Ajker Patrika

কারখানা নদীর ভয়াল থাবায় বাউফলে হাজারো পরিবারের আর্তনাদ

বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
কারখানা নদীর তীরবর্তী কাছিপাড়া, কনকদিয়া ও বগা ইউনিয়নের ছয়-সাতটি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখন পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে। ছবি: আজকের পত্রিকা
কারখানা নদীর তীরবর্তী কাছিপাড়া, কনকদিয়া ও বগা ইউনিয়নের ছয়-সাতটি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখন পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে। ছবি: আজকের পত্রিকা

কারখানা নদীর লাগাতার ভাঙনে দিশেহারা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের হাজারো পরিবার। একসময়ের কৃষিভিত্তিক সমৃদ্ধ গ্রাম এখন পরিণত হয়েছে বিলাপের জনপদে। একেকটি ঘর, জমি আর গৃহস্থালি যেন গিলে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত নদী। এই নদীর করাল থাবায় নিঃস্ব হয়ে আজ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে বহু পরিবার।

কাছিপাড়া ইউপির হাজিপুর গ্রামের আলেয়া বেগম (৫৫) সেই নির্মমতার এক প্রতীক। বিয়ের সময় শশুরবাড়ির গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুরে মাছ আর উর্বর জমি দেখে স্বজনেরা তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নদীভাঙন তাঁর চোখের সামনে গিলে খেয়েছে স্বপ্নের সেই ঘর, উঠান, ফসলি জমি আর স্বামীর উত্তরাধিকারের সম্পদ।

আলেয়া বলেন, ‘সর্বনাশা এই কারখানা নদী মোর স্বামীর ঘরবাড়ি, জমি সব খাইছে। খালি মোগো খায় না—পুরা হাজিরপুর গ্রামটা গিল্লা খাইছে। যেই জমি আছিল, তা পাশের উপজেলায় চর হইয়া বড়লোকরা খায় এখন।’

তিনবার ভাঙনের কবলে পড়ে সহায়-সম্বলহীন আলেয়া এখন দুই সন্তান নিয়ে কাছিপাড়া সড়কের পাশে খড়ের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।

নদীভাঙন শুধু আলেয়ার ঘর কেড়ে নেয়নি—গোপালিয়া বাঘা গ্রামের কৃষক আয়নাল হোসেনের জীবনেও এনেছে অমোচনীয় শোক। নিজের চোখের সামনে ভাই হারানোর স্মৃতি বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। আয়নাল বলেন, ‘বর্গা জমির আধা পাকা ধান কেটে গরুকে খাওয়ামু। ধানের আঁটি লইয়া আগে আইলাম আমি। কিন্তু বড় ভাই জয়নাল আর আইল না। পরে দেখি ধানের আঁটি ভাসে, ভাই ভাঙনে (মাটির নিচে চাপা পড়ে) মারা গেছে।’

কাছিপাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. ইয়াকুব আলী রুবেল মোল্লা জানান, তেঁতুলিয়া নদী থেকে বাকেরগঞ্জের গোমা হয়ে এই কারখানা-ঝিলনা নদী লোহালিয়া হয়ে পায়রায় মিলেছে। নদীর তীরবর্তী কাছিপাড়া, কনকদিয়া ও বগা ইউনিয়নের ছয়-সাতটি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখন পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে। তিনি বলেন, ‘বাহের চর, হাজিরপুর, গোপালিয়া, কলতা, সন্ন্যাসীকান্দা—এসব গ্রামের মানুষের কোথাও বেড়িবাঁধ নেই। এ কারণে বছরজুড়ে নদীভাঙন, বর্ষায় জলোচ্ছ্বাসে গরু-ছাগল থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে। হাজিপুর গ্রাম তো পুরোপুরি নদীগর্ভে গেছে।’

কারখানা নদীর তীরবর্তী কাছিপাড়া, কনকদিয়া ও বগা ইউনিয়নের ছয়-সাতটি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখন পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে। ছবি: আজকের পত্রিকা
কারখানা নদীর তীরবর্তী কাছিপাড়া, কনকদিয়া ও বগা ইউনিয়নের ছয়-সাতটি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখন পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে। ছবি: আজকের পত্রিকা

চররঘুনাদ্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হিস্যাজাত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উত্তর কাছিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে এখন অরক্ষিত।

হিস্যাজাত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এফ এম মামুন হোসেন বলেন, ‘আমি যোগদানের সময় নদী ছিল গ্রামের উত্তর পাশে। পাঁচ বছরে দেড় কিলোমিটার ভেঙে এখন বিদ্যালয়ের মাত্র দেড় শ মিটার দূরে এসে গেছে। জোয়ার এলেই শিক্ষার্থীদের ছুটি দিতে হয়—জোয়ারের গর্জনেই আমরা আতঙ্কে থাকি।’

বাউফল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম জানান, নদীর ১০-১৫ কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গ্রামগুলো টিকিয়ে রাখতে অবিলম্বে বাঁধ বা বস্তা ফেলে নদীশাসন জরুরি।

পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে প্রায় ৮০ লাখ টাকার জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পুরো এলাকায় স্থায়ী রক্ষাব্যবস্থা গড়তে প্রকল্প দাখিল করা হবে। অনুমোদন পেলে ব্লক ও জিও ব্যাগ দিয়ে স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ করা সম্ভব।

এদিকে প্রতিদিন নদীর গর্ভে বিলীন হচ্ছে নতুন নতুন ভূমি, ভাঙনের আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। ভাঙনের থাবা যদি দ্রুত ঠেকানো না যায়, তবে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে বাউফলের আরও কয়েকটি গ্রাম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ