‘পাঠান’ ছবি দিয়ে হইহই রইরই করে ফিরে এসেছেন বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান। চার বছর পর ফিরেছেন হলে। একের পর এক রেকর্ড করছে পাঠান। ছুটির দিনে মুক্তি পায়নি, তবু প্রথম দিনে সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড, ভারতে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৫০০ হলে মুক্তি পাওয়ার রেকর্ড। রেকর্ডের ওপরে রেকর্ড। আমাদের আলোচনার বিষয় সেটা নয়, আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের হলে ছবিটির মুক্তি। এ নিয়ে উত্তাল আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গন।
কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে আমার এই ভাবনাটা এসেছিল। ওখানকার গৃহবধূ, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বিনোদনের একটা বিশাল জায়গা দখল করে আছে হলে গিয়ে ছবি দেখা। আমি প্রধানত নারীদের কথাই বলছি। এখনো তাঁদের সিনেমাকেন্দ্রিক উদ্যাপন। পুরুষ-নারী, বন্ধুবান্ধব, স্বজন- রিজননির্বিশেষে দল বেঁধে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা রীতিমতো নৈমিত্তিক বিনোদনের মতো। অথচ আমরা?
আমাদের দেশে এই সময়ে যা প্রায় কল্পনারও অতীত। দল বেঁধে বাড়ির নারী-পুরুষেরা হলে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে—এমন দৃশ্য গত দুই দশকে কেউ কল্পনাও করতে পারে না। অথচ মাত্র তিন দশক আগেও বাড়িতে নতুন জামাই মানে দল বেঁধে সিনেমা হলে যাওয়া, কোনো পারিবারিক সম্মিলন মানে স্বজন-পরিজনসহ সিনেমা হলে যাওয়া। পাড়াতো বউ-ঝিরা মিলেমিশে একটা বাইরে সন্ধ্যা মানে সিনেমা। বন্ধুদের একসঙ্গে সবচেয়ে আনন্দময় সময় মানে সিনেমা। হলকেন্দ্রিক সিনেমা। আমাদের জেনারেশনের আগে তো বটেই, পরেরও কয়েক জেনারেশনের মধুময় সময় সিনেমা হলকেন্দ্রিক। বাড়ি পালানো, বাবার পকেট চুরি, ব্ল্যাকে টিকিট কাটা—এসবই ছেলেদের কৈশোর, যৌবনের মধুর স্মৃতি। আর নারীরা? সুযোগ তৈরি করে, কখনো সন্ধ্যায় না হলে বিকেলে ম্যাটেনি শো। পড়শি-বউ-সখীদের সঙ্গে মিলে এক একটি স্মরণীয় দিন হয়ে উঠত তাদের শুধু সিনেমা হলকেন্দ্রিক। নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে কে কার আগে দেখতে পারে—প্রতিযোগিতা ছিল। পাড়ায় সবার আগে দেখা মানুষটির গুরুত্বই ছিল অন্য রকম। আর অবসন্ন বিকেল কিংবা সান্ধ্য গল্পে সিনেমার গল্প শোনার চেয়ে আনন্দময় সময় নারী মহলে ছিল না।
সেদিন হয়েছে বাসি। দেশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ধস নেমেছে। তার পেছনের কারণ অনুসন্ধান অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু একের পর এক হল বন্ধ হয়েছে। ঢাকায় বড় আর নামকরা বিশাল বিশাল হল এখন শপিং মল। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরও খারাপ। একাধিক সিনেমা হল ছিল কোনো কোনো শহরে। সব কয়টি বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। সিনেমা দেখার এবং দেখানোর সংস্কৃতি এ দেশে এখন মৃত। তার ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। বিনোদনের স্থান নিয়েছে অন্ধত্ব। সমাজ অসংস্কৃত থেকে বর্বরতার দিকে যাত্রা করছে ক্রমেই। আমাদের প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি কোনোভাবেই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। না নান্দনিকভাবে, না বাণিজ্যিকভাবে।
সিনেমা দেখার রীতিটি বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত। যা একটু-আধটু টিকে আছে তা রাজধানীর সিনেপ্লেক্সকেন্দ্রিক। সিনেপ্লেক্সে যে পরিমাণ মানুষ দেশীয় ছবি ‘হাওয়া’ কিংবা ‘পরাণ’ দেখতে গেছে, তার অর্ধেকও দেখবে না মফস্বলের হলগুলোতে। এর অন্যতম কারণ হলের পরিবেশ। বাংলাদেশে নির্মিত কোনো সিনেমা গত দুই-তিন দশকে এমন হুজুগ তৈরি করতে পারেনি যে হল যেমন হোক, দর্শক ছবি দেখতে ভেঙে পড়বে। যুগ পাল্টেছে, সময় পাল্টেছে। এখন ঘরে বসে রিমোট টিপে বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা কিছু দেখা যায়। এই সময়ে মান্ধাতা আমলের পরিবেশে মানুষ কেন সিনেমা দেখতে যাবে?
সিনেমা হলমালিকেরা হয়তো বলবেন ব্যবসা নেই, কী দিয়ে উন্নত হল বানাবেন? উন্নত হল নেই বলে দর্শক নেই, দর্শক নেই বলে হলের উন্নতি হচ্ছে না। এই অবিচ্ছেদ্য চক্র থেকে যদি মুক্তি নিয়ে আসতে পারে হিন্দি সিনেমা, তবে এতে আমি তো মন্দের কিছু দেখি না। শিল্প-সংস্কৃতির কোনো দেশ-কাল-সীমারেখা নেই। থাকে না। সব সংস্কৃতিকেই টিকে থাকতে হবে তার নিজস্ব শক্তি দিয়ে।
লেখক: সাহিত্যিক
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে