ড. মিল্টন বিশ্বাস

কবি আসাদ মান্নান ‘চাই তাঁর দীর্ঘ আয়ু’ কবিতায় শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মহান পিতার স্বপ্নবুকে/ নিরন্তর যিনি আজ এ জাতির মুক্তির দিশারি/ ঘূর্ণিঝড়ে হালভাঙা নৌকাখানি শক্ত হাতে বৈঠা ধরে টেনে/ অসীম মমতা দিয়ে পৌঁছুচ্ছেন আমাদের স্বপ্নের মঞ্জিলে…।’
কবির মতে, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। তিনি মুক্তির দিশারি, যিনি মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন নির্ভীকভাবে গভীর মমতা নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে। কবির এই কথাগুলো সত্য হতো না, যদি না ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা নিজ দেশে ফিরে আসতেন। আসলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ দেশের শাসনকার্যে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আসীন থেকে মহিমান্বিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহাকালকে স্পর্শ করতে সক্ষম। এর কারণ আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের অধিকাংশেরই সুখদুঃখের পরিধি সীমাবদ্ধ; আমাদের জীবনের তরঙ্গক্ষোভ কয়েকজন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই অবসান হয়।...কিন্তু পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক লোকের অভ্যুদয় হয় যাঁহাদের সুখদুঃখ জগতের বৃহৎ ব্যাপারের সহিত বদ্ধ। রাজ্যের উত্থানপতন, মহাকালের সুদূর কার্যপরম্পরা যে সমুদ্র গর্জনের সহিত উঠিতেছে পড়িতেছে, সেই মহান কলসংগীতের সুরে তাঁহাদের ব্যক্তিগত বিরাগ-অনুরাগ বাজিয়া উঠিতে থাকে। তাঁহাদের কাহিনী যখন গীত হইতে থাকে, তখন রুদ্রবীণার একটা তারে মূল রাগিণী বাজে এবং বাদকের অবশিষ্ট চার আঙুল পশ্চাতের সরু মোটা সমস্ত তারগুলিতে অবিশ্রাম একটা বিচিত্র গম্ভীর, একটা সুদূর বিস্তৃত ঝংকার জাগ্রত করিয়া রাখে।’
অর্থাৎ, শেখ হাসিনার ‘সুখদুঃখ জগতের বৃহৎ ব্যাপারের সঙ্গে বদ্ধ’। কারণ, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। অন্যদিকে বিশ্বকবির ভাবনা সূত্রে বলা যায়, শেখ হাসিনাকে কেবল ব্যক্তিবিশেষ বলে নয়, বরং মহাকালের অঙ্গস্বরূপ দেখতে হলে দূরে দাঁড়াতে হয়, অতীতের মধ্যে তাঁকে স্থাপন করতে হয়; তিনি যে সুবৃহৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে ৪০ বছর প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে আছেন, সেটাসহ তাঁকে এক করে দেখতে হয়। এদিক থেকে তিনি ‘ইতিহাসস্র্রষ্টা মহান ব্যক্তিত্ব’। খণ্ড ক্ষুদ্র বর্তমানকালে তাঁর কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রামকে একীভূত করে দেখতে হবে।
দুই.
২০২২ সালের ১৭ মে করোনা মহামারি-পরবর্তী একটি বিশেষ দিন বলে আমাদের কাছে গণ্য হচ্ছে। কারণ, অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ হাসিনার ৪১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি ভারত থেকে ফিরে এসেছিলেন প্রিয় জন্মভূমিতে। বাংলাদেশ তারপর থেকে নতুন করে পথ চলা শুরু করে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের পর এ দেশ পুনরায় ‘জয় বাংলার’ বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল। ৪১ বছর আগের সেই দিনটি এখনকার মতো ছিল না। সেদিন ছিল ভারী বর্ষণ ও ঝোড়ো হাওয়ার এক অপরাহ্ণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনার পৎস্পর্শে সেই জল্লাদের দেশ পুনরায় সোনার বাংলা হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় মুখরিত হয়েছিল। আজ তার প্রমাণ পাচ্ছি আমরা।
চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে আজ বিশ্বে অভিনন্দিত। সব সময় সংকট মোকাবিলা করা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অবশ্য ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল আমেরিকার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বসে প্রকাশিত কানাডীয় লেখক অভিভাহ ভিটেনবার্গ-কক্স রচিত ‘8 (More) Women Leaders Facing The Coronavirus Crisis’ শীর্ষক প্রবন্ধে মহামারি মোকাবিলায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়। নারী নেতৃত্বাধীন সিঙ্গাপুর, হংকং, জর্জিয়া, নামিবিয়া, নেপাল, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কদের ওপর আলোকপাতের সময় বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৬ কোটি ১০ লাখের মতো মানুষের দেশ মহামারির সংকট মোকাবিলায় দ্রুত সাড়া দিয়েছে, যাকে প্রশংসনীয় বলেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। কলামে বলা হয়েছে, এ দেশের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সেগুলো এক অর্থে যুক্তরাজ্যও করতে পারেনি। তবে এ কথা সত্য, বিশ্ব মিডিয়ায় প্রশংসা পাওয়ার জন্য শেখ হাসিনা কাজ করেন না। তাঁর দিনপঞ্জিজুড়ে আছে মানুষের জন্য কাজে ব্যস্ত সময়ের কর্মকাণ্ড। আর তাঁর এই বর্তমান নেতৃত্ব সম্ভব হয়েছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে।
শেখ হাসিনা ধনিদের বলেছেন গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই তিনি গরিবের পক্ষে কল্যাণকর রাজনীতি শুরু করেন। এ জন্য নিজ দলের নেতাকর্মীদের মানুষের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনাও দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করতেন। তখনকার ভয়াবহ বন্যার সময় তাঁকে সেই সময়ের আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা একটা চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠিতে মানুষের পাশে থাকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। চিঠিটি নিম্নরূপ—
‘বন্ধুবরেষু গুণ, আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। “ত্রাণ বিতরণ করছি” এ ধরনের কোনো ছবি ছাপাবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন, ছাপান। আমার ধারণা, এ ধরনের, অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে।
ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত, তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না। ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্যদানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিবেকে বাধে। তবু অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও করি। বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে অনেক সময় সমাজ রক্ষার তাগিদে, সঙ্গীদের অনুরোধ বা অপরের মান রক্ষার জন্য এ ধরনের কাজ বা ছবি তুলতে হয় বৈকি। তবে যে যা-ই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য। ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেওয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে “ক্রেডিট” নেওয়ার সুযোগ কোথায়? এই ক্রেডিট নিতে যাওয়াটা কি দুর্বলতা নয়? আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? কতকাল আর বিবেককে ফাঁকি দিবে? এই গরিব মানুষগুলোর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে আবার এদেরই হাতে ভিক্ষে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ইমেজ তৈরির পদ্ধতি আমি পছন্দ করি না।
আমি মনে করি, যা দান করব তা নীরবে করব, গোপনে করব। কারণ এটা লজ্জার ব্যাপার, গর্ব করার ব্যাপার মোটেই নয়। গর্ব করার মতো কাজ হতো, যদি এই সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়া যেত। গর্ব করার মতো হতো যদি একখানা কাঙালের হাতও সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে না দিত। ফুটপাতে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ভিক্ষের হাত না বাড়াত—সেটাই গর্ব করার মতো হতো। যে স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন, সেদিন কবে আসবে? আমার অনুরোধ আপনার কাছে, সেই ছবি ছাপাবেন না, যে ছবি হাত বাড়িয়েছে সাহায্য চেয়ে, আর সেই হাতে কিছু তুলে দিচ্ছি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। অনেকেই তুলে থাকেন। আমার বড় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। লজ্জা হয় গরিব মানুষদের কাছে মুখ দেখাতে। আমরা সমাজে বাস করি। দুবেলা পেট পুরে খেতে পারি। ভালোভাবে বাঁচতে পারি। কিন্তু ওরা কী পাচ্ছে? ওদের নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা কেন? ওরা বরদাশত করবে না; একদিন জেগে উঠবেই। সেদিন কেউ রেহাই পাবে না। আমার অনুরোধ আশা করি রাখবেন। শুভেচ্ছান্তে, শেখ হাসিনা, ৯. ১০. ৮৮’
স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮—এই সাত বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শেখ হাসিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ ১৭ মে তাঁর দেশে ফেরা ছিল অতি সাধারণ। কারণ, সেভাবেই তিনি দেশের জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। সেদিন তিনি এক বৃহৎ শূন্যতার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এ দেশে তাঁর ঘর নেই; আপনজনও কেউ নেই। তাই সারা দেশের মানুষ তাঁর আপন হয়ে উঠল। তিনি ফিরে আসার আগে ছয় বছর স্বৈরশাসকেরা বোঝাতে চেয়েছিল, তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছিল, বিচার দাবি করছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের। সেনাশাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় জনগণের শাসনের দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রাতদিনের এক অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি নেতা; কিন্তু তারও বেশি তিনি কর্মী। কারণ, দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা তাঁর প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত হলো। দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় আবেগসিক্ত বর্ণনা আছে তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন, তখনই বুঝে নিয়েছিলেন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ।’ তাঁর ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১৯৮১ সালের ১৭ মে) আগে ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুই দিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানব না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবই করব।’ তাই তো কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’।
তিন.
প্রকৃতপক্ষে ১৭ মে এ দেশের ইতিহাসের মাইলফলক। সেদিন থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এত দিন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের আগে সেই বছরই শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং জিয়ার অভিসন্ধি ভেস্তে যায়। সেদিনের ঢাকায় লক্ষ্য মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত তাঁকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল বিচিত্র ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি—‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। আরও ছিল—‘শেখ হাসিনা আসছে, জিয়ার গদি কাঁপছে, গদি ধরে দিব টান জিয়া হবে খানখান। আবালবৃদ্ধ জনতা আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়ে উচ্চারণ করেছিল—‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।’
সেদিনের প্রত্যয় শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারই বাস্তব করে তুলেছে। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে এনে শিগগিরই ফাঁসি দেওয়া হবে বলে আমরা আশা করি। ১৭ মে সম্পর্কে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সংবাদ ছিল এ রকম—‘ওই দিন কালবোশেখির ঝোড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ৬৫ মাইল। এবং এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় ছিল।’ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেখ হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উড়োজাহাজ থেকে নেমেই তিনি দেশের মাটিতে চুমু খান। এ সময় বিপুল জনতার বিচিত্র স্লোগান মুখরিত করে তুলেছিল ঢাকার রাজপথ। যেন সূর্যোদয় হয়েছে, নতুন দিনের পথ চলা শুরু হলো। অশ্রুসজল সেই দিনের কথা আছে নানাজনের স্মৃতিচারণে। ঢাকা শহর তখন মিছিলের নগরী। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটের পর বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি মাটি স্পর্শ করার আগেই হাজার হাজার উৎসাহী জনতা সকল নিয়ন্ত্রণের সীমা, নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে ফেলে। নিরাপত্তাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতায় অবশেষে তিনি নেমে আসেন; হাত নেড়ে জনতাকে শুভেচ্ছা জানান। কিন্তু তাঁর অন্তরে ততক্ষণে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। বিকেল ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা একটি ট্রাকে ওঠেন। এ সময় বজ্র নিনাদে জনতার স্লোগান চলছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক যখন ফুলের মালা পরিয়ে অভিবাদন জানান, তখন বাঁধভাঙা কান্নার জোয়ার এসে ভাসিয়ে দেয় শেখ হাসিনাকে; কেঁদে ওঠেন তিনি। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি কেবল পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গেই তুলনীয়।
শেখ হাসিনার ফিরে আসা খুব বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জনতার স্বার্থে। আগেই উল্লেখ করেছি, তাঁর প্রত্যাবর্তনের আগে নৈরাজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল মানুষ। পাকিস্তানি শাসক, দালাল-রাজাকার ও আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি দেশের বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং আপামর জনগণের অংশগ্রহণে ৯ মাসের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার প্রচেষ্টা সফল হতে দেয়নি খুনিরা। ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সামরিক শাসকদের অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে। দেশ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। দেশের প্রতিকূল এক সময়ে জননেত্রীকে আমরা রাজনীতির মঞ্চে পেলাম। তিনি দায়িত্ব নিলেন এবং লাখো জনতার সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আজকের জনসভায় লাখ লাখ চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। ...বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’
গত চার দশক ধরে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও হাজারো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে শেখ হাসিনা জনগণের পাশেই আছেন; ভবিষ্যতে থাকবেনও। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল পর্যন্ত একাধিকবার বন্দী অবস্থায় নিঃসঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে তাঁকে।
চার.
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশ ও জনগণের কাছে প্রত্যাবর্তনের মতো শেখ হাসিনার দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনও ছিল আমাদের জন্য মঙ্গলকর। ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারির পর তাঁর দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ১৬ জুলাই যৌথ বাহিনী তাঁকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে ৩৩১ দিন কারাগারে বন্দী করে রাখে। সে সময় গণমানুষ তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। তাঁর সাবজেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করেছিল। কারণ, সে সময় আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্য কথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও লুটপাটের মাধ্যমে এ দেশকে নরকে পরিণত করেছিল। নেত্রীকে গ্রেনেড, বুলেট, বোমায় শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক; এখনো তেমনটাই আছেন। নতুন প্রজন্মকে যথার্থ ইতিহাসের পথ দেখিয়েছেন তিনি নিজের রাজনৈতিক সততার মধ্য দিয়ে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে একাধিকবার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৬ আগস্ট জননেত্রীর ওপর ঢাকায় গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর তাঁর বাসভবন আক্রান্ত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে একটি বিরাট মিছিল নগরীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ৪০ জন নিহত হন। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ধানমন্ডিতে তাঁর ওপর বন্দুকধারীরা রাসেল স্কয়ারে আক্রমণ চালায়। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনে ভ্রমণকালে ঈশ্বরদী ও নাটোরে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা জননেত্রীর ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। এভাবেই দেশ-বিদেশে কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে চলেছে হত্যার ষড়যন্ত্র। ২০০০ সালের ২০ জুলাই পূর্বনির্ধারিত জনসভাস্থল কোটালীপাড়া থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি বিস্ফোরকের বোমা উদ্ধার করা হয়। ২০০৪ সালের ৫ জুলাই তুরস্ক সফরের সময় জননেত্রীকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল ভয়াবহতম দিন। অজস্র গ্রেনেড নিক্ষেপের পরও নেতাকর্মীদের মানবঢালের বেষ্টনীর কারণে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তবে নিহত হন আওয়ামী লীগের অনেক নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী। এ ছাড়া অনলাইন, ব্লগ ও ফেসবুকে জননেত্রীকে কটাক্ষ করে খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে বারবার। হত্যার প্রচেষ্টা ও হুমকির মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে শিগগিরই মহামারি অতিক্রম করে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে—এটা নিশ্চিত। তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সব অশুভ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে।
পাঁচ.
মূলত ১৯৮১ সালের ১৭ মের সেকাল আর ২০২২ সালের একালের মধ্যে অনেক পার্থক্য। কিন্তু সীমাবদ্ধ কালকে অতিক্রম করে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেখেছেন সাফল্যের সুদীর্ঘ স্বাক্ষর। তিনি ২০১০ সালে নিউইয়র্ক টাইমস সাময়িকীর অনলাইন জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০ নারীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন। এ ছাড়া ২০১১ সালে বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী নারী নেতাদের তালিকায় সপ্তম স্থানে, ফোর্বসের করা ২০১৬ সালের বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ৩৬তম স্থানে ছিলেন। ফোর্বসের তালিকায় ২০১৮ সালে ২৬ এবং ২০১৯ সালে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর মধ্যে তিনি ছিলেন ২৯তম। ২০১০ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসের শতবর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা সিএনএন ক্ষমতাধর আট এশীয় নারীর তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে ছিলেন শেখ হাসিনা।
একটানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর আরও অনেক অর্জন রয়েছে। যেমন—২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা জয়ের জন্য তিনি সাউথ সাউথ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ৭০তম অধিবেশনে পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ লাভ করেন। এই তালিকা দীর্ঘ। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার পেয়েছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরিসহ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, নারীর অধিকার, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রক্ষায় তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত। আর বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তিনি জনগণের কাছে আজ নন্দিত। তাঁর প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি। এ জন্য ১৭ মে ঐতিহাসিক দিবসে ইয়াফেস ওসমান রচিত ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: ১৭ মে ১৯৮১’ কবিতাটির একটি অংশ স্মরণ করছি—
‘মনে কি পড়ে মনে কি পড়ে/ বেদনার তরী বেয়ে একদিন/ ছুঁয়ে ছিলে স্বদেশের মাটি।/ চারদিকে নাগিনীর বিষাক্ত নিশ্বাস/ পিতার পতাকা হাতে তবু অবিচল,/ খরস্রোতা নদী হয়ে অবিরাম বয়ে চলা/ মানুষের মুক্তিটা গড়ে দেবে বলে।’
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

কবি আসাদ মান্নান ‘চাই তাঁর দীর্ঘ আয়ু’ কবিতায় শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মহান পিতার স্বপ্নবুকে/ নিরন্তর যিনি আজ এ জাতির মুক্তির দিশারি/ ঘূর্ণিঝড়ে হালভাঙা নৌকাখানি শক্ত হাতে বৈঠা ধরে টেনে/ অসীম মমতা দিয়ে পৌঁছুচ্ছেন আমাদের স্বপ্নের মঞ্জিলে…।’
কবির মতে, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। তিনি মুক্তির দিশারি, যিনি মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন নির্ভীকভাবে গভীর মমতা নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে। কবির এই কথাগুলো সত্য হতো না, যদি না ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা নিজ দেশে ফিরে আসতেন। আসলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ দেশের শাসনকার্যে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আসীন থেকে মহিমান্বিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহাকালকে স্পর্শ করতে সক্ষম। এর কারণ আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের অধিকাংশেরই সুখদুঃখের পরিধি সীমাবদ্ধ; আমাদের জীবনের তরঙ্গক্ষোভ কয়েকজন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই অবসান হয়।...কিন্তু পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক লোকের অভ্যুদয় হয় যাঁহাদের সুখদুঃখ জগতের বৃহৎ ব্যাপারের সহিত বদ্ধ। রাজ্যের উত্থানপতন, মহাকালের সুদূর কার্যপরম্পরা যে সমুদ্র গর্জনের সহিত উঠিতেছে পড়িতেছে, সেই মহান কলসংগীতের সুরে তাঁহাদের ব্যক্তিগত বিরাগ-অনুরাগ বাজিয়া উঠিতে থাকে। তাঁহাদের কাহিনী যখন গীত হইতে থাকে, তখন রুদ্রবীণার একটা তারে মূল রাগিণী বাজে এবং বাদকের অবশিষ্ট চার আঙুল পশ্চাতের সরু মোটা সমস্ত তারগুলিতে অবিশ্রাম একটা বিচিত্র গম্ভীর, একটা সুদূর বিস্তৃত ঝংকার জাগ্রত করিয়া রাখে।’
অর্থাৎ, শেখ হাসিনার ‘সুখদুঃখ জগতের বৃহৎ ব্যাপারের সঙ্গে বদ্ধ’। কারণ, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। অন্যদিকে বিশ্বকবির ভাবনা সূত্রে বলা যায়, শেখ হাসিনাকে কেবল ব্যক্তিবিশেষ বলে নয়, বরং মহাকালের অঙ্গস্বরূপ দেখতে হলে দূরে দাঁড়াতে হয়, অতীতের মধ্যে তাঁকে স্থাপন করতে হয়; তিনি যে সুবৃহৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে ৪০ বছর প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে আছেন, সেটাসহ তাঁকে এক করে দেখতে হয়। এদিক থেকে তিনি ‘ইতিহাসস্র্রষ্টা মহান ব্যক্তিত্ব’। খণ্ড ক্ষুদ্র বর্তমানকালে তাঁর কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রামকে একীভূত করে দেখতে হবে।
দুই.
২০২২ সালের ১৭ মে করোনা মহামারি-পরবর্তী একটি বিশেষ দিন বলে আমাদের কাছে গণ্য হচ্ছে। কারণ, অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ হাসিনার ৪১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি ভারত থেকে ফিরে এসেছিলেন প্রিয় জন্মভূমিতে। বাংলাদেশ তারপর থেকে নতুন করে পথ চলা শুরু করে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের পর এ দেশ পুনরায় ‘জয় বাংলার’ বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল। ৪১ বছর আগের সেই দিনটি এখনকার মতো ছিল না। সেদিন ছিল ভারী বর্ষণ ও ঝোড়ো হাওয়ার এক অপরাহ্ণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনার পৎস্পর্শে সেই জল্লাদের দেশ পুনরায় সোনার বাংলা হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় মুখরিত হয়েছিল। আজ তার প্রমাণ পাচ্ছি আমরা।
চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে আজ বিশ্বে অভিনন্দিত। সব সময় সংকট মোকাবিলা করা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অবশ্য ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল আমেরিকার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বসে প্রকাশিত কানাডীয় লেখক অভিভাহ ভিটেনবার্গ-কক্স রচিত ‘8 (More) Women Leaders Facing The Coronavirus Crisis’ শীর্ষক প্রবন্ধে মহামারি মোকাবিলায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়। নারী নেতৃত্বাধীন সিঙ্গাপুর, হংকং, জর্জিয়া, নামিবিয়া, নেপাল, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কদের ওপর আলোকপাতের সময় বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৬ কোটি ১০ লাখের মতো মানুষের দেশ মহামারির সংকট মোকাবিলায় দ্রুত সাড়া দিয়েছে, যাকে প্রশংসনীয় বলেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। কলামে বলা হয়েছে, এ দেশের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সেগুলো এক অর্থে যুক্তরাজ্যও করতে পারেনি। তবে এ কথা সত্য, বিশ্ব মিডিয়ায় প্রশংসা পাওয়ার জন্য শেখ হাসিনা কাজ করেন না। তাঁর দিনপঞ্জিজুড়ে আছে মানুষের জন্য কাজে ব্যস্ত সময়ের কর্মকাণ্ড। আর তাঁর এই বর্তমান নেতৃত্ব সম্ভব হয়েছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে।
শেখ হাসিনা ধনিদের বলেছেন গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই তিনি গরিবের পক্ষে কল্যাণকর রাজনীতি শুরু করেন। এ জন্য নিজ দলের নেতাকর্মীদের মানুষের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনাও দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করতেন। তখনকার ভয়াবহ বন্যার সময় তাঁকে সেই সময়ের আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা একটা চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠিতে মানুষের পাশে থাকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। চিঠিটি নিম্নরূপ—
‘বন্ধুবরেষু গুণ, আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। “ত্রাণ বিতরণ করছি” এ ধরনের কোনো ছবি ছাপাবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন, ছাপান। আমার ধারণা, এ ধরনের, অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে।
ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত, তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না। ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্যদানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিবেকে বাধে। তবু অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও করি। বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে অনেক সময় সমাজ রক্ষার তাগিদে, সঙ্গীদের অনুরোধ বা অপরের মান রক্ষার জন্য এ ধরনের কাজ বা ছবি তুলতে হয় বৈকি। তবে যে যা-ই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য। ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেওয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে “ক্রেডিট” নেওয়ার সুযোগ কোথায়? এই ক্রেডিট নিতে যাওয়াটা কি দুর্বলতা নয়? আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? কতকাল আর বিবেককে ফাঁকি দিবে? এই গরিব মানুষগুলোর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে আবার এদেরই হাতে ভিক্ষে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ইমেজ তৈরির পদ্ধতি আমি পছন্দ করি না।
আমি মনে করি, যা দান করব তা নীরবে করব, গোপনে করব। কারণ এটা লজ্জার ব্যাপার, গর্ব করার ব্যাপার মোটেই নয়। গর্ব করার মতো কাজ হতো, যদি এই সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়া যেত। গর্ব করার মতো হতো যদি একখানা কাঙালের হাতও সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে না দিত। ফুটপাতে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ভিক্ষের হাত না বাড়াত—সেটাই গর্ব করার মতো হতো। যে স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন, সেদিন কবে আসবে? আমার অনুরোধ আপনার কাছে, সেই ছবি ছাপাবেন না, যে ছবি হাত বাড়িয়েছে সাহায্য চেয়ে, আর সেই হাতে কিছু তুলে দিচ্ছি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। অনেকেই তুলে থাকেন। আমার বড় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। লজ্জা হয় গরিব মানুষদের কাছে মুখ দেখাতে। আমরা সমাজে বাস করি। দুবেলা পেট পুরে খেতে পারি। ভালোভাবে বাঁচতে পারি। কিন্তু ওরা কী পাচ্ছে? ওদের নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা কেন? ওরা বরদাশত করবে না; একদিন জেগে উঠবেই। সেদিন কেউ রেহাই পাবে না। আমার অনুরোধ আশা করি রাখবেন। শুভেচ্ছান্তে, শেখ হাসিনা, ৯. ১০. ৮৮’
স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮—এই সাত বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শেখ হাসিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ ১৭ মে তাঁর দেশে ফেরা ছিল অতি সাধারণ। কারণ, সেভাবেই তিনি দেশের জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। সেদিন তিনি এক বৃহৎ শূন্যতার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এ দেশে তাঁর ঘর নেই; আপনজনও কেউ নেই। তাই সারা দেশের মানুষ তাঁর আপন হয়ে উঠল। তিনি ফিরে আসার আগে ছয় বছর স্বৈরশাসকেরা বোঝাতে চেয়েছিল, তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছিল, বিচার দাবি করছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের। সেনাশাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় জনগণের শাসনের দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রাতদিনের এক অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি নেতা; কিন্তু তারও বেশি তিনি কর্মী। কারণ, দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা তাঁর প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত হলো। দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় আবেগসিক্ত বর্ণনা আছে তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন, তখনই বুঝে নিয়েছিলেন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ।’ তাঁর ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১৯৮১ সালের ১৭ মে) আগে ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুই দিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানব না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবই করব।’ তাই তো কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’।
তিন.
প্রকৃতপক্ষে ১৭ মে এ দেশের ইতিহাসের মাইলফলক। সেদিন থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এত দিন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের আগে সেই বছরই শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং জিয়ার অভিসন্ধি ভেস্তে যায়। সেদিনের ঢাকায় লক্ষ্য মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত তাঁকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল বিচিত্র ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি—‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। আরও ছিল—‘শেখ হাসিনা আসছে, জিয়ার গদি কাঁপছে, গদি ধরে দিব টান জিয়া হবে খানখান। আবালবৃদ্ধ জনতা আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়ে উচ্চারণ করেছিল—‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।’
সেদিনের প্রত্যয় শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারই বাস্তব করে তুলেছে। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে এনে শিগগিরই ফাঁসি দেওয়া হবে বলে আমরা আশা করি। ১৭ মে সম্পর্কে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সংবাদ ছিল এ রকম—‘ওই দিন কালবোশেখির ঝোড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ৬৫ মাইল। এবং এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় ছিল।’ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেখ হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উড়োজাহাজ থেকে নেমেই তিনি দেশের মাটিতে চুমু খান। এ সময় বিপুল জনতার বিচিত্র স্লোগান মুখরিত করে তুলেছিল ঢাকার রাজপথ। যেন সূর্যোদয় হয়েছে, নতুন দিনের পথ চলা শুরু হলো। অশ্রুসজল সেই দিনের কথা আছে নানাজনের স্মৃতিচারণে। ঢাকা শহর তখন মিছিলের নগরী। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটের পর বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি মাটি স্পর্শ করার আগেই হাজার হাজার উৎসাহী জনতা সকল নিয়ন্ত্রণের সীমা, নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে ফেলে। নিরাপত্তাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতায় অবশেষে তিনি নেমে আসেন; হাত নেড়ে জনতাকে শুভেচ্ছা জানান। কিন্তু তাঁর অন্তরে ততক্ষণে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। বিকেল ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা একটি ট্রাকে ওঠেন। এ সময় বজ্র নিনাদে জনতার স্লোগান চলছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক যখন ফুলের মালা পরিয়ে অভিবাদন জানান, তখন বাঁধভাঙা কান্নার জোয়ার এসে ভাসিয়ে দেয় শেখ হাসিনাকে; কেঁদে ওঠেন তিনি। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি কেবল পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গেই তুলনীয়।
শেখ হাসিনার ফিরে আসা খুব বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জনতার স্বার্থে। আগেই উল্লেখ করেছি, তাঁর প্রত্যাবর্তনের আগে নৈরাজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল মানুষ। পাকিস্তানি শাসক, দালাল-রাজাকার ও আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি দেশের বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং আপামর জনগণের অংশগ্রহণে ৯ মাসের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার প্রচেষ্টা সফল হতে দেয়নি খুনিরা। ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সামরিক শাসকদের অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে। দেশ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। দেশের প্রতিকূল এক সময়ে জননেত্রীকে আমরা রাজনীতির মঞ্চে পেলাম। তিনি দায়িত্ব নিলেন এবং লাখো জনতার সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আজকের জনসভায় লাখ লাখ চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। ...বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’
গত চার দশক ধরে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও হাজারো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে শেখ হাসিনা জনগণের পাশেই আছেন; ভবিষ্যতে থাকবেনও। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল পর্যন্ত একাধিকবার বন্দী অবস্থায় নিঃসঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে তাঁকে।
চার.
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশ ও জনগণের কাছে প্রত্যাবর্তনের মতো শেখ হাসিনার দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনও ছিল আমাদের জন্য মঙ্গলকর। ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারির পর তাঁর দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ১৬ জুলাই যৌথ বাহিনী তাঁকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে ৩৩১ দিন কারাগারে বন্দী করে রাখে। সে সময় গণমানুষ তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। তাঁর সাবজেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করেছিল। কারণ, সে সময় আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্য কথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও লুটপাটের মাধ্যমে এ দেশকে নরকে পরিণত করেছিল। নেত্রীকে গ্রেনেড, বুলেট, বোমায় শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক; এখনো তেমনটাই আছেন। নতুন প্রজন্মকে যথার্থ ইতিহাসের পথ দেখিয়েছেন তিনি নিজের রাজনৈতিক সততার মধ্য দিয়ে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে একাধিকবার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৬ আগস্ট জননেত্রীর ওপর ঢাকায় গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর তাঁর বাসভবন আক্রান্ত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে একটি বিরাট মিছিল নগরীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ৪০ জন নিহত হন। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ধানমন্ডিতে তাঁর ওপর বন্দুকধারীরা রাসেল স্কয়ারে আক্রমণ চালায়। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনে ভ্রমণকালে ঈশ্বরদী ও নাটোরে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা জননেত্রীর ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। এভাবেই দেশ-বিদেশে কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে চলেছে হত্যার ষড়যন্ত্র। ২০০০ সালের ২০ জুলাই পূর্বনির্ধারিত জনসভাস্থল কোটালীপাড়া থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি বিস্ফোরকের বোমা উদ্ধার করা হয়। ২০০৪ সালের ৫ জুলাই তুরস্ক সফরের সময় জননেত্রীকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল ভয়াবহতম দিন। অজস্র গ্রেনেড নিক্ষেপের পরও নেতাকর্মীদের মানবঢালের বেষ্টনীর কারণে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তবে নিহত হন আওয়ামী লীগের অনেক নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী। এ ছাড়া অনলাইন, ব্লগ ও ফেসবুকে জননেত্রীকে কটাক্ষ করে খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে বারবার। হত্যার প্রচেষ্টা ও হুমকির মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে শিগগিরই মহামারি অতিক্রম করে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে—এটা নিশ্চিত। তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সব অশুভ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে।
পাঁচ.
মূলত ১৯৮১ সালের ১৭ মের সেকাল আর ২০২২ সালের একালের মধ্যে অনেক পার্থক্য। কিন্তু সীমাবদ্ধ কালকে অতিক্রম করে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেখেছেন সাফল্যের সুদীর্ঘ স্বাক্ষর। তিনি ২০১০ সালে নিউইয়র্ক টাইমস সাময়িকীর অনলাইন জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০ নারীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন। এ ছাড়া ২০১১ সালে বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী নারী নেতাদের তালিকায় সপ্তম স্থানে, ফোর্বসের করা ২০১৬ সালের বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ৩৬তম স্থানে ছিলেন। ফোর্বসের তালিকায় ২০১৮ সালে ২৬ এবং ২০১৯ সালে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর মধ্যে তিনি ছিলেন ২৯তম। ২০১০ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসের শতবর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা সিএনএন ক্ষমতাধর আট এশীয় নারীর তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে ছিলেন শেখ হাসিনা।
একটানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর আরও অনেক অর্জন রয়েছে। যেমন—২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা জয়ের জন্য তিনি সাউথ সাউথ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ৭০তম অধিবেশনে পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ লাভ করেন। এই তালিকা দীর্ঘ। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার পেয়েছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরিসহ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, নারীর অধিকার, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রক্ষায় তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত। আর বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তিনি জনগণের কাছে আজ নন্দিত। তাঁর প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি। এ জন্য ১৭ মে ঐতিহাসিক দিবসে ইয়াফেস ওসমান রচিত ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: ১৭ মে ১৯৮১’ কবিতাটির একটি অংশ স্মরণ করছি—
‘মনে কি পড়ে মনে কি পড়ে/ বেদনার তরী বেয়ে একদিন/ ছুঁয়ে ছিলে স্বদেশের মাটি।/ চারদিকে নাগিনীর বিষাক্ত নিশ্বাস/ পিতার পতাকা হাতে তবু অবিচল,/ খরস্রোতা নদী হয়ে অবিরাম বয়ে চলা/ মানুষের মুক্তিটা গড়ে দেবে বলে।’
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
৩৭ মিনিট আগে
পৃথিবীজুড়ে মনে করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন ও পেশাগত কার্যাবলিতে তাৎপর্যময় বিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং, আইনাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম থাকবে না। বরং ঐতিহ্যবাহী আইনি পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বিশ্বব্যাপী চলা এআই-জ্বরের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
১ ঘণ্টা আগে
একটা সময় হয়তো সবাই বিশ্বাস করতে পারত যে মা-বাবার পর সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায় শিক্ষকের কাছে। একজন শিক্ষক যে আদর্শ ধারণ করেন এবং শিক্ষাদানের মতো যে মহান কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাতে করে সমাজে সব সময়ই শিক্ষাগুরুর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১ ঘণ্টা আগে
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
১ দিন আগেগণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপ্রত্যাশী জনগণ চাইছে, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার আসুক। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় সেই জনপ্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটে।
আজাদুর রহমান চন্দন

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক তরুণ প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জেঁকে বসে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত, তার ছিদ্রটা হাঁ হয়ে যায় ওই একটি ঘটনায়। শুধু তা-ই নয়, কয়েক দিনের মাথায় বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই গুলিবিদ্ধ তরুণের মৃত্যুর খবরজনিত ক্ষোভ-উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ চালানো হয়। আক্রান্ত হয় বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের প্রধান কার্যালয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন এবং শিশু-কিশোরদের জন্য সংস্কৃতি-সমন্বিত ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার কার্যক্রম। পরদিনই হামলা চালানো হয় দেশের ঐতিহ্যবাহী আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ৫০-৬০ জনের একটি দল মিছিল নিয়ে গিয়ে ছায়ানট ভবনে হামলা করে। প্রথমে পার্কিং লটের দিকে আগুন দেওয়া হয়। পরে তারা ভবনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। মিলনায়তনে হামলাকারীরা যা পেয়েছে তা-ই ভাঙচুর করে। তবলা, হারমোনিয়াম, তানপুরা থেকে শুরু করে কোনো বাদ্যযন্ত্রই অক্ষত রাখা হয়নি। ভাঙচুর করা ছাড়াও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তছনছ করা হয়েছে বই-কাগজপত্র। পুরো মনিটরিং সিস্টেম, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, স্পিকার, লাইট ও ফ্যান ভেঙে ফেলা হয়। ভেঙে ফেলা হয় সেখানে থাকা মাটির তৈরি চারুকর্ম ও শিল্পকর্ম, কক্ষ ও অফিস রুমের বেশির ভাগ আসবাব। ওই হামলার পর ছায়ানট ভবনে পরিচালিত ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না যে এর আসল উদ্দেশ্যটা কী! এরা আসন্ন নির্বাচন বানচাল করে দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে হামলার ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। গত শুক্রবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানায় দলটি। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, হাদি হত্যাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক অগ্নিসংযোগ করে। কর্মরত সাংবাদিকদের জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। একই সঙ্গে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজের সম্পাদক দেশবরেণ্য সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ করা হয়। এ ছাড়া ছায়ানটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করে বিএনপি বলেছে, এসব ঘটনা প্রমাণ করে একটি পুরোনো চিহ্নিত মহল দেশকে পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্যের পথে ধাবিত করতে চায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে তারা নস্যাৎ করে দেশে ফ্যাসিবাদের নতুন সংস্করণ তৈরি করতে চায়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনে করে, এসব ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র। একই রকম বক্তব্য বাংলাদেশ জাসদসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলেরও।
সংবাদমাধ্যমে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, সরকারের দুর্বলতার কারণেই ‘মবতন্ত্র’ প্রশ্রয় পেয়েছে এবং এটি কঠোর হাতে দমন করা প্রয়োজন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ উপলক্ষে রোববার দুপুরে রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা তো চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি। কিন্তু কেন হয়ে যাবে মবোক্রেসি? তাকে কেন লালন করতে দেওয়া হবে?’ গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন রোববার ক্ষতিগ্রস্ত ডেইলি স্টার ভবন পরিদর্শনকালে বলেন, দুটি গণমাধ্যমে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো ব্যক্তিরা গণবিরোধী শক্তি, তারা দেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, এ ধরনের সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর হুমকি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানজনিত পরিস্থিতি দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সেই ন্যায্য ক্ষোভকে ভিত হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে চরম ডানপন্থী অগণতান্ত্রিক শক্তি নিজেদের নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত একটি বিকল্প রাজনৈতিক অবয়ব গড়ার চেষ্টাও তাদের আছে বলে মনে করা যেতে পারে। দেশে প্রতিবেশী বড় দেশের কূটনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা মূলত সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের পক্ষে জনমত ধরে রাখার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কর্মরত এক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকের আশঙ্কা, ওসমান হাদির ভাবমূর্তি এবং তাঁর হত্যাজনিত ক্ষোভের পাটাতনে দাঁড়িয়ে অচিরেই একটি তথাকথিত বিপ্লবী সরকারের ধারণা উপস্থাপন করার তোড়জোড় চলছে।
দেশে এখন যে সরকার আছে তা গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি অন্তর্বর্তী সরকার। গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপ্রত্যাশী জনগণ চাইছে, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার আসুক। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় সেই জনপ্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটে। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনেরও প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাছে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন অভাবনীয় আবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করছে। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না তাঁদেরও অনেকের মতে, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারেক রহমানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প বিপ্লবী সরকারের ধারণা বেশ দুরভিসন্ধিমূলক।
কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার ওপর। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহির অভাব। বিএনপি জুলাই আন্দোলনের বছরখানেক আগেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব হাজির করলেও দলের ভেতরে গণতন্ত্রচর্চার প্রসার ঘটানোর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রস্তাবগুলো তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১১ থেকে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ তখনকার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার লক্ষ্যে এক দফা আন্দোলন শুরু করেছিল বিএনপি। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বা রূপরেখা উপস্থাপন করে। রূপরেখাটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—প্রথম ভাগে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব এবং দ্বিতীয় ভাগে অর্থনীতি ও সমাজসংক্রান্ত নানা বিষয়ে নীতি-সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত। সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, সম্প্রীতিমূলক সমন্বিত রাষ্ট্রসত্তা প্রতিষ্ঠা ও ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ—এগুলো জনগণের যতটা নজর কাড়ার কথা ছিল, বাস্তবে তেমনটা দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণ, প্রতিশ্রুতির বিষয়ে দলটির আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ। এই সন্দেহ অনেকাংশে নিরসন করা যেত দলের ভেতরে সংস্কার শুরু করে।
অস্বীকার করা যাবে না, আন্দোলনের সময় বিএনপিকে মিত্রদের যতটা গুরুত্ব দিতে দেখা যেত, গণ-অভ্যুত্থানের পর তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। এ নিয়ে হতাশাও ভর করছে মিত্র দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। ঝড়ঝঞ্ঝার এই দেশের মানুষ সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। রাজনীতিতেও বারবার জয় পেয়েও হারিয়ে ফেলার নজির আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই ভয় কতটা দূর করতে পারবেন, তার ওপর দেশের মঙ্গলও অনেকখানি নির্ভরশীল।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক তরুণ প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জেঁকে বসে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত, তার ছিদ্রটা হাঁ হয়ে যায় ওই একটি ঘটনায়। শুধু তা-ই নয়, কয়েক দিনের মাথায় বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই গুলিবিদ্ধ তরুণের মৃত্যুর খবরজনিত ক্ষোভ-উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ চালানো হয়। আক্রান্ত হয় বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের প্রধান কার্যালয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন এবং শিশু-কিশোরদের জন্য সংস্কৃতি-সমন্বিত ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার কার্যক্রম। পরদিনই হামলা চালানো হয় দেশের ঐতিহ্যবাহী আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ৫০-৬০ জনের একটি দল মিছিল নিয়ে গিয়ে ছায়ানট ভবনে হামলা করে। প্রথমে পার্কিং লটের দিকে আগুন দেওয়া হয়। পরে তারা ভবনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। মিলনায়তনে হামলাকারীরা যা পেয়েছে তা-ই ভাঙচুর করে। তবলা, হারমোনিয়াম, তানপুরা থেকে শুরু করে কোনো বাদ্যযন্ত্রই অক্ষত রাখা হয়নি। ভাঙচুর করা ছাড়াও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তছনছ করা হয়েছে বই-কাগজপত্র। পুরো মনিটরিং সিস্টেম, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, স্পিকার, লাইট ও ফ্যান ভেঙে ফেলা হয়। ভেঙে ফেলা হয় সেখানে থাকা মাটির তৈরি চারুকর্ম ও শিল্পকর্ম, কক্ষ ও অফিস রুমের বেশির ভাগ আসবাব। ওই হামলার পর ছায়ানট ভবনে পরিচালিত ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না যে এর আসল উদ্দেশ্যটা কী! এরা আসন্ন নির্বাচন বানচাল করে দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে হামলার ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। গত শুক্রবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানায় দলটি। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, হাদি হত্যাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক অগ্নিসংযোগ করে। কর্মরত সাংবাদিকদের জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। একই সঙ্গে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজের সম্পাদক দেশবরেণ্য সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ করা হয়। এ ছাড়া ছায়ানটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করে বিএনপি বলেছে, এসব ঘটনা প্রমাণ করে একটি পুরোনো চিহ্নিত মহল দেশকে পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্যের পথে ধাবিত করতে চায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে তারা নস্যাৎ করে দেশে ফ্যাসিবাদের নতুন সংস্করণ তৈরি করতে চায়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনে করে, এসব ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র। একই রকম বক্তব্য বাংলাদেশ জাসদসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলেরও।
সংবাদমাধ্যমে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, সরকারের দুর্বলতার কারণেই ‘মবতন্ত্র’ প্রশ্রয় পেয়েছে এবং এটি কঠোর হাতে দমন করা প্রয়োজন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ উপলক্ষে রোববার দুপুরে রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা তো চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি। কিন্তু কেন হয়ে যাবে মবোক্রেসি? তাকে কেন লালন করতে দেওয়া হবে?’ গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন রোববার ক্ষতিগ্রস্ত ডেইলি স্টার ভবন পরিদর্শনকালে বলেন, দুটি গণমাধ্যমে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো ব্যক্তিরা গণবিরোধী শক্তি, তারা দেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, এ ধরনের সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর হুমকি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানজনিত পরিস্থিতি দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সেই ন্যায্য ক্ষোভকে ভিত হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে চরম ডানপন্থী অগণতান্ত্রিক শক্তি নিজেদের নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত একটি বিকল্প রাজনৈতিক অবয়ব গড়ার চেষ্টাও তাদের আছে বলে মনে করা যেতে পারে। দেশে প্রতিবেশী বড় দেশের কূটনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা মূলত সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের পক্ষে জনমত ধরে রাখার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কর্মরত এক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকের আশঙ্কা, ওসমান হাদির ভাবমূর্তি এবং তাঁর হত্যাজনিত ক্ষোভের পাটাতনে দাঁড়িয়ে অচিরেই একটি তথাকথিত বিপ্লবী সরকারের ধারণা উপস্থাপন করার তোড়জোড় চলছে।
দেশে এখন যে সরকার আছে তা গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি অন্তর্বর্তী সরকার। গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপ্রত্যাশী জনগণ চাইছে, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার আসুক। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় সেই জনপ্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটে। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনেরও প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাছে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন অভাবনীয় আবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করছে। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না তাঁদেরও অনেকের মতে, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারেক রহমানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প বিপ্লবী সরকারের ধারণা বেশ দুরভিসন্ধিমূলক।
কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার ওপর। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহির অভাব। বিএনপি জুলাই আন্দোলনের বছরখানেক আগেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব হাজির করলেও দলের ভেতরে গণতন্ত্রচর্চার প্রসার ঘটানোর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রস্তাবগুলো তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১১ থেকে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ তখনকার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার লক্ষ্যে এক দফা আন্দোলন শুরু করেছিল বিএনপি। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বা রূপরেখা উপস্থাপন করে। রূপরেখাটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—প্রথম ভাগে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব এবং দ্বিতীয় ভাগে অর্থনীতি ও সমাজসংক্রান্ত নানা বিষয়ে নীতি-সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত। সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, সম্প্রীতিমূলক সমন্বিত রাষ্ট্রসত্তা প্রতিষ্ঠা ও ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ—এগুলো জনগণের যতটা নজর কাড়ার কথা ছিল, বাস্তবে তেমনটা দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণ, প্রতিশ্রুতির বিষয়ে দলটির আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ। এই সন্দেহ অনেকাংশে নিরসন করা যেত দলের ভেতরে সংস্কার শুরু করে।
অস্বীকার করা যাবে না, আন্দোলনের সময় বিএনপিকে মিত্রদের যতটা গুরুত্ব দিতে দেখা যেত, গণ-অভ্যুত্থানের পর তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। এ নিয়ে হতাশাও ভর করছে মিত্র দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। ঝড়ঝঞ্ঝার এই দেশের মানুষ সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। রাজনীতিতেও বারবার জয় পেয়েও হারিয়ে ফেলার নজির আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই ভয় কতটা দূর করতে পারবেন, তার ওপর দেশের মঙ্গলও অনেকখানি নির্ভরশীল।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

প্রকৃতপক্ষে ১৭ মে এ দেশের ইতিহাসের মাইলফলক। সেদিন থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এত দিন শেখ হাসিনার স্বদে
১৭ মে ২০২২
পৃথিবীজুড়ে মনে করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন ও পেশাগত কার্যাবলিতে তাৎপর্যময় বিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং, আইনাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম থাকবে না। বরং ঐতিহ্যবাহী আইনি পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বিশ্বব্যাপী চলা এআই-জ্বরের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
১ ঘণ্টা আগে
একটা সময় হয়তো সবাই বিশ্বাস করতে পারত যে মা-বাবার পর সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায় শিক্ষকের কাছে। একজন শিক্ষক যে আদর্শ ধারণ করেন এবং শিক্ষাদানের মতো যে মহান কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাতে করে সমাজে সব সময়ই শিক্ষাগুরুর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১ ঘণ্টা আগে
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
১ দিন আগেরাইসুল সৌরভ

পৃথিবীজুড়ে মনে করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন ও পেশাগত কার্যাবলিতে তাৎপর্যময় বিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং, আইনাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম থাকবে না। বরং ঐতিহ্যবাহী আইনি পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বিশ্বব্যাপী চলা এআই-জ্বরের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
আইনি কাজে এআইয়ের ব্যবহার আদালতে আইনি জটিল প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ, দলিলাদি ও সাক্ষ্য বিশ্লেষণের পাশাপাশি মামলার ফল ভবিষ্যদ্বাণী বা এ সম্পর্কে পূর্বাভাস বা অভিযুক্তের পূর্বের কার্যাবলি বিশ্লেষণপূর্বক ভবিষ্যৎ অপরাধপ্রবণতা প্রভৃতি জানার জন্যও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই এ কথা বলা যায় যে এই উদীয়মান, শক্তিশালী এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নিঃসন্দেহে কিছু সুবিধা রয়েছে।
তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্বপরিকল্পনা বা যাচাই ছাড়া ঢালাওভাবে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সতর্কতা না নিয়ে সব কাজে এআই প্রযুক্তি সংযুক্ত করে এর ওপর নির্ভর করার বিপরীত দিকসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক লেখায় বা আলোচনায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে এর অভূতপূর্ব সাফল্যের আলোচনার তোড়ে ক্ষতিকর দিকসমূহ, সীমাবদ্ধতা ও অনালোচিত দিকগুলো ভেসে চলে যাচ্ছে। ফলে এই লেখার উদ্দেশ্য হলো আইনাঙ্গনে বা আইন পেশায় এআই প্রযুক্তির কিছু কম আলোচিত বা উপেক্ষিত সীমাবদ্ধতার ওপর আলোকপাত করা; যেন পাঠককুল আইনি কার্যক্রমে এআইয়ের ওপর নির্ভরতার সম্ভাব্য ক্ষতিকর পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হন।
এআই প্রকৃতপক্ষে একটি প্রেডিকশন টুল বা বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস যন্ত্র। এআই প্রযুক্তিকে সক্ষম করার জন্য যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখানে আসলে প্রচুর পরিমাণ সাবেক বা ঐতিহাসিক তথ্য বা ডেটা ব্যবহার করা হয় এবং সেখান থেকেই এই প্রযুক্তি সম্ভাব্যতামূলক ধরনগুলো শনাক্ত করতে শেখে। ফলে, এটি আসলে মানুষের মতো যুক্তি, চিন্তা বা প্রশ্ন করে না বা এর সে সক্ষমতাও নেই।
আইন, আইনি কার্যক্রম এবং আইন পেশা কেবল কতগুলো নিয়মের সমন্বয় নয় বরং এটি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা নির্ধারণ করে। কারণ, আইন-আদালতের কাজই হলো মানুষের মধ্যকার সমস্যার সমাধান করা। অতএব, আইন কোনো গণিত বা ফর্মুলা না যে কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রে প্রবেশ করিয়ে দিলে অপর প্রান্ত দিয়ে সে সূত্রানুসারে সমাধান হয়ে বের হয়ে আসবে। আইনি জটিলতা তার চেয়ে বেশি কিছু; এটি একটি জীবন্ত ব্যবস্থা এবং সর্বদা পরিবর্তনশীল বিষয়, যা সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং নৈতিক বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়। বিপরীতে এআই প্রযুক্তি মানসিক সহানুভূতি, আবেগ, নৈতিক বিচার, মানবিক অন্তর্দৃষ্টি, কর্তৃত্ব, সামাজিক প্রেক্ষাপট, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ, দুর্বলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি নেই; যা সামাজিক মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে এবং আইনি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
অপরদিকে, প্রতিটি মামলা আলাদা এবং সব আইন পেশাজীবী (যেমন: আইনজীবী, বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারী) প্রতিটি মামলা একটি অপরটি থেকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন। ফলস্বরূপ, মানব আইনজীবীরা আদালতে তাঁর নিজস্ব মামলায় কেবল আইন প্রয়োগ বা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন না; বরং প্রয়োজনানুসারে বিচারক এবং আদালতের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দক্ষতাও রাখেন। তদানুসারে, সময়-সময় তাঁরা আদালতের প্রতি তাঁদের আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ করেন; আদালতে বিচারকের মেজাজ, কথার সুর বা ভঙ্গি, সময়, প্রেক্ষাপট এবং চাহিদার সঙ্গে সংবেদনশীলভাবে সাড়া দেন। আর এখানেই এআই মানুষের মতো আদালতে এ রকম অনন্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ।
অধিকন্তু, প্রতিটি মামলা কেন সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য ও তথ্যের ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা হয়, তার একটি যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। কারণ, আদালতে কেবল নামকাওয়াস্তে বিচার সম্পন্ন করলেই চলে না; বরং এমনভাবে বিচার করতে হয় যেন জনসাধারণের কাছে প্রতীয়মান হয় যে ন্যায়বিচার নিষ্পন্ন করা হয়েছে। সুতরাং, জনগণের অধিকার ও আইনি সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য গাণিতিক সূত্র বা অ্যালগরিদমিক প্রযুক্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে জনসাধারণ এবং আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি এবং দূরত্ব তৈরি হতে পারে।
তথাপি বর্তমান এআইয়ের যুগে, এই নব্য প্রযুক্তির সহায়তায় আদালতে নিজের মামলা আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই উপস্থাপনের প্রবণতা দুনিয়াজুড়ে এখন ক্রমবর্ধমান। এ প্রক্রিয়াকে স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলা নামে অভিহিত করা হয় এবং যেহেতু আইনজীবী নিয়োগের জন্য কোনো খরচের প্রয়োজন পড়ে না, তাই দ্রুত স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলা দেশে দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কারণ, এআই চ্যাটবট কাউকে আইনি পরামর্শ বা সহায়তার জন্য কোনো অর্থ নেয় না।
তা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে এআইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বিচারপ্রার্থীর জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, বিচারিক কার্যক্রম সব সময় পরিকল্পনামাফিক আগায় না। বিচার বা শুনানি চলাকালে বিচারক যদি কোনো আইনি জটিল প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট পক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন বা কোনো বিষয়ে স্পষ্টীকরণ চান বা বিচার থেকে সাক্ষ্য অনুপযুক্ত বিবেচনায় প্রত্যাহার করেন, তখন আদালতে এআই চ্যাটবট তাৎক্ষণিক মানব আইনজীবীর মতো বিচারপ্রার্থীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনে অক্ষম।
উপরন্তু, একটি অনুপযুক্ত জেরার প্রশ্ন বা প্রক্রিয়া বা আদালতে বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই এবং সেটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কাছে আপত্তি তুলতে সক্ষম নয়। এসব ছাড়াও, আদালত হলো একটি খেলার মাঠের মতো; যেখানে প্রতিপক্ষ হঠাৎ করে নতুন কৌশল নিয়ে আসতে পারে বা কৌশল পরিবর্তন করতে পারে। অতএব, এসব ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীর নিয়োগ করা মানব আইনজীবী তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম; যেখানে স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলায় এআই টুল এ ধরনের জটিল সেবা দিতে পারে না।
পাশাপাশি অদ্যাবধি এআই প্রযুক্তি কোনো ভুলের দায়িত্ব গ্রহণ করেনি; না এর প্রোগ্রামার, না এটি নিয়ে যে কোম্পানি ব্যবসা করছে, তারা সে দায়িত্ব নিয়েছে। আদালত যখন এআইয়ের ভুলের জন্য আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীকে শাস্তি দেবে, তখন কোনো এআই চ্যাটবট এসে তাদের পাশে দাঁড়াবে না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের উচ্চ ট্রাইব্যুনাল (ইমিগ্রেশন এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চেম্বার) আইনজীবীদের বিচারিক কার্যক্রমে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। উক্ত আদালতে সাব্যস্ত হয়েছে যে একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যারিস্টার এআই চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি দ্বারা তৈরি একটি কাল্পনিক আপিল আদালতের রায় উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনালকে বিভ্রান্ত করেছেন। তাই উক্ত আইনজীবীর এহেন দায়িত্বহীন আচরণ তদন্তের জন্য যুক্তরাজ্যের বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ডে রেফার করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে আরও বেশ কয়েকজন আইনজীবী আদালত এবং আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক এ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে এআই আউটপুট যাচাই না করে আদালতে উপস্থাপন করায় তীব্র ভর্ৎসনা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ, চ্যাটজিপিটি থেকে উদ্ভূত কাল্পনিক কেস রেফারেন্স ও পূর্ব নজির হিসেবে মামলায় দাখিল করা হয়েছে। সুতরাং, আইনাঙ্গনে আইনজীবী, বিচারক বা বিচারপ্রার্থী যে-ই মামলায় এআই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করুক না কেন; দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। তাই এই প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা যথাযথভাবে না জেনে এবং এর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ না নিয়ে বিচারিক কার্যক্রমে এর ব্যবহার সমীচীন নয়।
বিচার বিভাগের ভূমিকা কেবল মামলাসমূহ দক্ষতার সঙ্গে বিচার নিষ্পন্ন করা নয়; বরং এর নৈতিক পরিণতি মূল্যায়ন করা, বিচারে ন্যায্যতা দৃশ্যমান করা এবং সর্বোপরি আইনের শাসনকে এমনভাবে সমুন্নত রাখা, যেন কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি সেখানে বিভ্রান্তি বা বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। সুতরাং, আদালতে বিচার নিষ্পন্ন করার কাজে আমরা কতটুকু আধুনিক যন্ত্র ও আমাদের নিজস্ব বিবেকের সংমিশ্রণ ঘটাব, সে সম্পর্কে একটি স্পষ্ট রেখা আমাদের অবশ্যই টানতে হবে।
লেখক: ডক্টরাল গবেষক, গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, আয়ারল্যান্ড

পৃথিবীজুড়ে মনে করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন ও পেশাগত কার্যাবলিতে তাৎপর্যময় বিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং, আইনাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম থাকবে না। বরং ঐতিহ্যবাহী আইনি পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বিশ্বব্যাপী চলা এআই-জ্বরের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
আইনি কাজে এআইয়ের ব্যবহার আদালতে আইনি জটিল প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ, দলিলাদি ও সাক্ষ্য বিশ্লেষণের পাশাপাশি মামলার ফল ভবিষ্যদ্বাণী বা এ সম্পর্কে পূর্বাভাস বা অভিযুক্তের পূর্বের কার্যাবলি বিশ্লেষণপূর্বক ভবিষ্যৎ অপরাধপ্রবণতা প্রভৃতি জানার জন্যও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই এ কথা বলা যায় যে এই উদীয়মান, শক্তিশালী এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নিঃসন্দেহে কিছু সুবিধা রয়েছে।
তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্বপরিকল্পনা বা যাচাই ছাড়া ঢালাওভাবে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সতর্কতা না নিয়ে সব কাজে এআই প্রযুক্তি সংযুক্ত করে এর ওপর নির্ভর করার বিপরীত দিকসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক লেখায় বা আলোচনায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে এর অভূতপূর্ব সাফল্যের আলোচনার তোড়ে ক্ষতিকর দিকসমূহ, সীমাবদ্ধতা ও অনালোচিত দিকগুলো ভেসে চলে যাচ্ছে। ফলে এই লেখার উদ্দেশ্য হলো আইনাঙ্গনে বা আইন পেশায় এআই প্রযুক্তির কিছু কম আলোচিত বা উপেক্ষিত সীমাবদ্ধতার ওপর আলোকপাত করা; যেন পাঠককুল আইনি কার্যক্রমে এআইয়ের ওপর নির্ভরতার সম্ভাব্য ক্ষতিকর পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হন।
এআই প্রকৃতপক্ষে একটি প্রেডিকশন টুল বা বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস যন্ত্র। এআই প্রযুক্তিকে সক্ষম করার জন্য যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখানে আসলে প্রচুর পরিমাণ সাবেক বা ঐতিহাসিক তথ্য বা ডেটা ব্যবহার করা হয় এবং সেখান থেকেই এই প্রযুক্তি সম্ভাব্যতামূলক ধরনগুলো শনাক্ত করতে শেখে। ফলে, এটি আসলে মানুষের মতো যুক্তি, চিন্তা বা প্রশ্ন করে না বা এর সে সক্ষমতাও নেই।
আইন, আইনি কার্যক্রম এবং আইন পেশা কেবল কতগুলো নিয়মের সমন্বয় নয় বরং এটি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা নির্ধারণ করে। কারণ, আইন-আদালতের কাজই হলো মানুষের মধ্যকার সমস্যার সমাধান করা। অতএব, আইন কোনো গণিত বা ফর্মুলা না যে কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রে প্রবেশ করিয়ে দিলে অপর প্রান্ত দিয়ে সে সূত্রানুসারে সমাধান হয়ে বের হয়ে আসবে। আইনি জটিলতা তার চেয়ে বেশি কিছু; এটি একটি জীবন্ত ব্যবস্থা এবং সর্বদা পরিবর্তনশীল বিষয়, যা সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং নৈতিক বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়। বিপরীতে এআই প্রযুক্তি মানসিক সহানুভূতি, আবেগ, নৈতিক বিচার, মানবিক অন্তর্দৃষ্টি, কর্তৃত্ব, সামাজিক প্রেক্ষাপট, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ, দুর্বলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি নেই; যা সামাজিক মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে এবং আইনি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
অপরদিকে, প্রতিটি মামলা আলাদা এবং সব আইন পেশাজীবী (যেমন: আইনজীবী, বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারী) প্রতিটি মামলা একটি অপরটি থেকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন। ফলস্বরূপ, মানব আইনজীবীরা আদালতে তাঁর নিজস্ব মামলায় কেবল আইন প্রয়োগ বা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন না; বরং প্রয়োজনানুসারে বিচারক এবং আদালতের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দক্ষতাও রাখেন। তদানুসারে, সময়-সময় তাঁরা আদালতের প্রতি তাঁদের আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ করেন; আদালতে বিচারকের মেজাজ, কথার সুর বা ভঙ্গি, সময়, প্রেক্ষাপট এবং চাহিদার সঙ্গে সংবেদনশীলভাবে সাড়া দেন। আর এখানেই এআই মানুষের মতো আদালতে এ রকম অনন্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ।
অধিকন্তু, প্রতিটি মামলা কেন সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য ও তথ্যের ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা হয়, তার একটি যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। কারণ, আদালতে কেবল নামকাওয়াস্তে বিচার সম্পন্ন করলেই চলে না; বরং এমনভাবে বিচার করতে হয় যেন জনসাধারণের কাছে প্রতীয়মান হয় যে ন্যায়বিচার নিষ্পন্ন করা হয়েছে। সুতরাং, জনগণের অধিকার ও আইনি সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য গাণিতিক সূত্র বা অ্যালগরিদমিক প্রযুক্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে জনসাধারণ এবং আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি এবং দূরত্ব তৈরি হতে পারে।
তথাপি বর্তমান এআইয়ের যুগে, এই নব্য প্রযুক্তির সহায়তায় আদালতে নিজের মামলা আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই উপস্থাপনের প্রবণতা দুনিয়াজুড়ে এখন ক্রমবর্ধমান। এ প্রক্রিয়াকে স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলা নামে অভিহিত করা হয় এবং যেহেতু আইনজীবী নিয়োগের জন্য কোনো খরচের প্রয়োজন পড়ে না, তাই দ্রুত স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলা দেশে দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কারণ, এআই চ্যাটবট কাউকে আইনি পরামর্শ বা সহায়তার জন্য কোনো অর্থ নেয় না।
তা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে এআইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বিচারপ্রার্থীর জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, বিচারিক কার্যক্রম সব সময় পরিকল্পনামাফিক আগায় না। বিচার বা শুনানি চলাকালে বিচারক যদি কোনো আইনি জটিল প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট পক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন বা কোনো বিষয়ে স্পষ্টীকরণ চান বা বিচার থেকে সাক্ষ্য অনুপযুক্ত বিবেচনায় প্রত্যাহার করেন, তখন আদালতে এআই চ্যাটবট তাৎক্ষণিক মানব আইনজীবীর মতো বিচারপ্রার্থীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনে অক্ষম।
উপরন্তু, একটি অনুপযুক্ত জেরার প্রশ্ন বা প্রক্রিয়া বা আদালতে বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই এবং সেটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কাছে আপত্তি তুলতে সক্ষম নয়। এসব ছাড়াও, আদালত হলো একটি খেলার মাঠের মতো; যেখানে প্রতিপক্ষ হঠাৎ করে নতুন কৌশল নিয়ে আসতে পারে বা কৌশল পরিবর্তন করতে পারে। অতএব, এসব ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীর নিয়োগ করা মানব আইনজীবী তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম; যেখানে স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলায় এআই টুল এ ধরনের জটিল সেবা দিতে পারে না।
পাশাপাশি অদ্যাবধি এআই প্রযুক্তি কোনো ভুলের দায়িত্ব গ্রহণ করেনি; না এর প্রোগ্রামার, না এটি নিয়ে যে কোম্পানি ব্যবসা করছে, তারা সে দায়িত্ব নিয়েছে। আদালত যখন এআইয়ের ভুলের জন্য আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীকে শাস্তি দেবে, তখন কোনো এআই চ্যাটবট এসে তাদের পাশে দাঁড়াবে না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের উচ্চ ট্রাইব্যুনাল (ইমিগ্রেশন এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চেম্বার) আইনজীবীদের বিচারিক কার্যক্রমে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। উক্ত আদালতে সাব্যস্ত হয়েছে যে একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যারিস্টার এআই চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি দ্বারা তৈরি একটি কাল্পনিক আপিল আদালতের রায় উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনালকে বিভ্রান্ত করেছেন। তাই উক্ত আইনজীবীর এহেন দায়িত্বহীন আচরণ তদন্তের জন্য যুক্তরাজ্যের বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ডে রেফার করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে আরও বেশ কয়েকজন আইনজীবী আদালত এবং আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক এ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে এআই আউটপুট যাচাই না করে আদালতে উপস্থাপন করায় তীব্র ভর্ৎসনা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ, চ্যাটজিপিটি থেকে উদ্ভূত কাল্পনিক কেস রেফারেন্স ও পূর্ব নজির হিসেবে মামলায় দাখিল করা হয়েছে। সুতরাং, আইনাঙ্গনে আইনজীবী, বিচারক বা বিচারপ্রার্থী যে-ই মামলায় এআই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করুক না কেন; দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। তাই এই প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা যথাযথভাবে না জেনে এবং এর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ না নিয়ে বিচারিক কার্যক্রমে এর ব্যবহার সমীচীন নয়।
বিচার বিভাগের ভূমিকা কেবল মামলাসমূহ দক্ষতার সঙ্গে বিচার নিষ্পন্ন করা নয়; বরং এর নৈতিক পরিণতি মূল্যায়ন করা, বিচারে ন্যায্যতা দৃশ্যমান করা এবং সর্বোপরি আইনের শাসনকে এমনভাবে সমুন্নত রাখা, যেন কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি সেখানে বিভ্রান্তি বা বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। সুতরাং, আদালতে বিচার নিষ্পন্ন করার কাজে আমরা কতটুকু আধুনিক যন্ত্র ও আমাদের নিজস্ব বিবেকের সংমিশ্রণ ঘটাব, সে সম্পর্কে একটি স্পষ্ট রেখা আমাদের অবশ্যই টানতে হবে।
লেখক: ডক্টরাল গবেষক, গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, আয়ারল্যান্ড

প্রকৃতপক্ষে ১৭ মে এ দেশের ইতিহাসের মাইলফলক। সেদিন থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এত দিন শেখ হাসিনার স্বদে
১৭ মে ২০২২
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
৩৭ মিনিট আগে
একটা সময় হয়তো সবাই বিশ্বাস করতে পারত যে মা-বাবার পর সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায় শিক্ষকের কাছে। একজন শিক্ষক যে আদর্শ ধারণ করেন এবং শিক্ষাদানের মতো যে মহান কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাতে করে সমাজে সব সময়ই শিক্ষাগুরুর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১ ঘণ্টা আগে
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

একটা সময় হয়তো সবাই বিশ্বাস করতে পারত যে মা-বাবার পর সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায় শিক্ষকের কাছে। একজন শিক্ষক যে আদর্শ ধারণ করেন এবং শিক্ষাদানের মতো যে মহান কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাতে করে সমাজে সব সময়ই শিক্ষাগুরুর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাজ আদর্শ মানুষ গড়ে তোলা, যে মানুষ দেশের কল্যাণে ভূমিকা পালন করবেন, দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করবেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে শিক্ষকতা একটি সম্মানীয় পেশা হতে পারে, সেই শিক্ষক শ্রদ্ধার পাত্র না-ও হতে পারেন! তিনি আদর্শবান না হয়ে ভয়ংকরও হতে পারেন!
২০ ডিসেম্বর এমন একটি মন খারাপ করা সংবাদ ছাপা হয়েছে আজকের পত্রিকায়। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে তার প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। কোচিং ক্লাসে বিভিন্ন সময় তিনি ওই ছাত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করতেন। গত মার্চে কোচিং ক্লাস চলাকালীন তিনি ওই ছাত্রীকে অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। ভয়ভীতি ও পরীক্ষায় ফেল করানোর হুমকি দিয়ে এই নিকৃষ্ট কাজটি তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন। নৈতিকতার কী ভয়ংকর অধঃপতন!
চলতি মাসে ওই শিশুশিক্ষার্থীর পরিবার এ নিয়ে সন্দেহ করে। তারা শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করলে সে পুরো ঘটনা জানায়। এরপর পরিবার থানায় অভিযোগ করলে ১৮ ডিসেম্বর অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাহলে পাঠক বুঝতেই পারছেন, শিশুরা কারও কাছেই নিরাপদ নয়। এমনকি যাঁরা শিক্ষকতার মতো মহান কাজে ব্রত, তাঁদের মাঝেও কারও কারও কাছে নয়। কুমিল্লার জঘন্য ঘটনাটিই তার প্রমাণ। এ ধরনের শিক্ষকেরা সবচেয়ে সম্মানজনক পেশাটির মর্যাদাহানি করেন।
এমন অপরাধী মানসিকতার শিক্ষকদের আগে থেকেই চিহ্নিত করতে না পারলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। একজন শিক্ষক নিয়োগের আগে প্রার্থীর পরিচয় আইনিভাবে যাচাই করে নেওয়া উচিত। যাচাই করা যায় ওই প্রার্থীর আচার-আচরণ, অপরাধসংক্রান্ত অতীত ইতিহাস, কোনো পরিস্থিতির ওপর প্রার্থীর মতাদর্শ, শিশু সুরক্ষা ও যৌন হয়রানির ওপর তাঁর মতামত ইত্যাদি বিষয়। এরপরও সুনিশ্চিত করে বলা যায় না ওই প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মতো কোনো অপরাধ করবেন কি না। তাই নিয়োগের পরও শিক্ষকদের জন্য আচরণ সম্পর্কিত যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
অবশ্যই পরিবার থেকেও শিশুকে বোঝাতে হবে কোনটা ভালো স্পর্শ আর কোনটা মন্দ। কারও মন্দ স্পর্শ পেলে চিৎকার করবে ও দৌড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করবে—এসবও তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিভাবকের কাছে এ ধরনের ঘটনার কথা লুকানো যাবে না। ছেলে হোক কিংবা মেয়েশিশু, উভয়কেই এই তালিম দিতে হবে।
সবাই মিলেই শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। সচেতন প্রশ্ন তুলতে হবে—শিক্ষক কেন শিক্ষার্থীর সামনে ভয়ংকর হয়ে উঠবেন?

একটা সময় হয়তো সবাই বিশ্বাস করতে পারত যে মা-বাবার পর সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায় শিক্ষকের কাছে। একজন শিক্ষক যে আদর্শ ধারণ করেন এবং শিক্ষাদানের মতো যে মহান কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাতে করে সমাজে সব সময়ই শিক্ষাগুরুর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাজ আদর্শ মানুষ গড়ে তোলা, যে মানুষ দেশের কল্যাণে ভূমিকা পালন করবেন, দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করবেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে শিক্ষকতা একটি সম্মানীয় পেশা হতে পারে, সেই শিক্ষক শ্রদ্ধার পাত্র না-ও হতে পারেন! তিনি আদর্শবান না হয়ে ভয়ংকরও হতে পারেন!
২০ ডিসেম্বর এমন একটি মন খারাপ করা সংবাদ ছাপা হয়েছে আজকের পত্রিকায়। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে তার প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। কোচিং ক্লাসে বিভিন্ন সময় তিনি ওই ছাত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করতেন। গত মার্চে কোচিং ক্লাস চলাকালীন তিনি ওই ছাত্রীকে অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। ভয়ভীতি ও পরীক্ষায় ফেল করানোর হুমকি দিয়ে এই নিকৃষ্ট কাজটি তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন। নৈতিকতার কী ভয়ংকর অধঃপতন!
চলতি মাসে ওই শিশুশিক্ষার্থীর পরিবার এ নিয়ে সন্দেহ করে। তারা শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করলে সে পুরো ঘটনা জানায়। এরপর পরিবার থানায় অভিযোগ করলে ১৮ ডিসেম্বর অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাহলে পাঠক বুঝতেই পারছেন, শিশুরা কারও কাছেই নিরাপদ নয়। এমনকি যাঁরা শিক্ষকতার মতো মহান কাজে ব্রত, তাঁদের মাঝেও কারও কারও কাছে নয়। কুমিল্লার জঘন্য ঘটনাটিই তার প্রমাণ। এ ধরনের শিক্ষকেরা সবচেয়ে সম্মানজনক পেশাটির মর্যাদাহানি করেন।
এমন অপরাধী মানসিকতার শিক্ষকদের আগে থেকেই চিহ্নিত করতে না পারলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। একজন শিক্ষক নিয়োগের আগে প্রার্থীর পরিচয় আইনিভাবে যাচাই করে নেওয়া উচিত। যাচাই করা যায় ওই প্রার্থীর আচার-আচরণ, অপরাধসংক্রান্ত অতীত ইতিহাস, কোনো পরিস্থিতির ওপর প্রার্থীর মতাদর্শ, শিশু সুরক্ষা ও যৌন হয়রানির ওপর তাঁর মতামত ইত্যাদি বিষয়। এরপরও সুনিশ্চিত করে বলা যায় না ওই প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মতো কোনো অপরাধ করবেন কি না। তাই নিয়োগের পরও শিক্ষকদের জন্য আচরণ সম্পর্কিত যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
অবশ্যই পরিবার থেকেও শিশুকে বোঝাতে হবে কোনটা ভালো স্পর্শ আর কোনটা মন্দ। কারও মন্দ স্পর্শ পেলে চিৎকার করবে ও দৌড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করবে—এসবও তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিভাবকের কাছে এ ধরনের ঘটনার কথা লুকানো যাবে না। ছেলে হোক কিংবা মেয়েশিশু, উভয়কেই এই তালিম দিতে হবে।
সবাই মিলেই শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। সচেতন প্রশ্ন তুলতে হবে—শিক্ষক কেন শিক্ষার্থীর সামনে ভয়ংকর হয়ে উঠবেন?

প্রকৃতপক্ষে ১৭ মে এ দেশের ইতিহাসের মাইলফলক। সেদিন থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এত দিন শেখ হাসিনার স্বদে
১৭ মে ২০২২
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
৩৭ মিনিট আগে
পৃথিবীজুড়ে মনে করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন ও পেশাগত কার্যাবলিতে তাৎপর্যময় বিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং, আইনাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম থাকবে না। বরং ঐতিহ্যবাহী আইনি পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বিশ্বব্যাপী চলা এআই-জ্বরের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
১ ঘণ্টা আগে
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
১ দিন আগে
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু এবং রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতিকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল?
আশঙ্কা বাস্তবতাবিবর্জিত ছিল না। প্রাথমিকভাবে, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পৌঁছামাত্রই সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া তা-ই প্রমাণ করে। গণ-অভ্যুত্থানের পর সংঘটিত পূর্ববর্তী (অ)রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড, হত্যাচেষ্টার ধারাবাহিকতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক চরম অস্থিরতা মোকাবিলায় ব্যর্থতাই হাদির ওপর গুলিবর্ষণে সাহস জুগিয়েছে স্বার্থান্বেষী মহলকে। তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনী
আবহ শুরু হওয়ামাত্রই প্রকাশ্যে এই আলোচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থীর ওপর গুলি এবং হামলাকারীদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্য অশনিসংকেত। এই ঘটনা জনমনে ভয় সৃষ্টি করবে, যা রাজনৈতিক সহিংসতা, চোরাগোপ্তা হামলা, মব ভায়োলেন্সের মাত্রাসহ হত্যাচেষ্টার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে, যদি দ্রুত ও অর্থবহ তদন্ত না হয় এবং অভিযুক্ত সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে তা ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিযোগকেও আরও দৃঢ় করবে।
নির্বাচনের আগে এ ধরনের সহিংস ঘটনা কি নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে? আপনি কী বলবেন?
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকাই অন্যতম প্রধান সম্ভাব্য কারণ। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের ব্যাপারে ‘যদি, কিন্তু, তবে’ ইত্যাদি যোগ করা; কারও পক্ষ থেকে প্রতিরোধ কিংবা বর্জনের হুমকি এই আশঙ্কাকে ভিত্তি দিচ্ছে। তবে বিস্তর বিশ্লেষণের স্বার্থে এই হত্যা অন্যান্য সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ও কারণ কর্তৃপক্ষের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ঘটনার সময়কাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিনই হাদির ওপর হামলা হওয়ার ক্ষেত্রে, ঘটনার পরপরই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাঁর পদত্যাগ দাবি, ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর পরিস্থিতি, ‘বিচার না হলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’ এমন হুমকি, মৃত্যুসংবাদের পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া এবং নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরকে শারীরিক লাঞ্ছনা—সব মিলিয়ে নির্বাচন বানচালের শঙ্কা থেকে যায়।
গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনদের পারস্পরিক চূড়ান্ত দোষারোপের পেছনের রাজনীতি, অভিযুক্ত গুলিবর্ষণকারীর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি হুমকি, এমনকি কার সঙ্গে কখন, কোথায় অভিযুক্ত হত্যাকারী সময় কাটিয়েছে, তার ছবি বিশ্লেষণ—এসবই ইঙ্গিত করে নির্বাচনকে লক্ষ্যবস্তু করে একটি ‘নির্বাচনভীতি’ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের ঘটনার বিচার না হওয়া অথবা লাশকে সুবিধা আদায়ের রাজনীতিতে পরিণত করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তদলীয় সহিংসতা বৃদ্ধি করে তৃতীয় পক্ষ সার্বিক পরিস্থিতিকে সাংঘর্ষিক করে তুলতে পারে, যা নির্বাচন ব্যাহত করার রাজনীতিই বটে।
আগামী নির্বাচনে এই রাজনৈতিক সহিংসতা কী প্রভাব ফেলতে পারে?
নির্বাচন নানাভাবে প্রভাবিত করা হতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলো দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল এবং সহিংস চক্রের সঙ্গে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এসবই সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে। অন্তত তিনটি সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়নের দাবি রাখে—৫ আগস্ট ২০২৪-এ লুণ্ঠন হওয়া অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি, ভোটযাত্রায় ভয় ও নিষ্ক্রিয়তা এবং উসকানিমূলক বক্তব্য ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির মেরুকরণ বৃদ্ধি। ভয় ও অনিশ্চয়তার কারণে ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমতে পারে। আবার, সরকারের দায়সারা মনোভাব এই হামলাকে ভিকটিমহুড (সিম্বলিক মার্টায়ারডম) বা শক্তি প্রদর্শনের উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে কোনো কোনো পক্ষ। অন্যদিকে, রাষ্ট্র
যদি লোকদেখানো মাত্রাতিরিক্ত কঠোর নিরাপত্তা আরোপ করে, নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের সক্ষমতা ও পেশাদারত্বের ওপর।
এই হামলার পর ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে যে ধরনের আলটিমেটাম কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দুইভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। একদিকে আবেগ তথা বৈধ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যা স্বাভাবিক। অন্যদিকে, অদূরদর্শী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। বিশেষত, শহুরে রাজনীতিতে আন্দোলন ও আলটিমেটাম একটি পরিচিত রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু এগুলো যখন মুহূর্তের উত্তেজনায় জ্বালাও-পোড়াও রূপে রূপান্তর হয় বা সহিংস চরিত্র ধারণ করে, তখন মূল ইস্যু চাপা পড়ে, সাধারণ জনগণ বিরক্ত হয়, আপাতদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। শান্তিপূর্ণ ও আইনি চ্যানেলের মাধ্যমে দাবি উত্থাপনই দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ হয়, যা স্থায়িত্ব দেয়। তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায়, সহিংস ঘটনার জবাব সহিংসতা, ঘৃণা কিংবা মব ভায়োলেন্স নয়, বরং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সহিষ্ণু, সৃজনশীল এবং জনমুখী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ফলপ্রসূ হয়।
এই ঘটনায় চিহ্নিত অপরাধী কীভাবে দেশ ছাড়তে পারল? এখানে কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল?
আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়, সীমান্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি এবং দ্রুত গ্রেপ্তার বাস্তবায়নে গুরুতর গ্যাপ ছিল। সন্দেহভাজনেরা মোটরসাইকেলে ভুয়া নম্বরপ্লেট ব্যবহার, মোবাইল সিম ও ফোন ফেলে দেওয়া, একাধিক যানবাহন বদল করে সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা, যা পূর্বপরিকল্পিত সমন্বয়ভিত্তিক আঁতাতনির্ভর পলায়নের ইঙ্গিত। সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা, আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ প্রতিরোধ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যারা নিয়োজিত রয়েছে, তাদের সহায়তা থাকতে পারে। কোনো একক সংস্থার ব্যর্থতা নয় এটি।
হাদির মৃত্যুসংবাদের পর যেসব সহিংস ঘটনা ঘটল, সেগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অবস্থাদৃষ্টে, কেবল ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার চরম শৈথিল্য ও প্রতিশোধপরায়ণ সুসংগঠিত উসকানির সম্মিলিত ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী সহিংসতার খবরগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ‘লড়াকু যোদ্ধা’ হিসেবে অনেকের কাছে ওসমান হাদির যে পরিচিতি তৈরি হয়েছিল, তা অনেকাংশে ম্লান করেছে বলেই অনুমান।
দেশের যে দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা অফিস পোড়ানো হয়েছে, সেখানে জুলাইয়ের অনেক স্মৃতি-স্মারকও ছিল। ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয়েছে ২৮ জন পেশাজীবীকে। অথচ এই দুটি পত্রিকা পতিত সরকারের সময় গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিষিদ্ধ ছিল। ছায়ানটের ওপর কিসের রাগ? সাংস্কৃতিক দর্শনের সঙ্গে মতবিরোধ নতুন কিছু নয়। মানুষকে আকৃষ্ট করবে এমন পাল্টা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেষ্টা
না করে, এ রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমে কারা উৎসাহ দিচ্ছে?
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ আরও স্পষ্ট করে ঘটনার পেছনের অশুভ শক্তির সংযোগ।
ওসমান হাদির নিজের বক্তব্য এবং অবস্থানের সঙ্গেও এই জঘন্য সহিংস ঘটনাগুলো সাংঘর্ষিক। কেননা, এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্যও ছিল স্পষ্ট: ‘পারলে আরও দশটা প্রথম আলো তৈরি করে দেখান। প্রথম আলো অফিসের সামনে আপনার কাজ কী?’ সবকিছু বিবেচনায়, এই সহিংসতা তরুণদের নিজস্ব বিবেচনায় সংঘটিত হয়েছে—এমনটা মনে হওয়ার কারণ সীমিত। ‘বিশেষ’ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও দলগত আদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রতিশোধমূলক রাজনীতি তরুণদের আবেগকে পুঁজি করছে বলেই অনুমান (ইনস্ট্রুমেন্টালাইজেশন অব ইয়ুথ)। বিনা উসকানিতে দুঃশাসন পতনোত্তর (রেজিম ফল) বাস্তবতায় এ রকম সংঘবদ্ধ সহিংসতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং সর্বোপরি শান্তি বিনির্মাণের পথে প্রধান অন্তরায়। বিশ্ব পরিমণ্ডলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যার দায় সরকারের ওপর চাপবে।
সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
এই বিষয়ে মোটাদাগে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি আইনের শাসন তথা কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অপরাধের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি সমাজকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীবিশেষে আইনের কঠোরতা, নমনীয়তা এমনকি বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা আইনের শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিপন্থী। দ্রুত, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের পাশাপাশি প্রতিটি তদন্তের অগ্রগতি ও চূড়ান্ত ফল জনসমক্ষে নিয়মিত প্রকাশ জরুরি। সীমান্ত নজরদারি
এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্রুত তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদি পরামর্শ। দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন। সঙ্গে বিদ্যমান ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, যার ওপর টেকসই স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে। ভিন্নমতের কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের কারও সহিংস মৃত্যুর ঘটনায় আজকাল উল্লাস—এসবই সুস্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বিলুপ্তির পূর্বাভাস।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য ও সুশিক্ষার অভাব। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক বিভাজনগুলো এখন শত্রু-মিত্রের বাইনারিতে পরিণত হয়েছে। ফলে সামষ্টিক জাতীয় স্বার্থ কিংবা জাতীয়তাবোধ তৈরি হচ্ছে না। রাজনীতিতে ধর্মের যাচ্ছেতাই ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগতকরণের বিপরীতে বিতর্কিতকরণের হীন প্রয়াস, যাকে-তাকে যখন-তখন ভারত-পাকিস্তানপন্থী ট্যাগিং—এসবই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ভয়ানক ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য নির্বাচনী আচরণবিধি বা দেশের বিদ্যমান আইনবিধির আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং প্রথম পরামর্শ অনুযায়ী অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তত মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম ও ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান—এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ পরিসরের জাতীয় রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাও রাখা যেতে পারে এই কমিশনে, যাতে কমিশন মান বজায় রেখে নিরপেক্ষ এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।
অধিকন্তু, সীমিত সম্পদের বিপরীতে দেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ বেকার জনগোষ্ঠী রয়েছে, যার বড় একটি অংশের কাছে রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে উঠেছে বিনা বেতনে তাদের ‘নিয়োগকারী কর্ম সংস্থা’। বিনা বেতনে তথাকথিত এই ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ’ দিয়ে তাদের অনেককে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত করছেন দলের এলিট নেতারা। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই মূলত এদের বেশির ভাগ জড়াচ্ছে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে, নিয়োজিত হচ্ছে বিরোধীমত নিয়ন্ত্রণের
মতো অপরাধমূলক কাজে। ফলে রাজনৈতিক সচেতনতা বাদ দিয়ে রাজনীতিপ্রবণ হয়ে উঠছে সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। তৈরি হচ্ছে অপরাধের এক ভিশাস সাইকেল (পরিবর্তনের নেতিবাচক চক্র)। ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে এবং স্থিতিশীলতা পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে।
অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল?
আশঙ্কা বাস্তবতাবিবর্জিত ছিল না। প্রাথমিকভাবে, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পৌঁছামাত্রই সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া তা-ই প্রমাণ করে। গণ-অভ্যুত্থানের পর সংঘটিত পূর্ববর্তী (অ)রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড, হত্যাচেষ্টার ধারাবাহিকতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক চরম অস্থিরতা মোকাবিলায় ব্যর্থতাই হাদির ওপর গুলিবর্ষণে সাহস জুগিয়েছে স্বার্থান্বেষী মহলকে। তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনী
আবহ শুরু হওয়ামাত্রই প্রকাশ্যে এই আলোচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থীর ওপর গুলি এবং হামলাকারীদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্য অশনিসংকেত। এই ঘটনা জনমনে ভয় সৃষ্টি করবে, যা রাজনৈতিক সহিংসতা, চোরাগোপ্তা হামলা, মব ভায়োলেন্সের মাত্রাসহ হত্যাচেষ্টার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে, যদি দ্রুত ও অর্থবহ তদন্ত না হয় এবং অভিযুক্ত সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে তা ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিযোগকেও আরও দৃঢ় করবে।
নির্বাচনের আগে এ ধরনের সহিংস ঘটনা কি নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে? আপনি কী বলবেন?
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকাই অন্যতম প্রধান সম্ভাব্য কারণ। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের ব্যাপারে ‘যদি, কিন্তু, তবে’ ইত্যাদি যোগ করা; কারও পক্ষ থেকে প্রতিরোধ কিংবা বর্জনের হুমকি এই আশঙ্কাকে ভিত্তি দিচ্ছে। তবে বিস্তর বিশ্লেষণের স্বার্থে এই হত্যা অন্যান্য সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ও কারণ কর্তৃপক্ষের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ঘটনার সময়কাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিনই হাদির ওপর হামলা হওয়ার ক্ষেত্রে, ঘটনার পরপরই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাঁর পদত্যাগ দাবি, ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর পরিস্থিতি, ‘বিচার না হলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’ এমন হুমকি, মৃত্যুসংবাদের পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া এবং নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরকে শারীরিক লাঞ্ছনা—সব মিলিয়ে নির্বাচন বানচালের শঙ্কা থেকে যায়।
গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনদের পারস্পরিক চূড়ান্ত দোষারোপের পেছনের রাজনীতি, অভিযুক্ত গুলিবর্ষণকারীর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি হুমকি, এমনকি কার সঙ্গে কখন, কোথায় অভিযুক্ত হত্যাকারী সময় কাটিয়েছে, তার ছবি বিশ্লেষণ—এসবই ইঙ্গিত করে নির্বাচনকে লক্ষ্যবস্তু করে একটি ‘নির্বাচনভীতি’ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের ঘটনার বিচার না হওয়া অথবা লাশকে সুবিধা আদায়ের রাজনীতিতে পরিণত করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তদলীয় সহিংসতা বৃদ্ধি করে তৃতীয় পক্ষ সার্বিক পরিস্থিতিকে সাংঘর্ষিক করে তুলতে পারে, যা নির্বাচন ব্যাহত করার রাজনীতিই বটে।
আগামী নির্বাচনে এই রাজনৈতিক সহিংসতা কী প্রভাব ফেলতে পারে?
নির্বাচন নানাভাবে প্রভাবিত করা হতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলো দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল এবং সহিংস চক্রের সঙ্গে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এসবই সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে। অন্তত তিনটি সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়নের দাবি রাখে—৫ আগস্ট ২০২৪-এ লুণ্ঠন হওয়া অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি, ভোটযাত্রায় ভয় ও নিষ্ক্রিয়তা এবং উসকানিমূলক বক্তব্য ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির মেরুকরণ বৃদ্ধি। ভয় ও অনিশ্চয়তার কারণে ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমতে পারে। আবার, সরকারের দায়সারা মনোভাব এই হামলাকে ভিকটিমহুড (সিম্বলিক মার্টায়ারডম) বা শক্তি প্রদর্শনের উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে কোনো কোনো পক্ষ। অন্যদিকে, রাষ্ট্র
যদি লোকদেখানো মাত্রাতিরিক্ত কঠোর নিরাপত্তা আরোপ করে, নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের সক্ষমতা ও পেশাদারত্বের ওপর।
এই হামলার পর ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে যে ধরনের আলটিমেটাম কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দুইভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। একদিকে আবেগ তথা বৈধ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যা স্বাভাবিক। অন্যদিকে, অদূরদর্শী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। বিশেষত, শহুরে রাজনীতিতে আন্দোলন ও আলটিমেটাম একটি পরিচিত রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু এগুলো যখন মুহূর্তের উত্তেজনায় জ্বালাও-পোড়াও রূপে রূপান্তর হয় বা সহিংস চরিত্র ধারণ করে, তখন মূল ইস্যু চাপা পড়ে, সাধারণ জনগণ বিরক্ত হয়, আপাতদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। শান্তিপূর্ণ ও আইনি চ্যানেলের মাধ্যমে দাবি উত্থাপনই দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ হয়, যা স্থায়িত্ব দেয়। তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায়, সহিংস ঘটনার জবাব সহিংসতা, ঘৃণা কিংবা মব ভায়োলেন্স নয়, বরং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সহিষ্ণু, সৃজনশীল এবং জনমুখী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ফলপ্রসূ হয়।
এই ঘটনায় চিহ্নিত অপরাধী কীভাবে দেশ ছাড়তে পারল? এখানে কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল?
আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়, সীমান্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি এবং দ্রুত গ্রেপ্তার বাস্তবায়নে গুরুতর গ্যাপ ছিল। সন্দেহভাজনেরা মোটরসাইকেলে ভুয়া নম্বরপ্লেট ব্যবহার, মোবাইল সিম ও ফোন ফেলে দেওয়া, একাধিক যানবাহন বদল করে সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা, যা পূর্বপরিকল্পিত সমন্বয়ভিত্তিক আঁতাতনির্ভর পলায়নের ইঙ্গিত। সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা, আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ প্রতিরোধ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যারা নিয়োজিত রয়েছে, তাদের সহায়তা থাকতে পারে। কোনো একক সংস্থার ব্যর্থতা নয় এটি।
হাদির মৃত্যুসংবাদের পর যেসব সহিংস ঘটনা ঘটল, সেগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অবস্থাদৃষ্টে, কেবল ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার চরম শৈথিল্য ও প্রতিশোধপরায়ণ সুসংগঠিত উসকানির সম্মিলিত ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী সহিংসতার খবরগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ‘লড়াকু যোদ্ধা’ হিসেবে অনেকের কাছে ওসমান হাদির যে পরিচিতি তৈরি হয়েছিল, তা অনেকাংশে ম্লান করেছে বলেই অনুমান।
দেশের যে দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা অফিস পোড়ানো হয়েছে, সেখানে জুলাইয়ের অনেক স্মৃতি-স্মারকও ছিল। ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয়েছে ২৮ জন পেশাজীবীকে। অথচ এই দুটি পত্রিকা পতিত সরকারের সময় গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিষিদ্ধ ছিল। ছায়ানটের ওপর কিসের রাগ? সাংস্কৃতিক দর্শনের সঙ্গে মতবিরোধ নতুন কিছু নয়। মানুষকে আকৃষ্ট করবে এমন পাল্টা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেষ্টা
না করে, এ রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমে কারা উৎসাহ দিচ্ছে?
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ আরও স্পষ্ট করে ঘটনার পেছনের অশুভ শক্তির সংযোগ।
ওসমান হাদির নিজের বক্তব্য এবং অবস্থানের সঙ্গেও এই জঘন্য সহিংস ঘটনাগুলো সাংঘর্ষিক। কেননা, এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্যও ছিল স্পষ্ট: ‘পারলে আরও দশটা প্রথম আলো তৈরি করে দেখান। প্রথম আলো অফিসের সামনে আপনার কাজ কী?’ সবকিছু বিবেচনায়, এই সহিংসতা তরুণদের নিজস্ব বিবেচনায় সংঘটিত হয়েছে—এমনটা মনে হওয়ার কারণ সীমিত। ‘বিশেষ’ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও দলগত আদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রতিশোধমূলক রাজনীতি তরুণদের আবেগকে পুঁজি করছে বলেই অনুমান (ইনস্ট্রুমেন্টালাইজেশন অব ইয়ুথ)। বিনা উসকানিতে দুঃশাসন পতনোত্তর (রেজিম ফল) বাস্তবতায় এ রকম সংঘবদ্ধ সহিংসতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং সর্বোপরি শান্তি বিনির্মাণের পথে প্রধান অন্তরায়। বিশ্ব পরিমণ্ডলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যার দায় সরকারের ওপর চাপবে।
সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
এই বিষয়ে মোটাদাগে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি আইনের শাসন তথা কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অপরাধের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি সমাজকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীবিশেষে আইনের কঠোরতা, নমনীয়তা এমনকি বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা আইনের শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিপন্থী। দ্রুত, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের পাশাপাশি প্রতিটি তদন্তের অগ্রগতি ও চূড়ান্ত ফল জনসমক্ষে নিয়মিত প্রকাশ জরুরি। সীমান্ত নজরদারি
এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্রুত তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদি পরামর্শ। দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন। সঙ্গে বিদ্যমান ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, যার ওপর টেকসই স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে। ভিন্নমতের কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের কারও সহিংস মৃত্যুর ঘটনায় আজকাল উল্লাস—এসবই সুস্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বিলুপ্তির পূর্বাভাস।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য ও সুশিক্ষার অভাব। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক বিভাজনগুলো এখন শত্রু-মিত্রের বাইনারিতে পরিণত হয়েছে। ফলে সামষ্টিক জাতীয় স্বার্থ কিংবা জাতীয়তাবোধ তৈরি হচ্ছে না। রাজনীতিতে ধর্মের যাচ্ছেতাই ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগতকরণের বিপরীতে বিতর্কিতকরণের হীন প্রয়াস, যাকে-তাকে যখন-তখন ভারত-পাকিস্তানপন্থী ট্যাগিং—এসবই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ভয়ানক ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য নির্বাচনী আচরণবিধি বা দেশের বিদ্যমান আইনবিধির আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং প্রথম পরামর্শ অনুযায়ী অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তত মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম ও ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান—এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ পরিসরের জাতীয় রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাও রাখা যেতে পারে এই কমিশনে, যাতে কমিশন মান বজায় রেখে নিরপেক্ষ এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।
অধিকন্তু, সীমিত সম্পদের বিপরীতে দেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ বেকার জনগোষ্ঠী রয়েছে, যার বড় একটি অংশের কাছে রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে উঠেছে বিনা বেতনে তাদের ‘নিয়োগকারী কর্ম সংস্থা’। বিনা বেতনে তথাকথিত এই ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ’ দিয়ে তাদের অনেককে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত করছেন দলের এলিট নেতারা। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই মূলত এদের বেশির ভাগ জড়াচ্ছে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে, নিয়োজিত হচ্ছে বিরোধীমত নিয়ন্ত্রণের
মতো অপরাধমূলক কাজে। ফলে রাজনৈতিক সচেতনতা বাদ দিয়ে রাজনীতিপ্রবণ হয়ে উঠছে সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। তৈরি হচ্ছে অপরাধের এক ভিশাস সাইকেল (পরিবর্তনের নেতিবাচক চক্র)। ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে এবং স্থিতিশীলতা পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে।

প্রকৃতপক্ষে ১৭ মে এ দেশের ইতিহাসের মাইলফলক। সেদিন থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এত দিন শেখ হাসিনার স্বদে
১৭ মে ২০২২
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
৩৭ মিনিট আগে
পৃথিবীজুড়ে মনে করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন ও পেশাগত কার্যাবলিতে তাৎপর্যময় বিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং, আইনাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম থাকবে না। বরং ঐতিহ্যবাহী আইনি পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বিশ্বব্যাপী চলা এআই-জ্বরের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
১ ঘণ্টা আগে
একটা সময় হয়তো সবাই বিশ্বাস করতে পারত যে মা-বাবার পর সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায় শিক্ষকের কাছে। একজন শিক্ষক যে আদর্শ ধারণ করেন এবং শিক্ষাদানের মতো যে মহান কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাতে করে সমাজে সব সময়ই শিক্ষাগুরুর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১ ঘণ্টা আগে