Ajker Patrika

গোয়েবলস ও সামাজিক মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণহীন মিথ্যাচার

চিররঞ্জন সরকার
গোয়েবলস ও সামাজিক মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণহীন মিথ্যাচার

জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন হিটলারের নাৎসি জার্মানির তথ্য ও প্রচারবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ছিলেন মিথ্যাকে ‘সত্য’ বানানোর এক ভয়ংকর কৌশলের রূপকার। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, ‘একটি বড় মিথ্যাকে বারবার বললে মানুষ একসময় সেটিকে সত্য বলে মেনে নেয়।’ তাঁর এই নীতি দিয়েই নাৎসি জার্মানি কোটি মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেছিল, উসকে দিয়েছিল যুদ্ধ, ঘৃণা আর ধ্বংস। ভাবুন তো, এমন একজন মানুষ যদি পেতেন বর্তমানের ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমের হাতিয়ার—তাহলে কী হতে পারত?

আমরা আজ যে সময়ে বাস করছি, তা যেন গোয়েবলসের সেই কল্পনারই বাস্তব রূপ। প্রতিদিন আমাদের সামনে ভেসে আসে মিথ্যার ঢেউ। কখনো তা রাজনৈতিক, কখনো পারিবারিক, কখনো আবার সাংস্কৃতিক বা ব্যক্তিগত। সামাজিক মাধ্যম এখন আর শুধুই যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি হয়ে উঠেছে বিভ্রান্তি, মিথ্যা প্রচার এবং বিভাজনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।

ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (আগের টুইটার)—এইসব সামাজিক মাধ্যম এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোকে আধুনিক যুগের চায়ের দোকান বললে ভুল হবে না। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে যেমন হরেক রকম মানুষ ভিড় করে, দেশের খবর থেকে শুরু করে পাড়ার গসিপ পর্যন্ত সব আলোচনা হয়, তেমনি এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতেও সব শ্রেণির মানুষের আনাগোনা। এখানে কেউ নিজেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করে জ্ঞান বিতরণ করছে, কেউ নীতি ও আদর্শের ধারক সেজে উপদেশ দিচ্ছে, আবার কেউ কেবল কৌতুকপ্রেমী দর্শক হয়ে অন্যের পোস্ট দেখছে আর লাইক-শেয়ার করছে। কিন্তু এই ডিজিটাল চায়ের দোকানে একটা বড় সমস্যা হলো, খবরের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো বালাই নেই। এখানে ভাবনার গভীরতার চেয়ে মন্তব্যের দ্রুততা আর প্রতিক্রিয়ার প্রতিযোগিতাটাই মুখ্য। কে কতটা দ্রুত একটা খবর ছড়াতে পারল, সেটাই যেন বড় বিষয়। ফলে যা ইচ্ছে তা-ই লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, আর মানুষ যাচাই না করেই তা বিশ্বাস করে ফেলছে।

এই খোলামেলা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের একদিকে যেমন ভালো কথা, শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু বা মানবিক উদ্যোগের খবর ছড়ায়, তেমনি এর উল্টো পিঠে রয়েছে ভয়ংকর মিথ্যা, কুৎসা আর চরিত্রহননের অবাধ বিচরণ। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে সহজেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। অনেক পুরোনো ছবিকে বর্তমানের ছবি হিসেবে ব্যবহার করে এই গুজবকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়। কে বা কারা এই মিথ্যা খবরটি প্রথম ছড়িয়েছিল, তা হয়তো আমরা জানতেও পারিনি, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই চোখ বন্ধ করে তা বিশ্বাস করে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। আর একবার যখন মিথ্যা ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা ফিরিয়ে আনা বা তার ক্ষতি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এটাই আমাদের বর্তমান সামাজিক মাধ্যমের বাস্তবতা। এখানে সত্যের তুলনায় মিথ্যার গতি অনেক বেশি। কেউ যদি চায়, সহজেই কারও সম্মান নষ্ট করে দিতে পারে। কারণ, এখানে দায় নেই, জবাবদিহি নেই। কেউ ভুল কিছু পোস্ট করলে সেটি একবার ভাইরাল হয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। খবরের কাগজে ভুল হলে সংশোধনী ছাপা যায়, টিভিতে ভুল হলে ক্ষমা চাওয়া যায়—কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভুল পোস্টের পরিণতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

মিথ্যার এক ভয়ংকর জালে আটকে যাচ্ছে আমাদের পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কিশোর-কিশোরীরা এখন রাতে ঘুমায় না—রিল দেখে, লাইকের নেশায় ছুটে চলে, অচেনা পরিচয়ের মোহে গড়ে তোলে সম্পর্ক, আর ধোঁয়াটে এক ‘পর্দার সুখ’-কে বাস্তব ভেবে মজে যায় অবাস্তবের জগতে। একেকটা রঙিন ফ্রেমে বন্দী হয়ে ভেঙে পড়ছে বাস্তব জীবন। ঘর ভাঙছে, সম্পর্ক ভাঙছে, ভালোবাসা বদলে যাচ্ছে সাময়িক উত্তেজনায়। মা সন্তান ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে, স্বামী নীরবে দ্বিতীয় বিয়ে করছে। এই নকল সুখ খুঁজতে গিয়ে মানুষ হারিয়ে ফেলছে জীবনের আসল মানে—শান্তি, দায়িত্ব আর মূল্যবোধ।

‘রিলস’ এখন এক ভয়ংকর ডিজিটাল মাদক। একবার যার নেশায় পড়লে সময়, বিচারবুদ্ধি, বাস্তবতা—সব হারিয়ে যায়। এখানে সত্য-মিথ্যার কোনো বাছাই নেই, যা খুশি তা-ই পোস্ট—গল্প হোক বা গুজব, অপমান হোক বা উসকানি। সামাজিক অনুশাসন, পারিবারিক মূল্যবোধ, নৈতিকতার দেয়াল ভেঙে পড়ছে মুহূর্তে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বুদ্ধিমান-নির্বোধ, মানবিক-অমানবিক—সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে এক মঞ্চে, যেখানে বিভ্রান্তি আর উগ্রতা হয়ে উঠেছে বিনোদনের অংশ।

মিথ্যা, কুৎসা, চরিত্রহনন মানুষের পুরোনো অভ্যাস হলেও এখন তার বিস্তার আগুনের মতো—তীব্র, দ্রুত, নিয়ন্ত্রণহীন। অতীতে এমন দ্রুতগতির ও শক্তিশালী মাধ্যম ছিল না। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে মানুষ এমনিতেই নিঃসঙ্গ, সামাজিক মাধ্যম সেই একাকিত্বে ঢেলে দিচ্ছে আরও বিষ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম—বাড়ির ভেতর আটকে থাকা এই প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যমকে আঁকড়ে ধরছে জীবনের বিকল্প হিসেবে। দারিদ্র্যপীড়িত, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া মধ্যবিত্ত-গরিবের কাছে এখন মোবাইল ফোনই একমাত্র সঙ্গী। পেটে ক্ষুধা থাকলেও হাতে মোবাইল ফোন থাকে, ফেসবুক স্ক্রল হয়—আর তাতেই জীবনের চালচিত্র বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু ভয়ংকরভাবে।

আর সবচেয়ে বিপদের দিক হলো, সামাজিক মাধ্যম এখন রাজনীতিরও প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিপক্ষকে হেয় করতে। ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে দাঙ্গার চেষ্টা চলছে। বিদেশি ঘটনার ভিডিওকে দেশের বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে কেউ, যেকোনো কিছু লিখে দিচ্ছে—কেউ সাংবাদিক না হয়েও ‘সংবাদ’ দিচ্ছে, কেউ সত্য যাচাই না করেই ‘বিশ্লেষণ’ করছে। এতটাই ভয়াবহ হয়েছে অবস্থা যে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য প্রায় বিলুপ্ত।

ভাবুন, যদি গোয়েবলসের হাতে থাকত আজকের এই ফেসবুক বা ইউটিউব—তাহলে তিনি কী করতে পারতেন? হয়তো বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতেন মানবজাতির জন্য। কারণ গোয়েবলস জানতেন, মিথ্যা দিয়ে একে একে সত্যকে দমন করা যায়। তবে তিনি এটাও জানতেন—বিদ্রোহ হলে তিনিই সবার আগে মরবেন। তাই হিটলারের মৃত্যুর পরপরই নিজের স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন।

আমাদের বর্তমান সমাজেও ‘গোয়েবলস’ আছে। তাদের চেহারা আলাদা, কিন্তু উদ্দেশ্য একই—মিথ্যা বলো, আবার বলো, যতক্ষণ না সেটি কেউ বিশ্বাস করে। এই প্রতারণার জালে আটকা পড়ছে সাধারণ মানুষ। আর সেটিকে সহায়তা করছে প্রযুক্তি, যেটি আসলে আমাদের জীবন সহজ করার কথা ছিল।

অবশ্য স্মার্টফোনের সুফল অস্বীকার করা যায় না। ঘরে বসে ব্যাংকিং, কেনাকাটা, যোগাযোগ, এমনকি কাজও করা যায়। কিন্তু সেই সুযোগের পাশাপাশি এসেছে ভয়ংকর একটি আসক্তি—অবিরাম স্ক্রলিং, রিল দেখা, নিজেকে সব সময় প্রকাশ করার তাড়া। এই নেশা এমন যে, সময় কেটে যায়, জীবনের মূল্যবান মুহূর্ত হারিয়ে যায়।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? শক্ত আইন নিশ্চয়ই দরকার। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্ট’ অনেকটাই মিথ্যা রটনা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ফ্যাক্ট চেকিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে মিথ্যা শনাক্ত করার প্রযুক্তি চালু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কী হচ্ছে? আমরা কি এভাবেই চলতে থাকব?

সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো—এই মিথ্যার বাজারে অনেক সময় রাষ্ট্র নিজেই সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তথ্য বিকৃতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব ছড়ানো কিংবা বিরুদ্ধস্বরে কুৎসা ছড়ানো যেন এক অঘোষিত কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক বিষাক্ত চক্রের মুখোমুখি—যেখানে রাষ্ট্র, প্রযুক্তি ও জনমন একসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে অসত্যের পক্ষে। এককথায়, ‘শর্ষের মধ্যেই ভূতের বাস’।

এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে দায় ঘাড়ে নিতে হবে প্রত্যেক নাগরিকের। আমাদের প্রত্যেককে প্রশ্ন করতে হবে—আমি কি যাচাই করে তথ্য শেয়ার করছি? আমি কি সত্য জানতে চাই, না শুধু নিজের বিশ্বাসকে সন্তুষ্ট করতে চাই? যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে, ততক্ষণ প্রযুক্তি মুক্তির চাবিকাঠি নয়, বরং ধ্বংসের তির।

সতর্ক না হলে, এই মিথ্যার ফুলঝুরি একদিন এমন এক আগুন ছড়াবে, যা সমাজকে শুধু ভেঙে ফেলবে না—ভেতর থেকে সম্পূর্ণভাবে গলিয়ে দেবে। তখন আর কারও কিছু করার থাকবে না। তাই এখনই সময়, সত্যকে আঁকড়ে ধরার। নয়তো প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মোবাইল ফোন আর প্রতিটি পোস্ট একেকটি ‘ছোট গোয়েবল্স’ হয়ে এই সমাজকেই কফিনে পুরে ফেলবে—আর আমরা নিজেদের ধ্বংস নিজের হাতে ডেকে আনব।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

নির্বাচনী সমঝোতা: এখনো হিসাব মেলাচ্ছে জামায়াত ও এনসিপি

তীব্র শীতে কাঁপছে মানুষ গুদামে তালাবদ্ধ কম্বল

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে— শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

নীলফামারীর ৪টি আসন: চমকে দিতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

সম্পাদকীয়
খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।

গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।

এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

নির্বাচনী সমঝোতা: এখনো হিসাব মেলাচ্ছে জামায়াত ও এনসিপি

তীব্র শীতে কাঁপছে মানুষ গুদামে তালাবদ্ধ কম্বল

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে— শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

নীলফামারীর ৪টি আসন: চমকে দিতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

অরুণ কর্মকার
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।

দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।

প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!

তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?

কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

নির্বাচনী সমঝোতা: এখনো হিসাব মেলাচ্ছে জামায়াত ও এনসিপি

তীব্র শীতে কাঁপছে মানুষ গুদামে তালাবদ্ধ কম্বল

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে— শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

নীলফামারীর ৪টি আসন: চমকে দিতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

হাসান আলী 
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা দূরত্বে—কিন্তু বন্ধু থাকে অনুভবের কাছাকাছি।

প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বড় শত্রু একাকিত্ব। ঘরের ভেতর থেকেও মানুষ একা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার মানুষ থাকে না, দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করার কেউ থাকে না। এই নীরবতার মধ্যে একজন বন্ধুর ফোনকল, বিকেলের আড্ডা বা একসঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া—সবই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বন্ধু মানে কেবল হাসি নয়, বন্ধু মানে নিজের মতো করে কথা বলার স্বাধীনতা।

পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় দায়িত্ব আর প্রত্যাশায় বাঁধা। সন্তানেরা বাবা-মাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সব কথা বলা যায় না। নিজের ভয়, হতাশা, মৃত্যুচিন্তা কিংবা ব্যর্থতার অনুভূতি—এই বিষয়গুলো সন্তানদের সামনে প্রকাশ করতে প্রবীণেরা সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু একজন বন্ধু সেই জায়গা, যেখানে কোনো বিচার নেই, আছে কেবল শোনা আর বোঝা। বন্ধুর কাছে কান্নাও নিরাপদ।

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব মানে স্মৃতির ভাগাভাগি। একই সময়ের মানুষ, একই সমাজ, একই লড়াই—এই মিলগুলো বন্ধুত্বকে গভীর করে তোলে। একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করলে কেবল স্মৃতি নয়, নিজেদের অস্তিত্বও নতুন করে আবিষ্কার হয়। ‘আমি ছিলাম, আমি করেছি’—এই অনুভূতি আত্মসম্মান জাগিয়ে তোলে, যা বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

মনোবিজ্ঞানের মতে, প্রবীণ বয়সে ভালো বন্ধুত্ব ডিমেনশিয়া ও বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায়। কারণ, কথা বলা, হাসা, মতবিনিময়—সবই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একজন প্রবীণ যখন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তখন তাঁর মনও সচল থাকে, জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে না। বন্ধুত্ব মানে শুধু সময় কাটানো নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা।

বন্ধু না থাকলে প্রবীণেরা অনেক সময় নিজেদের বোঝা মনে করেন। মনে হয় তাঁরা শুধু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই ধারণা ভেঙে যায়। তখন তাঁরা আবার একজন মানুষ—যার গল্প আছে, মতামত আছে, রসিকতা আছে। বন্ধুত্ব প্রবীণকে ‘রোগী’ থেকে আবার ‘মানুষ’ বানিয়ে তোলে।

আমাদের সমাজে প্রবীণদের বন্ধুত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ করা হয়। বলা হয়, ‘এই বয়সে আবার বন্ধু!’ অথচ এই বয়সেই বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তখন জীবনের অধিকাংশ দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধুত্বই একমাত্র জানালা দিয়ে আলো ঢোকে। প্রবীণদের বন্ধুত্ব মানে জীবনের শেষ অধ্যায়ে মানবিক উষ্ণতা।

বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, জীবনসঙ্গী হারিয়েছেন, সন্তানেরা দূরে—তাঁদের জন্য বন্ধুই পরিবার। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা বা শুধু পাশে বসে থাকা—বন্ধু এই কাজগুলো নীরবে করে যায়। কোনো রক্তের সম্পর্ক না হয়েও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে রক্তের চেয়েও ঘনিষ্ঠ।

প্রবীণদের বন্ধুত্ব তরুণদের জন্যও একটি শিক্ষা। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে সহমর্মিতা। এখানে লাভ-ক্ষতি নেই, আছে সময় দেওয়া। প্রবীণ বন্ধুরা একে অপরকে ব্যবহার করেন না, তাঁরা একে অপরকে থাকতে দেন। এই থাকার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিকতার সৌন্দর্য।

আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন—যাঁদের ভালো বন্ধু আছে, তাঁদের চোখে আলোর ঝিলিক থাকে। শরীর ভাঙলেও মন ভাঙে না। আর যাঁরা একা, তাঁদের চোখে ক্লান্তি। তাই প্রবীণকল্যাণ মানে শুধু ওষুধ বা খাবার নয়—বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করাও।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বলে থাকলে অন্ধকার ভয়ের নয়। বয়স বাড়ে, শরীর ঝরে—কিন্তু বন্ধুত্ব থাকলে মন সব সময় তরুণ থাকে। আর তরুণ মনই তো আসল জীবন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

নির্বাচনী সমঝোতা: এখনো হিসাব মেলাচ্ছে জামায়াত ও এনসিপি

তীব্র শীতে কাঁপছে মানুষ গুদামে তালাবদ্ধ কম্বল

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে— শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

নীলফামারীর ৪টি আসন: চমকে দিতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

সাদিয়া সুলতানা রিমি
সংকট, সম্ভাবনার  সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেও শান্ত থাকা যায়, কীভাবে উত্তেজনার মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা যায়। ইতিহাস আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, সংকটের সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এই অস্থির সময়ের কেন্দ্রে রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড। আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই গভীর শোকের কারণ। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যে কণ্ঠ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; তরুণদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিল আশা, সাহস ও প্রতিবাদের ভাষা। সেই কণ্ঠ আজ নীরব। আর এই নীরবতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

একজন নাগরিকের প্রাণহানি কখনোই ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হতে পারে না। বিশেষত, যখন সেই নাগরিক একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। হাদির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই হত্যার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ন্যূনতম কর্তব্য। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণ, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা এবং পরিবারটির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত এই দায়বদ্ধতারই একটি বার্তা দেয়। তবে ঘোষণা ও আশ্বাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারলে এমন হত্যাকাণ্ড ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

কিন্তু শোক ও ক্ষোভের প্রকাশ যখন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন তা নিজ উদ্দেশ্যকেই নস্যাৎ করে। হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় এবং দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মানে কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়; এগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে গণতন্ত্রের শিরায় আঘাত করা। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক না কেন সহিংসতা কখনোই ন্যায্যতা পায় না।

বিশেষ করে, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করার ঘটনা আমাদের আরও সতর্ক করে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। মতভিন্নতার কারণে কাউকে শত্রু বানিয়ে ফেলার এই প্রবণতা সমাজকে বিভক্ত করে, যুক্তিকে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতার পথ প্রশস্ত করে। আজ যদি আমরা যুক্তির বদলে লেবেলিংকে বেছে নিই, তবে কাল আর কেউই নিরাপদ থাকবে না।

এই অস্থিরতার পেছনে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য বড় ভূমিকা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাইহীন তথ্য, আবেগতাড়িত পোস্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার মুহূর্তের মধ্যে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডিজিটাল যুগে দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়; বরং তথ্য যাচাই করা, সংযত ভাষা ব্যবহার করা এবং উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে বিরত থাকা। এক একটি ভুয়া পোস্ট এক একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ—যা পুরো সমাজকে দগ্ধ করতে পারে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জনও সমান জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। পুলিশি তৎপরতা যদি একপক্ষীয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে তা উত্তেজনা কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেবে। তাই শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সংলাপ, ব্যাখ্যা ও আস্থার রাজনীতি জরুরি।

একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উসকানি নয়, সংলাপ; প্রতিহিংসা নয়, সহনশীলতা—এই নীতিই হতে হবে পথনির্দেশক। দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে প্রতিটি দলের ধৈর্য ধরার পরীক্ষা চলছে। নেতারা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, কর্মীদের সংযত না করেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহুকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।

নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়; এটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। অস্থিতিশীলতা সেই ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দেয়। শরিফ ওসমান হাদির স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে অক্ষুণ্ন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হলে সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই শক্তিশালী করতে হবে।

বিশেষ করে তরুণসমাজের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদির কণ্ঠ যে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছিল, আজ তাদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই দর্শনই পারে দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে। আবেগের বশে নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারে।

বাংলাদেশ আজ সংকট, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে শোক, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা; অন্যদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনা। কোন পথ বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের সামষ্টিক প্রজ্ঞা ও সংযমের ওপর। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয় বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদি আমরা এই শক্তিকে ধারণ করতে পারি, তবে হাদির রক্ত বৃথা যাবে না; বরং তা হয়ে উঠবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে এক কঠিন কিন্তু আশাব্যঞ্জক সংগ্রামের প্রেরণা।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

নির্বাচনী সমঝোতা: এখনো হিসাব মেলাচ্ছে জামায়াত ও এনসিপি

তীব্র শীতে কাঁপছে মানুষ গুদামে তালাবদ্ধ কম্বল

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে— শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

নীলফামারীর ৪টি আসন: চমকে দিতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত