Ajker Patrika

ইসরায়েলকে ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের হাওয়া, নেতৃত্বে সৌদি–ইরান

আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১৬: ৩০
ইসরায়েলকে ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের হাওয়া, নেতৃত্বে সৌদি–ইরান

মাত্র এক বছর আগেও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল সৌদি আরব। যা মূলগতভাবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই বদলে দিতে পারত। একই সঙ্গে, ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরানকে একঘরে করে ফেলত দারুণভাবে। পাশাপাশি, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রশ্ন নিয়েও কোনো কথা উঠত না জোরালোভাবে।
 
কিন্তু বর্তমানে সৌদি আরব–ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি অতীতের যেকোনো সময়ের বিবেচনায় সুদূর পরাহত। যদিও হামাসের প্রধান ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে হত্যার পর গাজায় একটি যুদ্ধবিরতির আশা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এরপরও বিষয়টি আর ইসরায়েলের পক্ষে যাচ্ছে না।

চির বৈরী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ করে তুলছে সৌদি আরব। দেশটি ইঙ্গিত দিয়েছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া রিয়াদ তেল আবিবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না। এটি সৌদি আরবের অবস্থানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।

এ ছাড়া ভারত মহাসাগরে যৌথ নৌ-মহড়া শুরু করেছে ইরান, রাশিয়া ও ওমান। এতে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকছে— সৌদি আরব, ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, কাতার ও বাংলাদেশ।

স্পষ্টত, মধ্যপ্রাচ্যে একটি কূটনৈতিক দাঁতাত (উত্তেজনা প্রশমন প্রক্রিয়া) চলমান। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেমনটা পরিকল্পনা করেছিলেন, এই দাঁতাত তার ধারেকাছেও নেই। নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, তাঁর দেশ রিয়াদের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চায়। কিন্তু সম্প্রতি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সাক্ষাৎ করেছেন, যা ইতিহাসে প্রথম।

এই পরিবর্তন নড়বড়ে হলেও ইরানের সঙ্গে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় বৈরীভাব দূর করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, এই বৈরিতার কারণে এই অঞ্চলে বিগত কয়েক দশকে যে রক্তপাত হয়েছে তা বন্ধ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ হাজির করেছে এটি।

কেবল উপসাগরীয় দেশগুলো নয়, সৌদি আরবও সফর করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। সফর করেছেন ইরাক ও ওমানে। যাতে করে দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা প্রশমন সম্ভব হতে পারে। এর বাইরে তিনি, জর্ডান, মিশর ও তুরস্ক সফর করেছেন। বিগত ১২ বছরের মধ্যে এ–ই প্রথম কোনো ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশর সফর করলেন।

গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তুরস্ক সফরকালে ইস্তাম্বুলে বলেন, ‘এই অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি, গাজা–লেবাননের যুদ্ধ এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের বিষয়ে এখন আমাদের একটি সাধারণ অভিযোগ আছে।’ এর ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, এই ইস্যুগুলোতে তিনি যেসব দেশ সফর করেছেন তাদের অবস্থান একই না হলেও খুবই কাছাকাছি।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যখন বারবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি অস্বীকার করছেন, তখন সৌদি আরব গণমাধ্যম এবং কূটনৈতিক ফোরাম সবজায়গাতেই এই ইস্যুকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বলেছে, ইসরায়েল যদি আমাদের পাশে পেতে চায় তাহলে একমাত্র পথ হলো— ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

netanyahu-2গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত চাপা পড়া শিশুদের ছবি, মৃত সন্তানের সামনে মায়েদের আহাজারি এবং ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য প্রবেশে ইসরায়েলি বাধাদানের চিত্র—এ সব কিছুই সৌদি আরবের নেতৃত্বকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইস্যুকে উপেক্ষা করা অসম্ভব করে তুলেছে।

সৌদি ব্যবসায়ী ও রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ এবং নিওম প্রকল্পের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য আলি শিহাবি বলেন, ‘গাজা যা করেছে, তা হলো—এই অঞ্চলে ইসরায়েলের অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি পিছিয়ে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি আরব দেখছে যে, ইসরায়েলের সঙ্গে যেকোনো সম্পর্ক গাজার ঘটনার পর থেকে ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। যদি না ইসরায়েলিরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি না দেখায়—ইসরায়েল ক্রমাগত এই দাবি অস্বীকার করছে—তাহলে এই অবস্থান খুব একটা বদলাবে না।’

এখন পর্যন্ত সৌদি আরব ও এর উপসাগরীয় মিত্ররা ইরানের কূটনৈতিক পদক্ষেপের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দিহান। কারণ, ইরানের দুই তথাকথিত প্রক্সি হামাস ও হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করলেও অন্য প্রক্সি ইয়েমেনের হুতিদের অস্ত্র ও সমর্থন করে যাচ্ছে। আর হুতিরা একসময় সৌদি আরবের তীব্র বিরোধিতা করেছে। এ বিষয়ে আলি শিহাবি বলেন, ‘ইরানিরা রিয়াদের প্রতি হাত বাড়ালে সৌদি আরব কখনো ফিরিয়ে দেবে না। আর ইরান যদি সত্যই আন্তরিক হয়, সেটি হবে মধ্যপ্রাচ্যের সত্যিকারের পুনর্গঠন।’

সৌদি আরব ও ইরান দীর্ঘকাল ধরে আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই করে চলেছে। এই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত ইসলামের প্রধান দুই ভাগের—সুন্নি ও শিয়া—মধ্যকার লড়াই থেকে উদ্ভুত। আর হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতি ইরানের সেই আধিপত্যের আকঙ্ক্ষারই ফসল।

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করে সাড়ে ১১ শ জনকে হত্যা করে। জিম্মি করে আড়াই শ জনের বেশি ইসরায়েলিকে। সেই ঘটনার পর ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ আগ্রসান শুরু করে। সেই হামলায় এখন পর্যন্ত ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে লাখখানেক।
 
gaza-1আলি শিহাবির মতো সৌদি রাজপরিবাবের ঘনিষ্ঠ অনেকেই মনে করেন, সৌদি আরবে গণতন্ত্র না থাকলেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জনমতের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। গত বছর ইসরায়েলের ব্যাপারে সৌদি আরবে সাধারণ মানুষের মত অনেকটাই কঠোর হয়ে উঠেছে।

উপসাগরীয় অঞ্চলেরে দেশগুলোর জনসংখ্যার একটা বড় অংশই তরুণ। ২০২২ সালে সৌদি আরবের নাগরিকদের গড় বয়স ছিল ২৯ বছর। এই অঞ্চলের দেশগুলোর তরুণরা প্রতিনিয়তই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মারফত গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের নির্মম চিত্র দেখতে পাচ্ছে। যা ইসরায়েল সম্পর্কে তাদের মনে যতটুকুও বা ইতিবাচক—নিদেনপক্ষে দ্ব্যর্থক—মনোভাব ছিল তাও বদলে দিয়েছে ঘৃণায়।

গত বছরের অক্টোবরের আগে সৌদি আরব ইসরায়েলের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র রিয়াদের সঙ্গে একটি বর্ধিত প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিতে সমর্থন দেওয়ার কথা ছিল। এর আগে, উপসাগরীয় কিছু দেশ ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের আওতায় ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে দেশগুলো তখন তাদের হাতে থাকা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ও স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার সুযোগটি ব্যবহার করারই আলাপ তোলেনি।

রিয়াদ দীর্ঘদিন ধরে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ব্যাপারে সোচ্চার সমর্থক ছিল। তবে নানা কারণে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই বিষয়টি সৌদি আরবের বৈদেশিক নীতিতে কম অগ্রাধিকার পেয়েছে। কারণ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁর ক্ষমতাকে দৃঢ় করার পাশাপাশি দেশের আঞ্চলিক ও দেশীয় নীতিগুলোকে নতুন আকার দিয়েছেন। গত বছর সৌদি আরব যখন ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আলোচনা চালিয়েছে তখনও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শর্ত হিসেবে উত্থাপিত হয়নি। বরং সে সময় রিয়াদের দাবি ছিল, ইসরায়েল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে—যেটি পশ্চিম তীর শাসন করে—আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতা প্রসারিত করার অনুমতি দেবে।

কিন্তু গাজার পরিস্থিতি এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। কিছুদিন আগে, সৌদি যুবরাজ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ওকালতি করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর উপদেষ্টা পরিষদে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, ‘সৌদি আরব পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত প্রচেষ্টা বন্ধ করবে না এবং আমরা নিশ্চিত করছি যে, সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে এটি ছাড়া কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না।’ একই ধরনের ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন ইউএস স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে।

Lebanonযুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আব্রাহাম অ্যাকর্ড চুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতা করেছিলেন। কিন্তু এই চুক্তি কাঙক্ষিত শান্তি আনতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যে। যেসব আরব রাষ্ট্র এই অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেছে তাদের কেউই বিগত কয়েক দশকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি এবং তার চেয়েও বড় কথা এই চুক্তিতে ইরান এবং সিরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ এই দুটি দেশের সঙ্গেই ইসরায়েলের সক্রিয় বিরোধ আছে।

ইরানের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর বৈঠক এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে যার মাত্র কয়েক দিন আগে তেহরান ইসরায়েলে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালিয়েছে। ইরান বলেছে, ইসরায়েলি হামলায় নিহত হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ, গুপ্তহত্যার শিকার হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলায় ইরান ১৮০ টির বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল।

ঠিক কেন ইরান উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে জোর দিচ্ছে? এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা ভাবছেন, ইসরায়েলি হামলা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হিজবুল্লাহর বেশিরভাগ শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করেছে বলেই হয়তো সময়ক্ষেপণের জন্য এই কাজ করছে। কারণ, লেবাননের এই মিলিশিয়া বাহিনী দীর্ঘকাল ধরে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী আরব মিত্র ও প্রক্সি। দীর্ঘদিন গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ও মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের শক্তি প্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার। হিজবুল্লাহ ইরানের পক্ষ থেকে বেশ ভালোই ধাক্কা দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলকে। এই অঞ্চলে হিজবুল্লাহ ছাড়া তেহরান মারাত্মকভাবে দুর্বল।

গাজায় চলমান যুদ্ধ আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকেও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি শুরু করতে বাধ্য করেছে। কারণ, তারাও নিজ নিজ জনমত নিয়ে উদ্বিগ্ন। যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত গত কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই সম্পর্কও ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে। সেই চাপের কারণেই হয়তো আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ গত মাসে বলেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজা পুনর্নির্মাণের ভার ইসরায়েলের কাঁধেও বর্তাবে। তিনি বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া গাজা যুদ্ধের পরবর্তী পদক্ষেপ সমর্থন করতে প্রস্তুত নয়।’

যদিও নেতানিয়াহু দাবি করেই চলেছেন যে, রিয়াদের সঙ্গে একটি স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরে কাজ করছে ইসরায়েল। তবে সৌদি কর্মকর্তারা, দেশের জনমতের বিস্তৃত বিভাজনকে সামনে তুলে ধরে সেই বিষয়টিকে দৃষ্টির অগোচরে পাঠিয়ে দিয়েছে।

এ বিষয়ে আলি শিহাবি বলেন, ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস মূলত একটি চটকদার বিষয়। এতে বাস্তব, স্থায়ী আঞ্চলিক শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছুই এতে ছিল না। যেসব রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেছে তারা তা করেছে—কারণ, তারা ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনে প্রভাব বিস্তারের পথ হিসেবে দেখে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসরায়েলের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ক্ষমতা বা প্রভাব নেই—যা খুবই অপমানজনক এবং ইসরায়েলিদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কোনো ইচ্ছাই নেই।’

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত