Ajker Patrika

ফরেন অ্যাফেয়ার্সের নিবন্ধ /পারমাণবিক অস্ত্রধারী ইরানই হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার শর্ত

ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রচেষ্টা এবং দেশটির ইসলামি প্রশাসনকে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেভাবে ‘অতিরঞ্জিত’ করে তুলে ধরা হয়—তার বিরুদ্ধে অবস্থান প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেনেথ নি’ল ওয়াল্টজের। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যয়নে তিনি অন্যতম খ্যাতনামা গবেষক। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ‘নিওরিয়ালিজমের’ জনক হিসেবে পরিচিত কেনেথ ওয়াল্টজ মারা যান ২০১৩ সালে। মৃত্যুর আগের বছর ২০১২ সালে তাঁর একটি নিবন্ধ ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের এই প্রেক্ষাপটে তাঁর পর্যবেক্ষণটি খুবই প্রাসঙ্গিক। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

কেনেথ এন. ওয়াল্টজ
নাতানজ পরমাণু স্থাপনার স্যাটেলাইট চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
নাতানজ পরমাণু স্থাপনার স্যাটেলাইট চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ইরান আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। এরপরও গোটা বিষয়টি নিয়ে একটি উৎকট সংকটের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে।

কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে এই সংকটের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে উল্টো—সেটিই হয়তো হবে সবচেয়ে ভালো পরিণতি, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে চলমান সংকট তিনটি পথে শেষ হতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত চাপে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এটি খুব একটা সম্ভাবনাময় দিক নয়। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে তাকে ফেরানো খুবই কঠিন।

কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানো যায় না। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন—অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও তারা পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। যদি তেহরান মনে করে, তাদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র জরুরি, তবে নিষেধাজ্ঞা তাদের মত বদলাবে না। বরং, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইরান নিজেকে আরও অনিরাপদ মনে করতে পারে এবং এই আতঙ্ক থেকেই তারা ‘চূড়ান্ত প্রতিরোধের’ পথ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা না করে একটি ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন করবে। অর্থাৎ, তারা চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করতে পারে—এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আর যদি, ইরান সেটি না করে, তবে তারাই প্রথম কোনো দেশ হবে না, যারা ব্যাপক পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তুলেও সরাসরি বোমা তৈরি করবে না। জাপানের কথাই ধরুন, তাদের বিস্তৃত বেসামরিক পরমাণু অবকাঠামো আছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, তারা চাইলে খুব অল্প সময়েই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা এখনো সেই পথে যায়নি।

ইরানের বর্তমান শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ বা চাইলেই দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছানো একটি কৌশল হতে পারে। এতে করে তাঁরা ‘কট্টরপন্থীদের’ আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, তারা বোমা থাকার নিরাপত্তাসহ নানা সুবিধা পাবে, আবার এই সুবিধা ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বা নিন্দার ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এই কৌশল সব সময় পরিকল্পনামতো কাজ নাও করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রধান উদ্বেগ হলো—অস্ত্রায়ন বা অস্ত্র তৈরির পর্যায়। তাই, যদি ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা হয়তো এই পরিস্থিতিকে মেনে নেবে। কিন্তু ইসরায়েল অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাও অগ্রহণযোগ্য হুমকি। ফলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যে, যেখানে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার দিলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে না। ‘ভার্চুয়াল পারমাণবিক অস্ত্র’ ইসরায়েলকে অতটা ভীত করবে না, যতটা আসল অস্ত্র করবে। সে কারণে তারা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নস্যাৎ করতে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্ত হামলা, নাশকতা কিংবা বিজ্ঞানীদের হত্যা চালিয়ে যেতে থাকবে, যা ইরানকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, শুধু ব্রেকআউট সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে অস্ত্রায়নই একমাত্র পথ।

তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান তার বর্তমান পথেই এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে এবং নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এ ধরনের পরিণতি তাঁদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের ভাষায়, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান হবে ভয়াবহ, অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যখনই দেখে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, তখনই এ ধরনের ভাষা পরাশক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতবারই কোনো দেশ সফলভাবে পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, বাকি সদস্যরা শেষ পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছে। বরং সামরিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়ায় নতুন পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্য বিরাজ করছে, সেটিই মূলত এই অঞ্চলের অস্থিরতার বড় উৎস। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন কোনো একক ও অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র নেই। বর্তমান সংকটের জন্য ইরানের পরমাণু আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডারই বেশি দায়ী। কারণ, ক্ষমতা থাকলে কেউ না কেউ সেটি প্রতিরোধ করতে চাইবেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এত দিনে কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই মাঠে নেমেছে।

অবশ্য, এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন ইসরায়েল এই অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় এবং কেন তারা সেই অবস্থান রক্ষায় প্রয়োজনে বলপ্রয়োগেও প্রস্তুত। ইরাক পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কায় ১৯৮১ সালে ইসরায়েল দেশটির ওসিরাক পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছিল। ২০০৭ সালে একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল সিরিয়ায়। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তেমন একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করছে তারা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদে ইসরায়েলকে পারমাণবিক আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করলেও এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি অসম সামরিক ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখলেও সেটি শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।

ইসরায়েল তার সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাতে পারে—এই প্রমাণিত বাস্তবতা ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের এমন এক মানসিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরাই এমন প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের হাতে আরেকটি আকস্মিক হামলার শিকার হতে না হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আসলে কোনো নতুন সংকটের সূচনা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক টানাপোড়েনের শেষ অধ্যায়—যার অবসান ঘটবে কেবল তখনই, যখন এই অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।

ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে—এই আশঙ্কা অনেক বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো—এই বিতর্ক নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যেভাবে আচরণ করে, সে সম্পর্কে মৌলিক ভুল ধারণা। সবচেয়ে প্রচলিত এবং গভীর উদ্বেগগুলোর একটি হলো—ইরানি শাসকগোষ্ঠী নাকি ‘স্বভাবগতভাবে অযৌক্তিক বা উন্মাদ’! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ইরানি নীতিনির্ধারকেরা ‘পাগল মৌলবাদী’ নয়, বরং সম্পূর্ণ সচেতন এবং বাস্তববাদী আয়াতুল্লাহরা নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের নেতার মতোই চিন্তিত।

তাঁরা উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা যদি ধরে নেন যে, ইরানের নেতারা আত্মবিনাশের দিকে এগোচ্ছে, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ একটি ভুল হিসাব। তবুও, মার্কিন ও ইসরায়েলি অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তা ইরানকে ‘বিচারবুদ্ধিহীন’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তারা এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য নাকি ইরানের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। তাঁদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র পায়, তাহলে তাঁরা দ্বিধা না করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালাবে। এমনকি, যদি তাতে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলার শিকার হয় এবং নিজেও ধ্বংস হয়ে যায় এরপরও নাকি তারা হামলা চালাবে!

ইরানের আসল অভিপ্রায় নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র চায়ও, তাহলে সেটি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়। ইরান হয়তো আলোচনায় অনমনীয় এবং নিষেধাজ্ঞার মুখে জেদি আচরণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর ইরান প্রচুর হুমকি দিলেও, শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি। কারণ, তারা জানে—এমন পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক এবং ধ্বংসাত্মক জবাব আসত। এর মানে হচ্ছে, ইরানি নেতৃত্ব কথায় যতটা আগ্রাসী, কাজে ঠিক ততটাই হিসাবি।

তবুও, অনেক পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারক—যাঁরা মনে করেন ইরানি সরকার যুক্তিসংগতভাবে কাজ করে—আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তেহরানের হাতে একটি পরমাণু অস্ত্র চলে আসবে, যা তাকে আরও আগ্রাসী আচরণ করতে এবং সন্ত্রাসবাদে সহায়তা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক তো এমনটাও আশঙ্কা করেন যে, ইরান সরাসরি সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেবে!

তবে এসব আশঙ্কার একটা বড় সমস্যা হলো—এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তাদের আচরণে এসব আশঙ্কার প্রমাণ মেলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন তারা নিজেরাই আরও সতর্ক হয়ে পড়ে। কারণ তারা বুঝে যায়, এখন তারা বড় শক্তিধর দেশগুলোর নজরে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর মাওবাদী চীন অনেক কম উগ্র হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভারত ও পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে আসছে। ফলে ইরান এই ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম।

আর সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার যে আশঙ্কা, সেটিও বাস্তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও দুরূহ। কোনো দেশ চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র স্থানান্তর করতে পারবে না, কারণ তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতা এবং পারমাণবিক উপাদানের উৎস শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে, কোনো গোপন হস্তান্তর নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া, যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কোনো রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের আচরণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বাভাস দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, কোনো রাষ্ট্র যখন একবার পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তখন তার পক্ষে সেই অস্ত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়ার মতো বোকামি করার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এটি বানানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ—যা এমন কোনো পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া বোকামি হবে, যাদের বিশ্বাস করা যায় না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

আরেকটি বহুল চর্চিত আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেলে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একে একে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে হাঁটবে এবং এতে পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক যুগ প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। ‘প্রোলিফারেশন’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো—দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। এমন কিছু এখনো পর্যন্ত হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের পর থেকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের আবির্ভাবের হার অনেক কমে গেছে।

এই ধারা এখন হঠাৎ করে পাল্টে যাবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। ইরান যদি ১৯৪৫ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়, সেটি মোটেও ভয়াবহ ধারাবাহিকতার সূচনা হবে না। ইসরায়েল ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তখন তারা আশপাশের বহু দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আরব বিশ্বের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল, যা ইরানের বর্তমান কর্মসূচির চেয়ে বহুগুণ ভয়ানক। যদি সেই সময় একটি পারমাণবিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু না করতে পারে, তবে এখন একটি পারমাণবিক ইরান তার করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।

১৯৯১ সালে ঐতিহাসিক বৈরী ভারত ও পাকিস্তান একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা একে অপরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার অঙ্গীকার করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রতিপক্ষের পারমাণবিক সক্ষমতা যতটা ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে উদ্ভূত অস্থিরতা।

তখন থেকে, চরম উত্তেজনা ও ঝুঁকিপূর্ণ উসকানির মুখেও এই দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ইসরায়েল ও ইরান এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে প্রতিহত করবে, যেভাবে সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে প্রতিহত করে এসেছে। ইতিহাসে কখনো দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দোরগোড়া পেরিয়ে যায়, তাহলে সেই পারমাণবিক প্রতিরোধ কাজ করবে, এমনকি ইরানের অস্ত্রাগার ছোট হলেও। তখন আর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের তাগিদ থাকবে না, এবং চলমান সংকটও প্রশমিত হবে। ফলাফল হিসেবে, আজকের তুলনায় সেই মধ্যপ্রাচ্য আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।

এই কারণেই, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। ইরান ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ চলতে থাকা উচিত, কারণ খোলামেলা যোগাযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ করে তুলবে। তবে ইরানের ওপর আরোপিত বর্তমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত—এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ ইরানিদের কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করছে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আরব বিশ্ব, ইউরোপ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ নাগরিকদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত—ইতিহাস দেখিয়েছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে স্থিতিশীলতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায়, অতীতের মতো এখনো সত্য—অস্ত্র বেশি মানেই বেশি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা!

অনুবাদক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪২
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের সঙ্গে নতুন করে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক তৎপরতা। দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির এক গোপন বৈঠকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেছেন।

হিব্রু ভাষার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভের খবরে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে এক সামরিক প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের জানান, তেহরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের আশঙ্কা, আগের মতোই ইরান একযোগে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।

গত এক মাসে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা নিয়ে সতর্কবার্তা জোরালো হয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ও কিছু বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় পক্ষ দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, পরোক্ষ বা প্রক্সি ফ্রন্ট বিস্তৃত করছে এবং কূটনৈতিক পথ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বর্তমান উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) মেয়াদ শেষ হওয়া। চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। ফলে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তেহরানের দাবি অনুযায়ী তারা উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সব মজুত ধ্বংস করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, এর একটি অংশ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে—তাদের মতে, ইরানে ইসরায়েলের আরেকটি হামলা ‘হবে কি না’ এটা প্রশ্ন নয়, হামলা ‘কবে হবে’—সেটাই বড় প্রশ্ন। ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তেল আবিবের এই মনোভাব সামরিক হামলার সম্ভাবনাকে প্রায় অনিবার্য করে তুলছে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক সংকট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ জানান, তাঁর ইরানি সূত্র অনুযায়ী দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো দিনে ২৪ ঘণ্টাই চালু আছে। তাঁর ভাষায়, নতুন কোনো সংঘাত হলে ইরান আগের মতো ১২ দিনে ৫০০টি নয়, বরং একযোগে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত থাকায় সংঘাতের একটি চক্রাকার ধারা তৈরি হয়েছে, যেখানে উত্তেজনা প্রায় কাঠামোগতভাবেই অনিবার্য। ইরানের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ (যার মধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক মিত্র ও গোষ্ঠী রয়েছে) গত জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে এবং বিশেষ করে গত বছর সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবু ইরানের হাতে এখনো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক রসদ রয়েছে। যেমন—ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ (হুতি), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া। এসব শক্তির মাধ্যমে তেহরান এখনো এক ধরনের অপ্রতিসম প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রেখেছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কার্সরইনফোর বরাতে জানা যায়, দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার এক শীর্ষ সূত্রের দাবি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারির আগে ইরানে শাসক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেছে ইসরায়েল। সূত্রটি জানায়, ইরান একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরেকটি সামরিক সংঘাত এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরান নাতানজের দক্ষিণে ‘পিকঅ্যাক্স মাউন্টেন’ নামে একটি নতুন ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ করছে। সেখানে এখনো আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান শান্তি ও সংলাপ চায়, তবে চাপের কাছে মাথা নত করবে না, পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিও পরিত্যাগ করবে না। তাঁর মতে, এসব কর্মসূচি জাতীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি বহুপক্ষীয় আলোচনায় ফেরার আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছেন—‘ইরানের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে’।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও তাতে জড়াবে?

গেল নভেম্বরের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেন, জুনে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত ছিল। বিষয়টি এত দিন হোয়াইট হাউস অস্বীকার করে আসছিল। ওই সময় ট্রাম্প আরও বলেন, ওয়াশিংটন চাইলে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতেও প্রস্তুত।

ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে ট্রাম্প আবার বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি চায় এবং ওয়াশিংটন আলোচনায় প্রস্তুত। একই দিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা কামাল খারাজি জানান, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইরান, তবে প্রথম পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকেই নিতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আলোচনার বাইরে, কারণ এটি জাতীয় প্রতিরোধের মূল স্তম্ভ। কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েই সীমিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে, তাও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হলে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপে আরেকটি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিস্থিতিকে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখছে। ইসরায়েল চাচ্ছে, তারা এই সুযোগে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেবে।

সব মিলিয়ে, তেহরান আশাবাদী কথাবার্তায় ভরসা করছে না। ইরানি কূটনীতিকদের ধারণা, ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করেই সামরিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, ইসরায়েল হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে যেকোনোভাবে সংঘাতে টেনে আনার চেষ্টা করবে—যদিও ট্রাম্প নতুন যুদ্ধ এড়াতে চান।

যুক্তরাষ্ট্র চাক বা না চাক, পরিস্থিতির চাপে তাকে শেষ পর্যন্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে। আর যদি ইরান ইসরায়েলি হামলার জবাবে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ওয়াশিংটনের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত এসে দাঁড়াবে—হস্তক্ষেপ করবে, নাকি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ইরান অবশ্য স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—তারা ধ্বংসের ভয় পায় না এবং সর্বাত্মক যুদ্ধে নামলে ‘ইসরায়েলকেও সঙ্গে নিয়ে ডুববে’।

আরটি থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত