Ajker Patrika

মুনাফাখোর চক্র সক্রিয় বাজারে

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১: ২৭
মুনাফাখোর চক্র সক্রিয় বাজারে

নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন দামে রীতিমতো দিশেহারা মানুষ। নানা অজুহাতে প্রায় সব পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে পকেট কেটে চলেছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। তিন বছর ধরে এ অপচেষ্টা প্রায় অপ্রতিরোধ্য। সরকার, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, ভোক্তার দাবি–কোনো কিছুতেই গা করছেন না তাঁরা। পেঁয়াজ, চিনি, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, মাংস, ডিম, আলুসহ প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম শুধু সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে ৩ শতাংশ থেকে ১৬৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সরকারের দেওয়া শুল্কছাড়, এলসি-সুবিধাসহ কোনো সহায়তায়ই ভোক্তার কোনো লাভ হয়নি। বরং ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হয়েছে। অথচ বিশ্ববাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম কমে গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত সপ্তাহে দেওয়া তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত জানুয়ারিতে খাদ্যপণ্যের দাম গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এর মধ্যেও ব্যবসায়ীদের আবদার মেনে শুল্কছাড় দেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতি হলেও ভোক্তারা বলতে গেলে এর সুফলই পান না। রাজস্ব বিভাগও শুল্ককর ছাড়ের সুফল ভোক্তা পেল কি না, তার তদারকি করে না। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাজারদরে নৈরাজ্যের দায়ে তথ্য-প্রমাণসহ শক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে দাম সহনীয় হবে না।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, দুই বছর ধরে নানা কারণে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা অস্থির ছিল। তবে ক্রমেই তা সহনীয় হয়ে আসে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে দেশে যে হারে দাম বেড়েছে, তা সহনীয় তো নয়ই; বরং অব্যাহতভাবে বেড়েছে। শুধু যে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে তা-ই নয়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও সব ধরনের শাকসবজি, মাছ, মাংসের দামও বেড়েছে লাগামহীন। বলা যায়, রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন তাঁরা।

বাজারে ভোক্তারা যে দামে পণ্য কিনছেন, তার চেয়ে অনেক কমিয়ে মূল্যতালিকা প্রকাশ করে যাচ্ছে সরকারি সংস্থা টিসিবি। এ তালিকার প্রতি ভোক্তার আস্থা কম থাকলেও, ওই সংস্থাটির গতকালের মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেও জিনিসপত্রের দাম বাড়ার অস্থিরতার চিত্র পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, গত এক বছরে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৬৪ শতাংশের বেশি। চিনির বেড়েছে ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ, আটার বেড়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ডালের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির বেড়েছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ ছাড়া চাল, গরুর মাংস, ডিম, আলুসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। শুধু বাড়েইনি, বরং এই বাড়া ছিল চরম অসহনীয়।

সাধারণ ভোক্তাদের এ সময়ে আয় না বাড়লেও বাড়তি দাম দিয়ে নিত্যপণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে ধারকর্জ করে জীবন চালাচ্ছেন। অনেকে ক্ষুদ্র সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরকারের আগের মেয়াদে মানুষের কাছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার বিষয়টিই সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল। বর্তমান সরকার এ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই জিনিসপত্রের দাম সহনীয় করার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এক মাস ধরে সরকারের বাণিজ্য, কৃষি, অর্থ ও খাদ্য মন্ত্রণালয় গলদঘর্ম হয়ে পণ্যের দাম কমানোর বিষয়ে দফায় দফায় যৌথ সভা করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুরো ব্যাংকিং খাতে টাকার প্রবাহে লাগাম টেনেছে। সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে টাকা ব্যাংকে ঢোকানোর নীতি বাস্তবায়ন করছে। এতে অন্য সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও মূল্যস্ফীতি কতটা সহনীয় হবে, এ ব্যাপারে কমবেশি সবাই হতাশা প্রকাশ করেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী আসছে রমজান মাসে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুরের দাম সহনীয় রাখতে শুল্ককর কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশনা মেনে এসব পণ্যের শুল্ককর কমানো হচ্ছে।

অথচ বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সূচকে দেখা গেছে, গত জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন খাবারের গড় দাম অনেক কমেছে, যা গত ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম অনেক নিম্নমুখী হয়েছে। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে ফসলটির মাড়াই বেড়েছে। তাতে বিশ্ববাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আলোচ্য মাসে ভুট্টা ব্যাপক দর হারিয়েছে। গত জানুয়ারিতে সারা বিশ্বে মাংসের দাম আরও কমেছে। বিশ্বে পণ্যের বাম্পার ফলন হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে দাম কমাতে বিভিন্ন সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। সরকার কয়েকটি পণ্যের দাম ঠিক করে দিলেও তাঁরা তা মানছেন না। দেখা গেছে, চিনি, ডিম, ভোজ্যতেল, মাংসের দাম ঠিক করে দেওয়ার পরও তাঁরা তাঁদের ঠিক করা দামেই বিক্রি করে চলেছেন পণ্য। ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর বাজারে বাজারে গিয়ে কয়েকজনকে ধরে জরিমানা করার মধ্যেই সীমিত থাকছে। এতে সত্যিকার অর্থে বাজার সহনীয় হচ্ছে না।

রমজান শুরু হতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। সরকারের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাজার নিয়ন্ত্রণের ঘোষণার পরও বাজারে এর প্রভাব সামান্যই। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ভোক্তাদের সঙ্গে কথা হলে, তাঁরা বলেন, সরকারের গতানুগতিক পদক্ষেপ চলতে থাকলে বাজার সহনীয় হবে না। এখানে শুল্কছাড়ের বিষয়টির সুফল নিয়ে শুল্ক বিভাগকে নজরদারি করতে হবে। অতিমুনাফার কর দেয় কি না তা আয়কর বিভাগকে দেখতে হবে। কত টাকায় পণ্য এলসি খুলে, কত টাকা ঘোষণা দিয়ে পণ্য ছাড়িয়েছে, ওই পণ্য কত বিক্রি করেছে–কত মুনাফা করেছে ইত্যাদি দালিলিক তথ্য পর্যালোচনা করে ধরতে হবে। নাহলে বাজারে এর কার্যকর প্রভাব পড়বে না।

 অধ্যাপক-ড.-মিজানুল-হক-কাজলসংস্থাগুলোয় সমন্বয়ের অভাব: অধ্যাপক ড. মিজানুল হক কাজল
দাম কমাতে সরকারের সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে না। ফলে এর সুফল মিলছে না। শুল্কছাড়ের উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু এর সুফল ভোক্তা ঠিকমতো পায় না। যদি সুফল নাই পাবে, তাহলে এ সুবিধা কেন দিতে হবে? মূলত দেশে পণ্য উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য বিশ্লেষণ করে সরকারি সংস্থাকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেহেতু কোনোভাবেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে ধরা যাচ্ছে না, তাহলে বিকল্প হিসেবে টিসিবি আরও শক্তিশালী করা যায়।

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি

এ এইচ এম সফিকুজ্জামানঅভিযানের ফলে দাম কমছে: এ এইচ এম সফিকুজ্জামান
আমরা সাধ্যমতো আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। আমাদের অভিযানের ফলে ডিম, চাল, ভোজ্যতেল, আলুর দাম কিছুটা কমে এসেছে। মাংসের দামও কিছুটা কমেছে। দাম বাড়ার অনেক কারণ রয়েছে। এখানে আরও কিছু সংস্থা জড়িত রয়েছে। আমি আমার দিক থেকে যতটা করা দরকার করছি। দাম যে কমছে না, তা তো নয়। কমছে। দামটা যাতে যৌক্তিক থাকে সে ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত