বিয়ের ১৪ বছর পর অনেক সাধ্য সাধনায় জন্ম শ্রেয়া বালার (৭)। আদরের সন্তানকে প্রতিদিন স্কুলে থেকে আনা-নেওয়া করেন মা বুলি বালা। কিন্তু শনিবার ফেরার পথে বাবার দোকান গিয়ে তাঁর কাছে থেকে টাকা নিয়ে কিছু খাওয়ার আবদার করেন শ্রেয়া। আর সেই আবদার রাখতে মেয়েকে নিয়ে তার বাবার দোকানে যেতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় শ্রেয়া।
আজ শনিবার সকাল ১০টার দিকে যশোরের চৌগাছা শহরের পুরাতন মাইক্রোবাসস্ট্যান্ডে একটি নির্মাণাধীন ভবনের পাঁচ তলা থেকে ইট পড়ে মৃত্যু হয় শ্রেয়ার। এ ঘটনায় তার মা বুলি বালা আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ভবনটির সম্মুখে সড়কের বিপরীত পাশেই শ্রেয়ার বাবার দোকান।
শ্রেয়া চৌগাছা শহরের রাগিব আহসান নিহাল আইডিয়াল স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিরিবিলিপাড়ার ভাড়াটিয়া শংকর কুমার বালা ও বুলি বালা দম্পতির একমাত্র সন্তান। তাদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলার একটি গ্রামে। শ্রেয়ার বাবা দীর্ঘদিন চৌগাছা শহরে বসবাস করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয় ও চাঁদশীর (ক্ষত) চিকিৎসালয় পরিচালনা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী শাহিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা তিনজন ঘটনাস্থলের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় বাচ্চাটি ও তার মা স্কুল থেকে এসে সেখান দিয়ে বাবার দোকানে যাচ্ছিল। হঠাৎ ওপর থেকে গাঁথুনি করা কয়েকটি ইট ধসে পড়লে প্রথমে মেয়েটির মা মাটিতে পড়ে যান। পরপরই বাচ্চাটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমরা দ্রুত উদ্ধার করি। তখন বাচ্চাটি রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। উদ্ধারের পর দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট যশোর জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে শ্রেয়ার মৃত্যু হয়। শ্রেয়ার মাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে নেওয়া হয়।
শ্রেয়ার মা বুলি বালা বলেন, ‘আমাদের বিয়ের ১৪ বছর পর অনেক সাধনার পর শ্রেয়ার জন্ম। ওকে আমি প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাই। সেখানে ক্লাস এবং প্রাইভেট পড়ার পর কিছু সময় খেলাধুলা করে তবে বাড়িতে ফেরে। তবে আজ (শনিবার) প্রাইভেট শেষ করেই শ্রেয়া আমাকে বলে—আম্মু আমার খুব খিদে পেয়েছে, চলো আব্বুর দোকান থেকে টাকা নিয়ে কিছু খেয়ে তারপর বাড়ি যাব। আমরা ওর আব্বুর দোকানের প্রায় সামনে পৌঁছে দেখি দোকান বন্ধ। তখন কিছুক্ষণের জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকি। এ সময়ই ওপর থেকে কয়েকটি ইট পড়লে আমি নিজেও পড়ে যাই। স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করতেই দেখি আমার কলিজার টুকরা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পরে আমাকে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে আমার মা জননীকে যশোর নিয়ে যায়।’
এ সময় কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমি এখন কী নিয়ে থাকব? আমার মেয়ে যে না খেয়েই চলে গেল!’
ঘটনার পরপরই চৌগাছা থানা-পুলিশের একটি দল ও চৌগাছার পৌরসভার কয়েকজন কাউন্সিলর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে পৌরসভার কাউন্সিলর সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পাঁচ তলায় মেশিনে তৈরি ইটের পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনি ছিল। সেখানে একজন শ্রমিক কাজ করছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ওই শ্রমিকের পেছন দিকে ধাক্কা লেগে দেয়ালটি ধসে পড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
শ্রেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘শ্রেয়া আমার স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। ও ক্লাসে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে সব সময় দ্বিতীয় বা তৃতীয় হতো। আমি যখন বলতাম প্রথম হতে হবে, তখন শুধুই মুচকি হাসত।’
শিক্ষক আরও বলেন, ‘শ্রেয়া গতকালও (শুক্রবার) স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। আজও স্কুল থেকেই ওর মার সঙ্গে ফিরছিল।’
এ বিষয়ে চৌগাছা থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মেহেদী হাসান বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। বিষয়টির পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।’
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে