Ajker Patrika

ফরেন অ্যাফেয়ার্সের নিবন্ধ /যুক্তরাষ্ট্র মুখ ফেরালে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থামানোর শেষ চাবিকাঠি যাদের হাতে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২০ জুন ২০২৫, ১৫: ৩৯
যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজবাহী রণতরি ‘ইউএসএস নিমিটজ’। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজবাহী রণতরি ‘ইউএসএস নিমিটজ’। ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্য এক বিস্তৃত আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং তেল-গ্যাসের ডিপোগুলোতে টানা বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভাষায়, এই হামলার লক্ষ্য, ইরানের সম্ভাব্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির হুমকি ‘দমন, ধ্বংস এবং মুছে ফেলা।’ জবাবে ইরানও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে চলমান পারমাণবিক আলোচনা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে।

গত দেড় বছর ধরে ইরান-ইসরায়েলের পরোক্ষ সংঘাতে আরব দেশগুলো উদ্বিগ্ন ছিল যে, যুদ্ধ তাদের ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু লড়াই এখন যেভাবে ছড়াচ্ছে, আর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যেভাবে পুরো উপসাগরীয় অঞ্চল পাড়ি দিচ্ছে, তাতে আশপাশের দেশগুলো এখন ভাবছে—সংঘাত ‘কবে’ তাদের ওপর ‘কবে’ নেমে আসবে।

এখনো সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানোর সামান্য সুযোগ রয়ে গেছে। কিন্তু ওয়াশিংটন যখন কূটনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তখন এই দায়িত্ব এসে পড়ছে এই অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর। কারণ, আরব দেশগুলো এবং তুরস্ক—দুই পক্ষই ইসরায়েল, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক রাখে। এখন এদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে সংলাপ গড়ে তুলতে এবং মধ্যস্থতা করতে এদের নেতৃত্বেই একটি আঞ্চলিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ওয়াশিংটনকে কিছুটা অন্তর্ভুক্ত করলেও, পুরোপুরি তার ওপর নির্ভর করা যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্র যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, আরব দেশগুলো এবং তুরস্ক যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এই যুদ্ধ গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। ইরানের পক্ষ থেকে এসব দেশের অবকাঠামোতে হামলা হতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা।

বছরের পর বছর ধরে আরব সরকারগুলো ইরান ও ইসরায়েল—দুই দেশকেই ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখে এসেছে। ইরানের মতাদর্শিক সম্প্রসারণবাদ, পারমাণবিক কার্যক্রম এবং ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের শাসনকে সমর্থন—এসব কিছুই প্রতিবেশীদের জন্য ইরানকে এক ‘স্থায়ী’ হুমকিতে পরিণত করেছে।

২০১৯ সালে, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের তদন্ত অনুসারে, ইরান সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। ইরান সেই অভিযোগ অস্বীকার করলেও প্রকাশ্যে হামলার প্রশংসাও করে। ২০২২ সালে ইয়েমেনি হুতি বিদ্রোহীদের দূরপাল্লার হামলায় আবুধাবির একটি নির্মাণ ও তেল স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, আরব বিশ্ব আবার আতঙ্কিত হয়। হুতিরা স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হলেও তেহরানের সহায়তায় তারা আঞ্চলিক হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

গত কয়েক বছরে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক তুলনামূলক ভালো ছিল। কিন্তু গাজায় দীর্ঘমেয়াদি ও নির্মম যুদ্ধ, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি দমননীতি, বসতি সম্প্রসারণ এবং যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি বা নিরাপত্তা আলোচনা থেকে ইসরায়েলের অনীহা—এসব বিষয় আরব দুনিয়ায় ইসরায়েলকেও অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে ভাবতে বাধ্য করেছে।

ইসরায়েল যেভাবে হামাস ও হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব ও অবকাঠামো দুর্বল করেছে, সিরিয়ায় ইরানি উপস্থিতিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে এবং ইরানের অভ্যন্তরেও হামলা চালিয়েছে, তা উপসাগরীয় নিরাপত্তা মহলে ‘নিঃশব্দে প্রশংসিত’ হয়েছে। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের চলমান অভিযান আরব জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে, যা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের প্রক্রিয়াকে আরও বাধাগ্রস্ত করেছে। আবার, যুদ্ধপীড়িত সিরিয়াকে ঘিরে ইসরায়েলের ক্রমাগত হামলা আরব বিশ্বের স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে।

সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো—ইসরায়েল-ইরানের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া। আরব দেশগুলো এই আশঙ্কাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বলছেন না যে, তারা সংঘাত আরও বিস্তৃত করতে চান, কিন্তু তেহরানের শাহর রে রিফাইনারি ও পারস্য উপসাগরে অবস্থিত সাউথ পার্স রিফাইনারির ওপর ইসরায়েলের হামলা দেখে মনে হচ্ছে, তারা ইরানকে উসকানি দিচ্ছে—যাতে ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলের জ্বালানি স্থাপনায় হামলা চালায় কিংবা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়। ইরান যদি এমন কিছু করে, তাহলে আরব দেশগুলো বাধ্য হবে প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষ নিতে—এটাই ইসরায়েলের চাওয়া।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও খুব শিগগিরই ইসরায়েলের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমনটা হলে ইরানের পক্ষে আরব দেশগুলোর ওপর হামলার প্রলোভন আরও বেড়ে যাবে, কারণ এসব দেশেই যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হবে, ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে, উপসাগরীয় অঞ্চলের জ্বালানি অবকাঠামোয় কিংবা হরমুজ প্রণালির জাহাজে হামলা চালায়। এতে শুধু তেল রপ্তানিই বিপন্ন হবে না, বিনিয়োগকারীদের আস্থাও ধ্বংস হবে। কার্বননির্ভর অর্থনীতি এবং সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০—এর মতো অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। এ ছাড়া ইয়েমেনে সংঘাত আরও বেড়ে যেতে পারে, যেখানে হুতি বিদ্রোহীরা আবার লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করতে পারে। এমনকি সরাসরি উপসাগরীয় দেশগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে। সাধারণ আরব জনগণ খাদ্য সরবরাহ বিঘ্ন, পানির উৎস বিষাক্ত হওয়া কিংবা সাইবার হামলার মতো দুর্যোগের শিকার হবে। এই ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে খুব ভালোভাবে সচেতন বলেই এই দেশগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে, যুদ্ধ যেন আর না ছড়ায়।

নিজেদের নিরাপদ রাখতে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্টভাবে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রকাশ্য নিন্দা করেছে। জর্ডান শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। ওমান ও কাতার ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা শঙ্কিত যে—ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার পরমাণু চুক্তির প্রচেষ্টা ধ্বংস করে দিতে চাইছে। তুরস্কও কঠোর সমালোচনা করেছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেছেন, সংঘাত যেন আর বাড়তে না পারে, তা নিশ্চিত করতে তাঁর দেশ ‘যা কিছু দরকার’ তা করতে প্রস্তুত।

এরদোয়ান আসলে কী করতে চাইছেন, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে আঞ্চলিক দেশগুলো এখন এমন এক অবস্থানে আছে, যেখানে তারা ইরান, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র—এই তিন পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উপসাগরীয় দেশগুলোর তেহরান ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে। তারা মার্কিন ঘাঁটির স্বাগতিক দেশ, গোপন বৈঠকের মধ্যস্থতাকারী এবং উভয় পক্ষের নিরাপত্তা হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পাশাপাশি, এখন তারা ইসরায়েলের সঙ্গেও প্রকাশ্যে বা গোপনে কথা বলার পথ তৈরি করে ফেলেছে। এই সংকটময় মুহূর্তে তাদের এই সব কূটনৈতিক সম্পদ কাজে লাগাতে হবে—শুধু ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে নয় বরং যুদ্ধবিরতির পথ তৈরি করতে এবং পরমাণু ও বৃহত্তর আঞ্চলিক আলোচনার ধারায় ফেরার জন্য।

এর জন্য আঞ্চলিক দেশগুলোকে একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে, যা হতে পারে আরব লিগের নেতৃত্বে কিংবা একটি ছোট আকারের, উপসাগরীয় জোটের নেতৃত্বে। এই উদ্যোগে নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে ইসরায়েল ও ইরানের প্রতিনিধিদের মধ্যে পরোক্ষ সংলাপের পরিবেশ গড়ে তোলা যেতে পারে। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তারা একটি ‘কুলিং-অফ’ সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারে, যার মধ্যে দুই দেশ একে অপরের ওপর বিশেষ করে বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করে হামলা বন্ধ রাখবে।

একই সঙ্গে, আরব দেশগুলো এবং তুরস্কের উচিত একটি আলাদা কূটনৈতিক চ্যানেল খোলা, যার লক্ষ্য হবে জ্বালানি ও সামুদ্রিক অবকাঠামোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা হলে যে পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় ঘটতে পারে তা ঠেকানো। এমন কোনো উদ্যোগ প্রকাশ্যে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বুঝতে পারবেন যে শান্তিপূর্ণ সমাধান ও আলোচনাই হলো সবচেয়ে ভালো পথ এবং সেটাই মধ্যপ্রাচ্য চায়। এভাবে একটি পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তির পথ তৈরি হতে পারে।

প্রথমে এটি ভাবা কঠিন মনে হতে পারে যে, ট্রাম্প কোনো বিদেশি সরকারের মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তিতে রাজি হবেন কি না। কিন্তু আরব উপসাগরীয় দেশগুলোই ছিল হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম সফরের গন্তব্য। এই সফরের মাধ্যমে উপসাগরীয় নেতারা আবারও নিশ্চিত হন যে, ওয়াশিংটন কেবল তাদের কথা শুনছে না বরং তাদের প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগের দিকেও সক্রিয়ভাবে সাড়া দিচ্ছে।

ট্রাম্প অতীতের মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ এবং গণতন্ত্র প্রচারের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ‘শান্তি ও অংশীদারত্বের’ এক নতুন যুগের ডাক দেন। তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর ব্যবসা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের প্রশংসা করে বলেন, তারা বিনিয়োগ করছে ‘বিশৃঙ্খলায় নয়, বাণিজ্যে; সন্ত্রাসে নয়, প্রযুক্তিতে।’ ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর দাবিকে সমর্থন জানান এবং দেশটির নতুন সরকারকে সহযোগিতা দেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, গোপন বৈঠকে ট্রাম্প উপসাগরীয় দেশগুলোর অগ্রাধিকারগুলোকে সমর্থন দেওয়ার ইঙ্গিত দেন। তাঁর সফর দেখায় যে, তিনি কেবল তাদের কথা শুনতেই নয়, বরং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুত।

ইসরায়েল হয়তো উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যস্থতায় হওয়া কোনো শান্তিচুক্তি গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি অনিচ্ছুক। তবে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় এবং ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানেন, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে চললেই সে পথ আরও সহজ হবে। নেতানিয়াহু হয়তো সংঘাত বাড়াতে চাইবেন, কিন্তু ইসরায়েলের অন্য নেতারা বোঝেন, যুদ্ধ বিস্তৃত হলে তা বিশ্বজুড়ে জ্বালানি বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে—যার পরিণতি ইসরায়েলি নাগরিকদের ওপরই পড়বে।

অন্যদিকে, ইরানের জন্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতায় আসা এখন অত্যন্ত লাভজনক। ইসরায়েলের টানা ও নিরলস বোমাবর্ষণে বিপর্যস্ত তেহরানের শাসকগোষ্ঠী এখন মুখরক্ষা করে সরে আসার পথ খুঁজছে। দেশটির কর্মকর্তারা এতটাই চিন্তিত যে, তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে—যদি যুদ্ধবিরতির সুযোগ থাকে, তবে তারা আবার আলোচনায় বসবে। আরব দেশগুলো ইরানের সঙ্গে কঠিন আলোচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। ২০১৯ সালে উপসাগরে ইরানের হামলা এবং ২০২২ সালে হুতিদের আক্রমণ অঞ্চলজুড়ে আতঙ্ক ছড়ালেও শেষপর্যন্ত তা উত্তেজনা প্রশমনের পথ খুলে দেয়। ওই প্রেক্ষাপটে আমিরাত ২০২২ সালে আবার ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করে, সৌদি আরবও ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় একই পথে হাঁটে।

২০০৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালায়, তখন আরব রাষ্ট্র ও তুরস্ক তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। তারা সতর্ক করেছিল, এই আগ্রাসন অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করবে এবং চরমপন্থীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে। আজ আবারও তারা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানে একসুরে কথা বলছে। কারণ তারা জানে, আরেকটি অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ এই অঞ্চলে আরও ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।

তাদের জন্য ঝুঁকিটা অনেক বড়। যদি যুদ্ধ বন্ধ না হয়, তাহলে তারা জানে—এই অস্থিরতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা তাদের নেই। সময় খুব কম, ঝুঁকি বাড়ছে। তাই এই মুহূর্তে সবার সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি—একটি বড় যুদ্ধ থামাতে।

আশা করা যায়, এই দেশগুলো ইরান ও ইসরায়েলকে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এতে না জড়াতে রাজি করাতে পারবে। তারা ইসরায়েলকে বলতে পারে, তার বর্তমান কার্যকলাপ সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের পথকে একঘরে হওয়ার পথে ঠেলে দিচ্ছে, আর স্থিতিশীলতা নয়, বরং স্থায়ী সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করছে। তারা ইরানকে বোঝাতে পারে, পরমাণু কর্মসূচি, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও প্রক্সি কার্যক্রম আর সহ্য করা হবে না—এবং অঞ্চলভুক্তি চাইলে, তাদের আচরণ পরিবর্তন করতেই হবে।

একটি শান্তিচুক্তি অর্জন অত্যন্ত কঠিন কাজ। ইরান ও ইসরায়েল তাদের অবস্থানে দৃঢ়ভাবে অনড়। এই সংঘাত প্রশমনের বদলে আরও জোরালো রূপ নিচ্ছে। তবুও বিশ্ব এক জরুরি ও ধারাবাহিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অপেক্ষায় রয়েছে। সেই উদ্যোগে ইরান ও ইসরায়েলের অংশগ্রহণ যেমন জরুরি, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও প্রয়োজন। তবে এই নেতৃত্ব, বা অন্তত সূচনা, আসতে হবে—এই অঞ্চল থেকেই।

ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪২
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের সঙ্গে নতুন করে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক তৎপরতা। দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির এক গোপন বৈঠকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেছেন।

হিব্রু ভাষার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভের খবরে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে এক সামরিক প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের জানান, তেহরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের আশঙ্কা, আগের মতোই ইরান একযোগে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।

গত এক মাসে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা নিয়ে সতর্কবার্তা জোরালো হয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ও কিছু বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় পক্ষ দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, পরোক্ষ বা প্রক্সি ফ্রন্ট বিস্তৃত করছে এবং কূটনৈতিক পথ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বর্তমান উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) মেয়াদ শেষ হওয়া। চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। ফলে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তেহরানের দাবি অনুযায়ী তারা উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সব মজুত ধ্বংস করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, এর একটি অংশ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে—তাদের মতে, ইরানে ইসরায়েলের আরেকটি হামলা ‘হবে কি না’ এটা প্রশ্ন নয়, হামলা ‘কবে হবে’—সেটাই বড় প্রশ্ন। ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তেল আবিবের এই মনোভাব সামরিক হামলার সম্ভাবনাকে প্রায় অনিবার্য করে তুলছে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক সংকট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ জানান, তাঁর ইরানি সূত্র অনুযায়ী দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো দিনে ২৪ ঘণ্টাই চালু আছে। তাঁর ভাষায়, নতুন কোনো সংঘাত হলে ইরান আগের মতো ১২ দিনে ৫০০টি নয়, বরং একযোগে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত থাকায় সংঘাতের একটি চক্রাকার ধারা তৈরি হয়েছে, যেখানে উত্তেজনা প্রায় কাঠামোগতভাবেই অনিবার্য। ইরানের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ (যার মধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক মিত্র ও গোষ্ঠী রয়েছে) গত জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে এবং বিশেষ করে গত বছর সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবু ইরানের হাতে এখনো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক রসদ রয়েছে। যেমন—ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ (হুতি), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া। এসব শক্তির মাধ্যমে তেহরান এখনো এক ধরনের অপ্রতিসম প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রেখেছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কার্সরইনফোর বরাতে জানা যায়, দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার এক শীর্ষ সূত্রের দাবি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারির আগে ইরানে শাসক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেছে ইসরায়েল। সূত্রটি জানায়, ইরান একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরেকটি সামরিক সংঘাত এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরান নাতানজের দক্ষিণে ‘পিকঅ্যাক্স মাউন্টেন’ নামে একটি নতুন ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ করছে। সেখানে এখনো আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান শান্তি ও সংলাপ চায়, তবে চাপের কাছে মাথা নত করবে না, পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিও পরিত্যাগ করবে না। তাঁর মতে, এসব কর্মসূচি জাতীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি বহুপক্ষীয় আলোচনায় ফেরার আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছেন—‘ইরানের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে’।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও তাতে জড়াবে?

গেল নভেম্বরের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেন, জুনে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত ছিল। বিষয়টি এত দিন হোয়াইট হাউস অস্বীকার করে আসছিল। ওই সময় ট্রাম্প আরও বলেন, ওয়াশিংটন চাইলে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতেও প্রস্তুত।

ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে ট্রাম্প আবার বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি চায় এবং ওয়াশিংটন আলোচনায় প্রস্তুত। একই দিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা কামাল খারাজি জানান, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইরান, তবে প্রথম পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকেই নিতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আলোচনার বাইরে, কারণ এটি জাতীয় প্রতিরোধের মূল স্তম্ভ। কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েই সীমিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে, তাও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হলে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপে আরেকটি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিস্থিতিকে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখছে। ইসরায়েল চাচ্ছে, তারা এই সুযোগে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেবে।

সব মিলিয়ে, তেহরান আশাবাদী কথাবার্তায় ভরসা করছে না। ইরানি কূটনীতিকদের ধারণা, ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করেই সামরিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, ইসরায়েল হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে যেকোনোভাবে সংঘাতে টেনে আনার চেষ্টা করবে—যদিও ট্রাম্প নতুন যুদ্ধ এড়াতে চান।

যুক্তরাষ্ট্র চাক বা না চাক, পরিস্থিতির চাপে তাকে শেষ পর্যন্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে। আর যদি ইরান ইসরায়েলি হামলার জবাবে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ওয়াশিংটনের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত এসে দাঁড়াবে—হস্তক্ষেপ করবে, নাকি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ইরান অবশ্য স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—তারা ধ্বংসের ভয় পায় না এবং সর্বাত্মক যুদ্ধে নামলে ‘ইসরায়েলকেও সঙ্গে নিয়ে ডুববে’।

আরটি থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত