Ajker Patrika

‘শরীরের অনেক অংশ ঠুকরে খেয়েছে সামুদ্রিক মাছ’

হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২২, ১১: ৪২
‘শরীরের অনেক অংশ ঠুকরে খেয়েছে সামুদ্রিক মাছ’

‘রাত ঠিক তখন দেড়টা। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে উল্টে যায় ট্রলারটি। অথচ এর কিছুক্ষণ আগে জেলেরা সাগরে জাল ফেলে যে যার মতো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঘুম আসার আগে মাঝির ডাকে অনেকে আবার ট্রলারের ওপরে উঠে আসে। কিন্তু ততক্ষণে একটা ঢেউয়ের আঘাতে উল্টে যায় আমাদের ট্রলারটি। ট্রলারে থাকা ১৫ জনের মধ্যে সাতজন সাগরে পড়ে যান। তখন অনেকটা ডুবে যাওয়া ট্রলারের ওপরের অংশ ধরে ভাসতে থাকেন চারজন। আমিসহ অপর তিনজন তখনো সাগরে ছিলাম। প্রথম দিকে ট্রলারের পাশ ধরে কিছুক্ষণ ঝুলে থাকলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরপর একাধিক ঢেউয়ের আঘাতে ট্রলারের পাশ থেকে আমরা অনেক দূরে চলে যাই। এতে নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে ট্রলারের সঙ্গে থাকা চারজনের কাছ থেকে চিৎকার দিয়ে চিরবিদায়ও নিয়েছিলাম।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিভীষিকাময় ওই দিনের কথাগুলো বলছিলেন ট্রলারডুবির চার দিন পর জীবিত উদ্ধার হওয়া নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আফছার উদ্দিন।

আফছার উদ্দিন বলেন, ‘চিরবিদায় নেওয়ার পর আমি আর সোহেল সাগরে থাকা বাঁশের সঙ্গে বাঁধা একটি তেলের ড্রামের দুপাশ ধরে ঝুলে থাকলেও আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জাফর উদ্দিন। সকালের সূর্য ওঠার পর আমি আর সোহেল ড্রামটি ধরে থাকলেও আশপাশে কোথাও জাফরকে দেখা যায়নি। এরপর শুরু হয় ঝড়, বৃষ্টি আর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই। একে একে চার দিন পার হওয়ার পরও যখন আশপাশে কোনো ট্রলার বা জাহাজ দেখা যাচ্ছিল না, তখন বাঁচার শেষ আশাটুকু ছেড়ে দিয়েছিলাম। অন্যদিকে শরীরের অনেক অংশ ঠুকরে খেয়েছে সামুদ্রিক মাছ।’

সাগরের মোহনায় ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজের চার দিন পর দুই জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছেআফছার উদ্দিন আরও বলেন, ‘সাগরে পড়ে যাওয়ার প্রথম দিন থেকে সোহেল বারবার অচেতন হয়ে পড়েন। রাতে-দিনে একাধিকবার ডাকাডাকি করলেও সোহেলের কাছ থেকে সব সময় সাড়া পাওয়া যেত না। মাঝেমধ্যে তিনি কথা বলতেন। আবার মাঝে মাঝে আমার মনে হতো সোহেল বুঝি আর নেই, আমি একা কীভাবে বেঁচে থাকব! তিন দিন শেষ হওয়ার পর চতুর্থ দিন ভোরে যখন সূর্য ওঠে তখন আল্লাহকে ডেকে বলেছিলাম, হে আল্লাহ, হয় আমাদের কোনো ট্রলারের মাধ্যমে বাঁচিয়ে নাও, না হয় মৃত্যু দাও। এভাবে ভাসা আর ডোবায় শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। সেই সময়টুকুতে ঘুম বা ক্ষুধা কিছুই মনে ছিল না। যখন সকাল হতো, বিসমিল্লাহ বলে সাগর থেকে এক মুঠো পানি নিয়ে পান করতাম। আবহাওয়া খারাপ থাকায় ওই কয় দিন আশপাশে কোনো মাছ ধরার ট্রলার বা জাহাজ কিছুই দেখা যায়নি। চতুর্থ দিন দুপুরের দিকে জোয়ারে ঢেউয়ের সঙ্গে যখন ওপরের দিকে উঠি, তখন দূরে মাছ ধরার একটি ট্রলার দেখতে পাই। কিন্তু ঢেউয়ে নিচে নেমে যাওয়ার পর যখন পুনরায় ওপরে উঠি, তখন আর তা দেখতে পাইনি। কোনদিকে দেখেছি, সেটাও ভুলে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর আবারও ট্রলারটি দেখতে পেয়ে ড্রামের সঙ্গে থাকা একটি ছোট বাঁশের ভাঙা অংশে পতাকার ছেঁড়া অংশ লাগিয়ে এক হাত দিয়ে ড্রাম ধরে অন্য হাত দিয়ে পতাকাটি ওপরের দিকে তুলে নাড়তে থাকি। যেন ট্রলারটির নজরে পড়ে। প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর পতাকাটি ওই ট্রলারে থাকা মাঝির নজরে পড়ে। তাৎক্ষণিক তিনি ট্রলার নিয়ে দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসেন। ট্রলার থেকে আমাদের লক্ষ্য করে একটি দড়ি ছুড়ে মারলে ওটা ধরে আমরা দুজন ট্রলারের কাছে আসি। পরে তাঁরা আমাদের ট্রলারে তুলে নেন। ততক্ষণে শরীর আর কোনো কাজ করছিল না, আমরা দুজন অচেতন হয়ে পড়ি। পরে ওই ট্রলারের মাঝি আমাদের সুন্দরবনের পাথরঘাটা ঘাটে নিয়ে যান। এখনো নিখোঁজ আটজন ট্রলারের ইঞ্জিনরুমের মধ্যে আটকা পড়েছিল। দুর্ঘটনার সময় বৃষ্টি ছিল বলে তারা কেবিনের মধ্যে অবস্থান করেছিল। আমরা যখন সাগরে পড়ে যাই, তখন ইঞ্জিনরুম থেকে অনেক সময় ধরে তাঁদের চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম। আমার ধারণা, ট্রলারের ইঞ্জিনরুমে ব্যাটারির অ্যাসিড ও ডিজেলের গ্যাসে তাদের সেখানে মৃত্যু হয়েছে। ট্রলারটির সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ 

ডুবে যাওয়া ট্রলারের মালিক হাতিয়ার জাহাজমারা আমতলী গ্রামের বাসিন্দা লুৎফুল্লাহিল মজিব নিশান সরকারের কাছে দাবি করে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাগরে মাছ শিকার করা জেলেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু এই আর্থিক সেক্টরটির দিকে সরকারের তেমন সুদৃষ্টি নেই। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া প্রতিটি ট্রলারে যদি জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু থাকে, তাহলে অন্তত এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটত না। সাগরের যেকোনো সীমান্তে আটকা পড়লে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারটি পার্শ্ববর্তী ট্রলারের অবস্থান যেনে সহযোগিতা পেত। তাই ট্রলারমালিকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট মূল্য নিয়ে হলেও জিপিএস সিস্টেম চালু করার দাবি জানাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট রাতে বঙ্গোপসাগরের মইডুবি এলাকার সাগরের মোহনায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১৫ জেলে নিয়ে ডুবে যায় এফবি নিশাত নামের ট্রলারটি। ওই দিন পার্শ্ববর্তী একটি ট্রলারের সাহায্যে চার জেলেকে উদ্ধার করা হয়। এর চার দিন পর আরও তিনজনকে জীবিত উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো আট জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দুয়ারেই বিষাক্ত ধোঁয়া দম বন্ধ পড়াশোনা

জিল্লুর রহমান, মান্দা (নওগাঁ)
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই ইটভাটা। সম্প্রতি নওগাঁর মান্দা উপজেলার সাবাইহাট এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই ইটভাটা। সম্প্রতি নওগাঁর মান্দা উপজেলার সাবাইহাট এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

বিদ্যালয়ের আঙিনায় ভাসছে বিষাক্ত ধোঁয়া। নওগাঁর মান্দা উপজেলায় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অদূরে দীর্ঘদিন ধরে একটি ইটভাটা পরিচালিত হওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে কোমলমতি পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী। ইটভাটার লাগাতার কার্যক্রমে প্রতিদিনই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা। শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা ও অসুস্থতায় ভুগেও ক্লাসে বসতে হচ্ছে শতাধিক শিক্ষার্থীকে। নিরাপদ শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের বদলে কালো ধোঁয়ার নিচে বড় হচ্ছে তাদের শৈশব—যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে উপজেলার সাবাইহাট এলাকার ঝাঁঝরের মোড়ে ‘যমুনা ব্রিকস’ নামে ইটভাটাটি স্থাপন করা হয়েছে। ভাটার মাত্র ২৫০ মিটার দূরে রয়েছে একরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একরুখী উচ্চবিদ্যালয়। আশপাশে রয়েছে আবাসিক এলাকা ও দুটি আমবাগান। গোসাইপুর গ্রামের কার্তিক চন্দ্র মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি ভাটাটি পরিচালনা করেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ফিক্সড চিমনির মাধ্যমে ইট পোড়ানো হচ্ছে। কয়লার পাশাপাশি কাঠের খড়ি ব্যবহার করায় ধোঁয়ার মাত্রা আরও বেড়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে বসে পড়াশোনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১৩ সালের সংশোধনী) অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা ও বাগানের ১ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনা নিষিদ্ধ। তবে এই আইন অমান্য করেই প্রায় ২০ বছর ভাটাটি পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

একরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, গত বছর ভাটা চালু হওয়ার পর তার এক সহপাঠী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং চিকিৎসা নিতে হয়। অনেক শিক্ষার্থী শ্বাসকষ্টে ভোগে বলেও জানায় সে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান কামরুল বলেন, ইটভাটাটি নিয়ে তেমন কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে কিছুদিন আগে ভাটামালিক ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন।

জানতে চাইলে ভাটামালিক কার্তিক চন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েই ভাটার কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আগামী বছর থেকে আর ব্যবসা করব না।’

এ বিষয়ে ইউএনও আখতার জাহান সাথী বলেন, যমুনা ব্রিকসের পরিবেশ ছাড়পত্র ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে লাইসেন্সবিহীন সব ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

খাগড়াছড়ির ১ আসন

ভোটের মাঠে: জয়ের সমীকরণ পাল্টেদেবে পাহাড়ি ভোটার

  • স্বতন্ত্র ও আঞ্চলিক দলের প্রার্থীরা হেভিওয়েটদের জয়ে বড় বাধা হতে পারে।
  • পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীর মানুষ আমাকে সমর্থন দিয়েছে: বিএনপির প্রার্থী
নীরব চৌধুরী বিটন, খাগড়াছড়ি
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল পাহাড়ি এলাকার তিনটি সংসদীয় আসনের মধ্যে একটি খাগড়াছড়ি। আসনটিতে বিভিন্ন দলের হেভিওয়েট প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র ও আঞ্চলিক দলের প্রার্থীরাও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। স্বতন্ত্র ও আঞ্চলিক দলের এসব প্রার্থী হেভিওয়েটদের জয়ে বড় বাধা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সবুজ পাহাড়ের রাজনীতির হিসাবনিকাশ বুঝতে মূল রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আঞ্চলিক দলগুলোর ভোটের অঙ্ক কষতে হয় বিশ্লেষকদের। ভোটের সময় সেই অঙ্কে যুক্ত হয় পাহাড়ি-বাঙালি সমীকরণ। এবার জয়ের সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে পাহাড়ি ভোটাররা।

২৯৮ নম্বর খাগড়াছড়ি আসনে বিএনপি, জামায়াত, স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ১৬ জন। তাঁরা হলেন বিএনপির প্রার্থী আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, জামায়াতের এয়াকুব আলী, ইসলামী আন্দোলনের মো. কাউসার, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশের নুর ইসলাম। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী সমীরণ দেওয়ান, সন্তোষিত চাকমা, লাব্রিচাই মারমা, ধর্ম জ্যোতি চাকমা, সোনা রতন চাকমা, স্বতন্ত্র প্রার্থী জিরুনা ত্রিপুরা, জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী মিথিলা রোয়াজা, খেলাফতে মজলিস মনোনীত আনোয়ার হোসাইন মিয়াজী, গণঅধিকার পরিষদ মনোনীত দীনময় রোয়াজা, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ মনোনীত মো. মোস্তাফা, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি মনোনীত উশোপ্রু মারমা। এদিকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মনোনীত প্রার্থী মনজিলা সুলতানা ঝুমা।

জানা গেছে, বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দল প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও বেশ কৌশলী এবং শক্তিশালী। কারণ পাহাড়ি ভোটার। স্থানীয় আঞ্চলিক দল ও আঞ্চলিকতার প্রশ্নে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটের বাক্সে বেশ এককাট্টা স্থানীয় ভোটাররা।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নির্বাচনের ব্যাপারে আগে নীরব থাকলেও এখন তারা অনেকটা সরব। পাহাড়ের আরেক শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি জেএসএস (এমএন লারমা) সরাসরি ভোটে না এলেও পছন্দের প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়ার কথা বলছে। ফলে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জয়ে আশার বাতিঘরে কিছুটা হতাশাও বেশ প্রকাশ্যে। এ ছাড়া প্রার্থীর যোগ্যতা, ভোটারদের বিগত দিনের বিশ্লেষণ এবং হিসাবনিকাশে জয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে পারে আশাবাদী দলগুলো।

আঞ্চলিক দলগুলো নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার আগপর্যন্ত পাহাড়ের ভোটের যে সমীকরণ ছিল; এখন সেটা পাল্টে গেছে। কারণ আঞ্চলিক দলগুলো নির্বাচনে না এলে ভোটের মাঠ অনেকটা বিএনপি ও জামায়াতের দখলেই থাকত। কিন্তু ইউপিডিএফ ও জেএসএসের নির্বাচনে থাকার ঘোষণা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতুন মাত্রা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের ধারণা, আগামী নির্বাচন সরল-দ্বিমুখী লড়াইয়ের বদলে কোথাও কোথাও কঠিন-ত্রিমুখী লড়াইয়ে পরিণত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বিএনপি। যদিও আওয়ামী লীগহীন এই নির্বাচনে বিএনপি সারা দেশেই বড় জয়ের আশা করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ভোট কোন বাক্সে পড়বে, সেটিও দেখার পালা এবার।

পাল্টে যাওয়া সমীকরণ

এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য খাগড়াছড়িতে জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রার্থী ঘোষণার আগ থেকেই গণসংযোগে রয়েছেন। প্রার্থিতা ও তফসিল ঘোষণার পর প্রচারে আরও সরব হয়ে উঠেছেন তিনি। ইউপিডিএফ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণার আগপর্যন্ত এখানে ওয়াদুদ ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত এয়াকুব আলীকে ধরা হলেও এখন সমীকরণ পাল্টে গেছে।

বিএনপির প্রার্থী ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি আগেও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। জনগণ আমাকে চিনে। জেলার বেশির ভাগ সড়ক, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, বিহার আমার সময়ে নির্মিত হয়েছে। পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীর মানুষ আমাকে সমর্থন দিয়েছে। এরই মধ্যে চাকমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ স্বতন্ত্রভাবে আমার সমর্থনে সমাবেশও করেছে।’

জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এয়াকুব আলী বলেন, ‘আমরা এমন একটি বাংলাদেশ তৈরি করব, যেখানে নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে, নিরাপত্তা নিয়ে ভয়হীন দেশে ইনসাফের সঙ্গে বসবাস করবে। পাহাড়ি-বাঙালি মিলেমিশে তৈরি হবে এক সম্প্রীতির বাংলাদেশ।’

জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা নির্বাচনমুখী দল। তবে এই নির্বাচনে আমরা সরাসরি কোনো প্রার্থী না দিলেও কোনো না কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেব। তবে কোনো দলকে নয়। খাগড়াছড়ির এবার পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।’

পাহাড়িদের দীর্ঘদিনের ভূমি, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানে জাতীয় দলগুলোর আন্তরিকতা নিয়ে অভিযোগও বেশ পুরোনো। এই প্রেক্ষাপটে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বসহকারে দেখছেন স্থানীয় পাহাড়ি ভোটাররা। এখানেই তাঁরা এককাট্টা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ক্ষমতার মোহে আল্লাহর আরশ কাঁপানোর মতো বেপরোয়া হলেন’

পটুয়াখালী প্রতিনিধি
হাসান মামুন। ছবি: সংগৃহীত
হাসান মামুন। ছবি: সংগৃহীত

পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী ও সদ্য বহিষ্কৃত বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুন কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

মঙ্গলবার রাত ৮টা ৩৪ মিনিটে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে হাসান মামুন বলেন, ‘সবকিছু বুঝলাম, তাই বলে মজলুম নেত্রীর ইন্তেকালের দিনে দলের ও রাজপথের মজলুম নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা? ক্ষমতার মোহে আল্লাহর আরশ কাঁপানোর মতো বেপরোয়া হলেন?’

এর আগে সন্ধ্যা ৭টা ১৪ মিনিটে আরেক পোস্টে হাসান মামুন বলেন, বিএনপি থেকে বহিষ্কারের আগেই তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এ-সংক্রান্ত দুটি ছবি তিনি পোস্ট করেন, যেখানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের স্ক্রিনশট সংযুক্ত ছিল। পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ২৮ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

পরে সন্ধ্যা ৭টা ২৬ মিনিটে দেওয়া আরেক পোস্টে হাসান মামুন লেখেন, ‘বিএনপির সিদ্ধান্ত পূর্বনির্ধারিত। আমি আগেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। নেতা-কর্মীদের সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ ও ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে দেওয়া পৃথক এক পোস্টে হাসান মামুন প্রশ্ন তোলেন, ‘ময়মনসিংহের ফখরুদ্দিন বাচ্চুকে বহিষ্কার, তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে মামলা করার কত দিন পরে ডেকে এনে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও সঙ্গে মনোনয়ন দেওয়া হলো?’

এরপর রাত ৮টা ৪০ মিনিটে আরেক পোস্টে হাসান মামুন লেখেন, ‘বিএনপির সকল সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পটুয়াখালী-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন হাসান মামুন। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসনটি গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে ছেড়ে দেয় বিএনপি। এরপরও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন এবং সোমবার মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। একই সঙ্গে তিনি নিজ উদ্যোগে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এসব কর্মকাণ্ড বিএনপির গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলার পরিপন্থী হওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে হাসান মামুনকে দলের সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ শফিকুল মারা গেছেন

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ শফিকুল ইসলাম (৩৫) মারা গেছেন। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৭টায় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

নিহত শফিকুল ইসলাম আব্দুল সামেদ ও রোকেয়া বেগম দম্পতির ছেলে। তাঁরা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গী পূর্ব এলাকায় বসবাস করেন। তিনি গাজীপুরের গেজেটভুক্ত জুলাই যোদ্ধা। হালুয়াঘাট উপজেলার দর্শারপাড় গ্রামের বাসিন্দা।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুরে উত্তরা আজমপুরে ডান পায়ের ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হন শফিকুল। তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে সরকার তাঁকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে সব কাগজপত্র ব্যবস্থা করলে তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সম্প্রতি তাঁর জ্বর ও অন্যান্য শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গতকাল সোমবার গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফিকুল ইসলাম মারা যান।

এদিকে তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। স্বজন, সহযোদ্ধা ও এলাকাবাসী তাঁকে একজন সাহসী জুলাই যোদ্ধা হিসেবে স্মরণ করছে।

হালুয়াঘাট জুলাই শহীদ ও আহত সেলের প্রতিনিধি রিদওয়ান সিদ্দিকী জানান, শহীদ শফিকের জানাজা নামাজ বুধবার সকাল ১০টায় হালুয়াঘাট উপজেলার দর্শারপাড় মামা পাগলা মাজার মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে তাঁকে হালুয়াঘাটে নিজ এলাকায় দাফন করা হবে।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি নুরুল ইসলাম সাদ্দাম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, আজ হলুয়াঘাটের এক আহত জুলাই যোদ্ধা শফিকুল ইন্তেকাল করেছেন। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রায় দেড় বছর ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন।

নিহত শফিকুলের ছোট বোনের স্বামী শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মরদেহ হালুয়াঘাটে নেওয়ার জন্য একটি ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমরা গাজীপুরে শফিকের জানাজা শেষে হালুয়াঘাটের উদ্দেশে রওনা হই। বুধবার জানাজা শেষে তাঁর দাফন করা হবে।’

শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া আরও বলেন, সরকার থেকে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। তবে জুলাই যোদ্ধা শফিক বিদেশ যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সম্প্রতি গুলির স্থানে ইনফেকশন হয়, যে কারণে জ্বর আসে। পরে সোমবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফিক মারা যান। চিকিৎসক জানিয়েছেন, নিউমোনিয়া ও গুলির স্থানে ইনফেকশনের কারণে তিনি মারা গেছেন।

হালুয়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফেরদৌস আলম বলেন, জুলাই যোদ্ধা শফিক গাজীপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

এ বিষয়ে হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলিনুর খান বলেন, মৃত্যুর খবর পেয়ে মরদেহে হালুয়াঘাটে আনার জন্য ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে। বুধবার সকাল ১০টায় তাঁর জানাজা হবে। সেখানে উপস্থিত থেকে যথাযথ মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হবে। একই সঙ্গে নিহতের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত