Ajker Patrika

যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাড়াতে চায় চীন, পাশে ইরান-মিসর

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৮: ১৯
মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা কষছে চীন। ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা কষছে চীন। ছবি: সংগৃহীত

চীনের অনেক থিংকট্যাংক এবং রাজনৈতিক, গোয়েন্দা, নিরাপত্তা ও সামরিক মহল মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করছে। তারা এমন একটি জরুরি সামরিক পরিকল্পনা তৈরির সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে, যার মাধ্যমে ওই অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলো চিরতরে সরানো যায়। কারণ, এসব ঘাঁটি অঞ্চলটিতে চীনা স্বার্থ ও অংশীদারত্বে বাধা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ আওতায় চীনের মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে নেওয়া উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে বাধা।

এমন সম্ভাবনা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, সম্প্রতি এই অঞ্চলের একাধিক মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করে ইরান ও চীনের অন্য মিত্রদেশগুলোর ওপর হামলা চালানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। বিষয়টি বেইজিংকে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে, চীন ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের সহায়তায় উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে মার্কিন বাহিনীকে এই অঞ্চল থেকে তাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। চীনের দৃষ্টিতে, এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক।

চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা এই অঞ্চল এবং উপসাগরীয় এলাকায় থাকা সব মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মূল করতে চায়। এর জন্য ক্রমাগত চাপ সৃষ্টির কৌশল নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে, ইরানি সামরিক বাহিনী কয়েক বছর ধরে চীন ও রাশিয়ার পরোক্ষ সহায়তায় এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলো ‘ইমাম আলী ইরানি সামরিক ঘাঁটি’। এটি সিরিয়ার দেইর আল-জোর প্রদেশের আলবুকামাল শহরে ইরাক সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত।

চীন আত্মবিশ্বাসী যে, মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকায় থাকা সব মার্কিন ঘাঁটি নির্মূলে বেইজিংয়ের উচ্চাভিলাষী সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মিসরীয় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। মিসরই একমাত্র আরব দেশ, যেখানে কোনো মার্কিন সেনাঘাঁটি নেই। আবার আফ্রিকা মহাদেশে প্রবেশের প্রধান দরজাও মিসর।

অদূর ভবিষ্যতে চীন আফ্রিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কমান্ড বা ইউএস অ্যাফ্রিকম নির্মূলেও কাজ করতে পারে। ইউএস অ্যাফ্রিকম হলো একটি সমন্বিত বাহিনী। এটি আফ্রিকার ৫৩টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম ও সামরিক সম্পর্ক তত্ত্বাবধান করে। তবে ব্যতিক্রম মিসর, দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায়।

এই প্রেক্ষাপটে চীন, ইরান ও মিসরের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সব গতিবিধি এবং ইসরায়েলের ভেতরে অবস্থিত একমাত্র মার্কিন ঘাঁটির কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর গোয়েন্দা নজরদারির জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই ঘাঁটি ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ করে মিসর এবং দেশটিতে থাকা চীনা ও রুশ মিত্রদের ওপর নজরদারি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র।

২০২৫ সালের এপ্রিলে মিসর-চীনের যৌথ সামরিক মহড়া ‘সিভিলাইজেশন ঈগলের’ ওপরও তীক্ষ্ণ নজর রাখে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের এই সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করেছিল। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা মহল এই মহড়াকে সন্দেহ ও সতর্কতার দৃষ্টিতে দেখে। তাদের ধারণা, এই মহড়ার মাধ্যমে চীন ইঙ্গিত দিতে চেয়েছে যে, মিসর কিংবা এই অঞ্চলের অন্য যেসব দেশ চীনের মিত্র, তারা যদি যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের সরাসরি বা পরোক্ষ সামরিক হুমকির মুখে পড়ে, তবে চীন তাদের পাশে দাঁড়াবে।

এ ছাড়া মিসর ও চীন ‘সিভিলাইজেশন ঈগল’ মহড়ার মাধ্যমে ওয়াশিংটন ও তেল আবিবকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোর করে মিসরের সিনাই অঞ্চলে বা মিসরীয় সীমান্তে ঠেলে দেওয়ার যেকোনো চেষ্টার বিরোধিতা করবে চীন। মিসর, তার সরকার, জনগণ ও সেনাবাহিনীর পাশে থাকার বার্তাও দিয়েছে বেইজিং।

এ কারণে ইসরায়েলের কারেন পর্বতের কাছাকাছি অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র সামরিক ঘাঁটি থেকে চীন ও মিসরের সব সামরিক তৎপরতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বর্তমানে ইসরায়েলের মাটিতে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোই সক্রিয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কারেন পর্বতে অবস্থিত এএন/টিপিওয়াই-২ ক্ষেপণাস্ত্র সতর্কীকরণ রাডার স্টেশন।

গাজার বাসিন্দাদের মিসরীয় সীমান্ত ও সিনাই এলাকায় জোর করে স্থানান্তরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের চাপের মুখে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও মিসরীয় সেনাবাহিনীকে সামরিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে চীন। গাজা সংকট ঘিরে মিসর-ইসরায়েল সীমান্তে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা চীনের সামরিক ও গোয়েন্দা মহল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে, সিনাই অঞ্চলে মিসরের সেনা মোতায়েন নজিরবিহীনভাবে বাড়ানোর বিষয়টি তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

এই সময়ে চীন ও মিসরের যৌথ আকাশ মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে তেল আবিবের উদ্বেগ বেড়েছে। ইসরায়েলের মতে, চীনের সঙ্গে মিসরের এই সামরিক সহযোগিতা ‘ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির’ লঙ্ঘন। গাজা উপত্যকায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে, ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই এসব ঘটনা ঘটছে।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মিত্রদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতার জবাবে চীনও মূল ভূখণ্ডের বাইরে সামরিক উপস্থিতি ও সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠাকে বৈশ্বিক সামরিক কৌশলের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলেছে। চীনের বৈশ্বিক স্বার্থের নেটওয়ার্ক ও উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ রক্ষা করাই বেইজিংয়ের এই কৌশলের লক্ষ্য।

চীন বর্তমানে ভূমধ্যসাগর, লোহিতসাগর ও আরব সাগর এলাকায় একাধিক সামরিক ও নৌঘাঁটি গড়ে তোলার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে দেশটি বিআরআইয়ের অধীনে তৈরি হওয়া বিস্তৃত স্বার্থের নেটওয়ার্ক রক্ষা করতে চায়। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ আরব ও উপসাগরীয় দেশই ইতিমধ্যে চীনের বিআরআই প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। এই এলাকাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রভাবের সঙ্গেও পাল্লা দিতে চায় চীন। এ জন্য চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ও নৌবাহিনীকে আরব উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যের নির্দিষ্ট এলাকায় একাধিক সামরিক ঘাঁটি ও সামরিক প্রবেশাধিকার গড়ে তুলতে হবে।

চীন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। চীনা সামরিক বাহিনীর এসব ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পেছনে আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক—উভয় ধরনের উদ্দেশ্যই রয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে যদি চীন এসব সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে পারবে এবং এই অঞ্চলের বাস্তবতা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে অবগত হতে পারবে। এতে চীন মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় আগের চেয়ে আরও দ্রুত ও ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। চীনের এই বিদেশি সামরিক ঘাঁটিগুলো নিজ ভূখণ্ডের বহু দূরে থেকেও বড় পরিসরে সামরিক অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চীন এখনো মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সরানোর কোনো পরিকল্পনার প্রকাশ করেনি। তবে দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে নানা সামরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি অবস্থান গড়ে তুলতে চাচ্ছে। এই অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতি আপাতত সরল, অন্তর্বর্তী বা সাময়িক ধাঁচের হলেও, এগুলো খুব হিসাব করে নেওয়া পদক্ষেপ। যেমন চীনা সামরিক উড়োজাহাজকে আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি, যৌথ সামরিক মহড়া, অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধি, যুদ্ধজাহাজ পুনরায় সরবরাহ এবং ছোট সামরিক স্থাপনার মাধ্যমে কার্যক্রম চালানো। এসবের মাধ্যমে চীন ধীরে ধীরে একটি বড় পরিসরের সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করছে।

বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চীন এই অঞ্চলে সামরিক প্রভাব বাড়াতে চায়। এমনকি ইরানের সহায়তায় এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনতেও আগ্রহী। এটি চীনের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ।

চীন মূলত কয়েকটি কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চীন এই অঞ্চলে অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ফলে একটি অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে। সামরিক সহযোগিতার দিক থেকেও চীন মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চল, আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি, যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ ও মহড়ার মাধ্যমে সম্পর্ক জোরদার করছে। এর পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও চীনের উপস্থিতি বাড়ছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত নিরসনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে এবং নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য কৌশলগত অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে।

ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে যাওয়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে চীন। ওই সব এলাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ফলে যে কৌশলগত শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা চীন সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। এই প্রেক্ষাপটে চীন মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের জোটের রাজনৈতিক মানচিত্রে পরিবর্তন আনতে চায়। কারণ, ওই অঞ্চলের কয়েকটি দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন অংশীদার খুঁজছে।

এই প্রেক্ষাপটে চীন ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানকে সহায়তা করতে একটি জরুরি সামরিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, বিশেষ করে ইসরায়েল ও পরে যুক্তরাষ্ট্র একাধিক ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার পর। এ প্রসঙ্গে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, চীনের পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে তাদের পক্ষে। বিবৃতিতে বেইজিং হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ‘ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো আগ্রাসন এই অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতির পতনের দিকে নিয়ে যাবে। এই যুদ্ধপিপাসু শাসনের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলো।’

গত ২৩ জুন ইরান কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায়, যার মধ্যে কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটি এবং ইরাকের বেশ কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটি অন্যতম। এই হামলা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধের অংশ এবং ইরানে মার্কিন হামলার পাল্টা জবাব। কাতার জানায়, তারা ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতিহত করেছে।

ইরানের ‘বাশায়ের আল-ফাতাহ অভিযান’ ছিল মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ইরানের দ্বিতীয় হামলা। এর আগে চালানো হয়েছিল ‘শহীদ সোলেইমানি অভিযান’। হামলার এক সপ্তাহ আগে ইরাকের ইরবিলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটেও হামলা হয়, এর পেছনে ইরান ছিল বলে অভিযোগ ওয়াশিংটনের।

ইসরায়েলের সামরিক হামলা শুরু হওয়ার আগে, বেশ কয়েকজন ইরানি সামরিক কর্মকর্তা চীনের পরোক্ষ সামরিক সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানকে আক্রমণ করে, তাহলে ইরান ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দিয়েগো গার্সিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালাতে প্রস্তুত।’ তেহরান আরও জানায়, বেইজিংয়ের সমর্থনে তারা ঘোষণা দিয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ চালালে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ নৌঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়ায় হামলা করবে।’

এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকের পাশাপাশি কুয়েত ও বাহরাইন দূতাবাস থেকে কূটনীতিকদের সরিয়ে নেয়, তখন সেটি স্পষ্ট হয়। মূলত ইরানের হুমকি—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাবে—এর পরিপ্রেক্ষিতেই পদক্ষেপ নেয় ওয়াশিংটন। এই হুমকিতে চীনও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছে বলে জানা যায়।

বেইজিং এখন একটি বৃহৎ, পরিকল্পিত সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যার লক্ষ্য হলো উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আমেরিকান ঘাঁটিগুলো সরিয়ে দেওয়া। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হচ্ছে—উপসাগরীয় দেশগুলো ও পুরো অঞ্চলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমানো, যা চীনের স্বার্থ ও প্রভাব বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

বুলগেরিয়া থেকে প্রকাশিত মডার্ন ডিপ্লোমেসি থেকে অনূদিত। লিখেছেন, মিসরের বেনি সুয়েফ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইকোনমিক স্টাডিজ অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের লেকচারার ড. নাদিরা হেলমি।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত