Ajker Patrika

ইন্টারনেট যাত্রার ২৯ বছর

নারীদের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও হুমকি

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

১৯৯৩ সালে সীমিত আকারে চালু হলেও বাংলাদেশে সবার জন্য ইন্টারনেট উন্মুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। ২৯ বছরের এই যাত্রায় স্মার্টফোন ও ওয়াই-ফাইয়ের কল্যাণে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে প্রায় প্রতিটি ঘরে। শিক্ষা, ফ্রিল্যান্সিং, ব্যবসা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এর পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নারীদের জন্য নিরাপত্তা হুমকি, মানসিক চাপ এবং সৌন্দর্যবিষয়ক অস্থিরতা। এগুলো প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। প্রায় তিন দশকের এই যাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহারে নারীদের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও হুমকি বিষয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

স্বাবলম্বী ও সাইবার হুমকি

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনেক নারী উদ্যোক্তা তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। গ্রামাঞ্চলে কম হলেও শহরাঞ্চলে এই প্রবণতা বাড়ছে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের সংখ্যা কত, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান জানা যায় না। অনেক নারী ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স ও অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে নিজের অবস্থান গড়তে পেরেছেন। তাঁরা উদ্যোক্তা, ডিজিটাল অ্যাকটিভিস্ট, এমনকি রাজনৈতিক প্রচারণার ক্ষেত্রেও সক্রিয়। কিন্তু সাইবার হুমকির ছায়া সব সময় তাঁদের পেছনে। বিষয়গুলো কেমন?

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল অধিকারবিষয়ক বিশ্লেষক তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘অনলাইন হ্যারাসমেন্ট, রিভেঞ্জ পর্নো, সাইবার স্টকিং এবং ফেক আইডির মাধ্যমে অপপ্রচারে নারীরা বিপদে পড়ছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্রিয় নারীরা বেশি টার্গেট হচ্ছেন।’

প্রতিনিয়ত কমেন্ট বক্সে বুলিং এবং আক্রমণ থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে নারীদের হেয় করা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের বিপক্ষে মতাদর্শ গড়ে তোলার চেষ্টা করে একদল মানুষ। এ থেকে রক্ষার জন্য নারী ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সাইবার বুলিং প্রতিরোধে নারীদের জন্য একটি ইউনিট গঠনের কথা বলেছেন।

সোশ্যাল মিডিয়া ও সৌন্দর্য চাপ

ইন্টারনেটের এক অনিবার্য অংশ সোশ্যাল মিডিয়া। এই প্ল্যাটফর্মগুলো নারীদের ওপর তৈরি করছে ‘পারফেক্ট সৌন্দর্যে’র চাপ। রূপবিশেষজ্ঞ শারমিন কচি বলেন, ‘ক্লায়েন্টরা এখন রেফারেন্স ছবি নিয়ে আসেন—কারিনা কাপুরের বিয়ের লুক চাই।’ তিনি জানান, লুক যে শুধু মেকআপের বিষয় নয়, পোশাকসহ পুরো বিষয়টিই একটি প্যাকেজ, ক্লায়েন্টরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেন না। ফলে

এই অসম সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। বাড়ছে ডিপ্রেশন, বডি ডিসমরফিয়া ও আত্মমূল্যায়নের ঘাটতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল লুক বা ট্রেন্ডি মেকআপ যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে নারীদের।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, ‘আমাদের আচরণ, ফ্যাশন সেন্স, এমনকি মূল্যবোধও আজ সামাজিক মাধ্যম দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে।’ এই চাপ নারীদের লাবণ্য ও আবেদনময়ী হয়ে উঠতে বেশি উৎসাহ দিচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত। তিনি বলেন, ‘নারী প্রতি মুহূর্তে সচেতন থাকে নিখুঁত হতে। এই চরম অবমাননাকর পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে বিষাদগ্রস্ত, হতাশা অথবা অহমে নিমজ্জিত করে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’

নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক অধিকার

দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ডিজিটাল কোনো মাধ্যমে কথা বলা এখনো নিরাপত্তাহীন; বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। সীমা দত্ত বলেন, ‘ইন্টারনেটে যেকোনো তথ্য পাওয়া সহজলভ্য হওয়ায় নারীরাও এর সুফল পাচ্ছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বক্তব্য, তা প্রতিক্রিয়াশীল কি প্রগতিশীল যা-ই হোক, নারীরা তার অংশীদার হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ইন্টারনেটকে তারা আয়ের পথ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে। চব্বিশের গণ-আন্দোলনেও নারীদের নানান অনুপ্রেরণাদায়ক আয়োজন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের সামনে এসেছে।’

সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ প্ল্যাটফর্ম নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘নারী অধিকার, ভোটাধিকার, আইনি সুরক্ষা নিয়ে অনেকে আজ নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করছেন। অনেক নারী এখন ডিজিটাল অ্যাকটিভিস্ট হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করছেন, যা গণতন্ত্রের জন্য আশাব্যঞ্জক।’

গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহার

তানভীর হাসান জোহা বলেছেন, ‘শহরের নারীরা তুলনামূলকভাবে প্রযুক্তির সুযোগ পেলেও গ্রামীণ নারীরা এখনো সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন বাধার মুখে রয়েছেন। অনেকে প্রযুক্তি বিষয়টি এখনো “ছেলেদের বিষয়” মনে করেন। মোবাইল ফোন ব্যবহারে মেয়েদের প্রতি সন্দেহ ও নজরদারি চলে।’ এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম এবং নারী নেতৃত্বে পরিচালিত টেক ক্লাব চালু করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে সীমা দত্ত বলেন, ‘নারীরা কেন ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, এ রকম মনোভাব পোষণ করে গ্রামীণ মুরব্বিরা। তা ছাড়া অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও আছে। ঘর-সংসার সামলে ইন্টারনেট ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও মনে করে না অনেকে।’

কীভাবে আসতে পারে নিরাপত্তা

নারীর ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাইবার হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং গ্রামীণ নারীদের জন্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত। এই উদ্যোগগুলোর কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব‍্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন বলেন, ‘প্রথমত, নারীদের অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাইবার হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। দ্বিতীয়ত, নারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা উচিত; বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের জন্য। তৃতীয়ত, নারী উদ্যোক্তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশাধিকার এবং সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে। এ ছাড়া নারীবান্ধব কনটেন্ট এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ করাও গুরুত্বপূর্ণ।’ সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই একটি নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নারীবান্ধব ইন্টারনেট গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন ব‍্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন।

রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি

  • ডিজিটাল লিটারেসি ক্যাম্পেইন: নারীদের জন্য বিশেষ অনলাইন নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ।
  • সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও পুলিশ ইউনিট শক্তিশালীকরণ: দ্রুত বিচার ও প্রতিকার নিশ্চিত করার জন্য।
  • নারীবান্ধব প্রযুক্তি ডিজাইন: যেমন রিপোর্টিং বাটন, অ্যানোনিমাস সাপোর্ট সিস্টেম।
  • স্কুল পর্যায় থেকে সচেতনতা শিক্ষা: নারীদের কিশোর বয়স থেকে ডিজিটাল অধিকার সম্পর্কে জানানো।

তানভীর হাসান জোহা, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশ

সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল অধিকারবিষয়ক বিশ্লেষক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ক্ষত আর স্বপ্ন নিয়ে নতুন ভোরের অপেক্ষায় নারীরা

কাশফিয়া আলম ঝিলিক
ক্ষত আর স্বপ্ন নিয়ে নতুন ভোরের অপেক্ষায় নারীরা

আগামীকাল নতুন একটি বছর শুরু করতে যাচ্ছে পৃথিবী। ২০২৫ সালকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরে সবারই প্রত্যাশা থাকছে ইতিবাচক কিছুর। তবে পেছনে ফিরে তাকালে গত বছরটি নারী অধিকার এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে রেখে গেছে এক মিশ্র অভিজ্ঞতা। ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেখা গেছে পরিকল্পনা, প্রাপ্তি আর দীর্ঘশ্বাসের ছবি। ২০২৫ সালের শুরু থেকে বিশ্বজুড়ে নারীদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগজনক সব ঘটনা ঘটেছে। গত মার্চের শুরুতে মাগুরা সদর উপজেলায় ৮ বছরের এক শিশু ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশ। হয়রানির এই ছায়া বিশ্বজুড়ে এতটাই বিস্তৃত যে মেক্সিকোর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাউমও যৌন হয়রানি থেকে রেহাই পাননি। বছরজুড়ে যেমন কিছু নারী তাঁদের সাফল্যের আলোয় সমাজকে এগিয়ে নিয়েছেন, তেমনি যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কোটি কোটি নারীকে ঠেলে দিয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়ের দিকে।

বাংলাদেশ: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এ দেশের নারী ও শিশুরা। আশা ছিল রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার আরও কঠোর ও দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তের পরিসংখ্যান সেই স্বপ্নকে অধরা মনে হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যমতে, বছরের প্রথম সাড়ে সাত মাসে রাজধানীতে ২১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে ১৭টি ছিল দলবদ্ধ ধর্ষণ। উত্তরা, কদমতলী ও তুরাগ এলাকায় মামলার সংখ্যা ছিল উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, বছরের ১১ মাসেই সারা দেশে ২ হাজার ৫৪৯ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ভয়াবহ তথ্য হলো, এই পরিসংখ্যান ২০২৪ সালের মোট নির্যাতনের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আইন থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং গণপরিবহনে হয়রানি তেমনভাবে কমছে না, যা নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার সক্ষমতাকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

লিঙ্গভেদে বর্ণবাদের শিকার

২০২৫ সালেও আফগানিস্তানের নারীদের অবস্থা ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয়। তালেবান শাসকেরা নারীদের উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং জনসমক্ষে কণ্ঠস্বর কিংবা মুখ দেখানো নিষিদ্ধ করে একের পর এক ডিক্রি জারি করেছে। নারীরা ঘরের বাইরে যাওয়ার অধিকার হারিয়েছেন, বেড়েছে বাল্যবিবাহ ও মানসিক বিষণ্নতা। জাতিসংঘের বিশেষ দূত রিচার্ড বেনেট জানান, আফগানিস্তানে নারীদের ওপর এখন কাঠামোগত ও মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা চলছে। সেখানে সহিংসতাবিষয়ক রিপোর্ট করার নিরাপদ পথও এখন আর নেই। এদিকে ইরানেও হিজাব আইন অমান্য করার দায়ে নারীদের ওপর কঠোর নজরদারি ও কারাদণ্ড অব্যাহত রয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হচ্ছে।

যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী যৌন সহিংসতা

সুদান ও কঙ্গোয় ২০২৫ সালে সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে, যেখানে যৌন সহিংসতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘যুদ্ধের কৌশল’ হিসেবে। সুদানের সেনাবাহিনী (এসএএফ) ও আধা সামরিক বাহিনীর (আরএসএফ) লড়াইয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন কোটি মানুষ, যাদের অর্ধেকই নারী। জাতিসংঘের তথ্যমতে, সুদানে ৫৮ লাখ নারী ও কিশোরী বাস্তুচ্যুত। স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংস হওয়ায় তাঁরা প্রসবকালীন বা ধর্ষণ-পরবর্তী চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত। অন্যদিকে, কঙ্গোর খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নারীদের অপহরণ করে ‘যৌন দাসী’ হিসেবে তাদের ব্যবহার করছে। প্রতিদিন সেখানে শত শত নারী সহিংসতার শিকার হলেও সিংহভাগ লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে কয়েক হাজার নারী ও শিশু প্রাণ হারিয়েছে। গাজায় হাসপাতাল ধ্বংস হওয়ার কারণে অবরুদ্ধ অবস্থায় অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই মায়েদের সিজারিয়ান অপারেশন করতে হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবে হাজার হাজার নারী প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দিন

কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন এবং লাতিন আমেরিকায় হাহাকার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে লাখ লাখ নারী শরণার্থী জীবন যাপন করছে, যেখানে তারা মানব পাচারের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকায় ‘ফেমিসাইড’ বা নারী হত্যার হার ২০২৫ সালে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের নারীরা আজ ঘরের ভেতরে ও বাইরে কোথাও নিরাপদ বোধ করছে না।

২০২৫ সালটি নারীদের জন্য ছিল রক্ত, অশ্রু আর নিরন্তর সংগ্রামের। তবু সব আঘাত আর ক্ষত পাশে রেখে নতুন বছরের ভোরের আলোয় নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে বিশ্বের কোটি কোটি নারী। যেখানে নারীত্ব শুধু হাহাকারের নাম হবে না; বরং হবে মর্যাদা ও নিরাপত্তার এক নতুন উপাখ্যান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বইকে বেঁচে থাকার শক্তি হিসেবে দেখাতে চান দিয়া

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান 
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ০০
বইকে বেঁচে থাকার শক্তি হিসেবে দেখাতে চান দিয়া

বই মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে— এই সত্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে নূজহাত নাছিম দিয়ার জীবনে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের একটি শান্ত, বইপ্রেমী পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন দিয়া। পরিবারে মা-বাবা ও দুই ভাই সব সময় তাঁকে পড়াশোনা এবং সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। এই সমর্থন তাঁকে শক্তি জুগিয়েছে। বর্তমানে তিনি সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগে অনার্সে পড়ছেন। পাশাপাশি নিজের ক্যারিয়ার গড়ার পথে নিয়মিত বই পড়া এবং রিভিউ করা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বুক রিভিউ জগতে দিয়ার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সাতকাহন’ বইটি নিয়ে। বই নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত আসে নিজের বিষণ্নতা আর মানসিক চাপ থেকে। কারণ, তাঁর খারাপ সময়ে বই-ই তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। কাজ শুরু করার পর পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া ইতিবাচক সাড়া দিয়াকে সবচেয়ে বড় উৎসাহ দেয়। লেখা ও ভিডিও মিলিয়ে তিনি এরই মধ্যে ৮০টির বেশি বইয়ের রিভিউ করেছেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত রিভিউগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বপন মিয়ার গল্পকথায় বাংলা ব্যাকরণ এবং কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের পরাণচুল্লি। এ ছাড়া ‘ঈশ্বর, তুমি কি শুনছ? আমি মার্গারেট বলছি’, ‘সাতকাহন’, ‘টিউজডেজ উইদ মরি, অ্যাটমিক হ্যাবিটস এবং ডেইলি স্টোয়িক’, ‘মহৎ জীবন’ এমন অসংখ্য বই নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। বুক রিভিউ করা দিয়া কারও কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে শেখেননি। নিজেই দেশি-বিদেশি বুক ইনফ্লুয়েন্সারদের রিভিউ দেখেছেন, সাহিত্যতত্ত্ব পড়েছেন এবং লেখালেখির চর্চা করেছেন। সময় ব্যবস্থাপনাই তাঁর বড় চ্যালেঞ্জ। কখনো বই সংগ্রহের সমস্যা, কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত নেতিবাচক মন্তব্য—সবই তাঁকে আরও দৃঢ় করে তুলেছে। তবে তাঁর বুক রিভিউ যাত্রার সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ছিল যখন একজন পাঠক তাঁকে জানান, তাঁর রিভিউ দেখে তিনি আবার বই পড়ায় ফিরে এসেছেন।

২০২৪ সালে দিয়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁর বুকটক উইদ নূজহাত পেজটি চালু করেন। এখানে তিনি নিয়মিত রিভিউ, বইয়ের বিশ্লেষণ ও পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, আত্মোন্নয়নমূলক লেখা ও পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে থাকেন। যার কিছু অনলাইন সাহিত্যমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি আরশিনগর সাহিত্য চক্রে তিনি বই আলোচনা এবং নতুন লেখক ও রিভিউয়ারদের উৎসাহিত করার কাজ করেন। দিয়া পেয়েছেন ‘ঐতিহ্য বুক ইনফ্লুয়েন্সার ২০২৫’ সম্মাননা, যা তাঁর কাজকে আরও মূল্যায়িত করেছে। ঐতিহ্যের আয়োজিত বুক ইনফ্লুয়েন্সার গেট টুগেদারে যোগ দিয়ে তিনি লেখক, পাঠক এবং বইপ্রেমীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের বিশেষ সুযোগ পেয়েছেন। আগামী দিনে দিয়া আরও পেশাদারভাবে রিভিউ করতে চান, লেখালেখি বাড়াতে চান এবং শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চান।

বই দান কার্যক্রম এবং শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনায় সহায়তা করা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। এই যাত্রা সম্পর্কে দিয়া বলেন, বই মানুষকে বাঁচায়। ভেতরে ভেঙে যাওয়া মানুষেরাও বইয়ের কাছে ফিরে এলে আবার গড়ে উঠতে পারেন। তাঁর নিজের জীবনের মতো বই-ই তাঁর পুনর্জন্ম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সৌন্দর্যশিল্পের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ আরডেন

ফিচার ডেস্ক
সৌন্দর্যশিল্পের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ আরডেন

ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় থাকা নতুন বছরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা। যুগে যুগে বছরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টেছে ট্রেন্ড। কিন্তু আজও যখন আমরা আধুনিক প্রসাধনশিল্পের দিকে তাকাই, তখন একটি নাম ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—এলিজাবেথ আরডেন। ১৮৭৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কানাডার ওন্টারিওতে এক খামারে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল গ্রাহাম হিসেবে জন্ম নেওয়া এই নারীই মূলত আজকের বিলিয়ন ডলারের কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির রূপকার। তিনি এমন একজন মানুষ, যাঁর নাম আজ ব্র্যান্ড হয়ে কোটি নারীর অন্তর থেকে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে পৌঁছে গেছে। তিনি নিছক প্রসাধনকে নারীর আত্মবিশ্বাস আর অধিকারের হাতিয়ারে রূপান্তর করেছিলেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও সমাজে প্রসাধনী বা লিপস্টিকের ব্যবহার ছিল চরমভাবে বিতর্কিত। মেকআপকে তখন মনে করা হতো অশালীন এবং কেবল মঞ্চাভিনেত্রীদের সাজ। কিন্তু এলিজাবেথ আরডেন এই সামাজিক জড়তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। ১৯১০ সালে নিউইয়র্কের অভিজাত ফিফথ অ্যাভিনিউতে তাঁর প্রথম স্যালন উদ্বোধন করেন তিনি। সেই ‘রেড ডোর’ নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন, রূপচর্চা লুকানোর বিষয় নয়, বরং এটি আভিজাত্যের প্রতীক। তাঁর দর্শন ছিল, স্পষ্ট মেকআপ সৌন্দর্যকে আড়াল করার জন্য নয়, বরং প্রকৃতির দেওয়া স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তোলা। এলিজাবেথ আরডেন ছিলেন আধুনিক বিউটি ইন্ডাস্ট্রির প্রথম প্রকৃত উদ্ভাবক। বিজ্ঞানের সঙ্গে রূপচর্চাকে মিলিয়ে তিনি প্রথম ত্বকের যত্নে বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা ব্যবহার শুরু করেন। ১৯৩০ সালে তাঁর হাত ধরে আসা ‘এইট আওয়ার ক্রিম’ আজ এক শতাব্দী পরও বিশ্বজুড়ে রূপসচেতন নারীদের কাছে আস্থার নাম। তিনিই প্রথম নারীদের জন্য আই মেকআপ এবং মেকওভার বা ভোল বদলে দেওয়ার ধারণাটি নিয়ে আসেন। আজকের দিনে আমরা যে ট্রাভেল সাইজ কিংবা ছোট প্যাকের প্রসাধনী দেখি, তার প্রবর্তকও ছিলেন আরডেন। তাঁর ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা এতটাই প্রবল ছিল যে ১৯২৯ সালের চরম অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও তিনি ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘নারীরা যখন আর্থিক ক্ষতির চাপে পিষ্ট, তখন সুগন্ধিযুক্ত পানিতে গোসল তাঁদের নতুন করে সজীবতা দেয়।’

এলিজাবেথ আরডেনের জীবন ছিল লড়াইয়ের গল্প। ১৯১২ সালে যখন নারীরা ভোটাধিকারের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন, আরডেন তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সংহতির প্রতীক হিসেবে ‘লাল লিপস্টিক’ হাতে নিয়ে। ভোটাধিকার পাওয়ার আগেই তিনি নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম নারী ব্যবসায়ী হিসেবে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এমনকি

নিজের বয়স নিয়েও তাঁর ছিল এক অদ্ভুত আভিজাত্য; ১৯৬৬ সালে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বিশ্বকে তাঁর প্রকৃত বয়স জানতে দেননি। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, বয়স শুধু সংখ্যামাত্র। বর্তমান সময়ে নারীদের প্রসাধনের সামগ্রী ব্যবহারের দিকে তাকালে এলিজাবেথ আরডেনের সেই দূরদর্শী ভাবনার প্রতিফলন স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়। আজকের আধুনিক নারী শুধু সুন্দর দেখানোর জন্য প্রসাধনী ব্যবহার করেন না, বরং এটি তাঁদের ব্যক্তিত্ব এবং সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। বর্তমান বিউটি প্রোডাক্টগুলো নিয়ে নারীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। তাঁরা প্রসাধনী নির্বাচনে পণ্যের গুণমান এবং এটি তাঁদের ত্বকের সুস্থতায় কী ভূমিকা রাখছে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। আরডেনের সেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিই আজ আধুনিক নারীদের গাইডলাইন হিসেবে কাজ করছে। আজকের নারীর সজ্জা শুধু অন্যের চোখে সুন্দর হওয়ার জন্য নয়, বরং নিজের আত্মবিশ্বাস সুসংহত করার একটি মাধ্যম। ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের এই বিশাল সাম্রাজ্য শুধু পণ্যের ওপর দাঁড়িয়ে নেই, বরং টিকে আছে আরডেনের সেই বিশ্বাসের ওপর। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সামান্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলে একজন নারী যা অর্জন করতে পারে, তা সত্যিই বিস্ময়কর।’ এলিজাবেথ আরডেন আজ নেই, কিন্তু তাঁর সেই ‘লাল দরজা’ আজও কোটি নারীর আভিজাত্য আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে টিকে আছে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস ম্যাগাজিন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বড়দিনের বিখ্যাত গানগুলোর নেপথ্যের নারীরা

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০: ০৫
খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব বড়দিনের জন্য অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন নারীরা। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।
খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব বড়দিনের জন্য অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন নারীরা। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।

খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব বড়দিনের কথা মনে হলে কিছু জনপ্রিয় গানের কথা সামনে আসে। জানেন কি, হিমেল হাওয়ার পরশ আর আলোকসজ্জার রোশনাইয়ের মধ্যে যে সুরগুলো আমাদের কানে বাজে, সেগুলো সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে একদল নারী। তাঁদের লেখা, কণ্ঠ আর সুরের জাদুকরী মিশেলে বড়দিন পেয়েছে এক অনন্য রূপ।

কুইন অব ক্রিসমাস মারায়া

বড়দিনের গানের কথা উঠলে যে নামটি সবার আগে স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে, তিনি হলেন মারায়া কেরি। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় বড়দিনের অলিখিত অ্যানথাম, ‘অল আই ওয়ান্ট ফর ক্রিসমাস ইজ ইউ...’ গানটি। এটি যৌথভাবে লিখেছিলেন মারায়া কেরি ও ওয়াল্টার এন আফানাসিফ। এর কণ্ঠশিল্পী ছিলেন মারায়া। এই গানের প্রতিটি ছত্রে মিশে রয়েছে এক চিরন্তন আর্তি। তাঁর গানের কথায় ফুটে ওঠে সেই সত্য, ‘বড়দিনে খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই আমার,/ শুধু একটি জিনিসেরই বড় প্রয়োজন... বড়দিনে শুধু তোমাকেই চাই আমি!’ এর অর্থ, উৎসবের জাঁকজমক বা দামি উপহারের চেয়ে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যই আসল।

'কুইন অব ক্রিসমাস' মারিয়া কেরি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
'কুইন অব ক্রিসমাস' মারিয়া কেরি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

মারায়া কেরি ও ওয়াল্টার এ গানটি লিখতে ও সুর করতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ১৫ মিনিট। গান লেখা ও কণ্ঠ দেওয়াই নয়, মারায়া ছিলেন এই গানের সুরকার। প্রতিবছরের ডিসেম্বরে বিলবোর্ড চার্টের শীর্ষে ফিরে আসা এই এক গান থেকে তিনি কোটি কোটি টাকা রয়্যালটি পান, যা তাঁকে এনে দিয়েছে কুইন অব ক্রিসমাস বা বড়দিনের রানি উপাধি।

ড্রামের শব্দে ধ্রুপদি সুর

ক্যাথরিন কেনিকট ডেভিস। ছবি: উইকিপিডিয়া
ক্যাথরিন কেনিকট ডেভিস। ছবি: উইকিপিডিয়া

এক দরিদ্র শিশু, যার কাছে যিশুর জন্মের আনন্দ উৎসবে দেওয়ার মতো কোনো দামি উপহার ছিল না। তাই সে তার ছোট্ট ড্রামটি বাজিয়ে সম্মান জানাতে চেয়েছিল। এমনই একটি ঘটনাকে সুরে-তালে মিলিয়েছিলেন আমেরিকান সংগীত শিক্ষক ক্যাথরিন কেনিকট ডেভিস। ১৯৪১ সালের অনন্য সৃষ্টি ‘দ্য লিটিল ড্রামার বয়’ গানটি। প্রথমে এর নাম ছিল ‘দ্য ক্যারল অব দ্য ড্রাম’। গানটি একটি চেক গানের অনুকরণে তৈরি বলে ধারণা করা হয়। তবে এর সুর এবং কথা দুটোরই মূল কারিগর ছিলেন ক্যাথরিন। গানের সেই বিখ্যাত ‘পা-রাম-পাম-পাম-পাম’ সুরটি মূলত ক্যাথরিনেরই করা। আজও বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বড়দিনের ক্যারল হিসেবে এ সুরটি মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হয়।

চঞ্চলতা ও শাশ্বত আবেদন

বড়দিনের উৎসবে কেবল ভক্তি বা আবেগ নয়, মিশে থাকে কিছুটা চঞ্চলতা আর কৌতুকও। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘স্যান্টা বেবি’ গানটি তারই প্রমাণ। এর নেপথ্যে ছিলেন প্রতিভাবান গীতিকার জোয়ান জাভিটস। তিনি ছিলেন বিখ্যাত মার্কিন সিনেটর জ্যাকব জাভিটসের ভাইয়ের মেয়ে। সে সময়ে দাঁড়িয়ে এক নারীর এমন চটুল ও আধুনিক কথার গান লেখা ছিল বেশ সাহসী পদক্ষেপ। ফিল স্প্রিংগার ও টনি স্প্রিংগারের সঙ্গে মিলে জোয়ান এ গানটি লিখেছিলেন। গানটি আর্থ কিটের কণ্ঠে অমর হয়ে আছে। দশকের পর দশক পার হলেও গানটির আবেদন একটুও কমেনি। ম্যাডোনা থেকে শুরু করে কাইলি মিনোগ, টেইলর সুইফট এবং আরিয়ানা গ্রান্দের মতো বর্তমান সময়ের পপতারকারাও এ গানটি নতুন করে গেয়েছেন।

‘স্যান্টা বেবি’ গানটির নেপথ্যে ছিলেন প্রতিভাবান গীতিকার জোয়ান জাভিটস। ছবি: উইকিপিডিয়া
‘স্যান্টা বেবি’ গানটির নেপথ্যে ছিলেন প্রতিভাবান গীতিকার জোয়ান জাভিটস। ছবি: উইকিপিডিয়া

কিংবদন্তির সুর ও আধুনিকতার ছোঁয়া

কান্ট্রি মিউজিকের কিংবদন্তি ডলি পার্টন বড়দিনের উৎসবকে রাঙিয়েছেন নিজের মেধা দিয়ে। তিনি বড়দিন উপলক্ষে একাধিক সফল অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন, যেগুলোর অধিকাংশ গানই ছিল তাঁর নিজের লেখা। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘হার্ড ক্যান্ডি ক্রিসমাস’ ও ‘ক্রিসমাস অব মেনি কালার্স’ গানগুলো আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।

সিয়ার কণ্ঠে বড়দিনের আনন্দের স্রোত

অস্ট্রেলিয়ান সংগীতশিল্পী ও গীতিকার সিয়া। ছবি: রোলিং স্টোন
অস্ট্রেলিয়ান সংগীতশিল্পী ও গীতিকার সিয়া। ছবি: রোলিং স্টোন

সময়ের স্রোতে বড়দিনের গানে যোগ হয়েছে আধুনিকতার নতুন মাত্রা। তরুণ প্রজন্মের কাছে বড়দিন মানেই যেন অস্ট্রেলিয়ান সংগীতশিল্পী ও গীতিকার সিয়া। ২০১৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘এভরিডে ইজ ক্রিসমাস’ অ্যালবামটি। সিয়া প্রমাণ করেছেন, বড়দিনের গানের জন্য কেবল পুরোনো ক্ল্যাসিকের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। তাঁর নিজের লেখা ‘স্নো ম্যান’ ও ‘স্যান্টা ইজ কামিং ফর আস’ গানগুলো এখনকার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়।

বড়দিনের সুরের মূর্ছনা কেবল সুর নয়; বরং এক অদৃশ্য মিলনমেলা। পর্দার আড়ালে থাকা এই নারী কারিগরদের লেখনী আর সুরের মায়ায় বড়দিন হয়ে ওঠে আরও মধুময়, আরও প্রাণবন্ত। প্রিয়জন আর আত্মীয়স্বজনের সে মিলনমেলায় এ গানগুলোই হয়ে থাকে আত্মার খোরাক।

সূত্র: বিবিসি, ওয়েব্যাক মেশিন, কনকর্ড ফ্রি পাবলিক লাইব্রেরি, ভ্যানিটি ফেয়ার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত