Ajker Patrika

বিধির বিধান কাটবে তুমি...

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০২
বিধির বিধান কাটবে তুমি...

সারা দিন ধরে গাড়িটি রাস্তার পাশে পড়ে আছে। পড়ে আছে মানে, এক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। পুরোনো টয়োটা সিডান। পথচারী যাঁরা দেখছেন, ভাবছেন, চালক হয়তো আশপাশে কোথাও আছেন। এভাবে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে যায়, রাত আসে। দখিনা বাতাসে ভেসে আসে দুর্গন্ধ। সন্দেহ হয়, গাড়িটিই গন্ধের উৎস। শোরগোল পড়ে, গাড়িতে কেউ খুন হয়েছেন।

ঢাকা থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে মাওয়ার দিকে যেতে প্রথম যে টোল সড়ক, সেটাই ভাওয়ার ভিটা। এখন নাম আবদুল্লাহপুর। থানার হিসাবে পড়েছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে। সেখানেই গাড়িটি ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়। বাঙালির চেতনার মতো কেরানীগঞ্জ থানাও তখন অবিভক্ত। সেই থানা থেকে পুলিশ আসতে রাত গভীর হয়ে যায়। তল্লাশি শুরু হয় রাত দেড়টা নাগাদ। গাড়ির ট্রাংক স্পেস, চলতি ভাষায় যার নাম ব্যাকডালা, সেখানেই পাওয়া গেল হাত-পা বাঁধা এক ব্যক্তির মৃতদেহ। শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। গাড়ির ভেতরে মদের বোতল আর কিছু কাগজপত্র ছড়ানো। চাবিও ঝুলছে লকের সঙ্গে।

মৃতদেহের প্যান্টের পকেটে মানিব্যাগ, তাতে কিছু ভিজিটিং কার্ড। নাম লুৎফর রহমান ভূঁইয়া। সাবেক সাংসদ, জাতীয় পার্টি। ভিজিটিং কার্ড পেয়ে গরম হয়ে ওঠে পুলিশের ওয়াকিটকি। খোঁজখবর শুরু হয়। রাত শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ নিশ্চিত হয়, এই ব্যক্তি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান ভূঁইয়া। ১৯৮৬ সালে ভাঙ্গা থেকে জাতীয় পার্টির সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এলাকায় যাঁর পরিচিতি কালা ফারুক হিসেবে। ঢাকার ওপর মহলে তিনি তখন প্লেবয়। রাতভর পার্টিতে মত্ত থাকেন, তাঁর মাতাল হয়ে রাস্তায় চলাফেরা করার খবর পুলিশের নখদর্পণে। 
লাশ উদ্ধারের খবর ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায়। সকাল হতে না হতেই ক্রাইম রিপোর্টাররা তৎপর হয়ে ওঠেন। সকালে অফিসের নিয়মিত মিটিং বাদ দিয়ে দৌড় দিই কেরানীগঞ্জে। বাইক চালিয়ে থানায় পৌঁছে শুনি, মৃতদেহ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটা ১৯৯৮ সালের ৮ জুলাইয়ের সকাল।

কেরানীগঞ্জ থানার ওসি তখন মোহাম্মদ হানিফ, পরে তিনি অনেক দিন এসবিতে ছিলেন। তিনি আমার পরিচিত। ওসির সঙ্গে পরিচয় থাকলে ভালো কাজ দেয়। রাত থেকে তিনি যা যা জেনেছেন, সবই বললেন। ওসির কক্ষে তাঁর পাশে বসা এক যুবককে দেখিয়ে বললেন, ইনি ভিকটিমের ভাই। নাম জানতে চাইলে সেই যুবক বললেন, আবদুল কাদের মুরাদ। তিনি কালা ফারুকের ছোট ভাই। কথা বলে মনে হলো, ভাইয়ের ওপর মহাবিরক্ত। ভালো করে কোনো কিছুই বলতে চান না। বললেন, তাঁদের আদিবাস ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাধরদি গ্রামে। পিতার নাম আবদুর রব ভূঁইয়া। তাঁর বাবা এলাকায় ‘এ আর ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত। বাবা অগ্রণী ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে কালা ফারুক সবার বড়। মুরাদ তাঁর নিহত ভাইয়ের পরিবার সম্পর্কে কিছুই বলতে চান না। শুধু বললেন, কালা ফারুকের পরিবার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকেন।

দুপুরের আগেই খুঁজে পেলাম এলিফ্যান্ট রোডে কালা ফারুকের বাসা। বাসায় ঢুকে মনে হলো খুব নীরব। কিন্তু পরিবারে শোকের কোনো আবহ নেই। গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে মুখ ঢাকা এক নারী এগিয়ে এলেন। তাঁর নাম পপি, মনোয়ারা ভূঁইয়া পপি। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, তিনি কালা ফারুকের স্ত্রী। তবে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। দেড় বছর ধরে কালা ফারুক আলাদা থাকেন। কোথায় থাকেন তা তিনি জানেন না। তিন ছেলে নিয়ে তিনি এই বাসায় থাকেন। কালা ফারুক বাসায় না এলেও সংসার চালানোর খরচ দেন। স্বামীর সঙ্গে বিবাদের কারণ বললেন ফারুকের বেপরোয়া চলাফেরা। বললেন, অনেক মেয়ের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্কের কথা তিনি জানেন। তাঁর ধারণা, এসব নিয়েই তিনি খুন হয়েছেন। অনেক অনুরোধের পরও তিনি কারও নাম বললেন না। তাঁর পাশে থাকা এক যুবক এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, মডেল ফ্লোরাকে ধরেন, তিনি সব জানেন।

খুনের সঙ্গে মডেলের নাম শুনেই গল্প জমে গেল। এলিফ্যান্ট রোড থেকে বাইক চালিয়ে এলাম ডিবির পিআর শাখায় (জনসংযোগ শাখা)। পিআর শাখা তখন ছিল ডিবি কার্যালয়ের ভেতরের পুকুরপাড়ে, টিনসেডে। পিআরের ফোন থেকে ফোন দিলাম কেরানীগঞ্জের ওসি মোহাম্মদ হানিফকে। ফ্লোরার কথা তাঁকে বলতেই বললেন, লাশ যে গাড়িতে ছিল, তার মালিকও ফ্লোরা, পুরো নাম নাসরিন আক্তার ফ্লোরা। পিতার নাম ফরহাদ হোসেন। ঢাকা জজকোর্টের কর্মচারী।

ফ্লোরার তখন খুব নামডাক, চিনতে দেরি হলো না। জাম্প কেডস আর সাইফেং ফ্যানের টিভি বিজ্ঞাপনের সুবাদে তিনি সবার পরিচিত। ঈদে একটি নাটকও করেছেন। শোনা যেত, ফ্লাইং ক্লাবেও তাঁর বেশ যাতায়াত। তবে এটা মনে আছে, এ ঘটনার কিছুদিন আগে আজিমপুরে একটি বাড়ির ছাদে মদ্যপ বন্ধুদের নিয়ে হইচই করার সময় প্রতিবেশীরা ফ্লোরাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পরে কালা ফারুক তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন। জনকণ্ঠে এ নিয়ে রিপোর্ট হয়েছিল।  

ঢাকা জেলার তখন পুলিশ সুপার ছিলেন ফররুখ আহমেদ। পরে তিনি সিআইডির ডিআইজি হয়েছিলেন। খুনের ব্যাপারে তিনি আমাদের প্রতিদিন ব্রিফ করতেন। যা কিছু খুঁটিনাটি পাওয়া যেত, তাই নিয়ে রোজই ফলোআপ করতাম। তারপরও অফিস থেকে তাড়া থাকত ভালো কিছু করার।

কালা ফারুকের লাশ উদ্ধারের চার দিন পর, ১২ জুলাই বিকেলে ঢাকা জেলার এসপি বললেন, ফ্লোরাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ফ্লোরা স্বীকার করেছেন, কালা ফারুকের সঙ্গে তিনি দেড় বছর ধরে ‘লিভ টুগেদার’ করছেন। কিন্তু খুনের কথা তিনি জানেন না। পুলিশকে বলেছেন, ফরিদপুরে যাওয়ার কথা বলে ফারুক তাঁর গাড়ি নিয়েছিল দুই দিন আগে। গাড়িটি কাঁটাবনের একটি গ্যারেজে ছিল। সেই গাড়িতে কী করে লাশ রাখা হলো, তা তিনি জানেন না। তবে ফ্লোরা পুলিশকে বলেছেন, ঊর্মি ও স্নিগ্ধা নামের আরও দুই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন কালা ফারুক। খুনের সঙ্গে এদের হাত থাকতে পারে।

ফ্লোরার এটুকু বক্তব্য পেয়েই খবরের কাগজ গরম হয়ে ওঠে। ঢাকায় তখন সিনে ম্যাগাজিন ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর রমরমা বাজার। তারাও মেতে উঠল ফ্লোরাকে নিয়ে। প্রায় সব সাপ্তাহিক পত্রিকার কাভার স্টোরি হলো ফ্লোরাকে নিয়ে। আমাদের ওপর চাপ বাড়ছেই। প্রতিদিন কিছু না কিছু করতে হবে। অপরাধ রিপোর্টিংয়ের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে শিখেছিলাম, একটি ঘটনাকে কীভাবে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে হয়। তারপর অপরাধের মৌলিক উপাদানগুলো সেই ঘটনার ভেতর থেকে টেনে বের করে আনলেই একটি গল্প দাঁড়িয়ে যায়। সেই বুদ্ধিটা কাজে লাগিয়ে বাঁচলাম।  

দিন দশেক পরে পুলিশ মোস্তফা নামের ডিশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করল। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই বেরিয়ে এল খুনের রহস্য। ফ্লোরাকে মুখোমুখি করা হলো। পুলিশের কাছে তিনি সব কথা স্বীকার করলেন।

পুলিশ সুপার আমাদের জানালেন, কালা ফারুক খুন হয়েছেন ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডে, থানা লাগোয়া বাড়িতে। ধানমন্ডি থানা তখন ৬ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে ছিল। ওই বাড়ির মালিক ফারুক আজম ছিলেন কালা ফারুকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কালা ফারুকের সঙ্গে ওঠাবসা করতে গিয়ে ফ্লোরার সঙ্গে তিনিও বিশেষ সম্পর্কে জড়িয়ে যান। এ নিয়ে কালা ফারুকের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। অন্যদিকে আরও দুই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ার পর ফ্লোরাও কালা ফারুকের হাত থেকে নিষ্কৃতি চান। দুজনের স্বার্থ মিলে যায়। ৬ জুলাই রাতে এ নিয়ে কথাকাটাকাটির পর দুই ফারুকের মধ্যে মারামারি হয়। এরপর ফ্লোরা ও ফারুক আজম মিলে মদের সঙ্গে ঘুমের বড়ি মিশিয়ে দিয়ে কালা ফারুককে অজ্ঞান করে মেরে ফেলেন। এসপি বললেন, ফারুক আজমের পরামর্শেই ফ্লোরার গাড়িতে মৃতদেহ তোলা হয়। ফ্লোরা প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু ফারুক আজম তাঁকে বোঝান, এতে পুলিশ একদম সন্দেহ করবে না। রাজি হয়ে যান ফ্লোরা। ফারুক আজম নিজে গাড়ি চালিয়ে কেরানীগঞ্জের রাস্তার পাশে গিয়ে মৃতদেহসহ গাড়িটি রেখে আসেন।

গ্রেপ্তার করা ফ্লোরাকে আদালতে পাঠানো হয়। ফ্লোরার বাবা ফরহাদ হোসেন ছিলেন ঢাকা জেলা জজকোর্টের অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কান্নাকাটি করেন মেয়েকে রিমান্ডে না দেওয়ার। আদালত তাঁকে রিমান্ডে না দিয়ে কারাগারে পাঠান। এরপর পুলিশ কালা ফারুকের মামলা নিয়ে আরও কয়েকজন আসামি ধরে। অভিযোগপত্র দেয়। বিচারও চলতে থাকে। আমরা ভুলে যাই হত্যাকাণ্ডের কথা।

এবারের ‘আষাঢ়ে নয়’ লেখার আগে কালা ফারুকের কথা মনে পড়ে গেল। ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন দিলাম ভাঙ্গায় পরিচিতিজনদের কাছে। তাঁরা বললেন, এই হত্যাকাণ্ডের পর  কালা ফারুকের স্ত্রী পপি তাঁর চাচাতো দেবরকে বিয়ে করেন। কয়েক বছর আগে তিনি ভাঙ্গা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। এখন তিন সন্তান নিয়ে আমেরিকায় থাকেন।

খোঁজ নিচ্ছিলাম, সেই খুনের মামলার কী হলো? আমার প্রশ্ন শুনে কালা ফারুকের ছোট ভাই টিপু ভূঁইয়া বললেন, সেই মামলায় কারও সাজা হয়েছে এমন খবর তিনি জানেন না। তিনি জানেন, মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন। আর বিচারের বাণী কাঁদতে কাঁদতে বোবা হয়ে গেছে।

টিপু ভূঁইয়ার ফোন রাখতে রাখতে মনে পড়ে গেল ২৪ বছর আগের কথা। কত প্রভাবই না ছিল এই লোকটার। এরশাদের পতনের পর রাজনীতি ছেড়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চরম বেপরোয়া। একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়াতেন। থানায় অভিযোগ আসত, কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরত না। অনেকের চোখে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন কালা ফারুক। অথচ সেই ক্ষমতাধর লোকটি কাদার মধ্যে তলিয়ে গেলেন। তাঁর জন্য কেউ সাহায্যের হাতটিও বাড়ালেন না। বিধির বিধান বোধ হয় এভাবেই লেখা হয়।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ: জেএমবির সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে পরিচালক গ্রেপ্তার হন দুবার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৪
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় গত শুক্রবার সকালে একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। মাদ্রাসাটি শেখ আল আমিন নামের এক ব্যক্তি পরিচালনা করতেন। যিনি এর আগে নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাতটি মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, ভবনটি বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, হাসনাবাদ বাজারের ফলপট্টি গলিতে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিশুদের পাঠদান করা হয়। বিস্ফোরণে চার কক্ষের একতলা ভবনটির পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে, সিঁড়ির পাশের ছাদের একাংশ উড়ে গেছে এবং সব কটি কক্ষের পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের ক্রাইম সিন ইউনিটের কর্মীরা আলামত সংগ্রহ করছেন। তাঁরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। ভবনের পাশের একটি ভবনের দোতলার দেয়ালে বিস্ফোরণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরণে পাশের একটি অটোরিকশার গ্যারেজের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিনের নিচে চাপা পড়েছিলেন গ্যারেজের ম্যানেজার আবুল কালাম।

আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত বিকট শব্দ হয়েছে যে আমার কানে তব্দা লেগে যায়। আমি টিনের নিচে চাপা পড়ি। পরে হামাগুড়ি দিয়ে বের হই। এরপর দেখি মাদ্রাসার মধ্যে আগুন জ্বলছে। যারা ভেতরে ছিল, তারা দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়ে চলে যায়।’

গ্যারেজের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আমিও বাসা থেকে দৌড়ে আসি। আমার গ্যারেজের দুজন অটোচালক দুই শিশুকে ওই ভবন থেকে বের করেন। এক নারী আর এক শিশুকে নিয়ে চলে যায়। এ সময় আল আমিনও দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন এসে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।’

মাদ্রাসার পাশের ৫ তলা বাড়ির বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হয়েছিল ভূমিকম্প। কারণ, বিস্ফোরণে সব ভবনে কাঁপুনি লাগে। সবাই চিৎকার করেছিল।’

ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘মাদ্রাসাটিতে ৩০-৩৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তবে শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’

ভবনটির পশ্চিম পাশের এক পাশে তিনটি কক্ষে মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অপর পাশের একটি কক্ষে পরিচালক শেখ আল আমিন (৩২), তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৮) এবং তাঁদের তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকতেন। বিস্ফোরণে দুই ছেলে উমায়েত (১০) ও আবদুল্লাহ (৭) আহত হয়। এর মধ্যে আছিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

পাশের ভবনের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমাদের ভবনের কিছু অংশ ফেটে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবও ভেঙে পড়েছে।’

ঘটনাস্থলেই পুলিশ হেফাজতে বসে ছিলেন ভবনমালিক পারভীন বেগম। ভবনের জমি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে লিবিয়ায় থাকা তাঁর দুই ছেলে এই ভবন ২০২২ সালে তৈরি করেন। এরপর হারুন অর রশীদ নামের এক ব্যক্তি এটি মাদ্রাসা করবেন বলে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুফতি হারুন অর রশীদ মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। হারুন তাঁর শ্যালক আল আমিন ও শ্যালকের স্ত্রী আছিয়াকে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় আসতেন। আমি নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ এসে দেখি, ভবনের চারপাশ উড়ে গেছে।’

পারভীন বেগমের পাশেই ছিলেন তাঁর ছোট মেয়ে সোহানা। তিনি বলেন, ‘ভাড়া নেওয়ার সময় শুধু হারুন অর রশীদ একাই এসেছিলেন। এরপর তাঁরা মাদ্রাসা পরিচালনা শুরু করেন। তবে তাঁরা আশপাশের কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না।’

পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে কেমিক্যাল, ককটেল, ভেস্ট ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, কোনো বিস্ফোরক তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে গতকাল বিকেলে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শেখ আল আমিন পলাতক রয়েছেন। তবে কেরানীগঞ্জ থেকে তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম, আছিয়ার ভাই হারুনের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার এবং ঢাকার বাসাবো থেকে আসমানী খাতুন নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, আল আমিনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগে ২০১৭ ও ২০২০ সালে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আসমানী খাতুনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত