Ajker Patrika

বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক

হাসান আলী
আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২: ০৩
বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক

জীবন চলার পথে অনেকগুলো সম্পর্ক আমাদের সামনে হাজির হয়। ছেলেমেয়ের সম্পর্ক, মা-বাবার সম্পর্ক, ভাই-বোনের সম্পর্ক, বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, পাড়া-প্রতিবেশীর সম্পর্ক, আত্মীয়স্বজনের সম্পর্ক, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ইত্যাদি। আজ শুধু বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে কথা বলব।

আমরা যখন প্রবীণ হই, তখন ধরে নিই আমরা অকর্মণ্য। সমাজ প্রবীণ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে বিধায় প্রবীণ নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করে, প্রবীণ মানে অকর্মণ্য। প্রবীণ বয়সে আয়-রোজগার কমতে থাকে। অসুখ-বিসুখ, রোগবালাই বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে খরচ বাড়ে। খোঁজখবর নেওয়ার লোক কমে যায়। ডাক্তারের চেম্বার অথবা হাসপাতালে কে নিয়ে যাবে, কার সময় হবে, এ নিয়ে ভাবনা শুরু হয়। সন্তানদের কাছে থাকার সৌভাগ্য অনেকেই পান না। কারও সন্তান বিদেশে কিংবা অন্য শহরে কাজ করেন, সে জন্য থাকা হয় না।

কেউ সন্তানের সঙ্গে থাকেন আবার কেউ থাকেন না। প্রবীণ স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে ভিন্নমাত্রা পায়। যাঁরা যৌবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে মর্যাদা দিয়েছেন, যত্ন করেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন, তাঁরা বৃদ্ধ বয়সে এসে তুলনামূলক কম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। তাঁদের বার্ধক্য শান্তিপূর্ণ এবং স্বস্তিদায়ক হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যাঁরা যৌবনে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, সন্দেহ, অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা, অসম্মান করে কাটিয়েছেন, তাঁরা কমবেশি সবাই বৃদ্ধ বয়সে নানা রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুবই কঠিন।

আমি মনে করি, বৃদ্ধ বয়সটা একজন মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। জীবিকা অর্জনের জন্য কাজ খুঁজতে হয় না। কাজ হারানোর ভয় থাকে না। কর্মক্ষেত্রে কাউকে সমীহ করে চলতে হয় না। কারও মন রক্ষার জন্য নাটক করতে হয় না। পদোন্নতির জন্য হাহাকার নেই। যাঁরা পদোন্নতি পেলেন, তাঁদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই। বদলির আতঙ্ক নেই। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তেল মারার, গুণগান করার দরকার হয় না। সত্যিকার অর্থে একজন মুক্ত মানুষ। ফলে বার্ধক্যকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে পারা আনন্দের। সেই আনন্দ মাটি হয়ে যাবে যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়। আমরা যৌবনে এমন ভান করি, যেন সংসারের যাবতীয় কাজ মাথায় বয়ে বেড়াচ্ছি। আর সবাই বসে বসে খাচ্ছে। অন্যরা গুরুত্বহীন, শুধু আপনি নিজে গুরুত্বপূর্ণ—এমন ভাবটা কমবেশি সবার মধ্যেই লক্ষ করা যায়। অনেকেই আক্ষেপ করেন পরিবার-পরিজনের জন্য অনেক করেছেন; কিন্তু নাম পাননি। আপনাকে এসব করতে কে বলেছে? আসলে আপনি সংসারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন। দণ্ড-মুণ্ডের মালিক হতে চেয়েছিলেন। পারেননি, তাই আক্ষেপ, বিলাপ, অভিশাপ।

বৃদ্ধ বয়সে আরেকটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা হলো, সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে রাখার। সন্তানদের দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা-ই সফল হন। কারণ, যৌবনে তিনি সন্তান লালনপালনে বেশি সময় দিয়েছেন। কমবেশি স্বামী কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছেন। মা শোষিত শ্রেণির বলেই সন্তানদের আনুকূল্য বেশি পান। সন্তানদের সমর্থনে তিনি কিছুটা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তারপর স্বামী বেচারা নানাভাবে নাজেহাল হতে থাকেন। যৌবনে তিনি কী ধরনের আচরণ করেছেন, কী কী ভুল করেছেন, সেসব বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। তার সব অক্ষমতাকে উপহাস করা হয়। একসময় বৃদ্ধ স্বামীটি নির্বাক হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, একা এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন। বেশির ভাগ প্রবীণ ধর্মীয় কাজে বেশি বেশি নিয়োজিত হন। মৃত্যু ভাবনা, অসুখ-বিসুখ হয়ে ওঠে কাঙ্ক্ষিত। চলে যাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ স্বামী জীবনযুদ্ধে হার মেনে পরিবারের দয়ায় জীবনযাপন শুরু করেন।

একসময় বৃদ্ধ স্ত্রী ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। মনের অজান্তে ছেলে, ছেলে-বউয়ের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চালান। শুরু হয় সংঘাত। ছেলে-বউরা শুরুতেই শ্বশুরের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে শুরু করেন শাশুড়িকে নাজেহাল করতে। যেমন শ্বশুরকে পছন্দমতো খাবার দেওয়া, জামাকাপড় পরিষ্কার করে দেওয়া, বিছানার চাদর বদলে দেওয়া, হাতখরচের জন্য টাকা দেওয়া ইত্যাদি। এ রকম টানাপোড়েনের মধ্যেই বয়সের কারণে বৃদ্ধ স্বামীটি আগে মারা যান। বৃদ্ধ স্ত্রী ছেলেদের কিংবা মেয়েদের আশ্রয়ে কষ্টকর অবহেলার জীবন শুরু করেন।

আর যেসব স্বামী-স্ত্রী সন্তানদের কাছে থাকেন না, তাঁদের জীবন কিছুটা ভিন্ন রকমের। এসব দম্পতির ঝগড়া-বিবাদ, মনোমালিন্য তুলনামূলক কম। কারণ, তাঁরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় সন্তানদের কাছ থেকে গুরুত্ব পাওয়া না-পাওয়া থেকে। যেমন ছেলে যদি বাবার হাতে টাকা দেয়, তবে মা মন খারাপ করেন। এসব ক্ষেত্রে বৃদ্ধ স্বামী নিজের ইচ্ছামতো খরচ করেন। বৃদ্ধ স্ত্রীর হাতে নিজ থেকে টাকা দিতে চান না। যদি দেন, তবে মাঝে মাঝেই হিসাব নেন। বৃদ্ধ স্বামীটি স্বভাবগতভাবে বৃদ্ধা স্ত্রীর সেবাযত্ন পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। স্ত্রী কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে নানা অসিলা দেখিয়ে যাত্রাবিরতি করান। ছেলেমেয়েদের আবদারে গেলেও অব্যাহত তাগিদ দিয়ে বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিজের কাছে এনে রাখেন।

অনেকেই মনে করেন, বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-মহব্বত অনেক বৃদ্ধি পায়। কথাটা কতখানি সত্য, আমি বুঝতে পারি না। এটা প্রেম নাকি নির্ভরশীলতা—এ দ্বন্দ্ব আমার কাটেনি। সন্তান থেকে আলাদা বসবাসকারী বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তানেরা টাকাপয়সা দেন। কেউ কেউ মাকে আলাদা টাকা দেন। মেয়েরা বাবার একটু বেশি যত্ন নেন। যেসব বাবা সন্তান লালনপালনে বেশি ভূমিকা রেখেছেন এবং স্ত্রীর বকাঝকা বেশি খেয়েছেন, তাঁরা কন্যাসন্তানের কাছ থেকে বেশি মনোযোগ পান। দুর্বল বৃদ্ধ বাবার প্রতি কন্যাসন্তানের অধিক মনোযোগে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি কেউ একজন বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকেন, একপর্যায়ে তিনি অবহেলার শিকার হন। সেবাদানকারী কর্মীর অভাবে কিংবা অবহেলায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত অবস্থায় চলে যায়। যেসব দম্পতির একাধিক সন্তান থাকে এবং যে সন্তানটি আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়, তার জন্য ঝগড়া-বিবাদ দেখা দেয়। মাদকাসক্ত সন্তানের দাবি মেটাতে গিয়ে চরম পারিবারিক সংকট দেখা দেয়। শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তান লালনপালনের প্রশ্নে বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা যায়। নিকটাত্মীয়স্বজনকে আর্থিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে সংকট তৈরি হয়।

যেসব বৃদ্ধ দম্পতির সন্তান নেই, তাঁদের সংকট ভিন্ন ধরনের। সেখানে স্ত্রীকুলের লোকজন প্রাধান্য পায়, ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঠান্ডাযুদ্ধ লেগেই থাকে। সেই যুদ্ধ মেটানো খুবই দুরূহ ব্যাপার।

বৃদ্ধ বয়সে শান্তিপূর্ণ, অর্থবহ, স্বস্তিদায়ক জীবন কাটানো অতি জরুরি বিষয়। যাঁরা এমন জীবন আশা করেন, তাঁদের অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সহনীয় রাখতে হবে। সে জন্য যৌবনই হলো মোক্ষম সময়। আর্থিক নিরাপত্তার জন্য আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ সঞ্চয় করা, সুস্থ জীবনের জন্য কায়িক পরিশ্রম করা, মাদক ও যৌন অনাচার থেকে দূরে থাকা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অর্থবহ সময় কাটানো, পরিবারের সদস্যদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজের অংশগ্রহণ বাড়ানো, ইতিবাচক চিন্তা করা, নতুন জ্ঞান, চিন্তা, প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করা। এসবের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ গড়ে উঠলে তার দাম্পত্যজীবন সুখের হবে।

হাসান আলী: সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন

দুই মামলা থেকে মির্জা আব্বাস-আমান-গয়েশ্বরসহ ৪৫ জনকে অব্যাহতি

আমরা চুপ থাকব না, উচিত শিক্ষা দেব—সেভেন সিস্টার্স নিয়ে হাসনাতের হুমকির জবাবে হিমন্ত

হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বরপ্লেট উদ্ধার

দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র: এবার গুলশান থানার মামলায় গ্রেপ্তার মেজর সাদিকের স্ত্রী সুমাইয়া

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ