Ajker Patrika

বিহার নির্বাচন: বিজেপির সাফল্য ও বিরোধীদের ব্যর্থতা

আব্দুর রহমান 
বিহার নির্বাচনে এনডিএ জোটের বিপুল জয়ের পেছনে আছে কৌশলগত ও সামাজিক কারণ। ছবি: সংগৃহীত
বিহার নির্বাচনে এনডিএ জোটের বিপুল জয়ের পেছনে আছে কৌশলগত ও সামাজিক কারণ। ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় রাজনীতির পরীক্ষাগারখ্যাত বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ও জনতা দল ইউনাইটেডের (জেডিইউ) জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা এনডিএ ভূমিধস জয় পেয়েছে। ২৪৩ আসনের মধ্যে ২০২টিতে জয়ী হয়ে তারা ক্ষমতা ধরে রেখেছে। বিপরীতে বিরোধী জোট রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) নেতৃত্বাধীন মহাগাঠবন্ধন মাত্র ৩৫টি আসনে জয়লাভ করেছে।

এখানে একটি বিষয় খটকা লাগার মতো। নির্বাচন কমিশন বলছে, তেজস্বী যাদবের আরজেডি এনডিএ জোটের দুই দলের চেয়ে এককভাবে ভোট বেশি পেয়েছে। আরজেডি যেখানে ২৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে, সেখানে বিজেপি ২০.০৭ শতাংশ এবং মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের জেডিইউ ১৯.২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ, এই দুই দলের চেয়ে আরজেডি গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ করে ভোট বেশি পেয়েছে। ফলে, বিহারের এই নির্বাচন ভারতের জাতীয় রাজনীতি তো বটেই, উপমহাদেশের ভোটের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে ভালো একটা উদাহরণ হতে পারে।

বিহার নির্বাচনে এনডিএ জোটের বিপুল জয়ের পেছনে আছে কৌশলগত ও সামাজিক কারণ। সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচন ভারতের রাজনীতির চেহারা পাল্টে দেবে। কারণ, এই নির্বাচনে শুধু ভোটের সংখ্যা নয়, ভোট গ্রহণ ও ভোটার সংগঠিত করার পদ্ধতিও এক নতুন মাত্রা পেয়েছে।

এই নির্বাচনে বিজেপির জোট ‘ওয়ার রুম’ মডেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কেন্দ্রীয় ওয়ার রুমে প্রায় ৩০০ জন প্রযুক্তি ও নির্বাচনী কৌশলে বিশেষজ্ঞ কর্মী নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল, আসন পর্যায়ের ওয়ার রুমগুলোর সঙ্গে সমন্বয়, তাঁদের পাঠানো রিপোর্ট বিশ্লেষণ এবং সেই অনুসারে কৌশল সাজানো।

এই ওয়ার রুম ছিল মূলত ব্যক্তিপর্যায়ে ভোটারকে লক্ষ্যবস্তু করে সংশ্লিষ্ট ডেটা ও অন্যান্য কৌশলের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের এক হাইব্রিড ল্যাব, যেখানে রাজনীতিকে বলা যায়—সফটওয়্যারের মতো পরিচালনা করা হয়েছে। বিভিন্ন বুথের ভোটারদের ধর্ম, জাতি, পেশা, গত তিন নির্বাচনে ভোটদান প্রবণতা সূক্ষ্মভাবে ম্যাপিং করা হয়েছে। প্রতিটি আসনে আলাদা ‘বিহেভিয়ারাল ক্যাটাগরি’ বা কোন ভোটার কীভাবে আচরণ করেন, তার ডেটাবেইস বানানো হয়েছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে কোনো একজন ভোটারকে কীভাবে চাঙা করা যায়, কোথায় ক্ষোভ জমে আছে, কোথায় উন্নয়নের গল্প বেশি বিক্রি হয়—তার একটা লাইভ চার্ট সব সময়ই চলেছে ওয়ার রুমে।

ওয়ার রুমের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল রিয়েল-টাইম রেসপন্স। কোন এলাকায় জোট ভাঙার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কোথায় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে, কোথায় কংগ্রেস বা আরজেডির প্রচার জোর পাচ্ছে—মিনিটে মিনিটে এগুলোর আপডেট নিয়ে পাল্টা কৌশল তৈরি করা হয়েছে। প্রার্থীদের গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মীদের ভোটারদের দ্বারে দ্বারে বলা কথা—সবই কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি করে পাঠানো হয়েছে।

বিজেপি-জেডিইউ জোটের জয়ের আরেকটি বড় কারণ রাজ্যের জনমিতিক গঠনের উপযুক্ত ব্যবহার ও জাতপাতভিত্তিক ভোটের সমন্বয়। এনডিএ জোট বিভিন্ন জাতিভিত্তিক সম্প্রদায়কে নিজেদের পক্ষে আনতে পেরেছিল। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ, রাজপুত এবং জাতিভিত্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলোকেও তারা নিজেদের পক্ষে টানতে পেরেছে। বিনিময়ে অবশ্য এসব গোষ্ঠীকে সামাজিক ও আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিতে হয়েছে।

এই নির্বাচনে নারীর ভূমিকাকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। নির্বাচনের ঠিক আগে, নারীদের নগদ ১০ হাজার রুপি করে দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এই অর্থ বিশ্বব্যাংকের দেওয়া অন্য উন্নয়ন প্রকল্প থেকে এনে নির্বাচনের আগে ভোটারদের টানতে ব্যয় করা হয়েছে। বিরোধী দল জন সুরাজ পার্টির অভিযোগ, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংকের ১৪ হাজার কোটি রুপির ঋণ ২০২৫ সালের বিধানসভা নির্বাচন ‘ভিন্ন খাতে ঘুরিয়ে দেওয়ার’ জন্য ব্যবহার করেছে। কেবল তা-ই নয়, নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগপর্যন্ত বিজেপি ও নিতীশ কুমারের জোট জনগণের ভোট কিনতে ৪০ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করেছে।

তবে বিরোধীদের অভিযোগ থাকলেও বাস্তবে ভোটের মাঠে এই পরিকল্পনায় ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন নারীরা, যা ভোটসংখ্যা বৃদ্ধিতে স্পষ্ট সাহায্য করেছে। পাশাপাশি, নারীদের জন্য নির্বাচনের ঠিক আগে বিজেপি জোট ‘লাখপতি দিদি’ তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয়। এ ছাড়া ‘উন্নয়ন’-সংক্রান্ত বিজেপির ব্যাপক প্রচারণাও নারী ভোটার টানতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া, নির্বাচিত হলে ১ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ৫০ লাখ নতুন পাকা ঘর তৈরি, বিনা মূল্যে রেশনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল বিজেপি জোট।

এর বাইরে, নারীদের ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা, ৭ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার রেলপথ আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা, পাটনা, দারভাঙ্গা, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চার শহরে মেট্রো নেটওয়ার্ক স্থাপনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জোট। এসব প্রতিশ্রুতি অনেকটা রূপকথার মতো লাগার কথা ভারতের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত রাজ্যের মানুষের কাছে।

বিজেপি-জেডিইউ জোটের চটকদার, কৌশলী প্রচারণার বিপরীতে বিরোধীদের দুর্বলতা ছিল স্পষ্ট। আরজেডি-কংগ্রেস জোট ঐতিহ্যগত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি ছাড়তে পারেনি এবং নতুন, গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। মহাগাঠবন্ধন জোট এনডিএ জোটের উন্নয়নের চাহিদা ছড়ানো আগ্রাসী প্রচারণার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

নির্বাচনপ্রক্রিয়া-সংক্রান্ত বিতর্কও বিহার নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন এই নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হয়েছে। এতে প্রায় ৬৫ লাখ ভোটার বাদ গেছে বলে জানা গেছে।

বিহার নির্বাচনে এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটার তালিকার ব্যাপক সংস্কার এনডিএর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা তৈরি করেছে। ৬৫ লাখের বেশি ভোটার ‘মৃত’, ‘স্থানান্তরিত’ বা ‘ডুপ্লিকেট’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় বিরোধী দলের ঐতিহ্যবাহী ভোটার সংখ্যা কমেছে। বিরোধীদের অভিযোগ—বিজেপি সরকারের নির্দেশে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন এই কারসাজি করেছে। আবার এই ৬৫ লাখ ভোটার বাদ পড়ায় মূল তালিকায় দরিদ্র, সংখ্যালঘু ভোটার অন্তর্ভুক্তি কম হয়েছে, যার প্রভাব এনডিএ জোটের পক্ষে গেছে।

অন্যদিকে, মুসলিম অধ্যুষিত সীমাঞ্চলের ভোটারের জনমিতিক গঠন এবং গোষ্ঠীগত কাঠামো বিজেপি-জোটের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক ছিল। পশ্চিম সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলার ভোটার চিত্রে এনডিএ জোট তাদের প্রভাব বাড়াতে পেরেছিল। বিশেষ করে, এই অঞ্চলে মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি রাক্ষস’ বলার মাধ্যমে অপরিকরণ করে বিজেপি এই অঞ্চলের হিন্দু ভোটারদের প্রায় সবাইকে নিজের পক্ষে নিয়ে গিয়েছিল। বিপরীতে মুসলিম-ভোটারদের ওপর কংগ্রেস-জোটের নির্ভরতা এবার তাদের কৌশলগত দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এটি স্পষ্ট যে বিজেপি জোট বিরোধীদের তুলনায় কৌশলগত প্রস্তুতি, সংগঠন শক্তি, নির্বাচন কৌশলে অভিযোজন এবং প্রযুক্তির ব্যবহার—সবদিকেই এগিয়ে ছিল। বিজেপি নেতৃত্ব তাঁদের বার্তা উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং আত্মনির্ভরতাকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে সামাজিক গঠন ও ভোটার ভিত্তি সুসংগঠিত করে তাঁরা নিজেদের পক্ষে টানতে পেরেছেন। বিরোধী জোট প্রয়োজনীয় কৌশলের সীমাবদ্ধতা, জোটের অভ্যন্তরীণ গঠনের সংকট ও ধারাবাহিকহীনতার মধ্যে আটকে পড়েছিল।

বিহারে এনডিএ জোটের এই জয় কেবল সংখ্যাগত নয়, এমন রাজনৈতিক এক মডেলের স্বীকৃতি—যেখানে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক প্রচারণা, তৃণমূল সংগঠনের সক্রিয়তা এবং নির্বাচনী কৌশল একসঙ্গে কাজ করে। বিহার নির্বাচনের এই ফলাফল নির্বাচন কৌশলের পুনর্বিবেচনার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যেখানে প্রযুক্তি এবং রাজনীতি ও অর্থনীতির এক সমন্বিত কৌশল আরও বেশি প্রাধান্য পেতে থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ