Ajker Patrika

শামীম মোল্লার দুঃসহ পৌনে ৩ ঘণ্টা, উপস্থিত থেকেও দায় এড়াচ্ছে প্রশাসন

সৌগত বসু, ঢাকা
আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২: ২৭
শামীম মোল্লার দুঃসহ পৌনে ৩ ঘণ্টা, উপস্থিত থেকেও দায় এড়াচ্ছে প্রশাসন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে ক্যাম্পাসের প্রক্টর অফিস ও নিরাপত্তা কার্যালয়ের পাশেই কয়েক দফা মারধর করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুরো ঘটনার দায় এড়িয়ে গেছে। যদিও ঘটনার দিন ১৮ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা শাখা ও প্রক্টর অফিসে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ছিল প্রক্টরিয়াল বডি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের। 

এ ঘটনায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ও অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনের নামে মামলা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মামলার তিন নম্বর আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। 

এর আগে গত ১৫ জুলাই মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন উপাচার্য নুরুল আলমের বাসভবনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছিলেন। সেদিন পুলিশ, শিক্ষক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে হামলা করেছিল ছাত্রলীগ ও বহিরাগতরা। উপাচার্যের বাসভবনেও ওই দিন নিরাপদ ছিলেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য দরজা আটকিয়ে বাসভবনে বসে ছিলেন, কোনো পদক্ষেপ নেননি। পরে বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা একত্র হয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন। 

জাবির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা (ডেপুটি রেজিস্ট্রার) সুদীপ্ত শাহীন ২০ সেপ্টেম্বর আজকের পত্রিকার কাছে শামীম মোল্লাকে মারধরের ঘটনার বর্ণনা করেন। সুদীপ্ত শাহীন প্রক্টরিয়াল বডির কিছু না করতে পারা ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান আসার পর মারধরকারী সাঈদ ভূইয়া উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এমন তথ্য দিয়েছিলেন। সেটি নিয়ে আজকের পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর গত ২৪ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন উপাচার্য। পরদিন জনসংযোগ দপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রশাসনের অবস্থান জানানো হয়। 

সেখানে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক ব্যতিরেকে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। শামীম মোল্লার মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দোষারোপ করা দুরভিসন্ধিমূলক। 

প্রশাসনের উপস্থিতি ছিল সার্বক্ষণিক
আজকের পত্রিকা শামীম মোল্লাকে নিরাপত্তা কার্যালয়ে মারধরের দিনের বিভিন্ন সময়ে প্রক্টরিয়াল বডি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি জানার চেষ্টা করেছে। শামীম মোল্লার মারধরের সময়ে প্রক্টরিয়াল বডির তিনজন ও নিরাপত্তা শাখার সাতজন উপস্থিত ছিলেন। প্রক্টর ছাড়াও দুজন সহকারী প্রক্টর—ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ রেজাউল রকিব, গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আল-আমিন খান উপস্থিত ছিলেন। আর নিরাপত্তা শাখার উপস্থিত ছিলেন— প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন (নিরাপত্তা-১), মো. জেফরুল হাসান চৌধুরী সজল (নিরাপত্তা-২), নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ. এস. এম রাশিদুল হাসান রাসেল, মো. রাসেল মিয়া স্বাধীন, নিরাপত্তা কর্মী রিয়াজুল, মনির ও সালাম। 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তাদের বক্তব্য এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা গেটে (প্রান্তিক গেট) একাই অবস্থান করছিলেন। বিকেল আনুমানিক সোয়া ৫টার দিকে তাঁকে সেখানে আটক করে মারধর করেন কিছু শিক্ষার্থী। সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটে নিরাপত্তা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা একটি ফোন কলে বিষয়টি জানতে পারেন। ৫টা ৫৭ মিনিটে ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ অন্যরা প্রান্তিক গেটে হাজির হন। সেখানে প্রক্টর এ কে এম রাশিদুল আলমও ছিলেন। নিরাপত্তা কর্মীরা শামীম মোল্লাকে একটি রিকশায় করে প্রক্টর অফিসে নেন। আরেকটি রিকশায় প্রক্টর ও সেই নিরাপত্তা কর্মকর্তাও সেখানে যান। শামীম মোল্লাকে প্রক্টরের কার্যালয়ের সামনের একটা কক্ষে রাখা হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয় বলে জানান প্রক্টর। এর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী ওই কক্ষ থেকে শামীম মোল্লাকে নিরাপত্তা শাখার নিরাপত্তা কর্মকর্তার কক্ষের সামনের করিডরে নিয়ে যায়। 

নিরাপত্তা অফিসের সামনের এই করিডোরেই শামীম মোল্লাকে পেটানো হয়। ছবি: আজকের পত্রিকাপ্রক্টর অফিস ও নিরাপত্তা শাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো রেজিস্ট্রার ভবনে। দুই দপ্তরের মধ্যে দূরত্ব আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ ফুট। করিডরে নিয়ে যাওয়ার পর শামীম মোল্লাকে আবার মারধর করা হয়। তিনি চিৎকার করছিলেন। সেসময় প্রক্টর তাঁর কার্যালয়েই ছিলেন। একপর্যায়ে প্রক্টর ও নিরাপত্তা কর্মীরা এসে মারধরকারীদের নিবৃত্ত করেন। সেখানে ৮–১০ জনের উপস্থিতি দেখা গেছে। এরপর শামীমকে গুরুতর আহত অবস্থায় রেখেই সামনের কলাপসিবল গেটে তালা মেরে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাকিরা আবার প্রক্টরের অফিসে ফিরে যান। এর কিছুক্ষণ পরেই কিছু শিক্ষার্থী সেখানে উপস্থিত হয়ে মারমুখী আচরণ করলে নিরাপত্তা কর্মীরা শিক্ষার্থীদের বাধা দিলে নিরাপত্তা শাখার দুই কর্মকর্তা এ. এস. এম রাশিদুল হাসান ও মো. রাসেল মিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয়। তখন প্রক্টরের অফিসে থাকা সহকর্মীদের ডাকে ওই দুই কর্মকর্তা অন্য একটি কক্ষে আশ্রয় নেন। শিক্ষার্থীরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে ওই দুই কর্মকর্তা একপর্যায়ে বাথরুমে আশ্রয় নেন। 

শিক্ষার্থীরা আবার শামীমকে মারতে আসে। তারা শামীমের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মী রিয়াজুলের কাছ থেকে চাবি চায়। রিয়াজুল দৌড়ে প্রক্টর অফিসের দিকে গেলে সেখানে গিয়ে চাবি ছিনিয়ে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তারা তালা খুলতে পারেনি। এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে শিক্ষার্থীরা কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙে ফেলে শামীমকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে প্রক্টর ও নিরাপত্তা কর্মীরা গিয়ে মারধরকারীদের সরিয়ে দেন। শামীম তখন নিথর অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছিলেন। তাঁকে সেভাবে রেখেই কলাপসিবল গেটে আরেকটি তালা মেরে প্রক্টর ও নিরাপত্তা কর্মীরা স্থান ত্যাগ করেন। 

শামীমকে পুলিশের হাতে দিতেও দেরি
আনুমানিক ৭টা ২০ মিনিটে উপাচার্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. এ বি এম আজিজুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রব, উপাচার্যের একান্ত সচিব মো. মঞ্জুরুল করিমসহ আরও কিছু কর্মকর্তা। উপাচার্য প্রক্টর অফিসে গেলে সাবেক কিছু শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। রাত পৌনে ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। উপাচার্য তখনো সেখানে ছিলেন। পুলিশ শামীম মোল্লাকে নিয়ে যায় রাত ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে। উপাচার্য ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন রাত আনুমানিক ৮টা ১৫ মিনিটে। রাত ৯টায় গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে শামীমকে মৃত ঘোষণা করা হয়। 

পুলিশের কাছে শামীমকে হস্তান্তর করা হয় পৌনে এক ঘণ্টা পর। কোন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে এ নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়। ১৫ জুলাই উপাচার্যের বাসভবনে হামলার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর কথা বলা হয়। কিন্তু মামলা না থাকায় শামীমের নামে আগের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

নিরাপত্তা অফিসের সামনের এই করিডোরেই শামীম মোল্লাকে পেটানো হয়। ছবি: আজকের পত্রিকারাত সোয়া ৮টার দিকে উপাচার্য চলে যাওয়ার পর শামীম মোল্লাকে পুলিশের কাছ হস্তান্তরের জন্য নিরাপত্তা অফিসের পাশের করিডর থেকে প্রক্টর অফিসে নেওয়া হয়। মারধরকারীরা সেসময় শামীমকে আবার ওই করিডরে নিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ ও মারধর করে। পরে প্রক্টর, নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশ শামীমকে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে তোলে। 

আশুলিয়া থানা সূত্রে জানা যায়, দুই পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে শামীম মোল্লা পুলিশ ভ্যানে ওঠেন। তখনো পেছন থেকে তাঁকে ধাক্কা ও কিলঘুষি মারা হচ্ছিল। গাড়িতে উঠেই শামীম পড়ে যান। এরপর পুলিশের গাড়ি সরাসরি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যায়। 

গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, আনার পর পরীক্ষা করে দেখা যায় শামীম মোল্লা মৃত। অর্থাৎ তাঁকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এন্ট্রি বইয়ে শামীম মোল্লাকে রাত ৯টায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে তথ্য রয়েছে। 

ঘটনার দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন জহির রায়হান ফিল্ম সোসাইটির দপ্তর সম্পাদক জুবায়ের আহমেদ। তিনি জাবি প্রেস ক্লাবের সদস্য। 

জুবায়ের আজকের পত্রিকাকে বলেন, শামীম মোল্লাকে প্রক্টর অফিসে রাখা হয়েছে এমন খবর পেয়ে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি প্রক্টর অফিসে যান। নিরাপত্তা অফিসের সামনে তিনি প্রক্টর ও সহকারীদের প্রক্টরদের দেখতে পান। নিরাপত্তা কর্মকর্তা তাঁকে জানান শামীম মোল্লাকে করিডরে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। অনুরোধ করে গেটের তালা খুলিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখেন শামীম মোল্লা অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছেন। ওই সময় প্রক্টর অফিসের সামনে কয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন। একটু দূরে প্রায় ২০ জনের একটি জটলা ছিল। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী আজকের পত্রিকাকে বলেন, শামীমকে মারধর থেকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন নিরাপত্তা কর্মকর্তা রাসেল ও স্বাধীন। এ জন্য তাঁদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল মারধরকারীরা। শামীমকে নিরাপত্তা কার্যালয়ের সামনে আনলে এই দুজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেয় মারধরকারীরা। তখন ওই দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে সরিয়ে প্রক্টর অফিসের মধ্যে নেওয়া হয়। রাতে শামীম মোল্লাকে পুলিশ নিয়ে গেলে তাঁরা বের হয়েছেন। 

শামীম মোল্লার বড় ভাই শাহীন মোল্লা আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জানতে পারেন তাঁর ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। এরপর খোঁজ নিয়ে জানেন, তাঁকে পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। তখন তিনি সাভার থানা ও এনাম মেডিকেলে যান। সেখানে না পেয়ে আশুলিয়া থানায় যান রাত ১১টার দিকে। থানা থেকে তাঁকে জানানো হয়, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে নেওয়া হয়নি। তখন জানতে পারেন তার ভাইকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পৌনে ১২টার দিকে তিনি সেখানে পৌঁছে জানতে পারেন ভাই আর নেই! ভাইয়ের শরীরে হাত দিয়ে দেখেন ঠান্ডা। তার মানে কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি মারা গেছেন। 

শাহীন বলেন, শামীমকে ক্যাম্পাস থেকে সরাসরি হাসপাতালে নেওয়া হয়। থানায় নেওয়া হয়নি। 

মারধরের সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকজন ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকলেও তাঁরা ঘটনার দায় এড়িয়েছেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহীন বলেন, ‘এখন তাঁরা যদি দায় এড়িয়ে যান, তাহলে কিছু বলার নেই! তবে (তাঁরা) মামলা দিয়েছেন। প্রক্টর ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, এটা শুনেছি। মামলা অনুযায়ী বিচার হলেই হবে। কেউ যদি তাঁকে রক্ষা করতে না পারে তবে আর কী করার আছে!’ 

শামীম মোল্লা নিহতের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিতে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভীন। তবে তিনি এই কমিটিতে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করে উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়েছেন। 

চিঠির বিষয়ে আনিছা পারভীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, অপারগতার কারণ হিসেবে হত্যার শিকার শামীম মোল্লাকে পেটানোর সময় স্বয়ং উপাচার্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার তথ্য পত্রিকার সংবাদের বরাতে চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন। সেই তথ্য উপাচার্য সরাসরি মৌখিক আলাপে অস্বীকার করেছেন। উপাচার্য হিসেবে তাঁর বক্তব্যের প্রতি তিনি (আনিছা পারভীন) আস্থা রাখতে চান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশীজন প্রকাশ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো নানা ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত। সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ব্যক্তিদের (প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরেরা) ঘটনার বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার খবরাখবরও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ অবস্থায়, তদন্ত কমিটির কর্মকাণ্ড সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে, প্রভাব ও চাপ মুক্ত থেকে পরিচালনা করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে তাঁর সংশয় ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

আনিছা পারভীন উপাচার্যকে দেওয়া চিঠিতেও একই কথা বলেছেন। 

ওই দিনের বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শামীমকে আমার কার্যালয়ে নয়, নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলাম। তবে পুলিশ আসতে দেরি করে। আমরা সোয়া ৬টায় পুলিশকে জানিয়েছিলাম। পুলিশ এসেছিল পৌনে ৮টায়। শামীমকে পুলিশ নিয়ে গেছে প্রায় পৌনে ৯টার দিকে।’ 

পুলিশ আসার পরেও কেন শামীমকে হস্তান্তরে সময়ক্ষেপণ করা হয়—এ প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর বলেন, ‘পুলিশ ওখানে তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে।’ 

শামীম মোল্লাকে মারধরের সময় প্রক্টরিয়াল বডি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি থাকলেও প্রশাসন দায় এড়িয়ে গেছে—এ প্রসঙ্গে প্রক্টর বলেন, ‘এখানে যেসব সাংবাদিক উপস্থিত ছিল তাদের কাছে শুনলে বোঝা যাবে আমরা কতটুকু চেষ্টা করেছি। আমি এখানে একদম ওনাকে (শামীম) আনা থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলাম। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি কেউ যেন তাকে প্রহার না করে। শিক্ষক হিসেবে অনেকে আমার কথা শুনেছে, আবার কেউ কেউ শোনেনি।’ 

তাহলে কি ঘটনাস্থলে মারধরকারীদের তুলনায় প্রক্টরিয়াল বডি বা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সংখ্যা কম থাকায় সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারেননি—এমন প্রশ্নে প্রক্টর বলেন, ‘আমার দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এটা হয়েছে। আমাদের সদস্য মাত্র চারজন। একটা মবে এই কয়েকজন যথেষ্ট নয়। আবার নিরাপত্তা শাখার যারা ছিলেন তাঁরা নির্লিপ্ত ছিলেন। এইজন্য তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তাঁরা সেখানে বলবেন কেন নির্লিপ্ত ছিলেন।’ 

অনেকটা একই কথা বলেছেন উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নিরাপত্তা শাখার দায়িত্বে অবহেলা ছিল। সে জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রক্টরিয়াল টিমের যে তদন্ত প্রতিবেদন তাঁরা করেছেন, সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে, (এজাহারে) অভিযুক্তদের ক্রম পরিবর্তন হয়েছে। সেটাও অত্যন্ত দুরূহ কাজ। প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা যেটি মামলার জন্য জমা দিয়েছে সেখানে তিনি ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। সাময়িক ভাবে তাঁকে ট্রান্সফার করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ 

উপাচার্য আরও বলেন, ‘প্রক্টরিয়াল টিমটা ইনকমপ্লিট (অসম্পূর্ণ) : এখানে প্রক্টর আর তিনজন। শামীম মোল্লাকে পুরোটা সময় নিরাপত্তা কার্যালয়ে রাখা হয়েছিল। আমাকে এই ভাবেই রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এটা তদন্ত সাপেক্ষে আরও পরিষ্কার হবে।’ 

ক্যাম্পাসের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নিজের পদক্ষেপ সম্পর্কে উপাচার্য বলেন, ‘শামীম মোল্লা একজন মানুষ হিসেবে অন্যায়ের শিকার হয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষকে সে যে দল, যে মত তাকে বিচারের আওতায় আসতে হবে। সে জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আমি প্রক্টরিয়াল রিপোর্ট নিয়ে যে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করেছি, সনদ স্থগিত করেছি। মামলাও করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমি (উপস্থিত) থাকা অবস্থায় (শামীমের ওপর) কোনো আঘাত হয়নি। এর বাইরে যেগুলো হয়েছে সেগুলো সবাই আমাকে বলেছে, কিন্তু সঠিক বলেছে কিনা সেটা তদন্ত করার পর বলা যাবে।’ 

ঘটনার সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নির্লিপ্ততার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাবির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি একদম সত্যি নয়। ওখানে প্রক্টর ছিলেন, তিনি যে আদেশ দেবেন আমাদের সেটিই করার কথা। তবে তেমন কিছু হয়নি। বরং সাবেক ছাত্রকে প্রক্টরিয়াল বডি (প্রান্তিক গেট থেকে) ক্যাম্পাসে এনেছেন এবং তাঁর নিজের কক্ষে না রেখে সামনের কক্ষে রেখেছেন। তাঁদের সামনে থেকে শামীমকে নিরাপত্তা শাখার করিডরে নেওয়া হয়। এসব কিছুই প্রক্টরের উপস্থিতিতেই ঘটেছে। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ।’ 

 [তথ্য নিয়ে সহযোগিতা করেছেন জাবি সংবাদদাতা]

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সৌদি আরবে অপহরণ, ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি দেশে

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সৌদি আরবে এক প্রবাসী ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে বাংলাদেশে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে একটি চক্র। না দিলে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে (এমএফএস) ধাপে ধাপে মোট ৩৫ লাখ টাকা পাঠালে সৌদি আরবের রিয়াদে অচেতন অবস্থায় তাঁকে ফেলে যায় অপহরণকারীরা।

গত মঙ্গলবার অপহরণকারী এই চক্রের বাংলাদেশি সদস্য মো. জিয়াউর রহমানকে (৪২) মাগুরার শালিখা থানার হরিপুর বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

গ্রেপ্তারের পর সংস্থার বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান জানান, অপহরণকারীদের দেওয়া এমএফএস ও ব্যাংক হিসাব নম্বর বিশ্লেষণ করে জিয়াউর রহমানকে শনাক্ত করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মুক্তিপণ থেকে ৫ লাখ টাকা কমিশন নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি মো. রাসেল নামের ওই প্রবাসীকে অপহরণের পর সে মাসের ২১ তারিখে তাঁর শ্বশুর রাজধানীর খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলাটি সিআইডির ঢাকা মেট্রো (পূর্ব) ইউনিট তদন্ত করছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, মো. রাসেল ২০ বছর ধরে রিয়াদে ব্যবসা করছেন। ১২ জানুয়ারি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাঁকে অপহরণ করে তাঁর বড় ভাই সাইফুল ইসলামের কাছে ইমু ও ভিওআইপিতে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না দিলে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। কয়েক ধাপে টাকা পাঠানোর পর তাঁকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুলিশের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ২০: ২৫
ডিবির সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। ছবি: আজকের পত্রিকা
ডিবির সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। ছবি: আজকের পত্রিকা

অরাজকতা প্রতিহত করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে অসদাচরণ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। তিনি বলেছেন, পুলিশ যখন অরাজকতা ঠেকানোর চেষ্টা করছে, তখন তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

ডিএমপি কমিশনার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমার অফিসারদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করবেন না।’

আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

সাম্প্রতিক অরাজকতা প্রতিরোধের সময় পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, ‘পুলিশ যখন অরাজকতা প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল, তখন আমার অফিসারদের সঙ্গে যে ধরনের ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। আমার অফিসারদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না। আমরা সংঘাতে জড়াতে চাই না; আমরা সেবা দিতে চাই। আপনারা যেটি করতে চাচ্ছিলেন, সেটি করলে সমাজে, ঢাকায় এবং পুরো দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।’

কমিশনার জানান, একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এখন যদি একই ধরনের কার্যকলাপ দেখা যায়, তাহলে সমাজে অস্থিরতা বাড়বে। এ জন্যই পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রতি এমন আচরণ কোনো শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

পল্লবী থানার সামনে ককটেল বিস্ফোরণে এক পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার নিরপরাধ অফিসারকে যেভাবে ককটেল মেরে আহত করা হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে সদস্যদের মনোবল নষ্ট হয় এবং এর ক্ষতি সমাজকেই ভোগ করতে হয়। যদি পুলিশের মনোবল ভেঙে যায়, তবে ৫ আগস্টের পর যেভাবে ৮০ বছরের বৃদ্ধও লাঠি হাতে নিয়ে মহল্লা পাহারা দিয়েছেন, সেই পরিস্থিতি আবার তৈরি হতে পারে।’

যারা ককটেল ছোড়া বা এ ধরনের দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন—‘এই কাজটি করবেন না।’

গুলির নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি পুলিশ কমিশনারের নির্দেশনা নয়, এটি দেশের আইন। আইন পুলিশ বানায় না, পার্লামেন্ট বানায়। আইন যা বলেছে, আমরা শুধু সেটাই অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছি।’

ডিএমপি কমিশনার জানান, দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ মোকাবিলায় আধুনিক সক্ষমতা গড়ে তুলতেই ডিবির সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন করা হয়েছে। এখানে থাকবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত ল্যাব, দক্ষ তদন্তকারী দল, ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং ২৪ ঘণ্টার রেসপন্স টিম। ফেসবুক পেজ, ই-মেইল এবং ডিবির অনলাইন চ্যানেলের মাধ্যমে নাগরিকেরা সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন। প্রযুক্তিনির্ভর, সময়োপযোগী ও প্রমাণভিত্তিক পুলিশ সেবা নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য।

ডিএমপি কমিশনার বলেন, বর্তমান সময়ে অনলাইন জালিয়াতি, প্রতারণা, ডিজিটাল হয়রানি, মানহানি, অনলাইন গ্যাম্বলিংসহ নানা অপরাধ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও আর্থিক সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাই জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ডিএমপি তার সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে।

নারী ও কিশোরদের সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সাইবার সাপোর্ট সেন্টার কাজ করবে উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী ও কিশোরদের ওপর হয়রানির অভিযোগ দ্রুত সমাধানের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। হয়রানির শিকার হলে দ্রুত সহায়তা নিশ্চিত করাই তাদের অন্যতম অঙ্গীকার।

সাইবার নিরাপত্তা শুধু পুলিশের দায়িত্ব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ অনলাইন পরিবেশ গড়ে তুলতে তিনি সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অতি লোভে তাঁতি নষ্ট: ৬০০ কোটি টাকা হারালেন নওগাঁর ৮০০ জন!

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ৩৪
বুধবার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার মো. নাজিম উদ্দিন তনু। ছবি: সিআইডি
বুধবার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার মো. নাজিম উদ্দিন তনু। ছবি: সিআইডি

‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’— প্রচলিত প্রবাদ যে হুবহু বাস্তবে ঘটতে পারে, তার প্রমাণ মিলল উত্তরাঞ্চলের জেলা নওগাঁয়। এই জেলার ৮০০ জনের বেশি মানুষকে অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে।

বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অন্যতম হোতা মো. নাজিম উদ্দিন তনুকে (৩৭) গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ—সিআইডি। গতকাল বুধবার সকালে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় রাজধানী ঢাকার দক্ষিণখান এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সিআইডির পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার মো. নাজিম উদ্দিন তনুর বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার জগৎসিংহপুরে। প্রায় এক বছর আগে ২০২৪ সালের ১২ নভেম্বর নওগাঁ সদর থানায় নাজিম উদ্দিনসহ কয়েকজনের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করেছিলেন এক ব্যক্তি। মামলাটি বর্তমানে সিআইডির নওগাঁ জেলা ইউনিট পরিচালনা করছে।

মামলার তদন্তে জানা যায়, প্রতি মাসে ১ লাখ টাকার বিপরীতে ২ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকদের টাকা নেয় ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি এনজিও। এনজিওটির কার্যালয় নওগাঁ সদরের অফিসপাড়া এলাকায়। পরিচালক মো. নাজিম উদ্দিন তনু।

প্রথম দিকে পরিচালকদের মনোনীত কিছু গ্রাহককে এই হারে লভ্যাংশ দেয় বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন। পরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকেরা সুকৌশলে প্রচার করা শুরু করেন। তাঁদের এই ফাঁদে পড়ে বহু সাধারণ মানুষ বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে গ্রাহক হিসেবে বিনিয়োগে আগ্রহী হন। মামলার বাদী নিজেই ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতা দেখা দেয়। ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা সে সময় থেকে তাঁদের জমাকৃত কিংবা ঋণের অর্থ ঠিকঠাক উত্তোলন করতে পারছিলেন না। বিষয়টি নিয়ে অভিযাগ জানালে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে গ্রাহকদের কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নেন পরিচালক তনু।

কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে আও বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে গিয়ে বাদীসহ অন্য ভুক্তভোগীরা নিজেদের অর্থ ফেরত চাইলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। একপর্যায়ে গ্রাহকদের অর্থ দেওয়া হবে না মর্মে জানিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এই ঘটনার পর বাদী নওগাঁ সদর থানায় মামলা (মামলা নম্বর ২০, তারিখ ১২-১১-২০২৪, ধারা-৪০৬/৪২০ পেনাল কোড-১৮৬০) করেন। বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন যে ভুক্তভোগীদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল।

তবে সিআইডি জানায়, এ পর্যন্ত আট শতাধিক ভুক্তভোগী ৬০০ কোটির বেশি টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় মো. নাজিম উদ্দিন তনুসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন ত্রাস ‘সন্ত্রাসী রনি’

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫৪
সন্ত্রাসী মামুন হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সন্ত্রাসী রনি। ছবি: সংগৃহীত
সন্ত্রাসী মামুন হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সন্ত্রাসী রনি। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর অপরাধজগতে নতুন পর্দা নামিয়েছেন রনি নামের এক সন্ত্রাসী। দুই লাখ টাকায় খুনি ভাড়া দিয়ে তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করিয়েছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, রনি সানজিদুল ইসলাম ইমনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। প্রথমে মুদিদোকানদার, পরে ডিশ ব্যবসায়ী। এখন ঢাকার অপরাধজগতের নতুন নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে জানান, রনি মূলত মুদিদোকানি ছিলেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কারাগারে থাকাকালে রনির সঙ্গে পরিচয় হয়। ইমন তাঁর মাধ্যমে অপরাধ চক্রের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। শুরুতে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার ডিশ ব্যবসা দখল, চাঁদাবাজি ও হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আদায় করে কারাগারে থাকা ইমনকে পাঠাতেন। পরে সন্ত্রাসী ইমনের শিষ্যদের ব্যবহার করে বড় বড় কাজ করতে থাকেন। মিরপুর এলাকায়ও ব্যবসা বড় করতে থাকেন। এভাবে রনি ধীরে ধীরে ঢাকার অপরাধজগতের পরিচিত মুখে পরিণত হন।

ডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল ইমনের। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রনির নির্দেশে ফারুক হোসেন ফয়সাল ও রবিন আহম্মেদ পিয়াস গুলি করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন তিনি। পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত ফারুক রবিন, রুবেল, শামীম আহম্মেদ ও ইউসুফ ওরফে জীবনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও রনির খোঁজ মিলছে না।

ডিবির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর ভেলানগর থেকে ফারুক, রবিন, শামীম ও রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যার পর তাঁরা প্রথমে ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ফারুক ও রবিন ব্যবহৃত অস্ত্র ও অব্যবহৃত গুলি রনির নির্দেশে রুবেলের কাছে রেখে আসেন। পরে রুবেল পেশায় দরজি ইউসুফের কাছে অস্ত্রগুলো হস্তান্তর করেন।

পুলিশ জানিয়েছে, ইউসুফ মোহাম্মদপুরে তাঁর বাসায় অস্ত্র ও গুলি লুকিয়ে রেখেছিলেন। মোটরসাইকেল, অস্ত্র ও নগদ ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। রনি পারিশ্রমিক হিসেবে এই টাকা দুই ভাগে ভাগ করে দুই শুটারকে দেন।

ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, জামিনে মুক্তির পর মামুন আবার অপরাধজগতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। রনিকে পাত্তা না দিয়ে তাঁর এলাকা দখল করতে চান। তখনই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সঙ্গে পরার্মশ করে মামুনকে পথ থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেন রনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই লাখ টাকায় ভাড়াটে খুনি ব্যবহার করেন।

পুলিশ ও ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, এই হত্যাকাণ্ড আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোনো দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা। মামুন ও ইমন দুজনই ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী, যাঁরা প্রভাব বিস্তার ও এলাকা দখল নিয়ে লড়াই করছিলেন। ইমনের সহযোগী হিসেবে রনি দ্রুত অপরাধজগতে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ মামুন হত্যার পর তিনি এখন ঢাকার অপরাধজগতে নতুন চরিত্র। ডিবি অভিযান চালিয়ে মূল পরিকল্পনাকারী রনি ও তাঁর সহযোগীদের ধরার চেষ্টা করছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

পাঁচজন রিমান্ডে

মামুন হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচজনকে গতকাল মোহাম্মদপুর থানার অস্ত্র আইনের মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে ডিবি পুলিশ। আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পার্থ ভদ্র প্রত্যেকের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত