Ajker Patrika

সোভিয়েত ইউনিয়ন: একটি স্বপ্নের মৃত্যু

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯: ২৮
সোভিয়েত ইউনিয়ন: একটি স্বপ্নের মৃত্যু

২৫ ডিসেম্বর ছিল সোভিয়েতফেরত শিক্ষার্থীদের পিকনিক। প্রতিবছরই এ দিনটিতে ঢাকার আশপাশে এই পুনর্মিলনী হয়। বছরের পর বছর এই দিনটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা এক হয়ে ফিরে যান তাঁদের ফেলে আসা দিনগুলোয় এবং অবধারিতভাবেই তাঁরা যেসব আলোচনা করেন, তাতে শাহ আবদুল করিমের ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানের একটা রেশ পাওয়া যায়।

যাঁরা এ দিনটিতে নিভৃতে কোনো এক পিকনিক স্পটে জড়ো হন, তাঁরা ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাপ্তির ট্র্যাজিক দিনটির কথাও স্মরণ করেন। যাঁরা ১৯৯১ সালের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন, তাঁদের মনে দেশটি এখনো হয়ে রয়েছে এক রূপকথার দেশ। নস্টালজিয়া তাঁদের জীবনযাপনের একটি বড় অনুষঙ্গ।

দুই. যে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাচ্ছিল, সে সময়টায় অন্য অনেক শিক্ষার্থীর মতো আমিও অবস্থান করছিলাম সেখানে। আমি পড়াশোনা করতাম রাশান ফেডারেশনের সর্বদক্ষিণের শেষ বড় শহর ক্রাসনাদারে। আমাদের এলাকাকে বলা হতো উত্তর ককেশাস। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যেত কুবান নদী। রাশিয়ায় খুব কম অঞ্চলই আছে, যেখানে নদীর বড় বড় মাছ বিক্রি হয়। যেখানে হেক্টরের পর হেক্টরজুড়ে চাষ হয় ধানের। ক্রাসনাদার ছিল সে রকম ‘মাছে-ভাতে’ এক শহর।

সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য, সেটা জানি না, সমাজতন্ত্রের শেষ পাঁচ বছর এবং গণতন্ত্রের প্রথম পাঁচ বছর আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলাম। ফলে সোভিয়েত পতনের ইতিহাসটি আসলে আমাদের চোখের সামনেই নির্মিত হয়েছে। আমরা ছিলাম তার অসহায় পর্যবেক্ষক।

তিন. কেন ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন, তা নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। তাই নতুন করে তার আলোচনা নিরর্থক। শুধু এটুকু বলাই বোধ হয় দরকারি, পশ্চিমা বিশ্বের কমিউনিস্টবিরোধী ষড়যন্ত্রই কেবল দেশটির ভাঙনের কারণ ছিল না, অভ্যন্তরীণ নানা অরাজকতাও দেশটির ইতি টানার ব্যাপারে অবদান রেখেছে। কাছে থেকে দেখা সেই কারণগুলো নিয়েই কিছু কথা বলব এখন। চোখে দেখা কারণগুলোর বাইরেও যেসব কারণ রয়েছে, তার আলোচনা এখানে করছি না বটে, তবে ‘আকেলমন্দ কে লিয়ে ইশারা-ই কাফি হ্যায়’ কথাটা অন্য অনেক কিছুর মতো এখানেও প্রযোজ্য।

প্রচারণার একটা নিজস্ব শক্তি আছে। বারবার কানের সামনে একই কথা বলতে থাকলে একসময় যেকোনো মিথ্যাও সত্য বলে মনে হতে থাকে। হিটলারের সহচর গোয়েবলস এ কথাটি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। খারাপ মানুষের অথবা ক্ষমতাবান মানুষের একটা বড় আশ্রয় হলো প্রচারণা দিয়ে সত্যকে লুকিয়ে ফেলা। সেই প্রচারণা একসময় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং তারা সত্য ভেবে নিজেরাও তা প্রচার করতে থাকে।

আমরা ১৯৮৬ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম, তখন আফগানিস্তানে ছিল সোভিয়েত সেনা। সরকারি প্রচারণা ছিল, যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী ভালো করছে, আফগানিস্তানে গণতন্ত্র রক্ষা করছে। অথচ মূল ঘটনার সঙ্গে এই প্রচারণার মিল ছিল না। যাঁদের সন্তানেরা আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন, তাঁরা সব সময় আতঙ্কে থাকতেন, সন্তানের মৃত্যুর খবর শুনতে হতে পারে ভেবে পাথর হয়ে যেত তাঁদের মন। অসহায় মা-বাবার নীরব দীর্ঘশ্বাস এবং পার্টির বিরুদ্ধে কিছু না বলতে পারার জ্বালা ঠিকই ধরা পড়ত আমাদের চোখে। কী ভয়টাই না তাঁরা পেতেন কমিউনিস্ট পার্টিকে! যে পার্টিকে বলা হচ্ছে কেন্দ্র, সেই পার্টিকে আপন ভাবতে পারছে না দেশের সাধারণ মানুষ—এই সহজ সত্যটি কী করে সে সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটা এখনো বুঝতে পারি না।

আর এর কিছুকাল পরে স্বনামধন্য গায়ক আলেগ গাজমানোভের ‘পুতানা’ গানটি তো আফগান যুদ্ধের পুরো ক্লেদটিকে সামনে নিয়ে এসেছিল।

চার. সোভিয়েত ইউনিয়নে শিক্ষার্থী যুবকদের সংগঠন ছিল ‘কমসোমল’। শিক্ষার্থীদের সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে কাজ করত সংগঠনটি। কিন্তু এরাই যেভাবে দুর্নীতিবাজ আর ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল, সে কথা না বললে সমাজতন্ত্র পতনের একটি সূক্ষ্ম কারণ ঊহ্য থেকে যাবে।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকাঅর্থনীতি বুঝুক আর না বুঝুক, একজন মানুষ বোঝে, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তরুণদের পড়াশোনা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যে বৃত্তিগুলো দিত, তাতে মূলত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তরুণেরা আসত। এই গরিব দেশগুলোর সন্তানেরা যে পোশাক পরত, যে যন্ত্রে গান শুনত, সেগুলো সোভিয়েত তরুণদের কাছে ছিল অকল্পনীয়। তারা চেষ্টা করত, কোনো না কোনোভাবে বিদেশি ছাত্রদের কাছ থেকে জিনসের প্যান্ট অথবা স্টেরিও সেট কিনতে। পড়াশোনার পাশাপাশি এ রকম একটি ব্যবসা গড়ে উঠল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে। এটা ছিল ওপেন সিক্রেট। কোনো কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী স্রেফ এই ব্যবসা করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠল। আর সোভিয়েত তরুণদের হাতে কী করে এত ‘বাড়তি পয়সা’ এল, সেটাও ভেবে দেখার মতো। একটু খোঁজ করতেই চোখে পড়ল, পার্টির ওপরদিকে যাদের অবস্থান, তাদের প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদেই গড়ে উঠতে পারছে এই অবৈধ ব্যবসা। মুখে বলা হচ্ছে এগুলো অবৈধ, অথচ সবখানেই তা ঘটছে সবার চোখের সামনে। এই বৈপরীত্যই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সমাজের নৈতিকতা কোথাও কোথাও নড়বড়ে হয়ে উঠছে।

পাঁচ. মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে পারছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে ভালো কিছু কেনার। কিন্তু ভালো কিছু পাবে কোথায়? সেই কোনো এক মান্ধাতার আমলে জামা-জুতা-প্যান্টের ডিজাইন করা হয়েছিল, আসবাবের ডিজাইন করা হয়েছিল, সেগুলোই তো পাওয়া যেত সরকারি দোকানগুলোয়। এর বাইরে একটু শখের জিনিস কিনবে, তার তো উপায় নেই।

সেবা ব্যাপারটা হয়ে উঠেছিল হাস্যকর! মাস গেলেই বেতন, সুতরাং কাজ করলাম কি না করলাম, সেটা খুব বড় ব্যাপার ছিল না। ক্রেতারা নির্ভর করতেন এই সরকারি কর্মচারীদের ওপর, যাঁদের অনেকেই ক্রেতাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন।

একঘেয়ে হয়ে যাওয়া পোশাক-আশাক, আসবাব, একই জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, বিদেশভ্রমণের সুযোগহীনতা রুশ মানুষকে করে তুলেছিল পৃথিবী-বিচ্ছিন্ন। আর তার মধ্যেই দরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র দেশের শিক্ষার্থীদের চকচকে চেহারা সোভিয়েত নাগরিকদের মনে সংশয়ের জন্ম দিত। যদি গরিব দেশের মানুষেরই এ রকম মনকাড়া বাহিরিয়ানা, তাহলে উন্নত বিশ্বের মানুষেরা না জানি কী সুখে আছে—এই ভাবনা যদি একজন সোভিয়েত নাগরিকের মন দখল করে নেয়, তাহলে দোষ দেওয়া হবে কাকে?

ছোট্ট একটি তথ্য: কোকা-কোলা কিংবা সেভেনআপ কিংবা পেপসি যদি হঠাৎ করে পৌঁছে যায় কারও হাতে, তাহলেই সে মানুষ পশ্চিমা বিশ্ব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পণ্যসামগ্রীর পার্থক্য বুঝে ফেলবেন। তখন তাঁর আরও ইচ্ছে হবে, পশ্চিমা বিলাসিতার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার। সে চেষ্টাই করেছে হতভাগা মানুষেরা।

ছয়. অর্থনীতি হোঁচট খেয়েছিল কোথায়, তা নিয়ে আমজনতার মনে জিজ্ঞাসা ছিল, কিন্তু তার উত্তর জানা ছিল কম। দক্ষতাহীন মানুষদের ততোধিক অপরিকল্পিত কারখানায় তৈরি সামগ্রীর গুণগত মান ছিল একেবারে নিচু পর্যায়ের। কিন্তু কে কথা বলবে এ নিয়ে? ছোট্ট উদাহরণ: ট্রাক বানানো হতো কুতাইসির কারখানায়। এত খারাপ মানের ট্রাক পৃথিবীর আর কোথাও বানানো হতো না। ব্যক্তিগত মালিকানায় ট্রাক কেনার কোনো সুযোগ ছিল না। ট্রাক কিনত সরকার। বছরের পর বছর গচ্চা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মান ভালো করার কথা মাথায়ই আসেনি কারও।

এভাবেই কোনো পরিবর্তন ছাড়াই টিকে ছিল কারখানাগুলো। সরকারি কাজ বলতে সেই ছন্নছাড়া সেবার কথা বলতে হচ্ছে, যা শুধু দেনায় জর্জরিত করেছে দেশকে। ধীরে ধীরে খুলে দিয়েছে পশ্চিমের বন্ধ দরজা।

১৯৮৭ সালে গরবাচোভ যখন অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ খুঁজলেন, তখন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হতে লাগল এবং তা সরকারি টাকা শুষে খেতে থাকল। একশ্রেণির মানুষের হাতে কোত্থেকে এসে পড়ল সীমাহীন অর্থ এবং তা দিয়েই তারা ঘটিয়ে দিলেন যাবতীয় অনর্থ।

সাত. সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলে ফেলা দরকার। অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটিই ছিল পরিকল্পিত অর্থনীতির পথটির মধ্যে নানা ধরনের সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকা। সে সময় তেলের দাম কমে যাওয়ায় দেশের বাজেটে একটা বড় ঘাটতি দেখা দেয়, যা থেকে উঠে আসা সহজসাধ্য ছিল না। মাদকবিরোধী প্রচারণা শেষ পর্যন্ত জনগণকে কোনো দিশা দেখাতে পারেনি; বরং বাড়িতে মদ তৈরি করে সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল সে দেশের জনগণ। আশির দশকের শুরুতে দেখা গেল দেশের নেতারা বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন, তাঁদের পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছেন, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ নানা কারণে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, জাতীয়তার প্রশ্নগুলো বড় হয়ে উঠছে ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে, কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরেও দ্বিধাবিভক্তি বেড়ে যাচ্ছে এবং গরবাচোভকে সরিয়ে কীভাবে ইয়েলৎসিনের আবির্ভাব হলো, কী করে তিনি জনপ্রিয়তা পেলেন, সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেও একটি স্বপ্ন কেন হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল, তার হদিস পাওয়া যাবে।

স্বপ্নটির অবসান ঘটেছে বটে, কিন্তু প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েতফেরত যে শিক্ষার্থীরা ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করেন, তাঁরা জানেন, কারও কারও মনে সত্যিই স্বপ্নটির জন্ম হয়েছিল তা বাস্তবে পরিণত করার প্রত্যয় নিয়ে। প্রত্যয়টি হয়তো মরে যায়নি।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...