Ajker Patrika

অসম সম্পর্কের করুণ পরিণতি

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০৬
অসম সম্পর্কের করুণ পরিণতি

এই, তুই খুনি! তুই আমার বোনকে খুন করেছিস। 
বয়স্ক লোকটি এভাবেই এক যুবককে বকাঝকা করছেন। যুবকটি সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলছেন না। একবার বললেন, ভাইয়া, আমি কেন খুন করতে যাব?
‘ভাইয়া’ ডাক শুনেই খেপে গেলেন লোকটি। আরও জোরে বললেন, তুই আমাকে ভাই ডাকিস ক্যান? আমি তোর কেমন ভাই? লোকটির বকাঝকা থামছে না।

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–তুই আমার বোনের বাড়িতে কোন অধিকারে থাকিস? টাকার লোভে, সম্পদের লোভে? তোকে আমি পুলিশে দেব। বলেই লোকটি সেই যুবককে টানতে টানতে পাশে দাঁড়ানো পুলিশের কাছে নিয়ে গেলেন। এক পুলিশ সদস্য দুজনকে থামিয়ে দিয়ে যুবকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়াও। যুবকটি কিছু না বলে পুলিশের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন।

ঘটনা কী হচ্ছে, আমরা তার কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর কথা শুনছি।

সে সময় জনকণ্ঠে রিপোর্টারদের প্রতিদিনের মিটিং হতো বেলা ১১টা থেকে। সেই মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় এক সহকর্মী খবর দিলেন, মোহাম্মদপুরে ষাটোর্ধ্ব এক বিদুষী নারী খুন হয়েছেন। আমাকে বলা হলো মিটিং বাদ দিয়ে সেখানে যেতে।

ঘটনাস্থল কোথায়, তা জানার জন্য ফোন দিলাম মোহাম্মদপুর থানার ওসি শহীদুল্লাহকে। তিনি আমার পরিচিত। ফোন পেয়ে বললেন, ‘ডেডবডি ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেলে আছে।’ বললেন, তিনি নিজেও সেখানে যাচ্ছেন। এ ঘটনার বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ মেডিকেলের যাত্রা শুরু হয়। হাসপাতালটি সবে নামডাক করেছে। সেই মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখি, সেখান থেকে মরদেহ লাশঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাশঘরের পাশে অনেক মানুষের ভিড়। কক্ষের ভেতরে এক নারীর লাশ রাখা। কক্ষের বাইরে এসে দেখা হলো বকাঝকা করা সেই বয়স্ক লোকের সঙ্গে। এটা ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, সোমবার সকালের ঘটনা।

ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, মোহাম্মদপুর থানার ওসি আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। তিনি থাকায় তথ্য জোগাড় একটু  সহজ হলো। বকাঝকা করা লোকটির কাছে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি একটু থামতে বললেন। এরপর ওসিকে দূরে ডেকে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বললেন। ফিরে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তাঁর নাম বজলুর রহমান, পেশায় ডেন্টাল সার্জন। আরেকজন নারীও তাঁর পাশে ছিলেন, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ও আমার ছোট বোন শামসুন্নাহার। যিনি মারা গেছেন তিনিও আমার বোন। ওর নাম তৌফিকা বেগম। এরপর তিনি তৌফিকা বেগম সম্পর্কে বলতে থাকলেন।

তাঁদের পিতা হাজি মো. ইউসুফ ছিলেন প্রকৌশলী। তাঁরা ধানমন্ডির বাসিন্দা। ৮ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তৌফিকা বেগম ছিলেন তৃতীয়। তৌফিকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী। দর্শনশাস্ত্রে এমএ করে বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করতে যান। পরে অক্সফোর্ড থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেন। দেশে ফিরে এসে শান্ত নামের এক সেনা কর্মকর্তাকে বিয়ে করেন। বুশরা নামে তাঁদের একটি মেয়ে আছে। সে স্বামীর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। তবে ১৯৬৪ সালে শান্তর সঙ্গে তৌফিকার ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর থেকে তিনি একাই ছিলেন।

তৌফিকার পেশা শিক্ষকতা। তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ সরকারি মহিলা কলেজ, রংপুর মহিলা কলেজসহ বেশ কিছু কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ৮১ নম্বর বাসার চারতলার ফ্ল্যাটে ওঠেন। এটি তাঁর নিজের ফ্ল্যাট।

এ ঘটনা কী করে জানলেন? প্রশ্ন করতেই বজলুর রহমানের বোন শামসুন্নাহার ইসলাম বললেন, তৌফিকার প্রতিবেশীরা তাঁদের ফোন করেছিলেন। সেই ফোন পেয়ে তাঁরা বাংলাদেশ মেডিকেলে ছুটে আসেন। এসে দেখেন তাঁর বোন মারা গেছেন। তাঁদের সন্দেহ, বোন খুন হয়েছে। বোনের বাসায় ফারুক হোসেন নামে এক যুবক থাকত। সম্পত্তির লোভে সে-ই তাঁর বোনকে খুন করে। তাঁরা ফারুকের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও জানালেন।

এবার বোঝা গেল যে যুবককে বয়স্ক লোকটি বকাঝকা করছিলেন, তাঁরই নাম ফারুক হোসেন। আমরা ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে শামসুন্নাহার বললেন, তার সব কথা বিশ্বাস করবেন না। সে একজন প্রতারক।

একটু দুরে ফারুক নামের সেই যুবককে দুজন পুলিশ আগলে রেখেছে, যাতে পালাতে না পারে। কিন্তু ফারুককে দেখে মনে হলো তাঁর পালানোর কোনো ইচ্ছেই নেই। ফারুক নির্বিকার, তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, আবার প্রতিবাদও করছেন না। যুবকটি দেখতে খুবই স্মার্ট, কিন্তু পোশাক-আশাক সাদামাটা। আমি ফারুকের কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এক পুলিশ সদস্য আপত্তি করলেন। কিন্তু মোহাম্মদপুর থানার ওসির ইশারা পেয়ে তিনি আর কিছু বললেন না।

ফারুকের কাছে জানতে চাইলাম, আপনি কী করেন? বললেন, আগে মোজাইক মিস্ত্রি ছিলাম। এখন কিছুই করি না। তাহলে এই নারীর বাসায় কী কাজ করতেন? তিনি বললেন, বাসায় যা যা করার থাকে সবই করতাম। কীভাবে পরিচয়? জবাবে ফারুক বললেন, ৫ মাস আগে ফ্ল্যাটের মোজাইকের কাজ করতে এসে পরিচয়। যুবকটি খুব মেপে মেপে কথার উত্তর দেন। 
আমাদের এসব প্রশ্নোত্তর সেই পুলিশ সদস্যও শুনছিলেন। তিনি ফারুককে বললেন, ওই মিয়া আসল কথাটা কও না ক্যা? কও। জানতে চাইলাম আসল কথা কী? ফারুক কিছু বলেন না। পুলিশ সদস্যই বললেন, ‘ওই বুড়ি তো এই ছেলেটার বউ’। একটু অবাক হয়ে ফারুকের কাছে জানতে চাইলাম—আপনার বয়স কত? বললেন, ২৯-৩০। আর ওই নারীর? বললেন, ৬২-৬৩। বিয়ে হলো কীভাবে?

এবার মুখ খুললেন ফারুক। বললেন, বাড়িতে দুই মাস ধরে মোজাইকের কাজ করার সময় তৌফিকা বেগমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন তৌফিকা বেগম নিজেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ফারুক এই নারীর প্রস্তাব শুনে একটু ভয় পেয়ে যান। কয়েক দিন আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেন। পরে তৌফিকা তাঁকে লোক দিয়ে খুঁজে আনেন। ফারুক বললেন, বিয়েতে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর মনে হলো এমন জীবন হয়তো তিনি কোনো দিন পাবেন না। একপর্যায়ে রাজি হয়ে যান। কবে বিয়ে হলো? ১৯৯৭ সালের ২৭ অক্টোবর, মোহাম্মদপুর কাজী অফিসে।

বিয়ের পর আপনার জীবন কেমন ছিল? জানতে চাইলে ফারুক বললেন, বিয়ের পর থেকে তৌফিকা বেগম বাইরে বের হতেন না। তিনি বেশির ভাগ সময় ঘরেই থাকতেন। আর বিয়ের পর মোজাইকের কাজ ছেড়ে ফারুকও বাসায় থাকতে শুরু করেন। ঢাকায় তাঁর পরিবারের কেউ থাকে না বলে জানালেন।

তৌফিকা বেগমের মৃত্যু হলো কীভাবে? ফারুক বললেন, রোববার বিকেল থেকে তৌফিকা বেগম বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। রাতে ব্যথাটা আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তিনি বুকে ও পিঠে তেল গরম করে দেন। রাত ২টার সময় সে ব্যথা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। তিনি বাথরুমে গিয়ে গায়ে একটু পানি দিতেই তাঁর নিশ্বাস আটকে যায়। এরপর তিনি বাথরুমের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন।

তখন আপনি কী করলেন? ফারুক বলেন, তিনি প্রতিবেশীদের খবর দেন। একজন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য হাসপাতালে ফোন করেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স পাননি। এরপর তিনি রিকশায় করে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাঁকে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ফারুক বারবার বলছিলেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করেন, আমি খুনি না। তাঁকে খুন করে আমার কী লাভ? তাঁর সম্পদের কোনো কিছুই তো আমার নামে নেই।’

বজলুর রহমান লিখিত অভিযোগ করলেন ফারুকের বিরুদ্ধে। পুলিশ একটি খুনের মামলা নিয়ে ফারুককে গ্রেপ্তার করল। তৌফিকা বেগমের লাশ আনা হলো বজলুর রহমানের ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোডের বাসায়। একজন সাব ইন্সপেক্টর সেই লাশের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দিলেন।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধুকে নিয়ে গেলাম মোহাম্মদপুরে তৌফিকা যে বাসায় থাকতেন, সেখানে। সেখানে প্রতিবেশীদের বক্তব্য ফারুকের সঙ্গে মিলে গেল। সেখান থেকে খুব অল্প দূরে মোহাম্মদপুরের কাজী অফিস। সেখানে গিয়ে কাজী এমএম আনসার আলীকে পেয়ে গেলাম। তিনি সব শুনে চিনতে পারলেন। বললেন, ৪ মাস আগে এই বিয়ে হয়েছিল। দুজনের বয়সের অসমতা দেখে তিনি প্রথমে রাজি হননি। পরে তৌফিকা বেগমের ইচ্ছায় তিনি রেজিস্ট্রি করান। কাবিননামায় ফারুকের ঠিকানা রয়েছে—গ্রাম দনিয়া, থানা ও জেলা ভোলা। সাক্ষী আছেন ফারুকের ভাই সাইফুল ও ভগ্নিপতি জয়নাল আবেদিন।

পরের দিন ফলোআপ করতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে শুনলাম পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড লাশের ময়নাতদন্ত করেছে। তারা মৃতের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখেননি। চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু।

দুদিন পরে গেলাম মোহাম্মদপুর থানায়। খুনের মামলায় ফারুককে দুদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হাজতের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি ফারুক মেঝেতে বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, স্যার একটু বলেন, আমি খুন করিনি। পুলিশ আমার কথা শুনছে না। শুধু মারধর করছে। এরপর হাজতের গ্রিল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, পারলেন না। তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

ফারুকের এই অবস্থা দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। অফিসে আসব বলে থানা থেকে বের হয়ে এলাম। মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিতেই আমার চিফ রিপোর্টারের কথা মনে পড়ে গেল–ক্রাইম রিপোর্টারের মন খারাপ করতে নেই।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালেদা জিয়াকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, চুনারুঘাটে ‘চিতল মুখলিছ’কে গণপিটুনি

খালেদা জিয়ার ৩ আসনে এখন কী হবে, জানাল নির্বাচন কমিশন

‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করতে ব্যাংকের চিঠি

খালেদা জিয়ার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতি জানালেন সংগীতশিল্পী পুতুল

রুমিন ফারহানাসহ আরও যাঁদের বহিষ্কার করল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ: জেএমবির সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে পরিচালক গ্রেপ্তার হন দুবার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৪
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় গত শুক্রবার সকালে একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। মাদ্রাসাটি শেখ আল আমিন নামের এক ব্যক্তি পরিচালনা করতেন। যিনি এর আগে নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাতটি মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, ভবনটি বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, হাসনাবাদ বাজারের ফলপট্টি গলিতে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিশুদের পাঠদান করা হয়। বিস্ফোরণে চার কক্ষের একতলা ভবনটির পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে, সিঁড়ির পাশের ছাদের একাংশ উড়ে গেছে এবং সব কটি কক্ষের পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের ক্রাইম সিন ইউনিটের কর্মীরা আলামত সংগ্রহ করছেন। তাঁরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। ভবনের পাশের একটি ভবনের দোতলার দেয়ালে বিস্ফোরণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরণে পাশের একটি অটোরিকশার গ্যারেজের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিনের নিচে চাপা পড়েছিলেন গ্যারেজের ম্যানেজার আবুল কালাম।

আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত বিকট শব্দ হয়েছে যে আমার কানে তব্দা লেগে যায়। আমি টিনের নিচে চাপা পড়ি। পরে হামাগুড়ি দিয়ে বের হই। এরপর দেখি মাদ্রাসার মধ্যে আগুন জ্বলছে। যারা ভেতরে ছিল, তারা দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়ে চলে যায়।’

গ্যারেজের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আমিও বাসা থেকে দৌড়ে আসি। আমার গ্যারেজের দুজন অটোচালক দুই শিশুকে ওই ভবন থেকে বের করেন। এক নারী আর এক শিশুকে নিয়ে চলে যায়। এ সময় আল আমিনও দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন এসে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।’

মাদ্রাসার পাশের ৫ তলা বাড়ির বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হয়েছিল ভূমিকম্প। কারণ, বিস্ফোরণে সব ভবনে কাঁপুনি লাগে। সবাই চিৎকার করেছিল।’

ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘মাদ্রাসাটিতে ৩০-৩৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তবে শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’

ভবনটির পশ্চিম পাশের এক পাশে তিনটি কক্ষে মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অপর পাশের একটি কক্ষে পরিচালক শেখ আল আমিন (৩২), তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৮) এবং তাঁদের তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকতেন। বিস্ফোরণে দুই ছেলে উমায়েত (১০) ও আবদুল্লাহ (৭) আহত হয়। এর মধ্যে আছিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

পাশের ভবনের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমাদের ভবনের কিছু অংশ ফেটে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবও ভেঙে পড়েছে।’

ঘটনাস্থলেই পুলিশ হেফাজতে বসে ছিলেন ভবনমালিক পারভীন বেগম। ভবনের জমি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে লিবিয়ায় থাকা তাঁর দুই ছেলে এই ভবন ২০২২ সালে তৈরি করেন। এরপর হারুন অর রশীদ নামের এক ব্যক্তি এটি মাদ্রাসা করবেন বলে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুফতি হারুন অর রশীদ মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। হারুন তাঁর শ্যালক আল আমিন ও শ্যালকের স্ত্রী আছিয়াকে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় আসতেন। আমি নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ এসে দেখি, ভবনের চারপাশ উড়ে গেছে।’

পারভীন বেগমের পাশেই ছিলেন তাঁর ছোট মেয়ে সোহানা। তিনি বলেন, ‘ভাড়া নেওয়ার সময় শুধু হারুন অর রশীদ একাই এসেছিলেন। এরপর তাঁরা মাদ্রাসা পরিচালনা শুরু করেন। তবে তাঁরা আশপাশের কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না।’

পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে কেমিক্যাল, ককটেল, ভেস্ট ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, কোনো বিস্ফোরক তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে গতকাল বিকেলে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শেখ আল আমিন পলাতক রয়েছেন। তবে কেরানীগঞ্জ থেকে তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম, আছিয়ার ভাই হারুনের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার এবং ঢাকার বাসাবো থেকে আসমানী খাতুন নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, আল আমিনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগে ২০১৭ ও ২০২০ সালে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আসমানী খাতুনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালেদা জিয়াকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, চুনারুঘাটে ‘চিতল মুখলিছ’কে গণপিটুনি

খালেদা জিয়ার ৩ আসনে এখন কী হবে, জানাল নির্বাচন কমিশন

‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করতে ব্যাংকের চিঠি

খালেদা জিয়ার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতি জানালেন সংগীতশিল্পী পুতুল

রুমিন ফারহানাসহ আরও যাঁদের বহিষ্কার করল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালেদা জিয়াকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, চুনারুঘাটে ‘চিতল মুখলিছ’কে গণপিটুনি

খালেদা জিয়ার ৩ আসনে এখন কী হবে, জানাল নির্বাচন কমিশন

‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করতে ব্যাংকের চিঠি

খালেদা জিয়ার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতি জানালেন সংগীতশিল্পী পুতুল

রুমিন ফারহানাসহ আরও যাঁদের বহিষ্কার করল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালেদা জিয়াকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, চুনারুঘাটে ‘চিতল মুখলিছ’কে গণপিটুনি

খালেদা জিয়ার ৩ আসনে এখন কী হবে, জানাল নির্বাচন কমিশন

‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করতে ব্যাংকের চিঠি

খালেদা জিয়ার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতি জানালেন সংগীতশিল্পী পুতুল

রুমিন ফারহানাসহ আরও যাঁদের বহিষ্কার করল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালেদা জিয়াকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, চুনারুঘাটে ‘চিতল মুখলিছ’কে গণপিটুনি

খালেদা জিয়ার ৩ আসনে এখন কী হবে, জানাল নির্বাচন কমিশন

‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করতে ব্যাংকের চিঠি

খালেদা জিয়ার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতি জানালেন সংগীতশিল্পী পুতুল

রুমিন ফারহানাসহ আরও যাঁদের বহিষ্কার করল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত