Ajker Patrika

ঝিলাম নদীর কান্নায় বাংলাদেশের উদ্বেগ

জুবায়ের হাসান
জুবায়ের হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জুবায়ের হাসান। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরের বুক চিরে বয়ে চলেছে ঝিলাম নদী। কাশ্মীর উপত্যকা হলো ঝিলামের উত্তর ভাগের অংশ। উপত্যকাটি ১৩৭ কিলোমিটার লম্বা এবং ৩০ থেকে ৪০ কিমি চওড়া। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে সেখানে অনেকে বেড়াতে যান। ১৯৪৭ সালের আগে কেউ ভাবতে পারেননি যে কাশ্মীর হয়ে উঠবে একদিন ভয়াবহ রণক্ষেত্র। আর সেখানে সমাবেশ ঘটবে বিপুল সৈন্যের।

এই কাশ্মীর উপত্যকায় একসময় ছিল বাংলাদেশের মতোই একটা মুসলিম স্বাধীন সালতানাত, যা প্রতিষ্ঠা করেন শাহ মির্জা, ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। মির্জা ছিলেন একজন ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তি। তিনি বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াত অঞ্চল থেকে যান কাশ্মীরে। তিনি নিজ যোগ্যতাবলে হয়ে ওঠেন কাশ্মীরের হিন্দু রাজার খুব বিশ্বস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারী। পরে রাজার মৃত্যু হলে তিনি হন কাশ্মীরের শাসক, যাকে বলা হয় সুলতান। তিনি বিয়ে করেন কাশ্মীরের বিধবা রানিকে। ১৩৪৬ সালে সুলতান শাহ মির্জার প্রতিষ্ঠিত সেই সালতানাতের মুসলিম সুলতানেরা তখন থেকে প্রায় আড়াই শ বছর কাশ্মীর শাসন করেন। এরপর কাশ্মীরের সুলতানের হাত থেকে সম্রাট আকবর কাশ্মীর দখল করেন ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। ফলে কাশ্মীর চলে যায় মোগল সম্রাটদের নিয়ন্ত্রণে। কাশ্মীরে দীর্ঘকাল একটি স্বাধীন মুসলিম সালতানাত থাকার কারণে সে সময় সেখানে গড়ে উঠেছিল পৃথক জাতীয় বৈশিষ্ট্য। কাশ্মীরের মুসলমানরা ঘরে বলে কাশ্মীরি ভাষা; কিন্তু এখন তাঁদের সাংস্কৃতিক ভাষা হলো উর্দু। তবে এই উর্দুকে বলা হয় কাশ্মীরি উর্দু।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারত যখন লোদি বংশের মুসলিম শাসনাধীন ছিল, তখন শিখ ধর্মের উদ্ভব ও বিস্তার ঘটতে থাকে। শিখ ধর্মের প্রবর্তক হলেন গুরু নানক (জন্ম-মৃত্যু: ১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর প্রচেষ্টায় সে সময় পাঞ্জাব এবং এর আশপাশ অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক লোক শিখ ধর্মমত গ্রহণ করেন। একসময় পাঞ্জাবের শিখ রাজা রণজিৎ সিংয়ের (১৭৮০-১৮৩৯) নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল বিরাট একটা শিখ সাম্রাজ্য; যার রাজধানী ছিল লাহোর। মোগল সম্রাজ্যের পতনের যুগে তাদের হাত থেকে এই শিখ রাজা রণজিৎ সিং কাশ্মীর দখল করেন ১৮১৯-১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে। আর তাঁর প্রধান সেনাপতি গুলাব সিং জয় করেন জম্মু। রণজিৎ সিং ধর্মের দিক থেকে গোঁড়া শিখ হলেও তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি গুলাব সিং ছিলেন পাঞ্জাবি ডোগরা হিন্দু। তিনি গুলাব সিংকে দেন জম্মু শাসনের ভার।

শিখ রাজা রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্জাব দখল করে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। অতঃপর ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশ্মীর দখল করে। জম্মুর হিন্দু রাজা গুলাব সিং ওই যুদ্ধে থাকেন নিরপেক্ষ। এ সময় গুলাব সিং ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে কাশ্মীর কিনে নেন ১০ লাখ স্টার্লিং পাউন্ড দিয়ে। সে সময় থেকে তিনি হন জম্মু-কাশ্মীরের করদ মহারাজা এবং ইংরেজদের মিত্র। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে জম্মু-কাশ্মীরের হিন্দু রাজা ছিলেন গুলাব সিংয়ের বংশের স্যার হরি সিং। তিনি কাশ্মীরকে ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। হরি সিং ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে যোগ দেন ভারতীয় ইউনিয়নে। ফলে কাশ্মীর নিয়ে বাধে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ছিল দুটি অংশে বিভক্ত। এক ভাগকে বলা হতো ব্রিটিশ ভারত, যা চলত সরাসরি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে। আর অন্য অংশকে বলা হতো দেশীয় রাজাদের শাসিত অংশ, যা ছিল মূলত করদ রাজ্য। করদ রাজ্যের রাজারা ব্রিটিশ প্রশাসনকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের বিনিময়ে তাদের রাজ্য এক প্রকার স্বাধীনভাবেই শাসন করত। ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যে এ ধরনের করদ রাজ্যের সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে ছিল প্রায় ৫৮৪টি, যা ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের মোট আয়তনের প্রায় ৫ ভাগের ২ ভাগ। কাশ্মীর ছিল এমনই দেশীয় রাজাদের শাসনের অধীন একটি করদ রাজ্য। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রশ্ন ওঠে, ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হলে এসব করদ রাজ্য ও দেশীয় রাজাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে। সিদ্ধান্ত হয়, দেশীয় রাজারা তাদের আপন ইচ্ছা-মর্জিতে ভারতে অথবা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, কিংবা থাকতে পারবেন স্বাধীন।

ভারতের বর্তমান গুজরাট রাজ্যের অধীন জুনাগড় ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্য। সে সময় জুনাগড়ের শাসক ছিলেন মুসলমান। কিন্তু বেশির ভাগ প্রজা ছিলেন হিন্দু। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের সময় জুনাগড়ের শাসক (নবাব) পাকিস্তানে যোগ দেন। কিন্তু ভারত জুনাগড় দখল করে এই যুক্তিতে যে জুনাগড় হিন্দুপ্রধান এবং তা পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। দক্ষিণ ভারতে বিরাট আরেকটি ব্রিটিশ করদ রাজ্য ছিল হায়দরাবাদ। একে শাসন করতেন মুসলমান নবাব (হায়দরাবাদের নিজাম)। ১৯৪৭ সালে হায়দরাবাদের নিজাম ভারত কিংবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চান। কিন্তু ভারত এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদ আক্রমণ করে। ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হায়দরাবাদের নিজামের সেনাবাহিনী এবং হায়দরাবাদের মুসলমানদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী সম্মিলিতভাবে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে ৬ দিনের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে নেয়। নিহত হয় অনেক মুসলমান। এভাবে উৎখাত করা হয় হায়দরাবাদের ৬০০ বছরের মুসলমান শাসন। ২ লাখ ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনসংবলিত সেকালের বিশাল হায়দরাবাদ রাজ্য এখন ভারতের দক্ষিণের তিন রাজ্য তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে বিলীন হয়েছে।

১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিং যোগ দিয়েছিলেন ভারতে। কিন্তু কাশ্মীরের বেশির ভাগ প্রজাই ছিলেন মুসলমান এবং তাঁদের আবাসভূমি পাকিস্তানের সঙ্গে লাগোয়া। কাশ্মীরের মুসলমানরা রাজা হরি সিংয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আর তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলের পাঠান সৈন্যরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখলে নিয়ে নেয় কাশ্মীরের বিশাল এক অংশ। পৌঁছে যায় শ্রীনগরের উপকণ্ঠে। এভাবেই কাশ্মীর নিয়ে শুরু হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু কাশ্মীর সমস্যাকে সমাধানের জন্য নিয়ে যান জাতিসংঘে। পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যাকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়নি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বলে যুদ্ধবিরতি করতে এবং কাশ্মীরে গণভোটের মাধ্যমে গণ-অভিমত (Plebiscite) গ্রহণ করতে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ফলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয় এবং দেশ দুটির মধ্যে স্থির হয় একটি যুদ্ধবিরোধী রেখা। এটাই হলো কাশ্মীরকে বিভাজনকারী সীমান্তরেখা লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি)। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে মোট পাঁচবার প্রস্তাব পাস করে বলে দেয় যে কাশ্মীরিরা পাকিস্তানে যোগ দেবে, নাকি ভারতে যোগ দেবে, সে সম্পর্কে কাশ্মীরের জনগণের কাছ থেকে গণ-অভিমত গ্রহণ করতে আয়োজন করতে হবে গণভোট। নেহরু প্রথমে গণভোটের প্রস্তাব মেনে নিলেও পরবর্তীকালে তা অমান্য করেন। তবে পাকিস্তান সম্মত হয় গণভোট গ্রহণে এবং এখনো তাতে স্থির আছে। ভারত সরকার ১৯৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারি তাদের প্রজাতন্ত্র দিবসে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরে গণ-অভিমত গ্রহণের পুনর্বার দাবি জানায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো দেয়। ফলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে গণ-অভিমত নেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সাবেক জম্মু-কাশ্মীরের ৩ ভাগের ১ ভাগ অংশ পাকিস্তান দখল করেছিল। এই অংশ এখনো পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আছে। একে বলা হয় আজাদ কাশ্মীর। পাকিস্তান এখনো কাশ্মীরিদের গণ-অভিমত গ্রহণে রাজি থাকায় সেই সাবেক জম্মু-কাশ্মীরের যে অংশ দখল করেছে, তাকে বলছে না পাকিস্তানের অংশ। দেশটি আজাদ কাশ্মীরকে এখন পর্যন্ত ঘোষণা করেনি নিজের কোনো প্রদেশ হিসেবে। আজাদ কাশ্মীরের রয়েছে একটি পৃথক পতাকা, আলাদা জাতীয় সংসদ, একজন প্রধানমন্ত্রী ও একজন প্রেসিডেন্ট। আজাদ কাশ্মীরের জনগণ পাকিস্তানি পাসপোর্টের পরিবর্তে একটি বিশেষ পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে পাকিস্তান এমন ব্যবস্থা নিয়েছে।

জম্মু-কাশ্মীরের পূর্বাংশে অবস্থিত লাদাখ অঞ্চল একসময় ছিল চীনের তিব্বতের অংশ। ব্রিটিশ শাসনামলে জম্মুর হিন্দু রাজা গুলাব সিং ব্রিটিশ সৈন্যদের সহযোগিতায় ১৮৩৪ থেকে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিব্বতের লাদাখ অঞ্চল জয় করেন। এরপর ব্রিটিশদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা গুলাব সিং ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে কাশ্মীর কিনে নেন। এভাবে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ নিয়ে গঠিত হয় বৃহত্তর জম্মু-কাশ্মীর। লাদাখের মানুষ দেখতে অবিকল তিব্বতিদের মতো। তারা তিব্বতি ভাষায় কথা বলে। ধর্মে তারা হিন্দু নয়, মুসলমানও নয়। তারা হলো তিব্বতিদের মতো লামা বৌদ্ধ। ১৯৬২ সালে চীন ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা লাদাখের ৩২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নেয়। চীনের দখল করা লাদাখ অঞ্চলের নতুন নামকরণ হয় আকসাই চীন। এদিকে ১৯৬৩ সালে চীন-পাকিস্তানের মধ্যে এক সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান তার দখলে থাকা লাদাখ অঞ্চলের ৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকা চীনকে উপহার দেয়। ফলে চীন তার জিন জিয়াং বা উইঘুর প্রদেশ থেকে আকসাই চীন অঞ্চলের মধ্যে চলাচলের সংযোগ স্থাপনের সুযোগ লাভ করে। এভাবে কাশ্মীরের মহারাজাদের শাসনাধীন ব্রিটিশ আমলের করদ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীর এখন তিন অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক অংশ আছে পাকিস্তানের হাতে, আর এক অংশ আছে ভারতের হাতে এবং অন্য অংশ আছে মহাচীনের নিয়ন্ত্রণে। কাশ্মীর সমস্যা তাই হয়ে উঠেছে আগের তুলনায় অনেক জটিল। এখন সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ভারত, পাকিস্তান ও চীন—এই তিন রাষ্ট্রের স্বার্থ। কাশ্মীর সমস্যা আর হয়ে নাই কেবলই ভারত-পাকিস্তান সমস্যা। কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনেরও প্রসঙ্গ। বর্তমানে ভারত কাশ্মীর সমস্যাকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে প্রচার করে। কাশ্মীর সংকট সমাধানে পাকিস্তান-ভারত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে ভারত নিজের খেয়ালখুশিমতো রাজি হয়। তবে ভারত কাশ্মীরবিষয়ক আলোচনায় কোনোভাবেই সম্পৃক্ত করতে চায় না তৃতীয় কোনো দেশকে। কিন্তু বাস্তবে কাশ্মীর হলো আন্তর্জাতিক সমস্যা, যা প্রথমে ভারতই নিয়ে গিয়েছিল জাতিসংঘে। বর্তমানে ভারত পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট বাল্টিস্তান, চীনের দখলে থাকা আকসাই চীন, পাকিস্তান কর্তৃক চীনকে উপহার দেওয়া লাদাখের অংশ—এসবের সমন্বয়ে গঠিত পুরো অঞ্চলকেই নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে। তবে ভারত চীনের কাছে হারানো আকসাই চীন এলাকা ফিরে পাওয়ার জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ভারত কেবলই চাচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনা বজায় রাখতে।

ভারত সরকার শুরুতে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরকে দিয়েছিল যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন। যেমন কাশ্মীরে ছিল পৃথক রাষ্ট্রপতি। তিনি নির্বাচিত হতেন কাশ্মীরের নির্বাচকমণ্ডলী দিয়ে। কাশ্মীরের রাষ্ট্রপতিকে বলা হতো সর্দার-ই-রিয়াসত। তাঁর ছিল যথেষ্ট ক্ষমতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু এটা করতে পেরেছিলেন কাশ্মীরের নেতা শেখ আব্দুল্লাহর সঙ্গে খাতির জমিয়ে। শেখ আব্দুল্লাহ থাকতে চেয়েছিলেন ভারতের অনুগত হয়ে। ভারত দীর্ঘদিন এই শেখ আব্দুল্লাহ ও তাঁর পরিবার এবং তাঁদের রাজনৈতিক দলকে (ন্যাশনাল কনফারেন্স) কাশ্মীরের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে রাখে। অতঃপর সুযোগমতো ভারত সরকার ধাপে ধাপে কাশ্মীরকে প্রদত্ত বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করে এবং শেখ আব্দুল্লাহর পরিবার কাশ্মীরের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন।

কাশ্মীর এখন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যমাত্র। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের বিজেপি সরকার দেশটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং অনুচ্ছেদ ৩৫(ক) বাতিল করে। এর মাধ্যমে ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের যে সীমিত স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা ছিল, সেটি বিলুপ্ত হয়। এরপর ভারতীয় আইনসভায় জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে বৃহত্তর জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে পৃথক দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (Union Territory) সৃষ্টি করা হয়। এভাবে কাশ্মীর ভারতের পুরোপুরি হস্তগত হয়। আর কাশ্মীরের যেসব রাজনৈতিক নেতা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অনুগত হয়ে থেকে ছিলেন, তাঁরা বিমর্ষ ও হতবাক হয়ে যান।

ভারতীয় শাসনতন্ত্রের ৩৬৭ নম্বর ধারার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভারত ছাড়া যেকোনো রাষ্ট্রই বিদেশি রাষ্ট্র, তবে রাষ্ট্রপতি কোনো রাষ্ট্রকে ‘বিদেশি রাষ্ট্র নয়’ বলে ঘোষণা করতে পারেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁদের সংবিধানের এই ধারা অনুসারে কাশ্মীরকে করে নিয়েছেন ভারতীয় রাষ্ট্রের অংশ। ভারতের রাষ্ট্রপতি যে ভবিষ্যতে আর কোনো দেশকে এভাবে ভারতের অংশ করে নিতে চাইবেন না, সেটা বলা যায় না। ভারতীয় সংবিধানের এই ধারার জন্য বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। ভারত ১৯৪৮ সালে করেছিল হায়দরাবাদ দখল। এরপর ১৯৭৫ সালে দখল করে সিকিম। ভারতের এই সিকিম দখলে সে সময় বাংলাদেশ হয়েছিল বিশেষভাবে শঙ্কিত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর পিতামহ গঙ্গাধর নেহরু ছিলেন কাশ্মীরের অধিবাসী। এ কারণে জওহর লাল নেহরু ব্যক্তিগতভাবে কাশ্মীরের জন্য অনুভব করতেন বিশেষ মমতা। তাই তিনি চান, কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকুক। একসময় অনেকে ভাবতেন, কাশ্মীর সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে জম্মু-কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যেমন যৌথ শাসন আছে ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে অ্যান্ডোরা (Andorra) নামক রাষ্ট্রে। অ্যান্ডোরা শাসিত হয় ফ্রান্স ও স্পেনের মাধ্যমে। অ্যান্ডোরার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করে না এই দুই রাষ্ট্র। কেবল পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতির ক্ষেত্রে অ্যান্ডোরাকে আলোচনা করতে হয় ফ্রান্স ও স্পেনের সঙ্গে। এখন যদি জম্মু-কাশ্মীরকে পাকিস্তান এবং ভারতের যৌথ শাসনে আনা যায়, তবে উভয় দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে শান্তি। দূর হবে উভয় দেশের কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র্য।

কাশ্মীর একসময় ছিল একটি পৃথক সালতানাত। কাশ্মীরিদের আছে একটি পৃথক ভাষা এবং এর সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলিম। তাই কাশ্মীরিরা হতে চাইতে পারে বাংলাদেশের মানুষের মতোই স্বাধীন। কাশ্মীরিরা পৃথক স্বাধীন কাশ্মীরি রাষ্ট্র গঠনের জন্য কিছুদিন আগেও ভারতের বিরুদ্ধে করেছে প্রচণ্ড সংগ্রাম। বর্তমানে তা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর দমন অভিযানে স্তিমিত হয়ে এলেও পুনরায় তা যেকোনো সময় প্রচণ্ড রূপ ধারণ করতে পারে। ভারতীয়দের ভাষায় কাশ্মীরদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বলা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এটা হলো কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসনামলেও কাশ্মীর ছিল একটি পৃথক দেশীয় রাজ্য। তখনো কাশ্মীর ছিল না ভারতের অংশ। কাশ্মীরের এই পার্থক্য চেতনা তাদের উদ্বুদ্ধ করছে স্বাধীন কাশ্মীর রাষ্ট্র গঠনের। তাই একে বলা চলে না ভারতীয় ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবাদ। বস্তুত ভারত কাশ্মীরকে কবজায় রাখতে এ ধরনের অনেক ভাষায় প্রয়োগ করতে পারে। একসময় অনেকে বলতেন, কাশ্মীরের উচিত হবে ভারতের সঙ্গে থাকা। কারণ, ভারত হলো একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র আর পাকিস্তান হলো ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র। কিন্তু বর্তমানে ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গিয়ে পড়েছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির হাতে। বিজেপির নেতারা এখন গ্রহণ করতে চাচ্ছেন অনেকটা হিটলারের আর্যবাদের তত্ত্বকে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয়

ড. কামরুল হাসান মামুন।

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান, ছাত্র সংসদ, ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭: ৫১

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।

সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।

আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?

আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।

চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।

গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে

গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?

ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।

ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?

এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।

শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!

ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।

২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।

৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।

চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।

৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।

তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।

৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!

বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।

৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।

বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।

লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।

নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।

৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।

আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,

দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নির্বাচনী ব্যয়

সম্পাদকীয়
নির্বাচনী ব্যয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।

সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।

নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।

‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

সম্পাদকীয়
খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।

গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।

এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত