শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

সেকশন

 
আষাঢ়ে নয়

নিশ্চিন্তে দেশ ছাড়লেন টোকাই সাগর

আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:১৭

টোকাই সাগর অভ্যর্থনাকক্ষ থেকে কে যেন ফোন করে বললেন, এক নারী দুই বাচ্চা নিয়ে দেখা করতে এসেছেন। সঙ্গে এক বন্ধু সাংবাদিক। একটু পর এলেন সেই নারী, সঙ্গে এক ছেলে ও এক মেয়ে। মার্জিত পোশাক, কথাবার্তায় ভীষণ বিনয়ী। পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি মাহবুবা রসুল লিপি।’

এটুকু বলায় চেনা গেল না। স্বামীর নাম বললেন আমিন রসুল সাগর। চিনতে আর বাকি রইল না। বললাম, আপনি তাহলে টোকাই সাগরের স্ত্রী? তিনি মাথা নাড়লেন। সাগরের সঙ্গে এই নারীকে কোনোভাবেই মেলানো যায় না। বাচ্চারা একজন বিআইটিতে, অন্যজন আইআইটিতে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মুখে বাংলা আসে না।

জানতে চাইলাম, শীর্ষসন্ত্রাসীকে বিয়ে করলেন কেন? হেসে বললেন, পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছে। তাঁর বাবা আগারগাঁও কৃষি ইনস্টিটিউটে চাকরি করেন। আসার কারণ জানতে চাইলে বলেন, আগের দিন তাঁর স্বামীর ব্যবহারের কারণে তিনি ক্ষমা চাইতে এসেছেন।

এই নারীর স্বামী শীর্ষসন্ত্রাসী আমিন রসুল সাগর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘টোকাই সাগর’ নামে পরিচিত ছিলেন। গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে আমিন রসুল ট্রেডার্সে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আমার। সেই সাক্ষাতের সময় তিনি গুলিভর্তি অস্ত্রটি টেবিলের ওপর রেখে আমাকে বলেছিলেন: ‘বলেন, কী জানতে চান?’

এটা ২০০০ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। পরদিন জনকণ্ঠে টোকাই সাগরকে নিয়ে যে রিপোর্ট করি, সেখানে অস্ত্র দেখানোর কথাটা এড়িয়ে যাই। সেই ঘটনার পর সাগর তাঁর স্ত্রীকে পাঠিয়েছেন দুঃখ প্রকাশের জন্য।

সাগর তখন আন্ডারওয়ার্ল্ড ও রাজনৈতিক অঙ্গন—দুই দিকেই প্রতাপশালী। তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

সেই কমিটির সভাপতি প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। কী কী অভিযোগ নিয়ে কথা হয়েছিল, তার সব মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, যুবলীগের নেতা আওরঙ্গ ও শীর্ষসন্ত্রাসী লিয়াকত তাঁর ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য এসব করেছেন। পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে যেসব খবর লেখা হচ্ছে, সবই তাঁদের দেওয়া। এমনকি তাঁর নামের আগে ‘টোকাই’ উপাধিটাও লিয়াকতের দেওয়া বলে দাবি করেছিলেন।

সাগরের স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আমি কিছুটা চিন্তামুক্ত হলেও ভয়ে ভয়ে ছিলেন আমার এক বন্ধু সাংবাদিক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতীয় চোরাচালান প্রতিরোধ কমিটির সভার সূত্র ধরে তিনি টোকাই সাগরের বিরুদ্ধে একটি নিউজ করেন। সেই নিউজ ছাপার পর সাগর তাঁকে হুমকি দেন। সেই বন্ধুকে মারার ছকও কষেন।

টোকাই সাগরকে নিয়ে আমি প্রথম বড় একটি নিউজ করি ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে, জনকণ্ঠে। বিমানবন্দর থেকে পাচার করা একটি সোনার চালান টোকাই সাগরের লোকজন মেরে দিয়েছিলেন। চালানটি ছিল কলকাতার এক ব্যবসায়ীর। পুলিশের কাছে তথ্য ছিল, চালানটা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সোনার পাইকারি বাজারে যাবে। চালান ধরতে পুলিশ ওত পেতে ছিল বিমানবন্দর মোড়ে। ঠিক সময়ে চালানটি বিমানবন্দর থেকে বের হলেও ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটের মুখে টোকাই সাগরের লোকজন আটকে দেন। সোনার বাহকেরা তাঁদের পুলিশের লোক ভেবে গাড়ি ফেলে পালিয়ে যান। সোনা চলে যায় সাগরের লোকজনের হাতে।

এই সোনা ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে ওই সময় বেশ হইচই হয়। গোয়েন্দা পুলিশের এসি মিয়া আবদুস ছালাম (বর্তমানে অবসরে) আমাকে বলেছিলেন, ওই চালানে নাকি ২০ কেজির মতো সোনা ছিল। কিন্তু প্রমাণ না থাকায় অন্ধকার জগতের জিনিস অন্ধকারেই হারিয়ে যায়।

সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে ঢাকা বরাবরই ছিল ট্রানজিট রুট। সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে টনে টনে সোনা নামে ঢাকায়। সেই সোনা চলে যায় ভারতের ব্যবসায়ীদের হাতে। এসব সোনা কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দুজন সন্ত্রাসীর নাম সবচেয়ে আলোচিত ছিল—একজন মুরগি মিলন, অন্যজন টোকাই সাগর। একসময় দুজন একসঙ্গে এই কাজ করতেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় টোকাই সাগর বলেছিলেন, ‘মগবাজার মোড়ে বিএনপির মিছিলে হামলার আগপর্যন্ত আমি লিয়াকত-মিলনের বাসায় দাওয়াতও খেয়েছি।’

পুলিশের খাতা অনুযায়ী, টোকাই সাগরের জন্ম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাউরিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা সাগরে মাছ ধরতেন। সাগরের আসল নাম আমির হোসেন। টোকাই সাগর আমাকে বলেছিলেন, তিনি সন্দ্বীপের বাউরিয়া হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাড়ি ছাড়েন। সন্দ্বীপ থেকে আসেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী মার্কেটে। সেখানে এক মাস্তানের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে কর্ণফুলী মার্কেটে চাঁদাবাজি নিয়ে এক যুবক খুন হন। সেই মামলায় তাঁর নাম আসে। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। আগারগাঁও বস্তিতে এসে নিজের নাম বদলে রাখেন আমিন রসুল সাগর। এখানে এসেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৯ সালে ডাকাতির অভিযোগে ডিবি তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

শোনা যায়, জেলে যাওয়ার পর সাগরের সঙ্গে ছাত্রদলের ক্যাডার নীরু ও বি. সেলিমের পরিচয় হয়। বি. সেলিম পরে ‘বাস্টার্ড সেলিম’ নামে পরিচিতি পান। তাঁরা সাগরকে অস্ত্র সংগ্রহের কাজে লাগান।
এরশাদ সরকারের পতনের পর আগারগাঁও থেকে আস্তানা গুটিয়ে আশকোনায় চলে যান সাগর। সেখানে সিভিল অ্যাভিয়েশনের এক কর্মচারীর মাধ্যমে সোনা চোরাচালানকারী ‘গোল্ড মজিবরের’ সঙ্গে পরিচয়। বলা যায়, মজিবরের হাত ধরেই এই কারবারে নামেন সাগর।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন বাস্টার্ড সেলিম। তখন বি. সেলিম, গোল্ড মজিবর ও সাগর মিলে সোনা চোরাচালানের কাজে নেমে পড়েন।
১৯৯৪ সালে সাগরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে যান। ১৯৯৫ সালে বিমানবন্দরে গোলাগুলির সময় অস্ত্রসহ ল্যাংড়া রফিক ধরা পড়েন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সাগরকে গ্রেপ্তার করে ডিটেনশনে দেওয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে কাওলার কামালের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। কামাল গুলিতে আহত হলে এলাকার লোকজন সাগরকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। কিন্তু এরই মধ্যে বিমানবন্দর এলাকায় নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন সাগর। বিমানবন্দরের গাড়ি পার্কিং ও কনকর্স হল ইজারা নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুবলীগের লিয়াকত ও মুরগি মিলনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন সাগর। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে সাগরের হাত থেকে বিমানবন্দরের ইজারা চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে দীপু চৌধুরীর হাতে। এতে মুরগি মিলনের লাভ হয়। বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ আসে মিলনের হাতে। এই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাগর ও মিলনের মধ্যে বিরোধ। পরে কালা জাহাঙ্গীর ও সুব্রত বাইনের সঙ্গে মিলে মুরগি মিলনকে খুন করেন সাগর। মিলন খুন হওয়ার পর সাগর একটি পত্রিকাকে বলেছিলেন, মামলায় তাঁর নাম ঢুকিয়েছিলেন লিয়াকত ও আওরঙ্গ।

পুলিশের খাতায় সাগরের বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১২টি। সব মামলায় তিনি জামিন পেয়েছিলেন। ওই সময় তিনি গুলশানে একটি ফ্ল্যাট ও নিকুঞ্জে একটি প্লট কেনেন। আশকোনায় তাঁর একটি চারতলা বাড়িও ছিল। ঢাকাই সন্ত্রাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তবান ছিলেন সাগর।

২০০১ সালের ৩ এপ্রিল দুবাই থেকে ঢাকায় ফেরার পথে সাগরকে গ্রেপ্তার করেন এসবির সাব ইন্সপেক্টর রেজা। তিনি ছিলেন এএসপি খলিলুর রহমানের টিমের সদস্য। সাগরকে নিয়ে যাওয়া হয় ১০/এ নিউ বেইলি রোডের সিটি এসবি অফিসে। এসবির বিশেষ সুপার (এসএস) ছিলেন ইমামুল হক ফিরোজ (হাইকোর্টের আইনজীবী)। এখনকার অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুব হোসেন ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। এসএসের রুমে কয়েকজন সাংবাদিক বসা। আমাদের সামনে টোকাই সাগরকে আনা হয়। ঠিক এ সময় সেই কক্ষে আসেন আমার সেই বন্ধু সাংবাদিক। তাঁকে দেখেই চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সাগর। অশ্লীল ভাষায় বলেন: ‘...তোকে আমি দেখে নেব।’

দিন কয়েক আগে অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুব হোসেন বলেন, টোকাই সাগরের সেই চোখরাঙানির কথা তাঁর এখনো মনে আছে।

টোকাই সাগরকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পর জেলে পাঠানো হয়। বেশ কয়েক মাস জেলে থাকেন। এরপর একদিন সবার অজান্তে জামিনে বেরিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। এত অপরাধ করেও তাঁকে কোনো বিচারের মুখোমুখি হতে হলো না। আমরাও নানান ইস্যুর ভিড়ে তাঁকে ভুলে গেলাম।

একদিন সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ সাগরের স্ত্রীর ফোন। তিনি বললেন, তাঁর দেবরের পরিবার ডিভিওয়ানে আমেরিকায় গেছে। তাঁরাও সপরিবারে আমেরিকায় চলে যাচ্ছেন। আমার কাছে আবারও সেই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন, ক্ষমা চাইলেন।

এভাবেই সবার চোখের সামনে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন শীর্ষ চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসী টোকাই সাগর। শুনেছি, সাগর এখন নিউইয়র্কের ফ্ল্যাশিং এলাকায় বাড়ি কেনাবেচার ব্যবসায় বেশ নামডাক করেছেন।

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    পঠিতসর্বশেষ

    এলাকার খবর

     
    আষাঢ়ে নয়

    মরণের দূত, ভালোবাসার কান্না

    আষাঢ়ে নয়

    এখনো কাঁদেন রোকেয়া প্রাচী

    আষাঢ়ে নয়

    অধরা জিসানের উপাখ্যান

    আষাঢ়ে নয়

    অর্থ যখন অনর্থের মূল

    আষাঢ়ে নয়

    যে চোখের পানির নাম ‘রেমিট্যান্স’

    আষাঢ়ে নয়

    সাধারণ এক নারীর জীবনবোধ

    চিরকুমার রতন টাটার উত্তরসূরি কে হচ্ছেন

    সাতক্ষীরায় কালীমন্দিরে মোদির উপহারের মুকুট চুরি, ভারতের উদ্বেগ

    মতলবে মেঘনার বালু অবৈধভাবে উত্তোলন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

    নবাবগঞ্জে মাঠে ঘাস কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে দুই বেয়াইয়ের মৃত্যু

    মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্রদের কী ‘গোপন সতর্কবার্তা’ দিল ইরান 

    নলডাঙ্গায় বজ্রপাতে ২ যুবকের মৃত্যু