Ajker Patrika

করোনাভাইরাসের চেয়ে ভয়ংকর যে জীবাণু

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১৪: ৩২
করোনাভাইরাসের চেয়ে ভয়ংকর যে জীবাণু

গত শনিবারের হিসাব অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় কোভিডে আক্রান্ত হয়ে একজন মানুষও মারা যাননি। দেড় বছরের মধ্যে এটাই ছিল করোনায় মৃত্যুহীন প্রথম দিন। খুবই স্বস্তিকর একটি সংবাদ। তবে করোনা সংক্রমণ কমে গেছে বলে তা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীর বহু দেশে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক জায়গায় করোনাভাইরাস এখনো তাদের প্রতিপত্তি বজায় রেখেছে; বিশেষ করে রাশিয়ায় এখনো তা বিপজ্জনকভাবেই বিরাজমান।

প্রতিটি মহামারির মতো করোনা মহামারি, যাকে আমরা অতিমারি নাম দিয়েছি, একদিন কেটে যাবে। করোনার জীবাণুকে শায়েস্তা করার মালমসলা পরিপূর্ণভাবে জোগাড় করে ফেলবেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবী যে এ রকম একটি ভয়াবহ সময় কাটিয়েছিল ২০২০-২১ সালের দিকে, সেটা হয়ে যাবে ইতিহাসের অংশ। এই সময়টায় জন্ম হয়নি যাদের, তারা কল্পনাতেও আনতে পারবে না, একদা মৃত্যু কেমন ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছিল বিশ্বব্যাপী আমাদের জীবনে।

এর আগে মৃত্যু ডাল-ভাত হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর একটিই আছে—মুক্তিযুদ্ধ। সেটা বৈশ্বিক নয়, পরিপ্রেক্ষিত দেশীয়। যদিও তখন একেবারে শৈশব আমার, কিন্তু সে বয়সেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম, জীবন-মরণের সীমানা ঘুচে যাওয়া কাকে বলে।

দুই. সে একসময় এসেছিল আমাদের জীবনে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র মানুষটিও তখন মহিরুহের রূপ নিয়েছিল। সবচেয়ে মুখচোরা মানুষটিও সেদিন চিৎকার করে স্লোগান দিয়েছিল, ‘জয় বাংলা’। গ্রামগঞ্জে রাজাকার, শান্তি কমিটি আর পাকিস্তানি হানাদারদের চরম অত্যাচারের মধ্যেও একটা স্বপ্ন বুকে নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে গ্রামবাসী। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের বাইরে একটা বিরাট জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অকুতোভয়ে। সংস্কৃতিসেবীরা ট্রাকে করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে শুনিয়েছে অনুপ্রেরণাদায়ী গান। অবরুদ্ধ নগরীতে বসে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতিসেবী, অধ্যাপকেরা গোপনে সাহায্য করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধের নায়ক যিনি, তিনি তখন কারাগারে। তাঁকে হত্যা করা হবে, এই সংশয় মাথায় নিয়েই তাঁর স্বপ্নের দেশকে মুক্ত করতে চেয়েছে বাঙালিসহ এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ।

তারপর? তারপর দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা কি সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে পেয়েছি? আমরা কি সেই দেশে বসবাস করছি, যে দেশে নানা ধর্মের, নানা পেশার মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন করছে?

উত্তরটা খুবই ঘোলাটে। কোনো কোনো সূচকে মনে হয়, আমরা এগিয়ে চলেছি। কোনো কোনো সূচকে মনে হয়, পিছিয়ে যাচ্ছি আরও।

পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা হয় যেসব কারণে, তারই কয়েকটি নিয়ে আজ আলোচনা করব। এর বাইরে নিশ্চয়ই আমাদের বড় অনেক সাফল্য আছে। যাকে আমরা হতাশার জায়গা বলছি, সেগুলো চিহ্নিত করা গেলে সাফল্যগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়বে চোখে। কিন্তু এগুলোকে আড়ালে রেখে দিলে তাতে নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধকে চিনে নেওয়ার সুযোগ আর থাকবে না।

তিন. মুক্তিযুদ্ধের গান ছিল ‘গেরিলা, গেরিলা, আমরা গেরিলা, স্বাধীনতার রক্তে রাঙা আমরা গেরিলা’। সেই গেরিলাদের হাতে থাকত গ্রেনেড। হাতে থাকত রিকয়েললেস রাইফেল। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা বাহিনীর অপারেশনের কাহিনিগুলো পড়লেই বোঝা যায়, সে সময় তাদের কাছে ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’ ছিল। এক একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের অর্থ ছিল মুক্তির দিকে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। দেশের একখণ্ড মাটিকে শত্রুমুক্ত করার মানে ছিল, নিজের স্বপ্নের আরও কাছে পৌঁছে যাওয়া। যেন ভুলে না যাই, এই যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এটা শুধু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধ নয়। শুধু নৈতিক, আদর্শিক সহযোগিতাই দেশের জনগণ করেনি, তারা অস্ত্র হাতেও লড়াই করেছে। একটি পুরো দেশের কতিপয় পথভ্রষ্ট দালাল আর বিপথগামী চৈনিক কমরেড ছাড়া সবার আকাঙ্ক্ষা তখন মুক্ত দেশ। সেই দেশটি আমরা পেলাম ১৬ ডিসেম্বরে।

রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা এ দেশটিতে এরপরও গ্রেনেড হামলা হয়েছে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য গ্রেনেড ছুড়েছিল যারা, তারা কিন্তু এই মুক্ত স্বদেশেরই নাগরিক। তারা হত্যা করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। এ ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৪ সালে। সালের উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া একটি দেশে দুটি সামরিক শাসন, বিএনপি-এরশাদ শাসন পার হতে হতে দেশটার সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতিটা হয়েছিল, সেটা ছিল মূল্যবোধের। দেশের আপামর জনগণ যে আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিল, অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িকতা, সেই আদর্শে তত দিনে মরিচা পড়েছে। একদল ভুঁইফোড় দালালে ভরে গিয়েছিল দেশ, যে যেভাবে পেরেছে, আখের গুছিয়ে নিয়েছে। দেশের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে তারা এক করে দেখেনি। নিজের পকেট স্ফীত হোক, দেশ গোল্লায় যাক—এই নীতিকেই তারা জীবনাচরণের আদর্শে পরিণত করেছে। দল-মতনির্বিশেষে সবাই তত দিনে মুক্তিযুদ্ধকে শুধু ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে, জীবনাচরণের অবশ্যম্ভাবী অংশ বলে আর মনে করছে না। ফলে ২০০৪ সালের কাছাকাছি সময়ে আসতে আসতে তারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে। যে গ্রেনেড বাঙালি ছুড়েছিল বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে, সেই গ্রেনেডই তারা ছুড়েছে নিজ দেশের মানুষের দিকে। এই পরিবর্তনটি হৃদয়ঙ্গম করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নইলে বোঝা যাবে না, আমরা ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে কতটা দূরে সরে এসে কী দেশ বানালাম!

চার. টিক্কা খান যখন গভর্নর হয়ে এলেন, তখন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী (বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী) তাঁকে গভর্নর হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করাননি। ৯ মার্চ তাঁর শপথ গ্রহণের দিন ঠিক হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। বি এ সিদ্দিকী জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে, জনগণের মনের ভাষা পড়ে নিয়ে টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন।

বিচারপতি বা বিচারকদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকে। আমরা সব সময়ই মনে করি, সওয়াল-জবাবের পর বিচারক যে রায় দেবেন, তা হবে নিরপেক্ষ। তাঁর সেই নিরপেক্ষতা অর্জন করতে হয় সমাজ, দেশ, দেশের সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। মূল যে বিষয়, বিচারিক ও আইনি পড়াশোনা তো আছেই।

ইদানীং আমরা নিম্ন আদালতের কয়েকটি রায় ও পর্যবেক্ষণ দেখেছি, তাতে দৃশ্যমান হয়েছে, আদালত যে রায় বা পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা আদালতের স্বাভাবিক রীতি-নীতির বাইরে। পরীমণিকে বারবার রিমান্ডে দেওয়ার ঘটনা কিংবা বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণবিষয়ক মামলার পর্যবেক্ষণ বিচলিত করেছে সাধারণ মানুষকেও। উচ্চ আদালতে ক্ষমাও চাইতে হয়েছে বিচারকদের।

এমন এক দেশ নির্মাণ করলাম আমরা, যে দেশে বিচারক তাঁর মর্যাদা ধরে রাখতে পারেন না! তাঁর বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে হয়! যদি সত্যিই স্বাধীনতার অর্থ তিনি বুঝতেন, তাহলে আরও অনেক বেশি বুঝতে পারতেন মানুষকে। পড়তে পারতেন মানুষের মনের কথা। পড়তে পারতেন আইনের কথা। মানবিকতা বজায় রেখে কীভাবে আইনের সঙ্গী হয়ে পর্যবেক্ষণ দিতে হয়, সেটা তাঁকে শিখিয়ে দিতে হতো না।

আমাদের স্বাধীনতার অর্থ এখানে এসেও খেই হারিয়ে ফেলেছে।

পাঁচ. ১৯৭১ সালে আমরা বসবাস করতাম ঢাকা শহরের শান্তিনগর এলাকার চামেলীবাগে। আবুজর গিফারী কলেজ ছিল মালিবাগে। এখনকার মৌচাক মার্কেটের বিপরীতে। সে কলেজেরই ছাত্র সংসদের সম্পাদক ছিলেন ফারুক ইকবাল। ১ মার্চ যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করেন, তখনই ঢাকা হয়ে ওঠে মিছিলের শহর। সেই উত্তাল দিনগুলোর একটি ছিল ৩ মার্চ। সেদিন দৈনিক ইত্তেফাকের মূল শিরোনাম ছিল ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। সেদিনই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ফারুক ইকবাল। সে খবর বিদ্যুতের গতিতে এসে পৌঁছেছিল আমাদের পাড়ায়। পাড়ার বৃদ্ধ, যুবক, শিশু বেরিয়ে পড়েছিল ফারুক ইকবালের লাশ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মিছিলে যোগ দিতে।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে যে তরুণটি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, তাঁর নাম নূর হোসেন। গরিব এই অটোরিকশাচালক নিহত হয়েছিলেন নিজ দেশের পুলিশের গুলিতে। বাইরের কোনো শক্তি তাঁকে হত্যা করেনি।

সরলভাবেই বোঝা যায়, আইয়ুব-ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মারা এই স্বাধীন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একইভাবে হত্যা করছে দেশের সাধারণ মানুষকে।

ছয়. এরপর আরও কত ঘটনা ঘটেছে। হরতাল চলাকালে বিশ্বজিৎ হত্যা, হরতালের নামে বাসে-গাড়িতে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা, বাংলা ভাইয়ের উত্থান, হোলি আর্টিজান, ক্যাসিনো কারবারসহ যা যা ঘটে চলল, তার কোথাও মানুষের প্রতি মমতা নেই। ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই।’

এই যে দেশপ্রেমহীনতার জীবাণু আমাদের ভেতরে ঢুকেছে এবং নিশ্চিন্তে বসবাস করছে, তা করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর। করোনা তো চলে যাবে, কিন্তু এই ভাইরাস নির্মূল করবে কে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...