Ajker Patrika

হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মেয়েটি

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০৬
হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মেয়েটি

মাদক ও চোরাকারবার নিয়ে রিপোর্ট করতে গেছি ঈশ্বরদীতে। ঈশ্বরদী তখন চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্য। সেই রাজ্যের রাজা মিন্টুর প্রভাব সবে পড়তে শুরু করেছে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ঈশ্বরদী আমবাগানের চোরাই পণ্যের দোকানগুলো। তখন অবধি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে সারদা হয়ে রাজশাহী পর্যন্ত পদ্মাপাড়ের সব ঘাট মিন্টু বাহিনীর দখলে। তাদের ভয়ে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খায়। সেসব নিয়ে খোঁজখবর করার পর পরিচিত কয়েকজন বললেন, ঈশ্বরদীতে আর রাত কাটানো ঠিক হবে না। আমারও মনে হলো, এই রিপোর্টে জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য লাগবে, পাবনায় গেলে রথ-কলা দুই হবে। অগত্যা রাতের বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরদী থেকে এলাম পাবনায়।

সকালে পড়িমরি করে উঠে গেলাম তখনকার পুলিশ সুপার শাহ আলম সিকদারের অফিসে। পরের দিন ২৬ মার্চের অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি মহাব্যস্ত। তারপর আবার আমার কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত, বিব্রতও। কথার ফাঁকে আমাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালকের একটি চিঠি পড়তে দিলেন। পাচারের শিকার হওয়া একটি মেয়ে অনেক দিন হাসপাতালে ছিল। মানবাধিকার সংস্থা তাঁকে হেফাজতে নিতে চায়। সে কথা পুলিশকে জানিয়েছেন পরিচালক। সেই চিঠি দেখিয়ে বললেন, এটার খোঁজ করেন, ফেনসিডিল কেনাবেচার চেয়ে এই নিউজ লোকে বেশি পড়বে।

পুলিশ সুপার আমাকে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন নম্বরও দিলেন। এসপির অফিস থেকেই ফোন দিলাম মানসিক হাসপাতালের পরিচালককে। তিনি তখন ওয়ার্ডে রাউন্ডে। ফোন ধরলেন তাঁর এক সহকারী। বললেন, ২৪ মার্চ দুপুরে মানবাধিকার সংস্থার লোকজন মেয়েটিকে ঢাকায় নিয়ে গেছে। এটা ১৯৯৮ সালের ২৫ মার্চের সকালের কথা।

কাজ শেষে ঢাকায় ফিরে এলাম। সকালে জনকণ্ঠ থেকে ফোন, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা থেকে আইনজীবী এলিনা খান আমাকে খুঁজছেন। পাচারের শিকার হওয়া একটি মেয়েকে তাঁরা পাবনা থেকে এনেছেন। তা নিয়ে সংবাদ বৈঠক করবেন। গেলাম ৩৪ বিজয়নগরের দোতলায়, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার অফিসে। দেখি আরও কয়েকজন সাংবাদিক আগে থেকেই বসে আছেন। আমাদের সামনে আনা হলো সেই মেয়েটিকে, দেখতে বেশ সুন্দর। মেয়েটি আমাদের একটি গল্প শোনালেন। সে গল্প শুনে চোখ ভিজে এল সবার। কিন্তু মেয়েটি স্থির, তাঁর দৃষ্টি শূণ্যের দিকে।

মেয়েটি বললেন, তাঁর নাম তানিয়া পারভিন টুম্পা। আখাউড়ার রাধানগর গ্রামে বাড়ি। পিতা সেকেন্দার আলী ঢাকায় স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন। তাঁরা থাকতেন গ্রামে। টুম্পার যখন বয়স সাত তখন মা মারা যান দুরারোগ্য ব্যাধিতে। সাত বছরের টুম্পাকে নিয়ে মহা বিপাকে পড়েন বাবা। তারপরও তিনি আরেকটা বিয়ে করেন। সৎমায়ের ঘরে টুম্পা হয় চোখের বালি। গড়াতে গড়াতে তাঁর ঠাঁই হয় গাজীপুরে মামার বাড়িতে।

সেখানে ভালোই কাটছিল সব। গাজীপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মামা তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেন। পাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের কর্মচারী সেলিম চৌধুরী। ১৯৯১ সালের কোনো এক দিন তাঁদের বিয়ে হয়। প্রথম কয়েক বছর ভালোই কাটে। তাঁদের একটি পুত্রসন্তানও হয়।

১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে টুম্পা বেড়াতে আসেন বাপের বাড়ি রাধানগরে। এখানেই ঘটে একটি দুর্ঘটনা। টুম্পার ছোট ভাই তাঁর শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ছাদে যায়। হঠাৎ একটি চিৎকার শুনে দৌড়ে যান। দেখেন, ছোট ভাইয়ের হাত থেকে তাঁর শিশুসন্তানটি মাটিতে পড়ে গেছে। দোতলা ছাদ থেকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় দুই বছরের শিশুটি। সন্তান হারিয়ে নির্বাক হয়ে যান টুম্পা।

টুম্পা বলেই যাচ্ছেন আর আমরা রেকর্ড করছি তাঁর কথা। বলেন, কয়েক মাস পর বেড়ানোর কথা বলে সেলিম তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাঁরা ওঠেন নবাবপুর রোডের একটি হোটেলে। একদিন সেই হোটেলে টুম্পাকে একা রেখে পালিয়ে যান সেলিম। পরে টুম্পা জানতে পারেন সেলিম তাঁকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এরপর কয়েক দিন তাঁকে হোটেলে বন্দী করে রাখা হয়। একদিন সুযোগ বুঝে এক মহিলার বোরকা পরে হোটেল থেকে পালিয়ে যান তিনি। বাসে উঠে আসেন গাবতলী, তারপর চলে যান মাগুরায়। অজানা গন্তব্য। মাগুরায় নামার পরে এক লোক টুম্পার কথা শুনে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু স্ত্রীর আচরণে তাঁকে আর রাখতে পারেননি। তাঁকে বের করে দেন। পথ ঘুরে টুম্পা আসেন চুয়াডাঙ্গায়। এ পথও টুম্পার অচেনা। ট্রেন থেকে মাঝপথে নেমে পড়েন। উদ্দেশ্য ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করবেন। দীর্ঘক্ষণ রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক লোকের সন্দেহ হয়। তিনি টুম্পাকে নিয়ে যান পাশের একটি বাজারের মধ্যে। বাজারের লোকজন টুম্পাকে দেখে নানা কথা বলতে থাকে। কেউ বলে মেয়েটা খারাপ, কেউ বলে পালিয়ে এসেছে।

মুহূর্তে বাঁচার পথ খুঁজতে মাথায় একটি ফন্দি আসে। মুহূর্তের মধ্যে পাগল সেজে প্রলাপ বকতে শুরু করেন। সবাই ধরে নেয় মেয়েটি পাগল। তাঁরা পুলিশের হাতে তুলে দেয় টুম্পাকে। পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে থেকে তাঁকে পাঠানো হয় পাবনা মানসিক হাসপাতালে। সেই থেকে টুম্পার ঠাঁই হয় মানসিক হাসপাতালে।

এলিনা খান বললেন, তিন বছর মানসিক হাসপাতালেই ছিলেন টুম্পা। কেউ তাঁর খোঁজ করেনি। মানবাধিকার সংস্থার একটি দল পাবনা মানসিক হাসপাতালে গিয়ে টুম্পার খোঁজ পায়। ১৯৯৮ সালের ২৪ মার্চ টুম্পাকে ঢাকায় আনা হয়। ২৮ মার্চ টুম্পাকে নিয়ে সেই প্রতিবেদন ছাপা হয় জনকণ্ঠের প্রথম পাতায়।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর পুলিশ তৎপর হয়। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে সিআইডি ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করে। পুলিশ একদিন টুম্পাকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিযান চালায়। তারা সদর হাসপাতালে গিয়ে সেলিম নামের এক কর্মচারীকেও খুঁজে পায়। সেলিমকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় আনা হয়। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সেলিম জানান, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। মেয়েটিকেও কোনো দিন দেখেননি। গ্রেপ্তারের সময় গ্রামবাসীও সেলিমের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করে। সব শুনে তদন্ত নিয়ে দ্বিধায় পড়ে পুলিশ।

উদ্ধার করে টুম্পাকে রাখা হয় মোহাম্মদপুরে একটি সংস্থার আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু কিছুদিন সেখানে থাকার পর হঠাৎ করে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন। একদিন আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। মাঝে মাঝে টুম্পা এমন আচরণ করতে থাকেন, যাতে সবাই ভয় পেয়ে যায়। শেষমেশ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একজন মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে। সেই চিকিৎসকের কাছে টুম্পা সব কথা খুলে বলেন। তিনি স্বীকার করেন, এত দিন যেসব গল্প বলেছেন, সবই বানিয়ে বানিয়ে। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই। সেলিম নামের কাউকে তিনি চেনেন না, জানেনও না। তাঁকে আগে কোনো দিনই দেখেননি। চিকিৎসক তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, টুম্পার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঈশ্বরদীর পতিতালয়ে। সেই পল্লি উচ্ছেদ হওয়ার পর আমবাগানের একটি চোরাচালান চক্রের আশ্রয়ে চলে যান। একদিন সেখানে পুলিশ হানা দিলে তিনি পাগলের ভান করেন। এরপরই তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সমাজ তাকে নেবে না বলে এসব গল্প ফাঁদে। এখন আশ্রয়কেন্দ্রের জীবন তাঁর মোটেই ভালো লাগছে না। টুম্পার এই কাহিনি শুনে বোকা বনে যায় পুলিশ। সব তদন্ত থেমে যায়। দুঃখ প্রকাশ করে সেলিমকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি পরিবারের কাছে ফিরে যান।

প্রথম সংবাদ ছাপা হওয়ার বছর দেড়েক পরে ফলোআপ করব বলে একদিন ফোন দিই সেই আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। তিনি আমাকে হতবাক করে দিয়ে বলেন, মেয়েটি আর নেই ভাই, সে তো পালিয়ে গেছে। বলেই ফোন রেখে দেন।

আমার কাছে সব অদ্ভুত লাগে। অন্ধকারে জন্ম, অজানায় হারিয়ে গেল মেয়েটি। আসলে, জীবন বড়ই বিচিত্র! তার চেয়ে বিচিত্র মানুষ। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত-কী যে হয়, তা বোধ হয় কেউই জানে না।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

খুনের পর মোবাইল, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট, ‘গৃহকর্মী আয়েশা’র পরিচয় মেলেনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫৭
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে খুন করার পর কথিক গৃহকর্মী আয়েশা ওই বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, বেশ কিছু স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করেন। এ ঘটনায় গতকাল সোমবার রাতে মোহাম্মদপুর থানায় করা হত্যা মামলার এজাহারে এই দাবি করা হয়েছে। তবে আয়েশা নামে পরিচয় দেওয়া ওই তরুণীর প্রকৃত পরিচয় মেলেনি এখনো।

স্ত্রী লায়লা আফরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫) হত্যার ঘটনায় গতকাল মামলাটি করেন নাটোরের স্থায়ী বাসিন্দা আ জ ম আজিজুল ইসলাম। মামলায় কথিত গৃহকর্মী মোছা. আয়েশাকে (২০) একমাত্র আসামি করা হয়েছে। তবে এজাহারে তাঁর বাবার নাম ও ঠিকানায় ‘অজ্ঞাত’ লেখা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে আজকের পত্রিকাকে মামলার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রকিবুজ্জামান তালুকদার। গতকাল সকাল ৭টা ৫১ মিনিট থেকে ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এজাহারে বাদী আজিজুল লিখেছেন, তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। মোহাম্মদপুরে পরিবার নিয়ে থাকেন। চার দিন আগে উল্লিখিত আসামি তাঁর বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। গতকাল সকাল ৭টার দিকে তিনি (আজিজুল) তাঁর কর্মস্থল উত্তরায় চলে যান। কর্মস্থলে থাকাকালে তিনি তাঁর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

পরে তিনি বেলা ১১টার দিকে বাসায় আসেন। এসে দেখতে পান, তাঁর স্ত্রীর গলাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটা। স্ত্রী রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন আর মেয়ের গলার নিচে ডান পাশে কাটা। মেয়ে গুরুতর অবস্থায় বাসার প্রধান ফটকে পড়ে আছে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে তিনি দ্রুত তাকে উদ্ধার করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী আশিকের মাধ্যমে মেয়েকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

মামলায় আজিজুল আরও লিখেছেন, তিনি বাসার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করেন। এতে তিনি দেখতে পান, আসামি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটের সময় কাজ করার জন্য বাসায় আসেন। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের সময় আসামি তাঁর (বাদী) মেয়ের স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ অন্যান্য মূলবান সামগ্রী নিয়ে যান আসামি।

মামলায় বাদী লিখেছেন, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, অজ্ঞাত কারণে আসামি তাঁর (বাদী) স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি বা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করেন।

মা-মেয়ে হত্যার আসামিকে শনাক্ত করা যায়নি। মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ জানায়, গৃহকর্মীর পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত