Ajker Patrika

সক্ষমতার ভিত্তিতেই মার্জিন ঋণ, ফোর্সড সেলে থাকবে না বাধা

  • কয়েক দফায় সংস্কার প্রস্তাব জানাবে টাস্কফোর্স
  • এপ্রিলের মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ
  • প্রথমেই থাকছে মার্জিন ঋণ, গ্রাহকের রিস্ক প্রোফাইলিং ও ফোর্সড সেল নিয়ে সুপারিশ
আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা 
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ১৬
সক্ষমতার ভিত্তিতেই মার্জিন ঋণ, ফোর্সড সেলে থাকবে না বাধা

শেয়ারবাজারে দরপতনে বিভিন্ন সময় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। এর অন্যতম প্রধান কারণ মার্জিন ঋণ নিয়ে করা বিনিয়োগে বড় লোকসান। তাই বিনিয়োগকারীদের হাহাকার বন্ধ করতে মার্জিন ঋণের বিষয়ে নতুন কিছু নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করতে যাচ্ছে পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স।

টাস্কফোর্সের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা পুঁজিবাজার সংস্কারে কয়েক ধাপে সুপারিশ প্রস্তাব করবেন। প্রথম ধাপে স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব এমন কিছু সুপারিশ করা হবে। এই ধাপে মার্জিন ঋণ নিয়ে কিছু নতুন নীতি সুপারিশ করবে টাস্কফোর্স। এতে থাকছে, মার্জিন ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের প্রোফাইল বিশ্লেষণের প্রস্তাব। গ্রাহকের ঝুঁকি গ্রহণ করার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করা হবে এতে। ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার সমঝোতার ভিত্তিতে। পোর্টফোলিওতে উল্লেখ থাকবে এই ঋণের সুদহার। এ ছাড়া ফোর্সড সেল বন্ধের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো চাপ দিতে পারবে না—এমন নীতি করার সুপারিশও করতে যাচ্ছে টাস্কফোর্স।

উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারী ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে যে ঋণ নেন, তাকেই বলা হয় মার্জিন ঋণ। বাজারে মন্দা চলার সময় শেয়ারের দরপতন একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে বিনিয়োগকারীকে অন্য উৎস থেকে টাকা দিয়ে ঋণ সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন ঋণদাতা। একে বলা হয় মার্জিন কল। মার্জিন কল পাওয়ার পরও বিনিয়োগকারী ঋণ সমন্বয় করতে ব্যর্থ হলে ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। একে বলা হয় ফোসর্ড সেল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে যে কেউ চাইলে মার্জিন ঋণ নিতে পারছেন। কিন্তু সেটা বন্ধের সুপারিশ করবে টাস্কফোর্স। প্রধানতম সংস্কার হচ্ছে গ্রাহকের প্রোফাইল। ব্যাংকের মতো করে ঋণগ্রহীতার রিস্ক প্রোফাইলিং করা হবে। গ্রাহকের বাজারে কত দিনের অভিজ্ঞতা আছে, মার্জিন নেওয়ার আগে ব্যবসার অবস্থা কী, মার্জিন নিয়ে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন কি না, বিনিয়োগের পর লোকসান হলে টাকা পরিশোধের সক্ষমতা আছে কি না ইত্যাদি বিষয় স্থান পাবে গ্রাহকের প্রোফাইল। এর ওপর ভিত্তি করেই মিলবে মার্জিন ঋণ।

মার্জিন ঋণের সুদের হারও নির্ধারিত হবে গ্রহীতা ও ঋণদাতার সমঝোতায়। যে ঋণ নেবে এবং যে দেবে, তাদের দুজনের পারস্পরিক সমঝোতায় সই করবে। প্রতিটা পোর্টফোলিওতে সুদের হার উল্লেখ করা থাকবে। যখনই মার্জিন কল আসবে, এসএমএস চলে যাবে ঋণগ্রহীতার কাছে। ফোনকল আসবে। লোকসানের টাকা জমা দিতে না পারলে শেয়ার বিক্রি হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

ফোর্সড সেল নিয়ে টাস্কফোর্সের একজন সদস্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি প্রতিষ্ঠানই ঠিক করবে, রেগুলেটর এতে হাত দেবে না। তারা বলবে না যে ভাই ফোর্সড সেল বন্ধ করেন, এই করেন, সেই করেন। এ ধরনের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের পর লোকসান হলে এবং মার্জিন কলের পরও বিনিয়োগকারী টাকা দিতে না পারলে তার শেয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিক্রি হয়ে যাবে।’

তবে এসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্য কেবল নীতিমালা নয়, আইন করতে হবে বলে জানান টাস্কফোর্সের ওই সদস্য। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব। আইন হলে সবাই মানতে বাধ্য হবে।’

এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও রেগুলেটর ফোর্সড সেল বন্ধ করতে পারে না। এখন করে। আইন করার অর্থ হচ্ছে, অনৈতিক চর্চা করা হয়, সেটা স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। আইন করলে তো আর বন্ধ হবে না।

টাস্কফোর্সের আরেক সদস্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মার্জিন ঋণের কারণে বাজারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। নেগেটিভ ইক্যুইটি তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কী কী ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কেন সমস্যায় পড়েছে, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সার্বিকভাবে আমরা যে পদ্ধতি করে দিয়ে যাব, তাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সমস্যা হবে না।’

জানা গেছে, সংস্কার নিয়ে টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলো আসবে কয়েক দফায়। এপ্রিলের মধ্যে তিনটা বিষয়ে সুপারিশ করবে টাস্কফোর্স। এগুলো হলো আইপিও ভ্যালুয়েশন, মার্জিন রুলস ও মিউচুয়াল ফান্ড।

এ বিষয়ে টাস্কফোর্সের এক সদস্য না প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই তিনটা বার্নিং ইস্যু। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ডিসক্লোজার লেভেলে কিছু আছে। সেটা পরের সেগমেন্টে আনব।’

জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, ‘বাজারটাকে কে কী অবস্থায় নিয়ে গেছে, এখানে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের মাথাব্যথা হচ্ছে, যেসব কারণে বাজারের ম্যাসিভ পতন, ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিগুলো ভবিষ্যতে যাতে না হয়, সেখানে আমরা পরিষ্কারভাবে লিখব। কী করলে আর এসব হবে না, সেগুলো জানাব। তখন এটার ব্যত্যয় যদি কেউ ঘটায়, সেই দায় আমাদের নয়।’

শেয়ারবাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য গত অক্টোবরের শুরুর দিকে পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর জ্যেষ্ঠ অংশীদার এ এফ এম নেসারউদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।

বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। বিএসইসি টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দিলেও কাজের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়নি। আদেশে বলা হয়েছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে টাস্কফোর্স তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে হস্তান্তর করবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, আপাতত আমরা সপ্তাহখানেকের মধ্যে কিছু সুপারিশ ড্রাফট আকারে দেব, সরকার চাইলে যাতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন।

অধ্যাপক হেলাল বলেন, সব শেষ করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু সব দিক থেকে প্রেসার আছে, সেহেতু কিছু কিছু করে শেয়ার করব। সবার শেষে প্রতিবেদন দেব।

টাস্কফোর্সের সদস্য এ এফ নেসারউদ্দীন বলেন, ‘বিএসইসি চেয়ারম্যান দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে শিগগিরই তাঁর কাছে আমরা প্রস্তাব জমা দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের (টাস্কফোর্স) ১৭টা টার্মস অব রেফারেন্সের ভিত্তিকে কাজ করতে বলা হয়েছে। সব শর্ত শেষ করতে গেলে দেড়-দুই বছরের ব্যাপার। সে জন্য আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যখন যেটা প্রস্তুত হবে, সেই সুপারিশ দিয়ে দেব। ড্রাফট ফরম্যাটে দেওয়া হবে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তারপর চূড়ান্ত হবে।

এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খন্দকার সাফফাত রেজা বলেন, ‘সংস্কার যখন হবে, তখন ভালোর জন্যই নিশ্চয় চেষ্টা করবে। রেগুলেটর যদি চায়, তাহলে গ্রাহকের কেওয়াইসি প্রোফাইল তৈরি করতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত