Ajker Patrika

মন্ত্রীর হুমকিতেও দাম বাড়েনি গরুর চামড়ার, ছাগলেরটি ফ্রিতেও নেয় না

আপডেট : ৩০ জুন ২০২৩, ১২: ০০
মন্ত্রীর হুমকিতেও দাম বাড়েনি গরুর চামড়ার, ছাগলেরটি ফ্রিতেও নেয় না

কোরবানির পশুর চামড়া বছর কয়েক ধরে যেন ফেলনা বস্তুতে পরিণত হয়েছে! গত বছর দাম না পেয়ে অনেকে ক্ষোভে চামড়া পুঁতে ফেলেছেন। এ বছর সরকার প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ঠকালে সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির উদ্যোগ নেবে বলে চামড়া সিন্ডিকেটের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। 

কিন্তু দাম নির্ধারণ এবং চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের হুমকি-ধমকির কোনো প্রভাব পড়েনি। গতবারের মতোই এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার দাম যৎসামান্য। দিনের শুরুতে কিছুটা দাম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমে এসেছে। ছাগলের চামড়ার ক্রেতাই নেই! 

অথচ চামড়াজাত পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এক দশক আগের তুলনায় দেশে অন্তত তিন গুণ বেড়েছে চামড়ার জুতা ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের দাম। 

আমাদের বগুড়া প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, মৌসুমি এবং নিয়মিত ব্যবসায়ীরা গত বছরের দামেই চামড়া কিনছেন। বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) দুপুর পর্যন্ত অনেক চামড়া অবিক্রীত ছিল। দুপুর ১২টা দিকে গরুর যে চামড়া ৭০০ টাকা দাম বলা হতো, দুপুরের পর সেটি ৫০০ টাকার বেশি দাম বলেনি কেউ। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক বছর বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া কিনে লোকসান হয়েছে। তাই এবার ভেবেচিন্তে কিনছেন। 

এর প্রমাণ মিলল শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গ্রাম ঘুরে চামড়া কিনে তাঁদের কাছে আনেন। কিন্তু বেলা দেড়টা পর্যন্ত সেখানে খুব একটা চামড়া পৌঁছায়নি। 

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান এলাকা থেকে চামড়া বিক্রি করতে আসা মামুনুর রশিদ নামের এক মৌসুমি ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুরো বাজারের ব্যবসায়ীরাই সিন্ডিকেট করে দাম কম দিচ্ছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আসল টাকাই তুলতে পারবেন না। 

চামড়া ব্যবসায়ী জসমত উল্লাহ বলছেন, গত বছরের চেয়ে এবার লবণের দাম বেশি, এ ছাড়া আড়ত থেকে নগদ টাকা পাওয়া যায়নি, এ কারণে বেশি দামে চামড়া কেনা সম্ভব হচ্ছে না। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়া ফড়িয়া ডেকে ৫০০ টাকায় গছিয়ে দিতে হয়েছে। আর ছাগলের চামড়া ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকার বেশি কেউ বেচতে পারেননি। গরুর চামড়া ৬০০ টাকার ওপরে কেউ দাম বলে না। ভেড়ার চামড়া বিনা মূল্যেও নিতে চাননি ফড়িয়ারা। 

তবে বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আড়তে সরকারনির্ধারিত মূল্যেই চামড়া কেনা হবে। এতে ভালো মানের চামড়ার দাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত হওয়ার কথা।’ তবে নগদ টাকার সংকটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিচ্ছে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

একই পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য জেলায়ও। ফেনীর পরশুরাম উপজেলা প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান ভুট্টো আড়াই লাখ টাকার গরুর চামড়া মাত্র দেড় শ টাকায় বিক্রি করেছেন। দেড় লাখ টাকার একটি গরুর চামড়ার দামও দেড় শ টাকার বেশি বলেনি ফড়িয়ারা। 

উপজেলা বক্সমাহমুদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল গফুর বলেন, ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের গরুর চামড়া অনেক দরকষাকষি করে মাত্র দেড় শ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। 

এরকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনীতে এক শ–দেড় শ টাকার বেশি দামে কেউ চামড়া বেচতে পারেননি। 

পরশুরাম বাজারের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তহিদুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন আকারের আড়াই শ চামড়া কিনেছেন সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা দরে। বেশির ভাগের দাম পড়েছে ১০০ টাকা। 

এদিকে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলায় গরুর চামড়া আকারভেদে বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। আর ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ৩০ টাকায়। 

ক্ষুব্ধ কোরবানিদাতারা বলেছেন, এত কম টাকায় চামড়া বিক্রয় করার চেয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা ভালো! 

মৌসুমি ব্যবসায়ী মোহা. জুয়েল রানা বলেন, ঝুঁকি নিয়ে চামড়া কিনছেন তাঁরা। বিক্রি করতে পারবেন কি না জানেন না। ব্যবসায়ী মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে কিনেছেন। 

চামড়া নিয়ে বিপাকে আখাউড়ার মানুষময়মনসিংহে বিনা মূল্যেও ছাগলের চামড়া নিচ্ছেন না ফড়িয়ারা। আর লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকা দরে। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কামরুজ্জামান দুটি ষাঁড় গরু ও দুটি গাভির চামড়া মোট ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেছেন! 

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলেন, গরুর চামড়া ৩০০-৬০০ টাকা এবং ছাড়লের চামড়া ২০-৪০ টাকা দরে কিনেছেন তাঁরা। সুদাংশু নামে এক ফড়িয়া ব্যবসায়ী বলেন, একটা খাসির চামড়া ১০ টাকা করে কিনে লবণ লাগাতে হয় ৩০ টাকার। বাজারে সেই চামড়া তুললে ১০ টাকাও দাম বলে না। তাই এবার খাসির চামড়া কিনছেন না। 

গত কয়েকবারের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও বিপদে। কারণ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে চাইছেন না। দাম না পাওয়ায় জেলার আখাউড়া উপজেলার বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিনা মূল্যে চামড়া দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পৌরসভার জামিয়া দারুল উলুম মূহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা মাকসুদুল আলম জানান, বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু বিক্রি করতে পারছেন না।

গরুর চামড়ার দাম কম, বিনা মূল্যে কেউ নিচ্ছে না ছাগলের চামড়া—এমন পরিস্থিতি ঠাকুরগাঁওয়ে। জেলার বালিয়াডাঙ্গীতে দেড় লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া ৪৩০ টাকায় বিক্রি করেছেন উপজেলার আমজানখোর ইউনিয়নের শরীফ উদ্দীন। সহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী ২৫টি ছাগলের চামড়া বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কিনেছেন মোট ৩২০ টাকায়। কিন্তু বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারছেন না। রাতের মধ্যে বিক্রি না হলে ফেলে দিয়ে যাবেন।

মৌসুমি ব্যবসায়ী শাহাজাহান আলী বলেন, একটা গরুর চামড়ায় কমপক্ষে ২০০ টাকার লবণ খরচ। যাঁরা লবণ লাগাবেন তাঁদের মজুরি আছে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা তাঁরা জানেন না। প্রতিবার বাইরের ব্যবসায়ীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবার কোনো সাড়াশব্দ নেই!

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বগুড়া, পরশুরাম (ফেনী), গাংনী (মেহেরপুর), ময়মনসিংহ, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ও বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ছয় মাসে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি
বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি

ডলার এখন রেমিট্যান্স, রপ্তানি, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই বাজারে ডলার হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে সবাই চুপ। এই ডলারের সরবরাহ ও দাম স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি পুরো বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত বিরতিতে ডলার কিনছে। সেই ধারাবাহিকতায় শুধু চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে জানান, ডিসেম্বর মাসে কেনা ডলারের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ৯২ কোটি ডলার এবং চলতি অর্থবছর ধরে মোট কেনা হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ে প্রথম ডলার কেনা হয়েছিল ৪৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার, আগস্টে ৪৫ কোটি ৪০ লাখ, সেপ্টেম্বরেই তা বেড়ে ৯২ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছায়। এরপর অক্টোবর ও নভেম্বরে অবশ্য অনেকটাই কমে ১৪ কোটি ২০ লাখ এবং ৫ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসে। ডিসেম্বরেই তার বড় উল্লম্ফন ঘটে, কেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২ কোটি ১০ লাখ ডলারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং চ্যানেলের শক্তিশালীকরণ এবং অনলাইনে আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজার মনিটরিংয়ের ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। এ ছাড়া ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ হওয়ায় ব্যবসার আড়ালে ডলার পাচার কমেছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে জমে থাকা অতিরিক্ত ডলার ক্রয় করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আগের অর্থবছরগুলোর সঙ্গে তুলনায় এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রেতার ভূমিকায়, যেখানে অতীতের বছরগুলোতে বড় অঙ্কে বিক্রি হতো। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন, ২০২২-২৩ এ ছিল ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন, ২০২৩-২৪ এ ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন এবং ২০২৪-২৫ এ ১ দশমিক ১২৪ বিলিয়ন ডলার। এই পরিবর্তন বাজারে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বর্তমান খোলাবাজারে ডলারের দর ১২৪-১২৫ টাকার মধ্যে, যেখানে গত বছরের এই সময়ে তা ছিল ১৩১ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে পণ্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ বিলিয়ন ডলার, আগের বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ কম। অনলাইনে বাজার নজরদারি এবং ওভার/আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণে আসায় পণ্যের আড়াল থেকে ডলার পাচারও অনেক কমেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ক্রয় বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এর ফলে আমদানি, বিনিয়োগ ও বাজার ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে।’

সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ, পাচার কমে আসা—সব মিলিয়ে ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ডলার বিক্রেতা নয়; বরং ক্রেতার ভূমিকায়, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত