা বিবেচনা করে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বৈশ্বিক পরাশক্তি সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ। যুদ্ধে সে সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে আমেরিকা তো বটেই, ইউরোপেরও নেতা হিসেবে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র। এই নেতৃত্ব গোটা বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, যেখানে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই দ্বিমেরু বিশ্ব কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে হাজির হয় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, যাদের শক্তির ভরকেন্দ্র হয়ে এখনো আছে ওয়াশিংটন। 

এই হয়ে ওঠা কিন্তু ‘হঠাৎ পাওয়া’ কিছু ছিল না। বলা যায়, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ীই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমোড়লের আসনটিতে বসেছিল। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক রেডিও বার্তায় বলেন, ‘গণতন্ত্রের মহত্তম অস্ত্রে পরিণত হতে হবে আমেরিকাকে’। নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ তো বটেই, নিজেকে রক্ষার জন্যও যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি এই অস্ত্রে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। এর এক বছর পর যখন পার্ল হারবারে হামলা চালাল জাপান, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলো যুদ্ধকালীন উৎপাদনে সম্পূর্ণ নিয়োজিত হয়। আর এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল ডেট্রয়েটের গাড়ি উৎপাদনকারী কারখানাগুলো। 

একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। হিস্ট্রি ডটকম ও ন্যাশনালডব্লিউডব্লিউ ২ মিউজিয়াম ডটওআরজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, পার্ল হারবার আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাঁকবদল করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে যায়। তাদের প্রতিটি কারখানা তো বটেই, প্রতিটি কর্মকাণ্ডই তখন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় বেকারত্ব, সামরিক-বেসামরিক মানুষের জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু। সেসব অন্য আলোচনার বিষয়। এখানে শুধু অস্ত্র নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ডেট্রয়েটের গাড়ি তৈরি কারখানাগুলো সে সময় রাতারাতি পরিণত হয় অস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানায়। ডেট্রয়েটের ওল্ডসমোবাইলে শুরু হয় কামানের উৎপাদন, ক্যাডিলাকে ট্যাংক, ক্রিসলারে মেশিন-গান উৎপাদন। আর বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানি শুরু করে বি-২৪ বোম্বার তৈরি। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনআজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপটে মার্কিন সরকার ও কারখানাগুলো কি একই বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছে? সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের সক্ষমতা কি চাহিদা বিবেচনায় বেড়েছে বলা যাবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মিত্রদের সহায় হওয়ার একক ক্ষমতা কি যুক্তরাষ্ট্রের আছে, নাকি কোথাও কিছু ক্ষয় হয়েছে? 

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্রে এখন কী চলছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আট দশক পর আজকের এই সময়ে রুজভেল্টের সেই চেয়ারে বসে আছেন জো বাইডেন। না পার্ল হারবার এখনো হয়নি, তেমনটা কেউ চায়ও না। কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা ভালো, শুরু থেকেই যুদ্ধের গোড়াটি আগলে বসে আছে যুক্তরাষ্ট্র। না প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষে। হোয়াইট হাউসের ভাষায়, ‘রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে যেকোনো মূল্যে জয়ী দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।’ এই যেকোনো মূল্যটা কী? 

একটু পেছনে ফেরা যাক, যুদ্ধের এক সপ্তাহের ভেতরেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আলোচনায় বসার জন্য জেরবার হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেনও সে কথা। কিন্তু বাকি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে সে আলোচনা আর হয়নি, যুদ্ধও থামেনি। দুই মাস পেরিয়ে গেছে। ক্ষয় ও মৃত্যু দেখছে বিশ্ব। কিন্তু জেলেনস্কিকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র অনড়, অনড় রাশিয়াও। এ তাদের দুই দেশের মর্যাদা ও টিকে থাকার লড়াই। রাশিয়া যেমন খোলাখুলি বলছে, যুদ্ধের এই পর্যায় থেকে পিছু হটলে রাশিয়া নামে কিছু আর থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র তেমন খোলাখুলি না বললেও, ঘটনা একই। না, যুদ্ধ কোনো একটি দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে না। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা হবে না নিশ্চিত। কিন্তু পরাশক্তির কাতার থেকে তাদের নাম খসে যেতে পারে পরাজয় বা পিছু হটার সূত্র ধরে। ইউক্রেনের সে ভয় না থাকলেও এ যুদ্ধের ময়দান সে-ই। 

এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া। যেকোনোভাবে তারা এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাশিয়া নতি স্বীকার করে। আর রাশিয়া তার যুদ্ধের কারণগুলোর মীমাংসা চায়। যুদ্ধের ময়দানে সে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র তার দাবিগুলো মেনে না নিচ্ছে। দুটি পক্ষই অনড় অবস্থানে দাঁড়িয়ে। 

রাশিয়া তার যুদ্ধের কারণগুলোর মীমাংসা চায়। যুদ্ধের ময়দানে সে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র তার দাবিগুলো মেনে না নিচ্ছেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২৮ এপ্রিল দেশটির কংগ্রেসের কাছে ইউক্রেন সংকট সামাল দিতে আরও ৩৩ বিলিয়ন (৩ হাজার ৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার চেয়েছেন। বলে রাখা ভালো, চলতি বছরই এই সংকটের প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস ১৩ বিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন দিয়েছিল। এর বাইরে বাড়তি এই টাকা চাওয়া হয়েছে। কোন পথে ব্যয় হবে এই অর্থ, সে হিসাবও দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তারা বলছে, এই তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি ডলার ইউক্রেন ও ইউরোপে মার্কিন মিত্রদের সামরিক সহায়তা খাতে ব্যয় হবে। বাইডেন বলেছেন, ‘এ যুদ্ধ ব্যয়বহুল; কিন্তু এই আগ্রাসনের কাছে নতি স্বীকার আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।’ 

বাইডেনের এই বক্তব্য কি পার্ল হারবার ঘটনার আগে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায় না? ১৯৪০ সালে বসে যখন রুজভেল্ট সে বক্তব্য দেন, তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আক্রান্ত বা আক্রমণকারীর ভূমিকায় নেই। এবারও নেই। দুবারই যুক্তরাষ্ট্র ঘটনার আগে থেকেই মিত্রদের প্রতি সামরিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ সামনে আসে। আট দশক আগের যুক্তরাষ্ট্রে তা সম্ভব হয়েছিল। এখনকার যুক্তরাষ্ট্র কি একইভাবে সাড়া দিতে পারবে? 

এবারের চ্যালেঞ্জটা আরেকটু বড়। এবার যুদ্ধ ময়দান ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম পাঠালেই শুধু চলবে না, সঙ্গে নিজেদের ও ইউরোপের মিত্রদেরও একইভাবে পুনঃসামরিকীকরণ করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলোর সামরিকীকরণের ধরন আর আগের মতো নেই। ফলে পুরো বিষয়টি এখন মার্কিননির্ভর হয়ে আছে। অস্ত্রাগারের মজুত বৃদ্ধির লক্ষ্যে পূর্ণ শক্তি নিয়ে এগোলে আবার রয়েছে অন্য শঙ্কা। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরাসরি পরাশক্তির লড়াইয়ের সংকেত দেবে। যুক্তরাষ্ট্র কি শেষ পর্যন্ত এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে ইউক্রেন সংকটের শুরুর দিনগুলোর দিকে। সে সময় জো বাইডেন বলেছিলেন, তিনি কখনোই সেখানে সেনা পাঠানোর কথা ভাবতে পারেন না। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে আসবে বিশ্বের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি রাশিয়া। 

তাহলে কি রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ চায় না যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর—হ্যাঁ এবং না। এই যুদ্ধ চলুক— যুক্তরাষ্ট্র এটা চায়, তা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ক্ষেত্রে তার দ্বিধা রয়েছে। এ কারণেই মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এবং অনেক তরুণ যুদ্ধে যোগ দিতে ইউক্রেন এলেও নিয়মিত বাহিনীর কেউ সেখানে জড়ায়নি। আবার রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, ইউক্রেনকে সহায়তা করে যুদ্ধকে নিজের পছন্দমতো একটি পরিণতির দিকে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, নিজের অস্ত্রীকরণ নিয়েই এখন চিন্তিত ‘গণতন্ত্রের মহত্তম অস্ত্র’ দেশটি। 

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনএ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড বাজেটারি অ্যাসেসমেন্টসের গবেষক থমাস মানকিন ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ‘ইউক্রেনীয়দের বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে পারাটা আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা কে দেবে? কেউ না।’ 

হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিকে তারা ৫ হাজার ৫০০ জ্যাভেলিন ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র হয় দিয়েছে, নয়তো দেশটির কাছে বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয় এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে জ্যাভেলিন ছাড়াও অন্য ধরনের আরও ১৪ হাজার অ্যান্টি-আর্মার সিস্টেম, একজন সেনার বহনক্ষম ১৪০০ স্টিঙ্গার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র, ৭০০ সুইচব্লেড (ব্যাকপ্যাকে বহনক্ষম একধরনের বোমা, যা ছোড়ার পর নির্দিষ্ট টার্গেটে গিয়ে উড়োজাহাজের মতো ক্র্যাশ করে এবং ভেতরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়), ৯০টি ছোট নলের কামান, ১৫৫ মিলিমিটার ব্যাসের ১ লাখ ৮৩ হাজার কামানের গোলা, ১৬টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, ১৪টি কাউন্টার-আর্টিলারি, চারটি কাউন্টার-মর্টার ও দুটি এয়ার সার্ভেইল্যান্স রাডারসহ আরও অনেক কিছু পাঠিয়েছে। 

এই যুদ্ধ যে সমীকরণের প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাতে শুধু ইউক্রেনে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোই আর যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে চালকের আসনে বসতে হলে তার সব মিত্রকেই নিরাপদ রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সে চেষ্টা করছেও। তবে এই চেষ্টা তার করতে হচ্ছে, ট্রাম্প জমানায় আহত ন্যাটো ও ইউরোপকে সঙ্গে নিয়ে। যে কারণে জার্মানিতে যখন দেশটি ৪০টি দেশের বৈঠক ডাকে, তখন তাকে অনেক কিছুই বিবেচনায় নিতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মুখোমুখি বসার সময় তাকে আফগান যুদ্ধ, আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় হওয়া যুদ্ধ, চীন, ভারত-চীন দ্বৈরথ ইত্যাদি অনেক কিছুকেই বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এই সবগুলো অঞ্চলকে নিজের আয়ত্তে রেখে দরকারি পক্ষগুলোর সশস্ত্রীকরণ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের পয়সাতেই করতে হচ্ছে। কারণ, এটি এখন তার ‘মর্যাদার’ আবরণে ‘পরাশক্তি’ পরিচয় টিকিয়ে রাখার লড়াই। 

এখন পর্যন্ত এসব অস্ত্র দেশটি তার মজুত থেকেই দিতে পারছে। কিন্তু সামনের চাহিদা পূরণ করতে হলে আট দশক আগের মতো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে হবে। কিন্তু মার্কিন কারখানাগুলো খুব দ্রুতই এমন উৎপাদনে যেতে পারবে না বলে মত দিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটি জ্যাভেলিন আছে, তা জানা নেই। ১৯৯৬ সালে এটি বাজারে আসার পর দেশটির সরকার ৩৪ হাজার ৫০০ জ্যাভেলিন কিনেছে বলে ধারণা করা যায়। এর মধ্যে পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণের কাজে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার জ্যাভেলিন ব্যবহার হয়েছে। এই হিসাব ঠিক ধরলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ২০২১ সাল নাগাদ ১৭ থেকে ২২ হাজার জ্যাভেলিন ছিল। ইউক্রেন সংকটে এই মজুতের এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি বের হয়ে গেল। রইল আর কত? তবে ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এই হিসাবে মার্কিন মেরিনের কেনা ২৪০০ জ্যাভেলিনকে যেমন ধরা হয়নি, তেমনি ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত ৫০০০ জ্যাভেলিনকেও ধরা হয়নি। 

যুক্তরাষ্ট্র যেকোনোভাবে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাশিয়া নতি স্বীকার করেসে যাই হোক, জ্যাভেলিন বিবেচনায় নিলেও যুদ্ধ বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ও মিত্রদের অস্ত্রাগার ভরতে রীতিমতো লড়তে হবে। এ কথা যুক্তরাষ্ট্র জানে বলে ৩ মে আলাবামার ট্রয়ে অস্ত্র কারখানা পরিদর্শনে গেছেন স্বয়ং দেশটির প্রেসিডেন্ট। ওই কারখানায় বছরে ২১০০টি জ্যাভেলিন উৎপাদন হয়। ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতেই এই কারখানার তিন-চার বছর লাগবে। আর মিত্রদের নিরাপত্তা বেশি গুরুত্ব পেলে এ সময় আরও বেশি লাগবে। এই কারখানার সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা বছরে সাড়ে ৬ হাজার। কিন্তু এই সর্বোচ্চ সীমায় যেতে হলে এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে লাগবে কাঁচামালের সরবরাহ। কিন্তু এই সরবরাহেই রয়েছে সংকট। একই অবস্থা স্টিঙ্গার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। ১৯৮১ সালে বাজারে আসা এই অস্ত্রের শেষ চালান যুক্তরাষ্ট্র কিনেছিল ২০০৩ সালে। গত বছর এর মার্কিন উৎপাদন বন্ধ হলেও চলতি বছর তা আবার চালু করা হয়। মুশকিল হলো এই অস্ত্র তৈরির কিছু উপকরণ এখন বাজারে পাওয়া কঠিন। 

ন্যাটোভুক্ত অন্য দেশগুলোও কিছু কিছু দিকে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু সবার তো উৎপাদন সক্ষমতা নেই। জার্মানির থাকলেও তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় নানা বিধিনিষেধে রুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে সে সক্ষমতা আবার অর্জন করতে চায় জার্মানি। এরই মধ্যে ট্যাংক পাঠানোর কথা জানিয়ে জার্মানি বলেছে, তারা এর চেয়ে বেশি সহায়তা করতে চাইলে কারখানাগুলো চালু করতে হবে। 

আকাশ-যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো একটু পিছিয়েই আছে। আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এ ধরনের অস্ত্রগুলোই চাওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি বড় সহায় হতে পারে। ফ্রান্সেরও সে সক্ষমতা আছে। কিন্তু পুরোনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে ফের নিজ পায়ে দাঁড়াতে সম্মতি ও সহায়তা দেওয়ার ঝুঁকি কি যুক্তরাষ্ট্র নেবে? তার অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। আবার আকাশ-যুদ্ধে পশ্চিমের দুর্বলতা লুকানো কিছু নয়। ২০১১ সালে লিবিয়া এবং সিরিয়া যুদ্ধে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার যুক্ত হওয়ার পর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাও প্রকাশ্য হয়েছিল। ফলে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কীভাবে এগোবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। 

যুদ্ধের এক সপ্তাহের ভেতরেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আলোচনায় বসার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেনসব মিলিয়ে নিজের ও মিত্রদের অস্ত্রীকরণ সক্ষমতা এক বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের। এক-মেরু বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়াত্ব তাকে এদিকে অনেক দিন তাকাতে দেয়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তার দক্ষতা ও সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জোট ন্যাশনাল ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের (এনডিআইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্প ক্ষয়ের পথে। সবচেয়ে বড় সংকট হলো দক্ষ কর্মীর অভাব। রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদানের সরবরাহ সংকট। আছে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও প্রয়োগের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর অভাব। সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে নিজেদের করা জরিপের বরাত দিয়ে এনডিআইএ বলেছে, মোট প্রতিষ্ঠানের ৩০ শতাংশই তাদের বলেছে, পেন্টাগনে সুনির্দিষ্ট কিছু অস্ত্রের একমাত্র জোগানদাতা তারাই। অর্থাৎ, এক কারখানার ঘাটতি অন্যকে দিয়ে মেটানো কঠিন হবে। প্রয়োজনের মুহূর্তে দক্ষ কর্মী ও প্রযুক্তির সংকট বড় হয়ে সামনে আসবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সংকটগুলো থাকলেও নেই সেই একই ভিত ও প্রেক্ষাপট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বৈশ্বিক যুদ্ধে প্রথম যুক্ত হওয়া। তার মন্দাপীড়িত অর্থনীতি এবং কারখানাগুলো যুদ্ধকালীন উৎপাদনের জন্য মুখিয়ে ছিল সে সময়। সে তখনো পরাশক্তি হয়ে ওঠেনি। পরাশক্তি হওয়ার বাসনা তার মধ্যে প্রবল। তার গণমনস্তত্ত্বও তখন এর পক্ষে ছিল। কারণ, যুদ্ধ-পালানো শরণার্থী, অভিবাসী বা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম দিয়ে গড়া যুক্তরাষ্ট্রই ছিল তখনকার দৃশ্যপটে। আর আজকের যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধক্লান্ত এক পরাশক্তি। তারও যুদ্ধস্মৃতি থাকলেও গণমনস্তত্ত্বে এর অভিঘাত ক্লান্তিই শুধু। কোভিড সাময়িক মন্দার সময় তৈরি করলেও বেকারত্ব ও বন্ধ কারখানার সংখ্যা এত উচ্চ নয় যে, চাইলেই হুট করে যুদ্ধকালীন উৎপাদন শুরু করতে পারবে সে। তেমনটি করলে ভেতর থেকেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে তাকে পড়তে হতে পারে। 

সব মিলিয়ে রাশিয়া সরাসরি যুক্ত—এমন একটি যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা অপ্রস্তুতই বলতে হবে। প্রশ্ন হলো—এমন পরিস্থিতির জন্য বিশ্বমোড়ল কেন অপ্রস্তুত হলো? এর কারণ কি তার অহমিকার মধ্যে লুকিয়ে আছে তবে? সে ভেবেছিল তার দুই মূল বিরোধী শক্তি রাশিয়া ও চীন কখনোই তার বিরুদ্ধে সরাসরি দাঁড়াবে না বা তার ঘোষিত মিত্র দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তার আশা ছিল, সামরিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধ পক্ষ হিসেবে যুদ্ধ ময়দানে ঢুকতে কেউই চাইবে না। ২০১৯ সালে প্রকাশিত মার্কিন পত্রিকা ফরেন অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষণেও এমন আশাই প্রকাশ করা হয়েছিল। সঙ্গে মিত্রদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়েও সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্নটি জ্যান্ত থাকলেও আশাটি মিইয়ে গেছে। কারণ, ইউক্রেনকে সামনে রেখে সংকটই এখন বাস্তব। আর বাস্তব এ সংকটে শুধু ইউক্রেন নয় উলুখাগড়ার কাতারে এসে দাঁড়াচ্ছে একের পর এক দেশ। বর্তমান বা ভবিষ্যৎ মোড়লের মতো কোনো সুবিধা ভোগ করবে না জানলেও অতীতের মতোই তাকে কাতারে কাতারে উজাড় হতে হচ্ছে। তার ফল কী হবে, সেটা কেউ জানে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, মার্কিন এ অহমিকার মূল্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অজস্র দেশ ও মানুষকে মেটাতে হচ্ছে এবং হবে। দুঃখ এই যে, মার্কিন এই অহমিকা বৈশ্বিক অহমিকা না হলেও তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, সবার জন্যই আজ শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত