Ajker Patrika

ইরান আক্রমণে দুই দশকে যেসব বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছে ইসরায়েল

আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৯: ২১
ইরান আক্রমণে দুই দশকে যেসব বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছে ইসরায়েল

বিগত কয়েক দশক ধরেই ইরানে হামলার পরিকল্পনা প্রস্তুত করে শাণিয়ে নিয়েছে ইসরায়েল। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে দেশটি ব্যাপক অত্যাধুনিক অস্ত্রও প্রস্তুত করেছে। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি যখন অন্য দেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি করতে শুরু করেছে, তখনই বিষয়টি জানা গেছে, ইসরায়েল আসলে কতটা অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরি করেছে।

গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের এফ-১৫ যুদ্ধবিমান নিজ দেশ থেকে ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূরে ইয়েমেনে গিয়ে হুতি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এই হামলার বিষয়টি ইসরায়েলের ‘প্রয়োজন বিবেচনায় উদ্ভাবন’ বা ইম্প্রোভাইজেশন দক্ষতারই ইঙ্গিত দেয়। সাধারণভাবে এফ-১৫ যুদ্ধবিমান তৈরি করা হয়, আকাশে যুদ্ধের জন্য। কিন্তু ইসরায়েল এই যুদ্ধবিমানগুলোকে নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে আরও শাণিত করে তুলেছে। নতুন নতুন সব অস্ত্র বহনে সক্ষম করে তুলেছে।

তবে ইয়েমেনে হুতি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো যতটা সহজ ছিল, ইরানের হামলা চালানো ততটা সহজ হবে না। কারণ, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি উভয়ই মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত। তবে দেশটির তেল স্থাপনা তুলনামূলক অরক্ষিত। এ ছাড়া, ইরানের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও আছে।

ইরানের দাবি, তারা এই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিজেরাই তৈরি করেছে। কিন্তু এখনো সেই অর্থে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কোনো শক্ত পরীক্ষার মুখে পড়েনি। তবে, এই ব্যবস্থাটি রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সঙ্গে মেলে। সাধারণভাবে, এই ব্যবস্থার ইসরায়েলের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু, গত এপ্রিলে ইসরায়েল যখন ইরানের ইস্পাহানে হামলা চালিয়েছিল তখন এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কোনো এক কারণে সক্রিয় হয়নি। এর বাইরে, ইরানের চার যুগ পুরোনো মিগ-২৯ ও যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৪ মডেলের যুদ্ধবিমান আছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পরও এই যুদ্ধবিমানগুলো সক্রিয় আছে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীতে।

এসব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ২০ বছর ধরে ইরানে সম্ভাব্য হামলা ছক কষেছে। বিনিয়োগ করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ও শেকেল। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, ইসরায়েল এমন কিছু অস্ত্র তৈরি করেছে নিজস্ব প্রযুক্তি, যা যুক্তরাষ্ট্র বিক্রি করতে চায়নি। ইসরায়েলের এসব প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও নেই।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দেশগুলো ১৮০০-২০০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য সাধারণত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বা বোম্বার বিমান ব্যবহার করে। তবে ইসরায়েল বরং ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমারু বিমানের জায়গা থেকে সরে এসে যুদ্ধবিমান দিয়েই এই দূরত্বে হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশটির কাছে এক স্কোয়াড্রন অত্যাধুনিক এফ-১৫ আই ও এফ-১৬ আইয়ের চারটি যুদ্ধবিমান আছে—যেগুলোকে ইসরায়েল নিজেদের মতো করে বিশেষায়িত করে নিয়েছে। এই যুদ্ধবিমানগুলো যেতে–আসতে টানা চার ঘণ্টা আকাশে উড্ডয়ন করতে সক্ষম।

বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন এমন একধরনের ফুয়েল ট্যাংক বানিয়েছে—বিশেষ করে এই বিমানগুলোর জন্য। যার ফলে, এই বিমানগুলো দীর্ঘ উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। তবে বেশি জ্বালানির জন্য ফুয়েল ট্যাংক তৈরি করা হলেও বিমানগুলোর অ্যারোডাইনামিকস বা রাডারের কার্যক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।

বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর খবর ইঙ্গিত করে, ইসরায়েল নিজের প্রযুক্তিতে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের জন্য বিচ্ছিন্নযোগ্য জ্বালানি ট্যাংক তৈরি করেছে। তবে এরপরও স্টেলথ ক্ষমতা বা নিজেতে গোপন রাখার ক্ষমতা বজায় রেখে ইরানে পৌঁছাতে সক্ষম। 
 
আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা 

একুশ শতকের শুরুর দিকে ইসরায়েল দুটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করে। যেগুলো যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা যায়। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পাল্লা কতটুকু, তা জানা না গেলেও এগুলো যে ইরানের আকাশসীমায় না গিয়েও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বাইরে থেকে ইসরায়েলকে দেশটিতে শত শত কিলোমিটার দূর থেকে হামলার সুযোগ দেবে; সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সুপারসনিক গতিতে অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়েও বেশি গতিতে চলতে সক্ষম। যার ফলে, এগুলোকে ইন্টারসেপ্ট করার সুযোগ কম থাকে এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 
 
Shavit-2র‍্যাম্পেজ ক্ষেপণাস্ত্র

এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি। ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এবং দেশটির রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস মিলে এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। প্রাথমিকভাবে এগুলোকে ভূমি থেকে নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত করা হলেও পরে এগুলোকে আকাশ থেকে নিক্ষেপের জন্যও মডিফাই করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পাল্লা বেড়ে গেছে। একাধিক নেভিগেশন সিস্টেম থাকায় এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা অনেক বেশি নির্ভুল।

মাত্র ৪ দশমিক ৭ মিটার লম্বা এবং ৩০ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার পরিধির এই ক্ষেপণাস্ত্রের ভর মাত্র ৫৪০ কেজি। এ ছাড়া, এগুলো ১৫০ কেজির সমান ভরের বিভিন্ন ওয়ারহেড বহন করতে পারে। গঠনগত কারণে, এর পক্ষে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া অনেকটাই সহজ। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ইসরায়েলের এফ-১৫, এফ-১৬ এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব। এ ছাড়া, দামের দিক থেকেও এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো খুবই সাশ্রয়ী। মাত্র কয়েক শ ডলার খরচ করেই একেকটি র‍্যাম্পেজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা সম্ভব।

রকস ক্ষেপণাস্ত্র

ফরাসি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাফালে ২০১৯ সালে রকস ক্ষেপণাস্ত্র প্রথমবার প্রকাশ করে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ‘স্যাটেলাইট নেভিগেশন ও ইনর্শিয়াল নেভিগেশন’ সিস্টেম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই সঙ্গে এর আছে, অপটিক্যাল টার্গেটিং সিস্টেম। যা এটিতে নিজের মতো করে লক্ষ্যবস্তুতে আলাদাভাবে চিনতে সহায়তা করে। এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রটির গতিও সুপারসনিক, অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়ে বেশি। এটি ইরানের শাহাব ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই অনেকটা।

এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে এফ-১৬ এবং এফ-৩৫–এর মতো যুদ্ধবিমান থেকেই নিক্ষেপ করা যেতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩০০ কিলোমিটার এবং এগুলো ৫০০ কেজি পর্যন্ত ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। যা এটিকে সুরক্ষিত বা ভূগর্ভস্থ কাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করতে সক্ষম করে তোলে। 

submarin-Israel-3অন্যান্য অত্যাধুনিক অস্ত্র

বিদেশি সূত্রগুলোর ইঙ্গিত, ইসরায়েলের কাছে সারফেস টু সারফেস বা ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও আছে। জেরিকো নামে পরিচিত এই ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে। তবে ইরান ইসরায়েলে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলেও, ইসরায়েল ইরানে হামলার ক্ষেত্রে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে—এমন সম্ভাবনা কম। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূলত ফ্রান্সের ড্যাসল্ট কোম্পানি তৈরি করেছিল। পরে ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এগুলোকে নিজেদের প্রয়োজনমতো মডিফাই করে নিয়েছে।

এ ছাড়া, এলবিট কোম্পানি ৫০০—এমপিআর নামে বাংকার বিধ্বংসী বোমা তৈরি করেছে। যা ৪ মিটার পর্যন্ত পুরো কংক্রিট ভেদ করতে সক্ষম। এফ-১৫ আই যুদ্ধবিমান এই বোমাগুলো করতে পারে। কিন্তু ভারী হওয়ার কারণে, যুদ্ধবিমানগুলোর পাল্লা সংকুচিত হয়ে আসে এসব বোমা থাকলে।
 
পপআই টার্বো ক্ষেপণাস্ত্র

এই ক্ষেপণাস্ত্রটিও ফ্রান্সের রাফালে কোম্পানির তৈরি। এগুলোর পাল্লা প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এগুলো পারমাণবিক ওয়ারহেডের পাশাপাশি প্রচলিত ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। মূলত, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নিক্ষেপ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। দূরপাল্লার হওয়ার কারণে, লোহিত সাগর বা আরব সাগরে থেকেই—যা ইরান থেকে বেশ দূরে—ইসরায়েলি নৌবাহিনী এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা চালাতে পারবে।

জেরুজালেম পোস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিনের দিল্লি সফর: ভারসাম্য রক্ষার কৌশলে ভারত, অস্ত্র–তেল বিক্রি বাড়াতে চায় রাশিয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে শীর্ষ সম্মেলন শুরু করেছেন। যেখানে বাণিজ্য এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চাপানো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর এই শুক্রবারের এই সম্মেলন পুতিনের ভারতে প্রথম সফর। এই সম্মেলন এক সময় হচ্ছে যখন ভারত রুশ তেল কেনার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের মুখোমুখি।

আলোচনা শুরুর সময় মোদি পুতিনকে বলেন, ‘ভারত নিরপেক্ষ নয়—ভারতের একটি অবস্থান আছে, আর সেই অবস্থানটি হলো শান্তির পক্ষে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তির জন্য নেওয়া সমস্ত প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি এবং শান্তির জন্য গ্রহণ করা প্রতিটি উদ্যোগের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াই।’

জবাবে পুতিন সংঘাত মেটানোর লক্ষ্যে মোদির মনোযোগ এবং প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান। পুতিন বলেন, ‘ইউক্রেনে কী ঘটছে এবং এই সংকটের সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে আমরা অন্যান্য কয়েকটি শরিক, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যৌথভাবে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি—তা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার সুযোগ আমরা পেয়েছি এবং আপনি আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।’

পুতিনের এই সফর এমন এক সময়ে এল—যখন মস্কো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চাইছে। ভারত রাশিয়ার অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের সর্বোচ্চ ৬৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে তাঁরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে বাড়াতে চান।

শুক্রবার পুতিনের সফরসূচি শুরু হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার মাধ্যমে, যেখানে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। পুতিনকে স্বাগত জানাতে মুর্মুর সঙ্গে মোদিও উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে পুতিনকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এরপর পুতিন রাজঘাটে গিয়ে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে মাল্যদান করেন।

বৃহস্পতিবার মোদি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিমানবন্দরে হাজির হয়ে পুতিনকে আলিঙ্গন ও হাত মিলিয়ে স্বাগত জানান। পরে তিনি রুশ নেতাকে তাঁর বাসভবনে এক নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন। দিল্লি থেকে আল–জাজিরার সাংবাদিক নেহা পুনিয়া মন্তব্য করেন, ‘অনেক আলিঙ্গন ও হাত মেলানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন নজর শুক্রবারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের দিকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুই নেতা এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করবেন যে—রুশ নেতা একঘরে নন এবং পশ্চিমা দেশগুলির চাপ সত্ত্বেও ভারতের মতো দেশ তাঁকে স্বাগত জানায়।’

২০২৩ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ইউক্রেনীয় শিশুদের বেআইনিভাবে নির্বাসনের অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। ভারত আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র নয় এবং তার চুক্তি বা নিয়মের দ্বারা আবদ্ধও নয়। সেই কারণে পুতিন গ্রেপ্তারের ভয় ছাড়াই ভারতে সফর করতে পেরেছেন।

রুশ নেতা স্থানীয় সময় আজ শুক্রবার রাত ৯টায় ভারত ছাড়বেন। রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে ২৫ বছর ধরে কৌশলগত শরিকানা রয়েছে, যা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পুতিনের প্রথম বছর থেকেই শুরু। তবে, রাশিয়ার ২০২২ সালের আগ্রাসনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখার এই ভারসাম্যের কাজটি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। রুশ কার্যক্রমের কারণে নেতাদের বার্ষিক সফরের বহুদিনের প্রথা ব্যাহত হয়। তবে গত বছর মোদির রাশিয়া সফরের মাধ্যমে তা কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

যুদ্ধের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলো যখন রুশ অপরিশোধিত তেলের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে শুরু করে, ভারত তখন তার ক্রয় বাড়ায়। কিন্তু আগস্টে ট্রাম্প পুতিনকে যুদ্ধবিরতি মানতে চাপ দেওয়ার জন্য, ভারতের রুশ তেল কেনার শাস্তিস্বরূপ ভারতীয় পণ্যের ওপর পূর্বে আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করে দেন। তা সত্ত্বেও ভারত রুশ তেল কেনা চালিয়ে যায়।

তবে এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে—নভেম্বরে রুশ তেল কোম্পানি রোজনেফ্ট এবং ল্যুকওয়েলের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়, সঙ্গে এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যকারী অন্য দেশের সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞার হুমকি আসে। ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই দুটি কোম্পানি থেকে।

নয়াদিল্লি জানিয়েছে, তাদের অন্যায়ভাবে নিশানা করা হচ্ছে। তারা উল্লেখ করে যে—পশ্চিমা দেশগুলোও যখন তাদের স্বার্থে প্রয়োজন হয়, তখন মস্কোর সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যায়। নয়াদিল্লি আসার আগে এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে পুতিনও একইরকম যুক্তি দেন। তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাই তাদের নিজস্ব পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এখনো আমাদের কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানি কেনে।’ তিনি আরও যোগ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যদি রুশ জ্বালানি কেনার অধিকার থাকে, তবে ভারতেরও ‘একই সুবিধা’ পাওয়া উচিত।

পুতিন ভারতকে আরও রুশ অস্ত্র কেনার জন্য চাপ দেবেন বলেও আশা করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রেও নয়াদিল্লিকে ওয়াশিংটনের চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। মস্কো ভারতকে আরও এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং এসইউ-৫৭ স্টেল্থ যুদ্ধবিমান বিক্রি করার আশা করছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের জন্য চাপ দিতে এই শুক্রবারের বৈঠকের মাত্র কয়েক দিন আগেই পুতিন মস্কোয় মার্কিন এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করেন। সেই বৈঠকের পর উভয় পক্ষই অগ্রগতির প্রশংসা করে, যদিও কোনো যুগান্তকারী সমাধান হয়নি। বৃহস্পতিবার মার্কিন কর্মকর্তারা ইউক্রেনের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন। ভারত যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার নিন্দা করা থেকে বিরত থেকেছে এবং আলাপ-আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে শান্তির আহ্বান জানিয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন প্রকল্প: এশিয়ায় উসকে দেবে সমুদ্রতলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
দক্ষিণ কোরিয়ার এ উদ্যোগ পানির নিচে অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ কোরিয়ার এ উদ্যোগ পানির নিচে অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনের পর দক্ষিণ কোরিয়ার পরমাণুচালিত সাবমেরিন প্রকল্প নতুন গতি পেয়েছে। দীর্ঘদিনের মার্কিন আপত্তি দূর হওয়ায় এই উদ্যোগ এখন এশিয়ার নিরাপত্তাকাঠামো পাল্টে দিতে পারে এবং পানির নিচে নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে।

উত্তর কোরিয়াকে মোকাবিলায় বহুদিন ধরে পরমাণুচালিত সাবমেরিনের অভিজাত ক্লাবে যোগ দিতে চেয়েছে সিউল। ট্রাম্পের সম্মতি পাওয়ায় দুই দেশের পারমাণবিক চুক্তির আওতায় জ্বালানির প্রবেশাধিকার মিলেছে, যা এত দিন ছিল বড় বাধা।

তবে বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুত অগ্রসরমাণ এই কর্মসূচি চীনকে বিরক্ত করতে পারে এবং জাপানকেও একই ধরনের সক্ষমতা অর্জনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সাবমেরিন ক্যাপ্টেন চোই ইল বলেন, সাবমেরিন অত্যন্ত কার্যকর আক্রমণাত্মক অস্ত্র। তাই এই অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা অনিবার্য।

সিউলের যুক্তি, উত্তর কোরিয়ার পানির নিচে থাকা হুমকি, বিশেষ করে সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় পরমাণুচালিত সাবমেরিন অপরিহার্য।

দক্ষিণ কোরিয়া অবশ্য বারবার বলছে, পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করবে না তারা।

গত বুধবার ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক থেকে পাওয়া এই চুক্তিকে ‘বড় ধরনের সাফল্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিউং।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, এটি দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নমনীয়তা বাড়াবে।

এদিকে উত্তর কোরিয়া দাবি করেছে, তারাও একই ধরনের সক্ষমতা বিকাশে মনোনিবেশ করেছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গত মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখায়, কিম জং-উন একটি তথাকথিত পরমাণুচালিত সাবমেরিন পরিদর্শন করেছেন।

উত্তর কোরিয়ার কর্মসূচি কতটা এগিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে কিছু বিশ্লেষকের সন্দেহ, পিয়ংইয়ং হয়তো রাশিয়ার সহায়তা পাচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া জানিয়েছে, তারা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করছে, তবে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

২০ বছর অন্ধকারে বন্দী, মৃত্যুর হুমকিতে থেমে যাওয়া শৈশব-কৈশোর

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: এনডিটিভি
ছবি: এনডিটিভি

পৃথিবী যখন খেলায় মত্ত, তখন তিনি বন্দী ছিলেন অন্ধকারে। ছয় বছর বয়সে ঘরবন্দী হওয়া লিসা ২০ বছর পর সেই দরজা পেরিয়ে বাইরে এলেও আলো দেখার ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন।

কিছু গল্প ক্ষতের মতো করে উন্মোচিত হয়। কিছু শৈশব যেন কোনোদিনই শুরু হয় না। লিসার জীবন তেমনই এক গল্প। নিঃশব্দে হারিয়ে যাওয়া এক শৈশবের, পরিস্থিতিতে মুছে যাওয়া এক শিশুর এবং এক নারীর।

যে বয়সে শিশুরা বর্ণমালা শেখে, ছত্তিশগড়ের বাস্তার জেলার বাকাওয়ান্দ গ্রামের বাসিন্দা লিসা তখন ভয়কে জানছিলেন। ছয় বছর বয়সেই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় বাইরের জগতের সব শব্দ। বাড়ির দরজা শুধু খাবারের জন্য খুলত, জীবনের জন্য নয়। ২০ বছর পর কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে খুঁজে পায়, তখন তাঁর চোখে নয়, স্মৃতিতেও ছিল শুধু অন্ধকার।

ছায়াই ছিল তাঁর পরিচয়। কথোপকথন বলতে ছিল শুধু দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দেওয়া থালাবাটির শব্দ। দুই দশক ধরে বন্দিদশার পর এখন তিনি নিজের নামে সাড়া দিতেও হিমশিম খান।

লিসার বন্দিত্ব শুরু হয়েছিল না লোহার শিক দিয়ে, না শিকল দিয়ে—শুরু হয়েছিল আতঙ্ক দিয়ে।

২০০০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় গ্রামের এক ব্যক্তি তাঁকে হত্যার হুমকি দেন। সেই কথায় আতঙ্ক এত গভীর হয়, তিনি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন নীরবতায়। এরই মধ্যে মারা যান তাঁর মা। কৃষক বাবা হয়ে পড়েন দুর্বল ও আতঙ্কিত। কোনো সহায়তা নেই, নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই, কারও কাছে ভরসা চাওয়ার নেই। তাই তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নেন, যা মেয়ের জীবনের পরবর্তী ২০ বছর নির্ধারণ করে দেয়।

তিনি মেয়েকে মাটির ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখেন। বলেন, অন্ধকারই তাঁকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে। জানালাবিহীন একটি ঘরই হয়ে ওঠে তাঁর পৃথিবী। না সূর্যের আলো। না কোনো কথা। না কোনো মানুষের স্পর্শ।

শুধু দরজায় রেখে যাওয়া এক প্লেট খাবার আর প্রতিদিন একটু একটু করে সংকুচিত হয়ে যাওয়া জীবনের প্রতিধ্বনি।

যে ব্যবস্থা তাঁকে রক্ষা করবে ভাবা হয়েছিল, তা-ই শেষমেশ তাঁকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়।

সমাজকল্যাণ দপ্তরের দল যখন কুঁড়েঘরে প্রবেশ করে, তারা দেখতে পায় এক নারীকে, যাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।

চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘদিন প্রাকৃতিক আলো থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে লিসার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তাঁর মানসিক বিকাশও গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়েছে। আচরণ বয়সের তুলনায় অনেক কম বয়সী শিশুর মতো। প্রতিটি শব্দে ভয় পান। যেকোনো স্পর্শে চমকে ওঠেন।

উদ্ধারের পর লিসাকে নিয়ে যাওয়া হয় জগদলপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, যেখানে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বিস্তারিত পরীক্ষা শুরু হয়। প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, লিসার শৈশব থেমে যায় প্রবল ট্রমায় আর প্রাপ্তবয়স্ক জীবন গঠিত হয়েছে ইন্দ্রিয়ের বঞ্চনায়।

সমাজকল্যাণ দপ্তর পুরো ঘটনায় এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে।

কর্তৃপক্ষ লিসার পরিবার ও প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে—কেন তিনি ২০ বছর ধরে বন্দী ছিলেন এবং এই বন্দিত্ব আইনবহির্ভূত আটক হিসেবে বিবেচিত হবে কি না।

জেলার প্রশাসন কর্মকর্তারা বলেন, ‘তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়লে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

এ ছাড়া কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখছে, লিসার বাবা কি ভয়ে ও অজ্ঞতার কারণে স্কুল, পঞ্চায়েত বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাননি?

লিসা বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের এক আশ্রমে আছেন, যেখানে সেবাকর্মী ও কাউন্সেলররা তাঁকে নতুন করে জীবন খুঁজে পেতে সহায়তা করছেন।

তথ্যসূত্র: এনডিটিভি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইন্ডিগোর ফ্লাইট বিপর্যয়: পানি-খাবারহীন অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা হাজারো যাত্রী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ০৩
ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারণে ভোগান্তির শিকার হন হাজারো যাত্রী। ছবি: সংগৃহীত
ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারণে ভোগান্তির শিকার হন হাজারো যাত্রী। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে যাত্রীরা নিজেদের মালপত্র হাতে পেতে রীতিমতো সংগ্রাম করছেন। খাবার–পানির কোনো ব্যবস্থা নেই আর ইন্ডিগোর কাউন্টারগুলো ফাঁকা। ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বিমান সংস্থা ইন্ডিগোর পরিচালনগত ত্রুটির কারণে পাঁচ শতাধিক ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় ভারতের বিমানবন্দরগুলোতে এমন বিশৃঙ্খল দৃশ্য দেখা গেছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি সরেজমিনে দেখেছে, দিল্লি বিমানবন্দরের টার্মিনালে হাজার হাজার স্যুটকেস পড়ে রয়েছে। বহু যাত্রী মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছেন আর কেউ কেউ ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

এক যাত্রী ইন্ডিগোর এই ব্যর্থতাকে ‘মানসিক অত্যাচার’ বলে অভিহিত করে এনডিটিভিকে জানান, ১২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তিনি বিমান সংস্থাটির কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট জবাব পাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘আমি ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এখানে। প্রতিবার তাঁরা বলছেন—এক ঘণ্টা দেরি, দুই ঘণ্টা দেরি। আমরা একটা বিয়েতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমাদের মালপত্র পর্যন্ত হাতে নেই। ইন্ডিগোর কর্মীরা আমাদের কিছু বলছেন না। এই মুহূর্তে এটি সবচেয়ে খারাপ বিমান সংস্থা। আমি বুঝি না কেন তাঁরা নতুন যাত্রী নিচ্ছেন আর মালপত্র জমিয়ে রাখছেন।’

আরও এক যাত্রী জানালেন, তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘তারা বারবার ফ্লাইট পিছিয়ে দিচ্ছে। ইন্ডিগোর তরফ থেকে আমরা কোনো স্পষ্ট খবর পাচ্ছি না।’ আরও এক যাত্রী বলেন, ‘খুবই মানসিক চাপের বিষয় এটা। ১৪ ঘণ্টা ধরে আমি বিমানবন্দরে বসে আছি। খাবার বা অন্য কিছুর জন্য কোনো কুপন নেই। আমার কানেকটিং ফ্লাইটটি বাতিল হয়েছে। যাত্রীরা চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন, কিন্তু কর্মীরা কোনো স্পষ্ট জবাব দিচ্ছেন না। এমন জরুরি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কর্মীদের বিন্দুমাত্র প্রশিক্ষণ নেই।’

হায়দরাবাদ বিমানবন্দরসহ অন্যান্য বিমানবন্দরেও একই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে। আটকা পড়া যাত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন। কারণ, তাঁদের কোনো খাবার বা থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়নি। একদল যাত্রী প্রতিবাদস্বরূপ একটি এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট পর্যন্ত আটকে দিয়েছিলেন।

হায়দরাবাদ বিমানবন্দরের এক যাত্রী বলেন, ‘আমার ফ্লাইট গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ছাড়ার কথা ছিল। আমি আমার সহকর্মীকে নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছাই। আমাদের বলা হয়েছিল, ফ্লাইট সময়মতো চলবে। এখন আমরা এখানে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আছি। ইন্ডিগো আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা দেয়নি। তারা শুধু বলে চলেছে, অনির্দিষ্টকালের জন্য দেরি হচ্ছে। আমাদের কোনো স্পষ্ট খবর, খাবার বা পানি দেওয়া হয়নি। ইন্ডিগোর সাড়া একেবারেই যাচ্ছেতাই। এখানে বয়স্ক মানুষ আছেন, যাঁদের বিশেষ দায়বদ্ধতা আছে, তাঁদের জন্য কোনো সমাধান নেই। এটা খুবই হাস্যকর।’

গোয়া বিমানবন্দরে একদল যাত্রী হতাশায় ভেঙে পড়েন। এক ভিডিওতে দেখা যায়, তাঁরা ইন্ডিগোর কর্মীদের লক্ষ্য করে চিৎকার করছেন। পরিস্থিতি সামলাতে বহু পুলিশ সদস্যকেও সেখানে দেখা যায়। চেন্নাই বিমানবন্দরে শত শত যাত্রী আটকা পড়েছেন। সেখানে সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (সিআইএসএফ) ইন্ডিগোর যাত্রীদের প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে। বিশাখাপত্তম বিমানবন্দরে কমপক্ষে ৪৯টি বহির্গমন ও ৪৩টি ইনকামিং ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।

ইন্ডিগোর এই পরিচালনগত ত্রুটি আজ চতুর্থ দিনের মতো চলছে। কুড়ি বছরের পুরোনো এই বিমান সংস্থাটি ক্রুসংকট, প্রযুক্তিগত সমস্যাসহ একাধিক কারণে ৫৫০টির বেশি ফ্লাইট বাতিল করার রেকর্ড তৈরি করেছে। এর মধ্যে মুম্বাই বিমানবন্দরে ১০৪টি, দিল্লি বিমানবন্দরে ২২৫টি, বেঙ্গালুরুতে ১০২টি এবং হায়দরাবাদে ৯২টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। ভূপাল বিমানবন্দরেও কমপক্ষে পাঁচটি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।

ইন্ডিগো স্বীকার করেছে যে, তারা নতুন নিয়ম অনুযায়ী ক্রুয়ের প্রয়োজনীয়তা ভুলভাবে আন্দাজ করেছিল এবং পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল, যার ফলস্বরূপ শীতকালীন আবহাওয়া ও যানজটের সময়ে পর্যাপ্ত ক্রুর অভাব দেখা দিয়েছে। বিমান সংস্থাটি সতর্ক করেছে, সময়সূচি স্বাভাবিক করার চেষ্টার অংশ হিসেবে আগামী দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত ফ্লাইট বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা জানিয়েছে, ৮ ডিসেম্বর থেকে তারা আরও বিঘ্ন এড়াতে ফ্লাইট পরিচালন কমিয়ে দেবে।

অন্যদিকে, ইন্ডিগোর সিইও পিটার এলবার্স কর্মীদের বলেছেন—পরিচালন স্বাভাবিক করা ও সময়ানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনা ‘সহজ লক্ষ্য হবে না’। বিমান সংস্থাটি গতকাল রাতে তাদের গ্রাহক ও স্টেকহোল্ডারদের কাছে নতুন করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘গত দুই দিন ধরে ইন্ডিগোর নেটওয়ার্ক ও পরিচালনব্যবস্থায় ব্যাপক বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের সব গ্রাহক ও শিল্প স্টেকহোল্ডারদের কাছে আমরা আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ তারা আরও যোগ করেছে, ‘ইন্ডিগো এই বিলম্বের প্রভাব কমাতে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে নিরলসভাবে ও সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত