Ajker Patrika

চাকরির বাজারে বেকারের সারি

চাকরির বাজারে বেকারের সারি

অর্থনীতি বড় হচ্ছে। বেসরকারি খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। সরকারও উন্নয়ন খাতে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। এসবে ভর করে বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। সরকার দাবি করছে, সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন হওয়ায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছে। তবে এত ভালো খবরের ভিড়ে হতাশাজনক খবর হলো, এই মুহূর্তে দেশে ২৩ লাখের বেশি বেকার চাকরি খুঁজছেন। গত বছরের শেষ তিন মাসেই বেকার বেড়েছে ৪০ হাজার। বেকারদের মধ্যে আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের অন্তত ২৮ শতাংশ বেকার রয়েছেন। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ডলারসহ নানা সংকটের কারণে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্থর গতি চলছে। তার প্রভাবেই চাকরির বাজারও কিছুটা সংকুচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে ২০১৮ সালে স্নাতক ও ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন আরিফুল ইসলাম। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর থেকেই চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন জানিয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কোনোটার প্রিলিমিনারি পাস করি তো লিখিত পরীক্ষায় আটকে যাচ্ছি। আবার কখনো সেটা উতরে গেলে ভাইভাতে আটকে যাচ্ছি।’

আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, প্রতিযোগিতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছরই হাজার হাজার ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। বেসরকারি খাতে চাকরির জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে। ফলে চাকরিতে কোথাও ঢুকতে না পারলে অভিজ্ঞতা হয় না। অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে চাকরি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত আরিফের মতো এ রকম অসংখ্য তরুণ বেকারেরই চাকরি না পাওয়া নিয়ে এমন হতাশার গল্প রয়েছে।

জানা যায়, দেশে ডলার, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম। আমদানি কড়াকড়ি করায় শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি কমছে। এতে নতুন শিল্প স্থাপন, বিদ্যমান শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে নতুন কাজের সুযোগ কমছে। আর সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে টাকার প্রবাহ কমানোর কারণে ব্যবসা ও শিল্পের প্রসার স্লথ হয়ে পড়ছে বলে উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন। তাঁরা মনে করেন, এতে চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষিতরা সহসাই চাকরিতে ঢুকতে পারছেন না। আর সরকারও উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ পরিকল্পনা করলেও ঠিকমতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সামনে এডিপির আকারও কাটছাঁট করা হবে বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে। এর ফলেও বেকার জনগোষ্ঠীর একটি অংশের কাজ পেতে সমস্যা হচ্ছে। পোশাক, বস্ত্র, চামড়া ও হালকা প্রকৌশল খাতের অনেক উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের অনেকেই ব্যবসা বাড়াচ্ছেন না, বরং পর্যাপ্ত পুঁজির অভাব ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় কিছু জনবল কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৩৬ শতাংশ।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সব শেষ তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানা যায়, সংস্থার শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ৮৩ শতাংশই তরুণ-তরুণী।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, শ্রমশক্তিতে ২ কোটি ৬৮ লাখ ২৪ হাজার যুবক-যুবতী আছেন, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। তাঁদের মধ্যে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার কাজের মধ্যে আছেন। যুবক-যুবতীদের মধ্যে ২১ লাখ ৪৮ হাজার বেকার, যা দেশের মোট বেকার জনগোষ্ঠীর ৮৩ শতাংশ।

বিবিএসের মতে, সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেনি, কিন্তু কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাঁদেরই বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি জরিপের আগে ৩০ দিন বেতন বা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন, তাঁরাও বেকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাঁদের ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিটা দেশের বাইরে যান।

নিট পোশাকমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, ‘কর্মসংস্থান হচ্ছে না এটা ঠিক। অনেকের ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়, কাটছাঁট করে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তবে দেশে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট আছেন কমই। যে ধরনের লোক আমরা চাই, সেই ধরনের লোক নেই। আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার একটা দূরত্ব রয়ে গেছে। এ কারণে প্রচুর বিদেশি লোকজন এখানে চাকরিতে ঢুকছেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো গেলে আমাদের চাকরি হবে, বিদেশি লোকজনের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে, বৈদেশিক মুদ্রাও বাঁচবে।’

বিবিএসের হিসাবে চাকরি করার মতো উপযুক্ত বেকারের বাইরেও দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে। এ সংখ্যাটি প্রায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ। যাঁদের বড় অংশই শিক্ষার্থী, অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক লোক।

গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা দেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ বেকার অবস্থায় আছেন। তাঁরা খুঁজছেন, কিন্তু চাকরি পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা উচ্চশিক্ষিতদের একটি বড় অংশ বেকার কেন–এ বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করা বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. এস এম জুলফিকার আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁদের সম্পর্কে চাকরিদাতাদের একটু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তা ছাড়া, ওই বেকারদের নিজের বিষয়ের বাইরেও জানা-বোঝা বা অন্য কিছু বিষয়ে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একটি বড় শ্রেণি চাকরির অপেক্ষায় থাকা সত্ত্বেও পোশাকশিল্পসহ এ রকম কয়েকটি খাতে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এটাও বেকারত্বের একটি কারণ। তাঁর মতে, উদ্যোক্তারা মনে করেন, দেশের শিক্ষিতদের একটি অংশের উৎপাদনশীলতা কম এবং যে ধরনের কাজে তাঁরা লোক খুঁজছেন, তাঁরা ওই কাজের জন্য উপযুক্ত নন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত