Ajker Patrika

প্রতিটি শিক্ষার্থী এক একটি ফুটন্ত গোলাপ

ড. তামান্না তাসকীন
সন্তানের জন্য মায়ের বিলাপ। ছবি: আজকের পত্রিকা
সন্তানের জন্য মায়ের বিলাপ। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের প্রতিটি কোণে আজ ভারী আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। চোখের পানি ঝরছে তো ঝরছেই সেই কবে থেকে। গত বছর জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা রাজপথে ঝরে পড়েছিল। তাজা তাজা প্রাণগুলো বুলেটের আঘাতে নিষ্পেষিত হয়ে রাজপথে পড়ে ছিল। ‘আমায় অনেক বড় ডিগ্রি দিছে মা, এই ডিগ্রি বড় ভারী, মাগো বইতে নাহি পারি’—গানটা এখনো কানে বাজে। আজ এক বছর বাদে আবার একটা জুলাই এল, যেখানে একটা ফুলের বাগানের মতো পবিত্র জায়গা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটা আস্ত যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ল। সেই বাগানের ছোট্ট ছোট্ট ফুলগুলোকে কেউ যেন টেনে-ছিঁড়ে উপড়ে দিল। আহত মানুষের আহাজারি শোনা যায় না, আর এরা তো শিশু। যাদের স্কুলের জুতোটা পর্যন্ত মা-বাবাকে বেঁধে দিতে হয়। স্কুলের টিফিনের খাবারটা যেন ঠিকমতো খায় সেই কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়। সেই স্কুলের শিশুরা এত কষ্ট কীভাবে সহ্য করল আমি জানি না।

অনেক বছর আগে একবার শৈশবে আমার বাসায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে, আর তাতে আমার ডান হাতটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। তখন ঢাকা শহরে কোনো বার্ন ইনস্টিটিউট ছিল না। আমার বাবা তাঁর পাঁচ বছরের কন্যাশিশুটিকে কোথায় নিয়ে যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। আমার আর্তচিৎকারে আমার বাবা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। আমাকে কোলে নিয়ে ছুটে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার মনে আছে জ্ঞান থাকা পর্যন্ত আমি শুধু সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে যাচ্ছিলাম। এর পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। আমার ভুল চিকিৎসা হয়। তাতে আমার ইনফেকশন বেড়ে যায়। আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। তারপর আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে একটি বছর লেগে যায়। তা-ও পুরোপুরি কোনো দিন আর আগের মতো স্বাভাবিক হয়নি। পোড়া হাত দেখলে সবাই ভয় পেত বলে ছোটবেলায় আমি আমার ডান হাত সহজে কাউকে দেখাতাম না। মানুষের করুণা আমার অপছন্দ, তাই সেই হাত নিয়ে কারও সামনে যেতাম না।

এত কথা বলার কারণ কাউকে আমার কষ্টের কথা শোনানো নয়, বরং এটা বলা যে এই শোক কেউ ভুলে যাবেন না। ঢাকা শহরের আকাশে যুদ্ধবিমান ওড়ে, এটাই আমার জানা ছিল না। যে ঢাকাকে আধুনিক নগরী বানাতে গিয়ে এত আয়োজন, সেখানে যুদ্ধবিমানকেও উড়িয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া লাগবে কেন আমি বুঝতে পারছি না।

শিক্ষক হিসেবে যখন আমি ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করি, তখন আমার মনে হয় প্রতিটি শিক্ষার্থী এক একটি ফুটন্ত গোলাপ, যারা শিক্ষা নামক আলো পেয়ে শুধু ফোটার অপেক্ষায় থাকে। আবার যখন তাদের সমস্যা নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলি, তখন তাদের উদ্বিগ্ন দেখলে বুঝতে পারি যে বাবা-মা মানে শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়া নয়, অভিভাবক মানে ত্যাগ স্বীকার করা। কিন্তু এ কেমন ত্যাগ যে কোনো দিন আর সেই ‘বাবা-মা’ ডাকটাই শুনতে পাবেন না? এ কেমন জীবন, যে তাকে আর কখনো দেখতে পাবে না?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আহতদের ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে। মোবাইল হাতে একদল বেরিয়ে পড়েছে ছবি তুলে ভিডিও দিয়ে ভিউ বাড়াতে। এমন বিপদে রাস্তায়, হাসপাতালে মানুষ নামক দর্শনার্থীদের ভিড় দেখলে অবাক লাগে ভাবতে, আমরা কোন সভ্যতায় বাস করি যেখানে কারও কষ্ট দেখার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? এমন দুর্ঘটনায় রাস্তাঘাট অচল করে দর্শনার্থীদের এমন আচরণ কম নিষ্ঠুর নয়। শিশুদের পাশে থাকার নামে তাদের পুড়ে যাওয়া দেহের ছবি প্রকাশ করার কোনো মানে হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আদালত যদি বিবেক হয়, তাহলে সেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মন থেকে নিহত-আহত সবার পাশে দাঁড়াই। প্রশ্ন করি, কেন এমন ঘটনা ঘটল? এই জায়গায় আমার সন্তান থাকলে কী করতাম আমি? টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে যেভাবে দাফনের মর্মান্তিক দৃশ্য ধারণ করাসহ লাইভে দেখানো হচ্ছে, তাতে কার কী উপকার হচ্ছে জানি না, তবে আমার মতে কিছুদিন চলার পর আমরা আবার যা ছিলাম তা-ই রয়ে যাব। ভুলে যাব আজকের দিনের এমন দুর্যোগের কথা। ঠিক যেমন রানা প্লাজার ঘটনা ভুলে গিয়েছি।

আনুষ্ঠানিকতাকে আমরা বড্ড বেশি জায়গা দিয়ে ফেলেছি। আবেগকে দিয়েছি প্রদর্শনের জায়গা। এমনটা যেন আর না হয় তার জন্য কী পদক্ষেপ আসে, তার বাস্তবতা দেখতে চাই। নাকি এমন হলো যে, চোখ খুলে দেখলাম

সময় কোথায়? সময় তো শেষ। বাংলাদেশের প্রতিটা শিশু আপনার-আমার সন্তান। আমরা সবাই তাদের হেফাজতের জন্য একত্রে কাজ করব। কারও কষ্ট দেখে শুধু বিলাপ

করার সময় এটা নয়। আপনার-আমার সবার দায়িত্ব এই দুর্যোগে আর্তদের সাহায্য করা। কিছু করতে না পারলে অন্তত দোয়া করি—মহান সৃষ্টিকর্তা যেন সব সময় আমাদের সন্তানদের পাশে থাকেন।

সবশেষে বলতে চাই, মাহরীন চৌধুরী নামের একজন শিক্ষক, যিনি শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি কিন্তু শিক্ষক হিসেবে নয়, মা হিসেবে নিজেকে চিন্তা করে এমন আত্মাহুতি দিয়ে গেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন, এই শিশুরাই তাঁর সন্তান আর তিনি তাদের মা, যেখানে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে বড় হলো আবেগ।

লেখক;– সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তর্কে জড়ানো চিকিৎসককে বরখাস্তের নির্দেশ ডিজির

সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছে, তারেক রহমান ফিরবেন যেকোনো সময়: আমীর খসরু

শেখ হাসিনা যত দিন ইচ্ছা ভারতে থাকতে পারবেন কি—জবাবে যা বললেন জয়শঙ্কর

খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত, মেডিকেল বোর্ডের সবুজসংকেতের অপেক্ষা

কর্মী নেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, নেই বয়সসীমা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গণতন্ত্র অধরা এখনো

সম্পাদকীয়
গণতন্ত্র অধরা এখনো

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর আয়োজনে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে উঠে এসেছে বাংলাদেশের টেকসই গণতন্ত্রের দুর্বলতা। আজকের পত্রিকায় ৩ ডিসেম্বর এ নিয়ে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূল চালিকা শক্তি ছিল একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করলেও গণতন্ত্র উত্তরণের পথ বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য দায়ী মূলত ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দল এবং রাজনীতিকেরা।

গণতন্ত্রের প্রাণ হলো অবাধ, গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিগত সরকারের সময়ে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে নানা অভিযোগ ছিল। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, বলপ্রয়োগ এবং ভোটের দিন সাধারণ মানুষের ভোট দিতে না পারার কারণে জনগণের ভোটের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে দলীয় বৃত্তের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। সংসদ এক দলের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ায় তা কার্যকর বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারেনি।

এর বাইরে বিচার বিভাগ সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হলেও, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়েও প্রশ্ন আছে। একই সঙ্গে সরকারি প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর একটি অংশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে, যা তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

গত সরকারের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগের পরেও কি আমরা বলতে পারি, গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার বিগত সরকারের সময়ের সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে? উত্তর হবে ‘না’। কারণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথের পথিক বলে অভিযোগ আছে। বিগত সরকারের পতনের পরপরই সচিবালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ থেকে সব ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। সেসব জায়গায় এখনকার প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তাদের দলীয় আনুগত্যের লোকজন বসিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তাহলে এ দেশে কীভাবে গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব হবে?

বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এই সংকট থেকে মুক্ত করতে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন, যার কেন্দ্রে থাকবে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী করা, যাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব হয় এবং জনগণ স্থানীয় পর্যায়ে অংশীদারত্বের ভূমিকা পালন করতে পারে সরাসরি।

তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংকট যেমন রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি, তেমনি এর সমাধানও দ্রুত সম্ভব নয়। এই উত্তরণের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অনুধাবন করতে হবে, গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। কেবল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক এবং শক্তিশালী কাঠামোগত ব্যবস্থার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক উত্তরণ অর্জন সম্ভব হতে পারে। এই সংকটে জনগণই শেষ ভরসা। বৃহত্তর জনগণের অংশগ্রহণ, সচেতনতা এবং জবাবদিহির দাবিই পারে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া সেটা সম্ভব না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তর্কে জড়ানো চিকিৎসককে বরখাস্তের নির্দেশ ডিজির

সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছে, তারেক রহমান ফিরবেন যেকোনো সময়: আমীর খসরু

শেখ হাসিনা যত দিন ইচ্ছা ভারতে থাকতে পারবেন কি—জবাবে যা বললেন জয়শঙ্কর

খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত, মেডিকেল বোর্ডের সবুজসংকেতের অপেক্ষা

কর্মী নেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, নেই বয়সসীমা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি খুবই অস্থিতিশীল!

অরুণ কর্মকার
দেশের রাজনীতিতে সংকট, অস্থিতিশীলতাও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনীতিতে সংকট, অস্থিতিশীলতাও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কখনোই যে প্রকৃত অর্থে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল ছিল তা বলা যাবে না। এখনো যে তা আছে তেমনও নয়। কিন্তু সেটা কি এমন মাত্রার যাতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা যাবে না? রাজনীতিতে কী এমন সংকট এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে যাতে তফসিল ঘোষণা বন্ধ রাখতে বা পিছিয়ে দিতে হবে? কিন্তু তেমনই একটি প্রসঙ্গ তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গত বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে এক বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতার এমন সময়ে সংকট উত্তরণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) অনুরোধ জানিয়েছে এনসিপি।

ওই বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যখন আসবে তখন তফসিল দেওয়া হলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কেন তফসিল পেছাতে চাইব? আমরা চাই সংকট সমাধান করে তফসিল দেওয়া হোক।’ রাজনৈতিক সংকট ও অস্থিতিশীলতার প্রসঙ্গটি এনসিপি নেতারা এমন সময় জনসমক্ষে আনলেন যখন পূর্বঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তো তফসিল ঘোষণার কথা কমিশন বলেছিল। এখন এনসিপি নেতাদের বক্তব্যের সূত্র ধরেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংকটের প্রসঙ্গটি জনপরিসরে এসেছে এবং বহুল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।

সিইসির সঙ্গে এনসিপি নেতাদের বৈঠকের বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাকেই তাঁরা রাজনীতিতে সংকটময় এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বলতে চেয়েছেন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনো কথা শোনা যায়নি। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা যে অত্যন্ত সংকটময়, যেমনটি এর আগে কখনো হয়নি সে কথা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগেই দেশবাসীকে অবহিত করেছেন। হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলেছে। একই সঙ্গে বিএনপির দলীয় এবং নির্বাচনী কার্যক্রমও চলেছে। এর মধ্যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংকটের তো কিছু নেই। এই কারণে রাজনীতিতে নতুন করে কিছু অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।

হ্যাঁ, খালেদা জিয়ার সংকটময় স্বাস্থ্য পরিস্থিতির খবরে দেশবাসীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটা উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। কারণ, তিনি দেশের সবচেয়ে বড় একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রী হিসেবে দেশবাসীর কাছে পরম শ্রদ্ধাভাজন। সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিকদের একজন। তাঁর জন্য সারা দেশের মানুষ তাই প্রার্থনা করেছে। দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং মানুষের প্রার্থনা ও ভালোবাসায় তিনি লন্ডনে যাওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন। আমরা আশা করি তিনি এবার হাসপাতালে ভর্তির আগের অবস্থায় কিংবা তার চেয়েও সুস্থ হয়ে স্বস্থানে ফিরে আসবেন।

খালেদা জিয়া তো দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। তিনি দলের চেয়ারপারসন হয়েও এই দীর্ঘ অসুস্থতার সময়ে কি দলের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পেরেছেন? কিংবা এবারও তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর কি দল এবং দলের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন? এমনকি তিনি যে তিনটি আসনে প্রার্থী হবেন বলে দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, সেই আসনগুলোতে তিনি কি সশরীরে নির্বাচনী প্রচারে যেতে পারবেন? দীর্ঘদিন ধরে হার্ট, কিডনি, লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গের অসুস্থতা, সঙ্গে ডায়াবেটিস আক্রান্ত ৮০ বছর বয়সী একজন মানুষের পক্ষে কি তা সম্ভব? সম্ভব নয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে খালেদা জিয়া যে কটি আসনে প্রার্থী হবেন, সবগুলোতে বিজয়ী হবেন। এমনকি লন্ডনের হাসপাতালে বসে নির্বাচন করলেও। তা ছাড়া এমন সম্ভাবনাও আছে যে খালেদা জিয়া যে কটি আসনে প্রার্থী হবেন অন্য কোনো দল সেই আসনগুলোতে প্রার্থীই দেবে না। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে রাজনীতির সংকটময় এবং অস্থিতিশীল বলা যেতে পারে আমরা জানি না।

তবে দেশের রাজনীতিতে সংকট আছে। অস্থিতিশীলতাও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার কোনো সম্পর্ক নাই। সম্পর্ক আছে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে কি না তা নিয়ে মানুষ নিঃশঙ্ক নয়। এটা একটা বড় সংকট। মানুষের আস্থার সংকট। আরও সংকট আছে। একই দিনে সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটের সিদ্ধান্ত জামায়াতসহ যে দলগুলো বা যে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মানতে কষ্ট হচ্ছে, তাদের ভূমিকা শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে। এটা আরেকটা বড় সংকট। আরও সংকট আছে। নির্বাচনের মাঠে সব রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ পাবে কি না তা নিয়ে এনসিপির যে উদ্বেগ সেটাও একটা বড় সংকট। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তো স্পষ্ট করেই বলেছেন ‘এখন যে ডিসি-এসপিদের নিয়োগ-বদলি করা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যেন সে বিষয়ে খেয়াল রাখে। সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব আছে বলে আমরা মনে করি। এই বিষয়ে যেন ইসি ব্যবস্থা নেয় এবং নিরপেক্ষ লোক যেন নিয়োগ হয়।’ এর আগে তাঁরা নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট আখ্যায়িত করে কমিশন পুনর্গঠনের দাবিও তুলেছিলেন। সেই পুনর্গঠন তো হয়নি। এই যে নানা ধরনের ক্ষতগুলো রাজনীতিতে রয়েছে, সেগুলোই সংকট। যথেষ্ট পুষ্টি উপাদান পেলে এর যেকোনো একটি ক্ষত ক্যানসারের মতো গুরুতর সংকট হয়ে উঠতে পারে। এর কোনোটির সঙ্গেই খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি তো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম বন্ধ করে বসে নেই! গত বৃহস্পতিবারও তো বিএনপি ৩৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি চলেছে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর সব প্রক্রিয়া-প্রস্তুতিও। এখানে তো কোনো সংকট দেখা যাচ্ছে না।

সংকট আরও অনেক রকম আছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কংগ্রেসের মহাসচিব অ্যাডভোকেট ইয়ারুল ইসলাম এ রিট দায়ের করেন। আগামীকাল রোববারই হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে রিট আবেদনটির শুনানি হতে পারে। এই রিট আবেদনে সংসদ নির্বাচনে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার পরিবর্তে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ হবে না, এই মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে। যুক্তি হলো, সংবিধান অনুসারে নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। এই কাজে নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রতিটি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগকে দেওয়া হয়। নির্বাহী বিভাগ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করে। ফলে নির্বাচন নিয়ে নানামুখী বিতর্ক তৈরি হয়। অত্যন্ত জোরালো যুক্তি। দীর্ঘদিন ধরেই এসব প্রশ্ন ছিল। নিরসন হয়নি। ফলে এগুলোও রয়ে গেছে সংকট হিসেবে। এসবের মীমাংসা হওয়া জরুরি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তর্কে জড়ানো চিকিৎসককে বরখাস্তের নির্দেশ ডিজির

সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছে, তারেক রহমান ফিরবেন যেকোনো সময়: আমীর খসরু

শেখ হাসিনা যত দিন ইচ্ছা ভারতে থাকতে পারবেন কি—জবাবে যা বললেন জয়শঙ্কর

খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত, মেডিকেল বোর্ডের সবুজসংকেতের অপেক্ষা

কর্মী নেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, নেই বয়সসীমা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বায়ুদূষণ: আজকের ভুলে আগামীর ঝুঁকি

ফারিহা জামান নাবিলা
বায়ুতে ধুলা, ধোঁয়া, কার্বন—সব মিলিয়ে বায়ুদূষণ এখন চরম পর্যায়ে চলে গেছে।	ছবি: সংগৃহীত
বায়ুতে ধুলা, ধোঁয়া, কার্বন—সব মিলিয়ে বায়ুদূষণ এখন চরম পর্যায়ে চলে গেছে। ছবি: সংগৃহীত

যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না—আজ সেই অদৃশ্য বাতাসই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে নীরব খুনির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ শব্দ করে আঘাত করছে না, কেউ সতর্ক করছে না। তবুও নিঃশব্দে ক্ষতি করে যাচ্ছে প্রতিটি শ্বাসে। আমরা চোখে দেখতে পাই না, কিন্তু নীরবে ধীরে অদৃশ্য শত্রুর মতো বায়ুদূষণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। তারা এমন এক পৃথিবীর দিকে হাঁটছে, যেখানে নির্মল বাতাস বিলাসিতা হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বড় বড় শহর এখন বায়ুদূষণের চরম ঝুঁকিতে। বায়ুতে ধুলা, ধোঁয়া, কার্বন—সব মিলিয়ে বায়ুদূষণ এখন চরম পর্যায়ে চলে গেছে। শিশুদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি বায়ুদূষণ। বাংলাদেশের রাজধানী শহর প্রায়ই বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় উঠে আসছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও বিকাশকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলছে এবং ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

শহরের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা ও কাশির হার বাড়ছে। ইটভাটা ও যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে শহরজুড়ে বাতাস প্রায় ধোঁয়াটে হয়ে থাকে, যা শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুসের ক্ষতি করে। বায়ুদূষণ শুধু আজকের নয়, এটি সরাসরি আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে আঘাত করছে।

বায়ুদূষণ শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটা মানুষের স্বাস্থ্য, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য এক গভীর সংকট। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে বায়ুদূষণের কারণে। দেশে শিল্প এলাকা, ইটভাটা, কারখানা ও যানবাহনের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। ফলে বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাস, ধোঁয়া, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডসহ নানা দূষণ উপাদান মিশে যাচ্ছে। শিশুরা এসব দূষণের প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, দুর্বল ফুসফুস নিয়ে বড় হচ্ছে। শহরে প্রায় সারা বছরই নির্মাণকাজ চলে। এসব কারণে যে ধুলা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে শিশুদের। ধুলাবালুর ছোট কণা ফুসফুসে সরাসরি গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে।

বাতাস বিশুদ্ধ করার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো গাছ। সবুজ কমে যাওয়ায় বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস জমে থাকে এবং পরিষ্কার হওয়ার সুযোগ পায় না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে আগামী প্রজন্মের শ্বাসযন্ত্রে। শিল্প-কারখানার মালিক, যানবাহনের মালিকদের অসতর্কতার জন্য বায়ুদূষণ দেখা দেয়। পরিবেশ আইন থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল হওয়ায় দূষণ কমানোর কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা তৈরি হয় না। প্রাপ্তবয়স্কর তুলনায় শিশুর শ্বাসযন্ত্র বেশি নাজুক। তারা বেশি দ্রুত শ্বাস নেয়, ফুসফুসের বৃদ্ধি চলমান থাকে ফলে দূষিত বাতাস তাদের দেহে আরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। এই কারণেই বায়ুতে থাকা বিষাক্ত কণা তাদের ভবিষ্যৎকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। পুরোনো বাস, ট্রাক ও লেগুনার ধোঁয়াই শহরের বড় দূষণকারী। অনুমোদনহীন ও পুরোনো প্রযুক্তির ইটভাটা বিপুল ক্ষতিকর ধোঁয়া ছাড়ে। ফলে বায়ুদূষণ দিনে দিনে ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।

বায়ুদূষণ থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা এবং পুরোনো গাড়িগুলো রাস্তায় না নামানো। ইলেকট্রিক বা হাইব্রিড গাড়ি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া।

সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ধোঁয়া পরিশোধক যন্ত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে। নিয়ম না মানলে জরিমানা বা লাইসেন্স বাতিল করা উচিত। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ইটভাটা তৈরি করা এবং ক্ষতিকর পুরোনো ভাটা বন্ধ করা। শহর ও গ্রামে গাছ লাগানো, রাস্তার পাশে সবুজ বেল্ট তৈরি করা, যাতে ধুলাবালু কমে ও বাতাস পরিষ্কার থাকে।

মানুষ বুঝে আর না বুঝে বায়ুদূষণ করে নিজের পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষতি করছে। সবাইকে মাস্ক ব্যবহার, অপ্রয়োজনে গাড়ি না চালানো এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দূষণের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, নীতিমালা আপডেট করা এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

বায়ুদূষণ এক দিনে তৈরি হওয়া সমস্যা নয়। তাই সমাধানও এক দিনে হবে না। তবে সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক—সবাই একসঙ্গে কাজ করলে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলানো সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ দেশ দিতে হলে আজ থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—উন্নয়ন হবে, কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে নয়। পরিষ্কার বাতাস আমাদের প্রাপ্য অধিকার এবং তা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তর্কে জড়ানো চিকিৎসককে বরখাস্তের নির্দেশ ডিজির

সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছে, তারেক রহমান ফিরবেন যেকোনো সময়: আমীর খসরু

শেখ হাসিনা যত দিন ইচ্ছা ভারতে থাকতে পারবেন কি—জবাবে যা বললেন জয়শঙ্কর

খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত, মেডিকেল বোর্ডের সবুজসংকেতের অপেক্ষা

কর্মী নেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, নেই বয়সসীমা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নারীরা কি মানুষ নয়

নুসরাত রুষা
নারীরা কি মানুষ নয়

দেশটা তবে কার? প্রশ্নটা শুনতে যত সরল, বাস্তবে ততটাই ভয়ের। বাউলদের গান—অন্তর্ভেদী মানবতার চর্চা—কারও ‘অপছন্দ’ হলে বাউলদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু ওয়াজে নারী বিদ্বেষ, গালাগালি, অপমান, প্রকাশ্য উসকানি দেওয়া হলেও, সেটাকে ধর্মীয় স্বাধীনতার অংশ মনে করা হয়। এই বৈপরীত্যই বলে দেয়—আইনের চোখ সবার জন্য সমান নয়; ক্ষমতা যাদের হাতে, দেশও যেন তাদেরই।

এক সপ্তাহে কয়েকটি ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। নোয়াখালীর বজরা মসজিদ একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, সংস্কৃতির অংশ। সেখানে মেয়েদের ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা, গালাগাল করে ‘বেপর্দা নারী’ বলে কটূক্তি করার একটা ঘটনার অভিযোগ উঠেছে। একজন নারী যখন বললেন, ‘মক্কা-মদিনাতেও তো নারীরা মসজিদে যায়’—তখন পুরো এলাকার মানুষ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যেন যুক্তি ও বাস্তবতা তাদের কাছে অপরাধ, আর নারী হওয়া আরও বড় অপরাধ।

একই সপ্তাহে নরসিংদীতে ঘটেছে আরেকটা ঘটনা। অটোতে একটি ইসলামি দলের দুইজন কর্মী অপরিচিত মানুষ, তাঁরা আমার বন্ধুদের জোর করে ধর্ম গ্রহণের উপদেশ দিতে লাগলেন। বললেন, হিন্দু মেয়ে হলে বাড়তি দুঃখ হয় তাঁদের। তাই ইসলাম গ্রহণ করাই উত্তম! ধর্মের নামে কি এভাবে ঠেলেঠুলে মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায়? এসব কি স্পষ্ট ধর্মীয় জবরদস্তির পর্যায়ে পড়ে না?

সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয়—শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু হিজাব–বোরকা পরিহিত তরুণী অন্য মেয়েদের অপমান করছে শুধু তারা হিজাব পরে না বলে। নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার সামাজিক কাঠামোয় মেয়েদেরই অংশগ্রহণ—এটাই সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। পিতৃতন্ত্র শুধু পুরুষদের হাতে থাকে না; নারীর হাত ধরেও সে বাড়ে, শক্তি পায়।

দেশজুড়ে যে অনানুষ্ঠানিক ‘মোরাল পুলিশিং’ চলছে—এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সংগঠিত একটি মানসিকতা, যা নারীর পোশাক, চলাফেরা, মতপ্রকাশ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কারও হাতে লাঠি নেই, কিন্তু সবার কাছে আইন-শাসনের মতো রায় দেওয়ার মতো ক্ষমতা চর্চার বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের আইনকে উপেক্ষা করে কেউ নিজেকে আইন রক্ষক সাজাচ্ছে, কেউ ধর্মের নামে অভিভাবক আবার কেউ সমাজের নামে বিচারক সাজছে।

এই দেশে মেয়েরা কি নাগরিক? নাকি শুধু নজরদারির বস্তু? যদি বাউলের গান ‘অপমান’ হয়, তবে ওয়াজে নারী বিদ্বেষ অপমান নয় কেন? যদি একজন নারী মসজিদে ঢুকতে না পারা অপরাধ না হয়, তবে তাঁকে গালাগাল করা অপরাধ নয় কেন? যদি হিজাব না পরা ‘অপরাধ’ হয়, তবে মানুষের স্বাধীনতা হরণ করা অপরাধ নয় কেন?

এই দ্বৈত মানদণ্ডের নামই পিতৃতন্ত্র—যেখানে আইন নয়, চলে তাদের ইচ্ছায়; মানবতা নয়, চলে নিয়ন্ত্রণের নেশায়।

বাংলাদেশ কোনো একদল মানুষের নয়। নারীকে ভয় দেখিয়ে, নিয়ন্ত্রণ করে, অসম্মান করে যে সমাজ টিকিয়ে রাখা যায়—এ ধারণা ভ্রান্ত। উন্নত সমাজে নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা, স্বাধীন চলাফেরা—এগুলো মৌলিক বিষয়। আমাদের এখানে এগুলো যেন ক্রমেই বিলাসিতায় পরিণত হচ্ছে।

সময় এসেছে এই অঘোষিত মোরাল পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। প্রশ্ন করার—কারা আপনাদের এই অধিকার দিল? ধর্মের নামে অপমান, সমাজের নামে গালিগালাজ, নৈতিকতার নামে নিপীড়ন—এসব মানবতা নয়, ক্ষমতার প্রদর্শন।

বাংলাদেশের নারীরা আর কারও অনুমতির অপেক্ষায় নেই। রাস্তায়, ক্যাম্পাসে, মসজিদে, রিকশায়—সব জায়গায় তারা সমান নাগরিক অধিকার পাবে, সেটাই রাষ্ট্রীয় নিয়ম হওয়ার কথা ছিল। অধিকার নিয়ে, মর্যাদা নিয়ে, ভয়হীনভাবে বাঁচার জন্য রাষ্ট্রে যে জায়গা তাদের, সেটা ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তর্কে জড়ানো চিকিৎসককে বরখাস্তের নির্দেশ ডিজির

সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছে, তারেক রহমান ফিরবেন যেকোনো সময়: আমীর খসরু

শেখ হাসিনা যত দিন ইচ্ছা ভারতে থাকতে পারবেন কি—জবাবে যা বললেন জয়শঙ্কর

খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত, মেডিকেল বোর্ডের সবুজসংকেতের অপেক্ষা

কর্মী নেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, নেই বয়সসীমা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত