Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সম্ভাব্য গতিপথ এবং সমাধানসূত্র

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৫, ১৬: ৪৪
ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েল ‘যত দিন লাগে’ হামলা চালিয়ে যাবে। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি দুর্বল করা এবং দেশটির সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করা। তবে এই লক্ষ্য অর্জিত হবে কি না তা সময়ই বলে দেবে।

ইরানও এরই মধ্যে ইসরায়েলে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। দেশটির হাতে প্রতিশোধ নেওয়ার আরও কিছু সীমিত পাল্টা পদক্ষেপের বিকল্প আছে। যদিও আরও রক্তপাত সম্ভবত অনিবার্য, তবে এখনই যুদ্ধ বন্ধ করার এবং এটি কীভাবে শেষ হতে পারে, তা নিয়ে ভাবা দরকার। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিকল্প আছে, যেভাবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শেষ হতে পারে।

প্রথমত, ইরান ইসরায়েলে বেশ কয়েকটি বড় আকারের সামরিক হামলা চালাবে। এরপর নিজ জনগণের কাছে দাবি করবে যে তারা পাল্টা জবাব দিয়েছে এবং ইসরায়েলিদের ক্ষতি করেছে। এরপর দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় তারা সম্মতি দেবে। সংক্ষেপে, এটি হবে মুখ বাঁচানোর লক্ষ্যে ‘একটি কৌশলগত আত্মসমর্পণ’।

মূলত, লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের অভিযানের পর একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। ইসরায়েলের বর্তমান ইরান হামলা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে চালানো প্রচেষ্টার সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ—সামরিক অবকাঠামোতে ব্যাপক হামলা এবং অসংখ্য গুপ্তহত্যার মাধ্যমে শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া। এই বিষয়টি ইরানের নিরাপত্তা পরিষেবায় ইসরায়েলের গভীর অনুপ্রবেশের প্রমাণ দেয়।

হিজবুল্লাহর কাছে রকেটের বিশাল মজুত এবং হাজার হাজার যোদ্ধা থাকার পরও তারা ইসরায়েলের শর্তেই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে কোনো কার্যকর পাল্টা আক্রমণ ছাড়াই। ইরানও এবারে হিজবুল্লাহর মতো একই পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি (অন্তত পশ্চিমা গণমাধ্যমের দাবি এমনটাই)।

এ ছাড়া, হিজবুল্লাহর মতো ইরানের প্রধান মিত্ররাও এখন আগের অবস্থার চেয়ে দুর্বল। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ইরানের একসময়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ডিটারেন্ট) এখন অকার্যকর। ইরানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চালানো বিধ্বংসী হামলা ইরানের নেতৃত্বকে বিশৃঙ্খল করে দিতে পারে। এতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো বা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তেহরান দ্রুত শীর্ষ কমান্ডারদের পরিবর্তনের ঘোষণা দিলেও চলমান সংঘাতে এই নতুন নেতৃত্বের কার্যকারিতা এখনো স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল সম্ভবত নতুন কমান্ডার এবং তাদের স্থলাভিষিক্তদের ওপরও হামলা চালাবে। ইরান অবশ্যই যুদ্ধের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে চায় না, কিন্তু তারা হয়তো ক্রমাগত হামলা সহ্য না করে ভবিষ্যতের জন্য টিকে থাকার পথ বেছে নেবে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, ইরান টিকে থাকবে এবং ইসরায়েলের ওপর কিছু আঘাত হানবে। এটি প্রক্সি গোষ্ঠী ব্যবহার করে গেরিলা কৌশলে আঘাত হানা, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ভেদ করে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা বা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে। একই সময়ে, ইসরায়েলের ওপর যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে। ইরানের নাতাঞ্জ ও অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইরান তুলনামূলকভাবে দ্রুত তা মেরামত করতে পারবে।

সাধারণত, ইসরায়েল যখন ‘শত্রুদের’ ওপর হামলা চালায় তখন প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রধান ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন পায়। কিন্তু ইসরায়েল যখন হামলা চালিয়ে যেতে চায়, তখন এই দেশগুলো দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।

ইসরায়েল হয়তো ইউরোপীয়দের মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেবে না। কারণ, ইউরোপ কয়েক মাস ধরে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও ইসরায়েল কর্ণপাত করেনি। কিন্তু ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মতামত, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতামতের বিষয়ে বেশি চিন্তিত। যদি ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ওপর সত্যিকারের চাপ সৃষ্টি করেন, তাহলে ইসরায়েল তাদের অভিযান সংক্ষিপ্ত করতে পারে।

এই চাপ দুই দেশতে ফলপ্রসূ কূটনীতির দিকে নিয়ে যাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি আলোচনার চুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই প্রস্তাবিত চুক্তিটি ২০১৫ সালের জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনের মতোই। তবে ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে সরে এসেছিলেন। ট্রাম্প নতুন করে প্রস্তাব দেওয়ার পর ইরান এই আলোচনাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছিল। দেশটির নেতৃত্বের আপাত সমর্থন ছিল, তবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে উত্তেজনাও ছিল। যা-ই হোক, ট্রাম্প হামলার পর ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘ইরানকে একটি চুক্তি করতেই হবে। এর আগে আর কিছুই থাকবে না এবং যা একসময় ইরানের সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল, তা রক্ষা করতে হবে। আর মৃত্যু নয়, আর ধ্বংস নয়, শুধু এটা করুন, খুব দেরি হওয়ার আগে।’

এই ধরনের আলোচনা তেহরানের জন্য আকর্ষণীয়—দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত এবং নিষেধাজ্ঞা কমানোর প্রতিশ্রুতি তাদের কাছে লোভনীয়। এ ছাড়া ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক অভিযানের পর আলোচনার টেবিলে ইরানকে কম ছাড় দিতে হবে। তবে ইসরায়েলি হামলার মুখে এটি রাজনৈতিকভাবে আরও কঠিন। ট্রাম্প যেকোনো ছাড়কে নিজের বিজয় বলে ঘোষণা করবেন এবং ইরানকে চাপের মুখে নতি স্বীকার করা হয়েছে বলে মনে হবে।

তবে এমন ইতিবাচক পরিস্থিতির বিপরীতে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিও সম্ভব এবং সম্ভবত এটিই ঘটার আশঙ্কা বেশি। বিপর্যয়কর পরিস্থিতিগুলোর মধ্যে একটি হলো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। ইসরায়েলি হামলার আগে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্থাপনায় হামলার হুমকি দিয়েছিল। এ ধরনের হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যেত। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং আকাশ প্রতিরক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সমর্থন ইরানকে এই ধারণা দিতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে, তারপরও ইরান ওয়াশিংটনকে জড়িত বলে মনে করতে পারে। তাদের কাছে মনে হতে পারে, আলোচনার আড়ালে মূলত ইসরায়েলকে সামরিক প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যদিও ইসরায়েল ও মার্কিন কর্মকর্তারা সতর্ক করেছিলেন, ইরান যদি চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু অভিযানের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ট্রাম্প নিশ্চিত করেন, যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সমাধানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং হামলা আসন্ন নয়। যদি তেহরান আলোচনাকে আড়াল হিসেবে দেখে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্থাপনাগুলো ইরানের ‘প্রতিশোধমূলক’ হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রও নিজ কারণে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করতে পারেন, ইসরায়েল হামলার মাধ্যমে অর্ধেক কাজ করে ফেলেছে এবং এখন যুক্তরাষ্ট্র বাকি কাজ শেষ করতে পারে। আর তারা ইরানের ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রে ভারী বাংকার বাস্টার দিয়ে হামলা চালাতে পারে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবেশে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ঘোরতর।

ইরান সম্ভবত ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন এবং অন্যান্য স্থানে তাদের প্রক্সিদের ইসরায়েলে হামলা চালানোর জন্য যা যা করা সম্ভব, করতে বলবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো কারণে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তারাও মার্কিন স্থাপনাকে তাদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। এভাবে, যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন, ইরাক এবং অন্যান্য স্থানে ইরানি প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে।

বর্তমানে অসম্ভাব্য মনে হলেও এই সংঘাতে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা জড়িত হতে পারে। জর্ডানের সশস্ত্র বাহিনী এরই মধ্যে তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আটকের খবর জানিয়েছে। জর্ডানের এই পদক্ষেপকে আত্মরক্ষা হিসেবে দেখানো হলেও যদি যুক্তরাষ্ট্র জড়িত হয়, তাহলে ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে অথবা তাদের ওপর নির্ভর করতে পারে।

একটি চূড়ান্ত সম্ভাবনা হলো, যুদ্ধ কখনোই শেষ হবে না। অন্তত আনুষ্ঠানিক অর্থে নয়। যদিও ইসরায়েলের বিশাল আকারের হামলার ঢেউ হয়তো একসময় থামবে, কিন্তু নিম্নস্তরের সংঘাত আরও কয়েক মাস ধরে চলতে পারে। ইসরায়েল হয়তো মাঝেমধ্যে ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র বা বিমান হামলা চালাবে, পাশাপাশি ইরানে গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড চালাবে। ইরানও মাঝেমধ্যে ইসরায়েলের দিকে হামলা চালাবে, সঙ্গে অন্যান্য উপায়েও পাল্টা আঘাতের চেষ্টা করবে। এটি সর্বাত্মক যুদ্ধ না হলেও কোনো স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিও নয়।

ক্রমাগত পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে, ইরান হয়তো পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শন ছাড়াই গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি তৈরি করতে পারে এবং ইসরায়েলি হামলাকে এর ন্যায্যতা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ইসরায়েল যদি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের তিনটি সংরক্ষণাগারেই আঘাত না করে, তাহলে তেহরানের জন্য এই কাজটি কঠিন হবে না।

আবার, বিভিন্ন সম্ভাবনার সমন্বয়ও সম্ভব। মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি একটি বৃহত্তর পারমাণবিক চুক্তির প্রথম ধাপ হতে পারে। ইরান হয়তো স্বল্প মেয়াদে ছাড় দেবে, কিন্তু বিশ্বাস করবে যে—প্রতিশোধ ঠান্ডা মাথায় নিতে হয় এবং আগামী মাসগুলোতে প্রক্সি হামলা চালাবে এবং প্রতিশোধের একটি রূপ হবে এটি। এভাবেই এটি একটি চিরস্থায়ী পাল্টাপাল্টি হামলার যুদ্ধে পরিণত হবে।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত