Ajker Patrika

ভেঙে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক এক মেরু বিশ্ব, বহু মেরু নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ–অনিশ্চয়তা

আব্দুর রহমান 
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৫, ১১: ২৯
যুক্তরাষ্ট্রের নিজের নেওয়া উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত দেশটির প্রভাব কমার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবি: গ্লোবাল টাইমসের সৌজন্যে
যুক্তরাষ্ট্রের নিজের নেওয়া উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত দেশটির প্রভাব কমার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবি: গ্লোবাল টাইমসের সৌজন্যে

যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরমহল তো বটেই, বিশ্বজুড়েই এক উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক তথাকথিত এক মেরু আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে আসছে এবং বিশ্ব বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। আবার, অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ। তবে চলতি বছরের মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব এক মেরু ব্যবস্থা থেকে বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং একই সঙ্গে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার এক নতুন যুগেও প্রবেশ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব কমে আসছে বলে দেশটিতে উদ্বেগের সূত্রপাত হয় বারাক ওবামা প্রশাসনের শুরুর দিকে। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার বাস্তব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে, এই উদ্বেগ ওবামার পরে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বশেষ বাইডেন প্রশাসন পর্যন্ত বহাল ছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবারও মহান করে’ তুলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের মাধ্যমে এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে।

২০২৫ সালের মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র–চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্ব একটি বিস্তৃত বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে কি না—তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ‘বহু মেরুকরণ’ প্রক্রিয়া ক্রমশ গতি পাচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় এক মেরুকরণ, দ্বিমেরুকরণ, বহু মেরুকরণ এবং এমনকি অ-মেরুকরণেরও উপাদান রয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে আরও বেশিসংখ্যক রাষ্ট্রের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা একটি স্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত।’ এতে আরও বলা হয়, ‘স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এক মেরু বিশ্ব গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদ এখন আর একমাত্র প্রভাবশালী শক্তি নয়। এটি অভ্যন্তরীণভাবে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অনেক উদার গণতন্ত্রে জাতীয়তাবাদী জনতুষ্টির রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। এ ছাড়া, এটি বাহ্যিকভাবেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং এই বিষয়টি ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ তথা জলে–স্থলে–অন্তরিক্ষে আমেরিকার একক প্রভাবের সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রাম্প বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে অনুকূল বলে মনে করেন না এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। এই বিষয়টি মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুকরণ থেকে বহু মেরুকরণের দিকে বিশ্বের এই পরিবর্তন নিয়ে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিক এবং গ্লোবাল সাউথের (তৃতীয় বিশ্ব) উদীয়মান শক্তিগুলোর নাগরিকদের মধ্যে ধারণা ব্যাপকভাবে আলাদা। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের এক জরিপে দেখা গেছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭–এর বেশির ভাগ মানুষ এই পরিবর্তনকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই পরিবর্তন বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং বৈশ্বিক চুক্তি সম্পাদনকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। জরিপ অনুসারে, এসব দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, বহু মেরু ব্যবস্থা বিশ্বে শান্তি আনবে না।

অন্যদিকে, ব্রিকস (পশ্চিমের বাইরে বিকল্প অর্থনৈতিক জোট) দেশগুলোর বেশির ভাগ অংশীজন বহু মেরুকরণকে একটি ন্যায্য, সুবিচার ও শান্তিপূর্ণ বিশ্বের পথ হিসেবে দেখেন। জরিপে দেখা গেছে, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের বেশির ভাগ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, বহু মেরু বিশ্ব ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগগুলোকে আরও ভালোভাবে আমলে নেবে এবং সমাধানের পথ বের করবে।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ফিয়োনা হিলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যে ধারণা প্রবল হচ্ছে, তা বৈশ্বিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহের জন্ম দিচ্ছে। তাঁর মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংহতির আহ্বানের প্রতি যে প্রতিরোধ তা মূলত ‘বৈশ্বিক বয়ান তৈরিতে সম্মিলিত পশ্চিমা কর্তৃত্ব এবং তাদের নিজেদের সমস্যা অন্য সবার ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে’ এটি বিদ্রোহের ইঙ্গিত।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেনেট পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরো ইউরেশিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকার উত্তর ও পশ্চিম অংশজুড়ে বিস্তৃত দেশগুলো ক্রমশ চীন–রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও আলোচনার প্রচলিত কাঠামো ভেঙে পড়ছে। পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ পেরিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বিশ্ব একটি বিভাজিত বাস্তবতায় প্রবেশ করছে। হিলের ভাষ্য অনুযায়ীও, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ‘প্যাক্স আমেরিকানার’ সমাপ্তি এবং এক নতুন বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার যুগের সূচনার ইঙ্গিত বহন করছে।

ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস পরিচালিত এক সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্ব ও অন্যান্য অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ এখন মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটছে। ইউক্রেন যুদ্ধ যদিও গ্লোবাল নর্থ বা বৈশ্বিক উত্তরের (উন্নত দেশ) দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন সংহত করেছে, তবে বৈশ্বিক দক্ষিণে (গ্লোবাল সাউথ) এটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার আরও অবক্ষয় ঘটিয়েছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে চীন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষের বসবাস উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দেশে। এসব দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ চীনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং ৮৭ শতাংশ রাশিয়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রাখে। কিন্তু বিশ্বের বাকি ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টো।

গ্লোবাল সাউথে ৭০ শতাংশ মানুষ চীনকে এবং ৬৬ শতাংশ মানুষ রাশিয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। একই সঙ্গে, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত ব্রিকস জোটের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এই উত্তর–দক্ষিণ বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করছে এবং বহু মেরু বিশ্বব্যবস্থার পথ প্রশস্ত করছে।

চীন ইতিমধ্যে প্রায় প্রতিটি গ্লোবাল সাউথ দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার, যা তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দাবি প্রত্যাখ্যান করার আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে। কারণ, এসব দেশের নেতারা বিশ্বাস করেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করার সামর্থ্য রাখেন। আবার চীনকে ছাড়াই ভারত একা মার্কিন চাপ প্রতিহত করার নজির দেখিয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে রাশিয়া ও চীন উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছে ভারত।

চীন নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে ভূরাজনৈতিক প্রভাবের কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং ব্রিকস জোটের প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। তবে চীন এককভাবে এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে না। বিশ্বের ৪১ শতাংশ জনসংখ্যা এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্বকারী ব্রিকস এখনো প্রসারিত হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ‘শোষণের’ রেকর্ড আছে, যার মধ্যে রয়েছে—তথ্য যুদ্ধ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং শর্তযুক্ত ঋণ। এসব দেশের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গভীর ক্ষোভ পোষণ করে। তারা দেখেছে, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রিয় মাতৃভূমির সঙ্গে ভয়ানক আচরণ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েলের গাজায় আগ্রাসন, গাজা নিয়ে ট্রাম্পের উদ্ধত পরিকল্পনা—এসবই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সেই অতীত রেকর্ডেরই ধারাবাহিকতা।

ইউক্রেন যুদ্ধ যে বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে বৈশ্বিক দক্ষিণের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধটি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের আলোকে দেখা হয়। হিলের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অহংকার ও ভণ্ডামির কথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিল এবং এত দিন ধরে পরিচালনা করেছে, তার প্রতি আস্থা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।’ মধ্যপ্রাচ্যে দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সামরিক হস্তক্ষেপের পর, যুক্তরাষ্ট্র তার নৈতিক অবস্থান অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ, গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের নগ্ন সমর্থনে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ।

এই পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিক হলো, বৈশ্বিক গণমাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব আর একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের’ লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা গ্লোবাল সাউথে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। চীন, ভারত, তুরস্ক ও রাশিয়ায় অধিকাংশ মানুষ এখন মনে করে—পশ্চিমা বিশ্ব কেবল আরেকটি ভূরাজনৈতিক মেরুরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

এর পাশাপাশি, সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের পুনর্মিলন একটি ক্রমেই আকার পেতে থাকা এশীয় ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক পরাগ খান্নার মতে, এশিয়া নিজেকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করছে এবং সেই বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় পুনরুদ্ধার করছে, যা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা ও আমেরিকান আধিপত্যের আগে প্রচলিত ছিল।

মস্কোভিত্তিক আমেরিকান রাজনীতি বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু করিবকো বলেন, ‘গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র আটলান্টিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিকের দিকে সরে যাচ্ছে। এটি সরাসরি দুই জায়ান্টের (চীন ও ভারত) উত্থানের কারণে, বিশেষ করে চীনের। দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বিনিয়োগ গ্লোবাল সাউথের বাকি অংশকেও উত্থানে সাহায্য করেছে। অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব হাত ধরাধরি করে চলে এবং ব্রিকস দেশগুলো বিশ্ব ব্যবস্থার সংস্কার চায়।’

যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে, বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশির ভাগ দেশ চীনকে সরাসরি সামরিক বা নিরাপত্তাগত হুমকি হিসেবে দেখে না। বরং চীন এখন তাদের জন্য অন্যতম প্রধান প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্যিক অংশীদার।

গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো মনে করে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক মেরু ব্যবস্থা কেবল ‘পরাক্রমশালী’ দেশটিরই স্বার্থ উদ্ধার করে। এই ধরনের ব্যবস্থা স্বৈরাচারী। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণাত্মকভাবে তার তথাকথিত ‘নিয়ম’ অন্য সবার ওপর চাপিয়ে দেয়। করিবকো বলেন, ‘এটি অসম। কারণ, পশ্চিমের অর্থনৈতিক উত্থান সম্পূর্ণরূপে গ্লোবাল সাউথের শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে। এটি অন্যায্য। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বিচারে লঙ্ঘন করে। সে অনুযায়ী, ব্রিকস দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও গণতান্ত্রিক, ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়সংগত করার লক্ষ্যে সংস্কার ত্বরান্বিত করছে।’

এটি স্পষ্ট যে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থার কাঠামো আর এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন থাকবে না। দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা নেতৃত্ব ছাড়াই একটি বহু মেরু বিশ্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হতে চলেছে।

গ্লোবাল নর্থ তথা বৈশ্বিক উত্তরের দেশগুলো রাশিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অথচ গ্লোবাল সাউথ ক্রমশ ব্রিকস কেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সম্ভাবনার দিকে ঝুঁকছে। পুরোনো ও নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যকার এই সংস্থানিক ব্যবধান পূরণ করা বিশ্বব্যাপী সংকট এড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ব্রিকসের এই লক্ষ্য সফল হলে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো উপকৃত হবে। তবে প্রত্যাশা সংযত করা উচিত। কারণ, তারা যে পরিবর্তন কল্পনা করছে, তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের বিষয়টি অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ।

তথ্যসূত্র: গ্লোবাল টাইমস, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল গভর্ন্যান্স ইনোভেশন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪২
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের সঙ্গে নতুন করে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক তৎপরতা। দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির এক গোপন বৈঠকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেছেন।

হিব্রু ভাষার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভের খবরে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে এক সামরিক প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের জানান, তেহরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের আশঙ্কা, আগের মতোই ইরান একযোগে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।

গত এক মাসে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা নিয়ে সতর্কবার্তা জোরালো হয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ও কিছু বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় পক্ষ দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, পরোক্ষ বা প্রক্সি ফ্রন্ট বিস্তৃত করছে এবং কূটনৈতিক পথ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বর্তমান উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) মেয়াদ শেষ হওয়া। চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। ফলে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তেহরানের দাবি অনুযায়ী তারা উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সব মজুত ধ্বংস করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, এর একটি অংশ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে—তাদের মতে, ইরানে ইসরায়েলের আরেকটি হামলা ‘হবে কি না’ এটা প্রশ্ন নয়, হামলা ‘কবে হবে’—সেটাই বড় প্রশ্ন। ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তেল আবিবের এই মনোভাব সামরিক হামলার সম্ভাবনাকে প্রায় অনিবার্য করে তুলছে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক সংকট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ জানান, তাঁর ইরানি সূত্র অনুযায়ী দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো দিনে ২৪ ঘণ্টাই চালু আছে। তাঁর ভাষায়, নতুন কোনো সংঘাত হলে ইরান আগের মতো ১২ দিনে ৫০০টি নয়, বরং একযোগে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত থাকায় সংঘাতের একটি চক্রাকার ধারা তৈরি হয়েছে, যেখানে উত্তেজনা প্রায় কাঠামোগতভাবেই অনিবার্য। ইরানের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ (যার মধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক মিত্র ও গোষ্ঠী রয়েছে) গত জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে এবং বিশেষ করে গত বছর সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবু ইরানের হাতে এখনো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক রসদ রয়েছে। যেমন—ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ (হুতি), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া। এসব শক্তির মাধ্যমে তেহরান এখনো এক ধরনের অপ্রতিসম প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রেখেছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কার্সরইনফোর বরাতে জানা যায়, দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার এক শীর্ষ সূত্রের দাবি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারির আগে ইরানে শাসক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেছে ইসরায়েল। সূত্রটি জানায়, ইরান একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরেকটি সামরিক সংঘাত এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরান নাতানজের দক্ষিণে ‘পিকঅ্যাক্স মাউন্টেন’ নামে একটি নতুন ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ করছে। সেখানে এখনো আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান শান্তি ও সংলাপ চায়, তবে চাপের কাছে মাথা নত করবে না, পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিও পরিত্যাগ করবে না। তাঁর মতে, এসব কর্মসূচি জাতীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি বহুপক্ষীয় আলোচনায় ফেরার আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছেন—‘ইরানের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে’।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও তাতে জড়াবে?

গেল নভেম্বরের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেন, জুনে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত ছিল। বিষয়টি এত দিন হোয়াইট হাউস অস্বীকার করে আসছিল। ওই সময় ট্রাম্প আরও বলেন, ওয়াশিংটন চাইলে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতেও প্রস্তুত।

ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে ট্রাম্প আবার বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি চায় এবং ওয়াশিংটন আলোচনায় প্রস্তুত। একই দিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা কামাল খারাজি জানান, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইরান, তবে প্রথম পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকেই নিতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আলোচনার বাইরে, কারণ এটি জাতীয় প্রতিরোধের মূল স্তম্ভ। কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েই সীমিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে, তাও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হলে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপে আরেকটি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিস্থিতিকে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখছে। ইসরায়েল চাচ্ছে, তারা এই সুযোগে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেবে।

সব মিলিয়ে, তেহরান আশাবাদী কথাবার্তায় ভরসা করছে না। ইরানি কূটনীতিকদের ধারণা, ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করেই সামরিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, ইসরায়েল হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে যেকোনোভাবে সংঘাতে টেনে আনার চেষ্টা করবে—যদিও ট্রাম্প নতুন যুদ্ধ এড়াতে চান।

যুক্তরাষ্ট্র চাক বা না চাক, পরিস্থিতির চাপে তাকে শেষ পর্যন্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে। আর যদি ইরান ইসরায়েলি হামলার জবাবে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ওয়াশিংটনের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত এসে দাঁড়াবে—হস্তক্ষেপ করবে, নাকি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ইরান অবশ্য স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—তারা ধ্বংসের ভয় পায় না এবং সর্বাত্মক যুদ্ধে নামলে ‘ইসরায়েলকেও সঙ্গে নিয়ে ডুববে’।

আরটি থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত