Ajker Patrika

আলোচনায় জীবাণু অস্ত্র: গোড়াটি কোথায়

বিজন সাহা
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৩: ০০
আলোচনায় জীবাণু অস্ত্র: গোড়াটি কোথায়

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা হতো বলে রাশিয়া ও চীন অভিযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটা স্বীকার করছে না। কিন্তু জর্জিয়ায় অনেকের অকস্মাৎ মৃত্যু, দাগিস্তানে বিরল প্রাণীদের দল বেঁধে মৃত্যু—এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, ওসব ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু জীবাণু তৈরি হতো, যা পাখির মাধ্যমে ছড়ানো যায়। ইদানীং পাওয়া কিছু তথ্য বলছে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে এমন কিছু ড্রোন অর্ডার দিতে চেয়েছিল, যা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্প্রে ছড়াতে পারে। 

উল্লেখ্য, ইউক্রেন, জর্জিয়া, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য এক্স-সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোয় এমন অনেক ল্যাবরেটরি আছে, যা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পেন্টাগনের অর্থ সহায়তায় চালিত। ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভব ২০০৫ সালে তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার অংশগ্রহণে। পরে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, এসব ল্যাবরেটরিতে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো, যা নিরাপদ ছিল না। রাশিয়া ও চীনের চারদিকে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি এ ধরনের ল্যাবরেটরির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আজ হোক, আর কাল হোক এই সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে তখন সেটা হতো আরও কঠিন যুদ্ধ। 

আজ যারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁরা যদি একইভাবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন; ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতেন; দেশে দেশে রং-বেরঙের বিপ্লবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন; পৃথিবী আজ এই মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারে এসে দাঁড়াত না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, হান্টার বাইডেন এসব ল্যাবরেটরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যখন ইউক্রেনে এসব ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়, তখন সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক উলিয়ানা সুপ্রুম, যাঁর পিতামহ স্তেপান বান্দেরার সহযোগী ছিলেন। 

উল্লেখ্য, বিদেশি নাগরিকের মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনে সাংবিধানিক বাধানিষেধ থাকার পরও সুপ্রুম কিন্তু নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের আসল শাসক কারা। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হান্টার বাইডেন আলোচনায় আসেন। তাঁর ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম একে রাশিয়ার চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিককালে তারা স্বীকার করেছে, ল্যাপটপের ঘটনায় রাশিয়া জড়িত ছিল না। কিছু কিছু নথি প্রমাণ করে যে, জো বাইডেন শুধু হান্টারের পিতাই নন, বিজনেস পার্টনারও বটে। অন্তত তিনি ছেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতেন। তাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি যে বাইডেন ফ্যামিলির স্বার্থও জড়িত—এটা বলা অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড—এদের শিকড় ইউক্রেনের ওদেসায়। এই দুই পরিবারই কয়েক প্রজন্ম আগে জারের রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যায় ভাগ্যের সন্ধানে। তাই এদের মধ্যেও যে অন্ধ রুশ বিরোধিতা নেই, সেটাই-বা কে জানে? 

বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। অনেক সময় ওরা অপেক্ষা করত ছোট ভাই বা বোন কখন আঘাত পেয়ে কাঁদবে, তারপর ওকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেবে। যদিও চাইলে আগেই ওরা বাচ্চাটা যাতে আঘাত না পায়, সেটা করতে পারত, যা সাধারণত বড়রা করে। মনে হয় প্রথমত কিউরিওসিটি থেকে—দেখি কী হয় পড়ে কি পড়ে না। আবার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে বাহবা পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রন্দনরত বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়। আজ রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দনবাসে তাণ্ডব চালানোর পর সেখানে আসত, হয়তো এতটা সমালোচনার মুখে পড়ত না। বরং অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেত। যেমন হয়েছে সিরিয়ায়। কিন্তু আমরা কি এ জন্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষের জীবন বলিদান করতে প্রস্তুত? মনে হয় তাই। আমরা আমাদের কাজের যুক্তি খুঁজি কোনো ঘটনা ঘটার পর, কেন ঘটল সেটা প্রায়ই বিবেচনায় না এনে। 

মানুষের চরিত্রই এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে, সে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু যখন সেই বিপদগ্রস্ত মানুষ মারা যাবে, তখন তার প্রতি সমবেদনার অন্ত থাকবে না। কিন্তু সেই একই লোক যদি জীবন বাঁচাতে অন্যায় কিছু করে, তখন সবাই মিলে তাকে অপরাধী সাজিয়ে ছাড়বে। আর এটা সে করে সব সময় শুধু খণ্ডচিত্র বিবেচনায় আনে বলে। যেকোনো বিষয়ে কম-বেশি নিরপেক্ষ ও সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য দরকার পূর্ণ চিত্র বিবেচনা করা। বর্তমান পৃথিবী এত বেশি স্বার্থান্ধ যে, সে কাউকে পূর্ণ চিত্র দেখতে শেখায় না। সবাই দেখায় শুধু সেই চিত্রটাই, অনেক সময় ফেইক চিত্র, যেটা তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। এখন সত্য খোঁজা হয় না। যে ভাষ্য স্বার্থ উদ্ধার করতে সাহায্য করে, সেটাকেই ছলে-বলে-কৌশলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকম চেষ্টা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক আইন-কানুন আজ কাজ করে না। অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও সামাজিক চুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। 

দনবাসের সংকট ছড়াল যে কারণে
অনেককেই বলতে শুনি দনবাসে যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাহলে রুশ আক্রমণ এখানে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো হতো। এখানে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের আগে সমস্ত ইউরোপ পদানত করে। আর এসব দেশ প্রায় বিনা প্রতিরোধে জার্মানির অধীনতা মেনে নেয়। ফলে সেসব দেশে পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়। এসব দেশের সৈন্যরা জার্মান সৈন্যের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে। পরাজিত জার্মান বাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন আসে সোভিয়েত সীমান্ত ত্যাগের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে কি হবে না। যদি সেটা না হতো বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের সমর্থনকারী সরকার ক্ষমতায় থাকত। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মানি নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধ শুরু করত। তাই সে সময় ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বিকল্প ছিল না। আর যেহেতু প্রায় প্রতিটি দেশেই যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়েছিল সেসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসব এলাকা মুক্ত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শুধু গায়ের জোর ছিল না, ছিল অবজেকটিভ রিয়্যালিটিও। 

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেছেন। হিটলার ও মুসোলিনির মতো না হলেও তিনি এদের চেয়ে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৯৪৫ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ দেখেনি। সেই একই কারণে ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ আজ যুগের দাবি। তা না করলে অচিরেই নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে, আর তা হবে আরও ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এটাই বলার চেষ্টা করে যে, এই যুদ্ধের পেছনে ভারতের হাত আছে, আর দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাই এ জন্যে দায়ী। ফলে একাত্তরে তারা নির্বিচারে হিন্দু নিধন করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা। এমনকি এখন যে জামায়াত-হেফাজতসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, সেটা তখনকার রাগ থেকেও। একইভাবে যদি ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎপাটন না করা হয়, তাহলে সেখানকার রুশদের সেই একই রকম বিপদের মধ্যে রাখা হবে। 

কারণ, এসব ফ্যাসিবাদী দল প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করবে স্থানীয় রুশদের, আর রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের ওপর। এরই মধ্যে সেখানে অনেকেই ডাক দিচ্ছে রুশ হত্যার, বিশেষ করে রুশ শিশু হত্যার, যাতে করে উত্তরসূরিরা পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। মনে করিয়ে দিতে চাই যে,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, রাজাকার-আলবদর নয়। শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে, রাজাকাররা নয়। একাত্তরের বিজয়ের পরে প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া, দেশকে আক্ষরিক অর্থেই রাজাকারমুক্ত করা। তখন সেটা হয়নি বলেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হয়েছে, তখন সেটা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে নতুন করে পাকিস্তানের জুতা পরতে হয়েছে। 

ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটা দিক ছিল—পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী হবে এসব কেন্দ্রের। চেরনোবিলের স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো গড়ে (১) ৩০ কিলোপাসকেল শক্তির শকওয়েভের চাপ সহ্য করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে-মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এর ওপর পড়লেও এগুলো ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে এগুলো; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে চেরনোবিলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভেতর থেকে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সেখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যখন দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন। ইউক্রেন সেই চেষ্টা করেছিল চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। যদিও রুশ সৈন্যরা প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে, পরে বেলারুশ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সে সমস্যার সমাধান করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপারোঝিয়ায় তারা প্রভোকেশন করেছিল। যদিও রুশ সৈন্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে উগ্রবাদীদের হাতে যেকোনো অস্ত্রই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই প্রমাণ তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট নিকট অতীতে বারবার দিয়েছে। 

দনবাসকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকট অন্য অঞ্চলগুলোয় ছড়িয়ে পড়ার পেছনেও কারণ রয়েছেরুশোফোবিয়া: শুনব নাকি শুনব না
যুদ্ধ শুরুর পর রুশোফোবিয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পোল্যান্ডের এক মন্ত্রী শিকার করেছেন—রুশোফোবিয়া এখন পশ্চিমা বিশ্বের মেইন স্ট্রিম আইডিয়া। আর এটা শুধু যারা রাশিয়ার নাগরিক তাদের সাথেই ঘটছে না, যারা যুগ যুগ ধরে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছে, তারাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অধ্যয়নরত শত শত রুশ ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দস্তইয়েভস্কি, চাইকোভস্কি—মানে রুশ সাহিত্য, রুশ মিউজিক আজ পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ। ভালেরি গিওর্গিয়েভ, আন্না নিত্রেপকাসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী, যারা ওখানে কাজ করতেন বা রেগুলার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে—এই আক্রমণের বিরোধিতা করতে। কিন্তু এঁরা তো জানেন, দনবাসের মানুষের কষ্টের কথা। সমস্ত খেলাধুলায় এদের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। শত শত রুশ ড্রাইভার আটকা পড়েছেন পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে। এখন বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের ট্রাক ও অন্যান্য মালবাহী গাড়ি আটকে দিচ্ছে। 

এটা আসলে রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বই কিছু নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল রুশ রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার রুশ রোগীদের স্যাম্পল টেস্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এরাই নিজেদের মানবতার ধারক ও বাহক বলে ভাবে। অনেকে রুশদের কাছে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না বা যারা অনেক দিন বাসা ভাড়া করে আছে, তাদের উঠে যেতে বলছে। এটা অনেকটা আমাদের সব দেশে ধর্ম দেখে বাসা ভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার মত। স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাদের রুশবিরোধী কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলোয় রুশ ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম পূরণ করতে বলা হচ্ছে, যেখানে বাবা-মার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, যেমন তারা এই যুদ্ধের ব্যাপারে কোন পক্ষ সমর্থন করে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ইউরোপের কোন না কোন দেশে শুধু রুশ হওয়ার অপরাধে অনেকের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবসর যাপনকারী রুশ নারী ও শিশুদের হত্যার ডাক দিচ্ছে। 

এ কারণে এ দেশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। পোল্যান্ড দূতাবাসে গেছি ভিসার জন্য। খুব ভোরে গেছি, দূতাবাস তখনো খোলেনি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে জানলাম ও পাকিস্তান থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকজনকে আসতে দেখলাম। পোশাক দেখে বুঝলাম শিখ। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি ছেলেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধ—ও ভারতীয়। এই দুজন লোক কোনো দিন একে অন্যকে দেখেনি, কেউ কারও ক্ষতি করেনি, অথচ বিনা কারণে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালাল। তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন দেখছি সভ্য ইউরোপের মানুষও এ ব্যাপারে খুব একটা এগিয়ে যায়নি। আসলে কী বলব। মাত্র তিন বছরে জার্মানির শিক্ষিত, সভ্য মানুষেরা হিটলারের ডাকে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘৃণা করতে শেখানো খুব সহজ, কিন্তু একদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু একদিনে এই ঘৃণা চলে যাবে না। বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে মানুষ তখন কী সমাজ গড়বে? 

এরই মধ্যে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যেভাবে পারছে দেশটির সম্পদ লুটপাট করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটাকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে। করছে নিজেরাই এদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। এখানে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে। একটা দিনের কথাও মনে পড়ে না, যখন এদের ওপর একটা না একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল না। আসলে কারও উদ্দেশ্য যদি হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা, সে অজুহাত খুঁজে বের করবেই। 

সেই নব্বইয়ের দশকে, যখন বরিস (ইয়েলৎসিন) আর বিল (ক্লিনটন) নিজেদের বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন, তখনো সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা কাজ করত। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো—‘যখন নেকড়ে ভাঁটিতে জলপানরত ভেড়াকে খেতে চায় জল ঘোলা করার অপরাধে। ভেড়া ভাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করলে নেকড়ে বলে, তুই না হলে তোর দাদা নিশ্চয়ই আমার জল ঘোলা করেছিল। তাই তোকেই সে ঋণ শোধ করতে হবে।’ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশদের নিয়ে যা ঘটছে, সেটা আমায় মনে করিয়ে দেয় ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলোর কথা, যখন অনেক মার্কিন মুসলিম নাগরিকও ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছিল। যদিও ইউরোপের মাল্টি-কালচারাল আইডিয়া অনেক আগেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ছিল, বর্তমান ঘটনা খুব সম্ভব তার জন্য শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। টলারেন্স বা পরমত সহিষ্ণুতা এভাবেই বেঘোরে মারা গেল। যুদ্ধে যাই ঘটুক ইউরোপ যে আর কোনো দিন আগের ইউরোপ থাকবে না, সেটা জোরেশোরেই বলা যায়। 

লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

শহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।

সেলিম জাহান 
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৭
বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।

পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।

তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয‍্যা।

পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।

একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।

শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭: ৪৩
পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি। ছবি: পিক্সাবে
পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি। ছবি: পিক্সাবে

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।

সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।

এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।

ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।

ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।

জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।

এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।

আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গুলিবিদ্ধ হাদি ও নির্বাচন

সম্পাদকীয়
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৫
গুলিবিদ্ধ হাদি ও নির্বাচন

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।

তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।

টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?

কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নির্বাচনের পথে দেশ

সম্পাদকীয়
নির্বাচনের পথে দেশ

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত