Ajker Patrika

১৯৬৭ বনাম ২০২৫: যে যুক্তিতে পরমাণু বোমা বানিয়েছিল ইসরায়েল, একই পরিস্থিতিতে ইরানকেও ঠেলে দিচ্ছে তারা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৫, ১২: ৩৫
ইরানের একটি পরমাণু কেন্দ্র। বিপরীতে ইসরায়েলের ডিমোনো পরমাণু কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
ইরানের একটি পরমাণু কেন্দ্র। বিপরীতে ইসরায়েলের ডিমোনো পরমাণু কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

মাটির অনেক গভীরে চলছিল গোপন পরমাণু কর্মসূচি। আমেরিকার নজর এড়িয়ে, ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছিল পরমাণুর রহস্য। তৈরি হচ্ছিল পারমাণবিক বোমার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি। শত্রুরা এগিয়ে আসছিল, যুদ্ধের পদধ্বনি ক্রমেই জোরালো হচ্ছিল। এরপর, যুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে, তাড়াহুড়ো করে অন্তত একটি সাধারণ পারমাণবিক বোমা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। যদি জাতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের মুখে পড়ে, তাহলে হয়তো একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ হয়তো দেশকে বাঁচাতে পারবে।

এটাই ছিল ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের অবস্থা। ইতিহাসবিদেরা এখন মনে করেন, ওই বছরই ইহুদি রাষ্ট্রটি প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। কিন্তু তারা শেষ মুহূর্তে সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কারণ, ছয় দিনের যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত বিজয় তাদের সেই ‘প্রদর্শনীমূলক বিস্ফোরণ’ বা পরীক্ষামূলক বোমার প্রয়োজনীয়তাকে অকার্যকর করে দেয়।

বর্তমান ইরানের গল্পটা খুব একটা আলাদা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ১২ দিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইসরায়েল একে একে ইরানের মিত্রদের দুর্বল করে দিয়েছে। এই মিত্রদের মধ্যে আছে লেবাননের হিজবুল্লাহ থেকে শুরু করে, সিরিয়ার সামরিক বাহিনী (আসাদ সরকারের পতনের পর এই বাহিনী এখন আর ইসরায়েলের জন্য কোনো হুমকি নয়) ও হামাস।

এখন ইরান যদি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা পুনর্গঠনের চেষ্টা করে এবং ইসরায়েল যদি আরও সহিংসতার হুমকি দেয়, তাহলে তেহরানও সেই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হবে, যে প্রশ্নের মুখোমুখি ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলকে হতে হয়েছিল। দেশকে বাঁচানোর জন্য কি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে ছুটতে হবে, নাকি শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে রাখতে হবে?

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এবং ‘ইরানস গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ বইয়ের লেখক ভালি নাসর বলেন, ‘ইরান এখন দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এক গভীর অভ্যন্তরীণ বিতর্কের মধ্যে রয়েছে। এটা এখন বাঁচা-মরার মুহূর্ত এবং এটা সত্যিই অবাক করার মতো যে, ইসরায়েলই এখন ইরানকে সেই একই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে, যেটা তারা একসময় নিয়েছিল।’

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য বদলে দিয়েছিল। ইসরায়েল, তার চেয়ে আকারে বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর বিজয় অর্জন করে এবং পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে। এটি ইসরায়েলের চরিত্রকেও বদলে দেয়। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্পর্ক এক অদ্ভুত, অস্পষ্ট রূপ নেয়। দেশটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হলেও তারা কখনো তা ঘোষণা করেনি, আবার কখনো অস্বীকারও করেনি।

পশ্চিমাদের তরফ থেকে ইসরায়েলের এই গোপন অস্ত্রভান্ডার মেনে নেওয়াকে মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিচারিতা হিসেবে দেখা হয়। পশ্চিমারা তাদের মিত্র ইসরায়েলকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি লঙ্ঘনের অনুমতি দিয়েছে, অথচ ইরানকে বিভিন্ন শাস্তির আওতায় রেখেছে—যদিও ইরান অনেক ক্ষেত্রেই তাদের চুক্তির দায়িত্ব পালন করেছে।

কিন্তু ইসরায়েলের এই বিশেষ মর্যাদা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র হওয়ার কারণে নয়। এটি ছিল একটি ভিন্ন সময়ের ফসল, যখন ইসরায়েল ছিল তরুণ, দুর্বল; শত্রুরা ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী, যারা দেশটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা গোপন চুক্তি—যার ফলে ইসরায়েল তাদের পারমাণবিক অস্ত্র অঘোষিত রাখতে পেরেছিল—ছিল ইসরায়েলি নেতৃত্বের দূরদর্শিতার ফসল। তারা তখন তাদের দেশের দুর্বল অবস্থানকে এবং হলোকাস্টের তাজা স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে এমন এক ব্যতিক্রম সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল, যা আর কোনো দেশ পায়নি।

কিন্তু যদি এখন ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগিয়ে যায়, তাহলে বিশ্বের সামনে এক অসম্ভব সমীকরণ হাজির হবে—নতুন আরেকটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেশ পরমাণু ক্লাবে প্রবেশ করবে, যা অন্যদেরও একই পথে ঠেলে দিতে পারে, কিংবা তাদের উত্তর কোরিয়ার মতো শাস্তির মুখে পড়তে হবে।

তৃতীয় বিকল্প হলো, ইরান চাইলে পরমাণু অস্ত্রের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে, ঠিক যেমনটা ইসরায়েল একসময় নিয়েছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক ইতিহাসের অন্যতম শীর্ষ গবেষক আভনার কোহেন বলেন, ইরান আসলে বহু বছর ধরে ইসরায়েলের পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। তারা এমন একটি পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়েছে, যা আংশিক প্রকাশ্য, আংশিক গোপন। তারা ধীরে ধীরে ‘বোমার আরও কাছাকাছি’ চলে যাচ্ছে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা একান্ত জরুরি না হয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক কোহেন বলেন, ‘ইরান খুবই আগ্রহী ছিল আরেক ইসরায়েল হতে, ইসরায়েলের পথ অনুসরণ করতে।’ তিনি বলেন, কোনো সংকটকালে যেন পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা যায়, ইসরায়েল সে লক্ষ্যে নিজেদের ব্যাপক দক্ষতা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কখনো প্রকাশ্যে সেই পথে হাঁটেনি। আর এটাই অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিল ইরান।

তিনি বলেন, ‘ইরান চেয়েছিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা ইসরায়েলের অস্পষ্ট কৌশল অনুকরণ করছিল, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অনেক বেশি শত্রুতাপূর্ণ।’ তিনি ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের গোপন চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত, বিশ্ব ইসরায়েলের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল থেকেছে, আর ইরানের ক্ষেত্রে বরাবরই কঠোর।’

ইসরায়েল-ইরানের আঞ্চলিক দ্বন্দ্বকে সরাসরি সংঘাতে পরিণত হতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে চার দশক। এই সময়ে ইরানের নেতৃত্ব ‘জায়নবাদী রাষ্ট্র’ ধ্বংস করার শপথকে তাদের জাতীয় রাজনৈতিক বক্তব্যের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছে। ইসরায়েলের কাছে, ২১ শতকের শুরু থেকে ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, পারমাণবিক কর্মসূচি এবং সশস্ত্র মিত্রগোষ্ঠী ক্রমেই দেশটির জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে, ইরানের দৃষ্টিতে ইসরায়েলও দ্রুত অস্তিত্বের হুমকিতে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি নেতারা প্রকাশ্যে তেহরানের শাসনব্যবস্থা বদলে দেওয়ার কথা বলেছেন এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে ইরানের ভেতরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে।

ইসরায়েল তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি এমনভাবে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল, যা ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কাছ থেকেও আড়াল ছিল। অন্যদিকে, ইরান ধীরে ধীরে পারমাণবিক বোমার কারিগরি সক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যদিও তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার শপথ নিয়েছে। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ২০০০—এর দশকের শুরুর দিকে পারমাণবিক অস্ত্রকে ‘হারাম’ বলে ফতোয়া (ধর্মীয় নির্দেশ) দিয়েছিলেন।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর সময়ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা এবং জাতিসংঘ একমত ছিল যে, ইরান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি।

১৯৬৭ সালে আসন্ন সংঘাত ইসরায়েলের সব সন্দেহ দূর করে দেয়। ঐতিহাসিক দলিলপত্রে দেখা যায়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী লেভি ইশকোল তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে ‘একটি নির্দিষ্ট অস্ত্র’ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান (পরে প্রধানমন্ত্রী) আইজ্যাক রবিন ইসরায়েলের একমাত্র পারমাণবিক চুল্লি ডিমোনায় সম্ভাব্য শত্রু হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এর কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বা বৈধতা নেই।’

ইরানের ক্ষেত্রেও, গত বছর যখন ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছিল, তেহরানের নীতিনির্ধারকেরা অস্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করতে শুরু করেন যে, তারা তাদের পারমাণবিক নীতি পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইসরায়েল ও ইরানের প্রথম পাল্টাপাল্টি হামলার কয়েক মাস পর, আয়াতুল্লাহ খামেনির পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল খাররাজি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘আমরা পরমাণু অস্ত্র তৈরির পক্ষপাতী নই, তবে যদি ইরান অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে আমাদের অবশ্যই আমাদের নীতি পরিবর্তন করতে হবে।’

এর আগে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান আলী আকবর সালেহি বলেন, ইরানের বিস্তৃত পারমাণবিক গবেষণা কর্মসূচি তাদের বিপুল কারিগরি দক্ষতা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘একটি গাড়ির জন্য যা যা লাগে—চ্যাসিস, ইঞ্জিন, স্টিয়ারিং, গিয়ারবক্স—আমরা সবকিছুই তৈরি করেছি। আপনি জিজ্ঞাসা করছেন, আমরা গিয়ারবক্স বানিয়েছি কিনা, আমি বলছি হ্যাঁ। ইঞ্জিন বানিয়েছি? হ্যাঁ। তবে প্রত্যেকটি নিজ নিজ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।’

ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের ঠিক আগে, সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গবেষণা তাদের প্রাথমিক পারমাণবিক বিস্ফোরকের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং জ্বালানি দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তখনো পর্যন্ত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র তৈরির নির্দেশ দেয়নি।

ইরানের ক্ষেত্রেও, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন দেখা যায়—তারা ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত দ্বিগুণ করেছে, যা এখন প্রায় ৪০০ কেজি। এই ইউরেনিয়াম সহজেই অস্ত্র তৈরি মানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে ইরান তা দিয়ে কোনো উন্নত পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে না; বরং তা হবে খুবই সাধারণ, তবুও কার্যকর, প্রোটোটাইপ অস্ত্র—যেমনটি ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে তড়িঘড়ি তৈরি করেছিল। সেটিকেই ‘স্যামসন অপশন’ বলা হয়।

ইসরায়েলের পরমাণু কর্মসূচির পেছনে ছিল গবেষণা ও চতুরতা, যার মূল কেন্দ্র ছিল নেগেভ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র ডিমোনায়। সেখানে ১৯৫০-এর দশকের শেষদিকে ইসরায়েল গোপনে প্লুটোনিয়াম প্রক্রিয়াকরণের একটি ভূগর্ভস্থ স্থাপনা তৈরি করেছিল। সে সময় ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগে ইরান ছিল না। ইরানের তৎকালীন শাহ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির অধীনে একটি পারমাণবিক চুল্লি উপহার দিয়েছিল। এক বছর পর ইরান এনপিটি স্বাক্ষর করে।

এরপর, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর, শাহ ক্ষমতাচ্যুত হলে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা প্রাথমিক পর্যায়ে থেমে যায়। তখন বেশির ভাগ পারমাণবিক বিজ্ঞানী দেশ ছেড়ে চলে যান। একই সময়ে, ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা পুরোনো এক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে সাগরে দুটি আলোর ঝলকানি শনাক্ত করেন। কয়েক মাস পর, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, ‘আমাদের বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশ্বাস বাড়ছে যে, ইসরায়েল দক্ষিণ আফ্রিকার কাছাকাছি সাগরে পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে।’

প্রায় ওই সময়েই, ইসরায়েল একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, যা আজও অপরিবর্তিত আছে বলে জানান ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক গবেষণা পরিচালক উজি আরাদ। সেটা হলো—‘বেগিন নীতিমালা।’ এই নীতিমালার মূল কথা হলো—কোনো শত্রু দেশের পারমাণবিক কর্মসূচি যদি ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, তাহলে সব রকম পথ বেছে দেখার পর পর, সেগুলোতে বিমান হামলা চালানো হবে।

এই নীতির বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৮১ সালে। সে বছরই ইসরায়েল ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালায়। ২০০৭ সালে সিরিয়ায় গোপনে নির্মাণাধীন উত্তর কোরিয়া সরবরাহকৃত পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা করে ইসরায়েল। আর এখন, ২০২৫ সালে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ইরানের নাতানজ, ফোরদো এবং ইস্পাহানে বোমা ফেলেছে।

এই পরিস্থিতি ইরানের নিজস্ব পারমাণবিক অবস্থানও গড়ে তুলেছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঠানামা করেছে। আশির দশকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের পর, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করেছিল, যাতে ভবিষ্যতে আরেকটি যুদ্ধ এড়ানো যায়। কিন্তু প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সেই হুমকি কমে যায়।

পাকিস্তানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান ২০০৪ সালে স্বীকার করেন, তিনি ১৯৯০-এর দশকে ইরানকে পুরোনো মডেলের সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তি বিক্রি করেছিলেন। এটাকেই অনেকে ইরানের সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির সূচনা মনে করেন। ২০০৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পেতে আক্রমণ চালানোর পর, ইরান তাদের ‘আমাদ’ নামের গোপন কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং তা বন্ধ করে দেয়। জাতিসংঘ তখন জানায়, ওই কর্মসূচিতে তারা গবেষণা করলেও প্রকৃত অস্ত্র তৈরি করেনি।

ইরান ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল, এই কর্মসূচিই যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিলে আনতে পারে এবং নিষেধাজ্ঞা তোলার পথ তৈরি করতে পারে। ইরানের দাবি ছিল, তারা এনপিটি স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির বৈধ অধিকার ভোগ করছে। তারা আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের অনুমতি দিয়েছে, এমনকি আকস্মিক পরিদর্শনেরও সুযোগ দিয়েছে।

কিন্তু তারা নাতানজ ও ফোরদোর মতো সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রও তৈরি করেছে, যা পশ্চিমা গোয়েন্দারা ফাঁস করেছে। এসব স্থাপনাও সম্প্রতি ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে, ইরানের প্রচলিত সামরিক প্রতিরোধ শক্তিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চারপাশের ‘আগুনের বৃত্ত’ বলে পরিচিত ইরানের সশস্ত্র মিত্র বাহিনীগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে।

এ অবস্থায়, ইরান এখন একেবারে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কিনারায় দাঁড়িয়ে। ভালি নাসর বলেন, ‘ইরান এখনো লাভ-ক্ষতির হিসাব করছে। আর এখন হয়তো সেই অভ্যন্তরীণ বিতর্ক অনেকটাই সেদিকেই এগিয়েছে, যারা বলছে, বোমা বানানোর সময় হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তবে দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এখনো এমন একটি কূটনৈতিক সমঝোতার সুযোগ আছে, যা যথেষ্ট আকর্ষণীয় এবং শক্তিশালী হলে ইরানের এই পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে।’

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

ঋণখেলাপির তালিকায় নাম: রিট খারিজ, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না মান্না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

ঋণখেলাপির তালিকায় নাম: রিট খারিজ, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না মান্না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

ঋণখেলাপির তালিকায় নাম: রিট খারিজ, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না মান্না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

ঋণখেলাপির তালিকায় নাম: রিট খারিজ, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না মান্না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

ঋণখেলাপির তালিকায় নাম: রিট খারিজ, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না মান্না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত