বিজন সাহা

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
বিজন সাহা

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১২ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১২ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১২ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১ দিন আগেশহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।
সেলিম জাহান

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১২ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১২ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১ দিন আগেমৃত্যুঞ্জয় রায়

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।
সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।
এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।
জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।
এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।
আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।
সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।
এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।
জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।
এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।
আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১২ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১২ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।
তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।
টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।
তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।
টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১২ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১২ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১২ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১২ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১২ ঘণ্টা আগে