আব্দুর রহমান
যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরমহল তো বটেই, বিশ্বজুড়েই এক উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক তথাকথিত এক মেরু আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে আসছে এবং বিশ্ব বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। আবার, অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ। তবে চলতি বছরের মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব এক মেরু ব্যবস্থা থেকে বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং একই সঙ্গে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার এক নতুন যুগেও প্রবেশ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব কমে আসছে বলে দেশটিতে উদ্বেগের সূত্রপাত হয় বারাক ওবামা প্রশাসনের শুরুর দিকে। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার বাস্তব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে, এই উদ্বেগ ওবামার পরে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বশেষ বাইডেন প্রশাসন পর্যন্ত বহাল ছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবারও মহান করে’ তুলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের মাধ্যমে এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে।
২০২৫ সালের মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র–চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্ব একটি বিস্তৃত বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে কি না—তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ‘বহু মেরুকরণ’ প্রক্রিয়া ক্রমশ গতি পাচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় এক মেরুকরণ, দ্বিমেরুকরণ, বহু মেরুকরণ এবং এমনকি অ-মেরুকরণেরও উপাদান রয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে আরও বেশিসংখ্যক রাষ্ট্রের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা একটি স্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত।’ এতে আরও বলা হয়, ‘স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এক মেরু বিশ্ব গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদ এখন আর একমাত্র প্রভাবশালী শক্তি নয়। এটি অভ্যন্তরীণভাবে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অনেক উদার গণতন্ত্রে জাতীয়তাবাদী জনতুষ্টির রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। এ ছাড়া, এটি বাহ্যিকভাবেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং এই বিষয়টি ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ তথা জলে–স্থলে–অন্তরিক্ষে আমেরিকার একক প্রভাবের সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রাম্প বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে অনুকূল বলে মনে করেন না এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। এই বিষয়টি মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুকরণ থেকে বহু মেরুকরণের দিকে বিশ্বের এই পরিবর্তন নিয়ে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিক এবং গ্লোবাল সাউথের (তৃতীয় বিশ্ব) উদীয়মান শক্তিগুলোর নাগরিকদের মধ্যে ধারণা ব্যাপকভাবে আলাদা। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের এক জরিপে দেখা গেছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭–এর বেশির ভাগ মানুষ এই পরিবর্তনকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই পরিবর্তন বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং বৈশ্বিক চুক্তি সম্পাদনকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। জরিপ অনুসারে, এসব দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, বহু মেরু ব্যবস্থা বিশ্বে শান্তি আনবে না।
অন্যদিকে, ব্রিকস (পশ্চিমের বাইরে বিকল্প অর্থনৈতিক জোট) দেশগুলোর বেশির ভাগ অংশীজন বহু মেরুকরণকে একটি ন্যায্য, সুবিচার ও শান্তিপূর্ণ বিশ্বের পথ হিসেবে দেখেন। জরিপে দেখা গেছে, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের বেশির ভাগ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, বহু মেরু বিশ্ব ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগগুলোকে আরও ভালোভাবে আমলে নেবে এবং সমাধানের পথ বের করবে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ফিয়োনা হিলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যে ধারণা প্রবল হচ্ছে, তা বৈশ্বিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহের জন্ম দিচ্ছে। তাঁর মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংহতির আহ্বানের প্রতি যে প্রতিরোধ তা মূলত ‘বৈশ্বিক বয়ান তৈরিতে সম্মিলিত পশ্চিমা কর্তৃত্ব এবং তাদের নিজেদের সমস্যা অন্য সবার ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে’ এটি বিদ্রোহের ইঙ্গিত।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেনেট পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরো ইউরেশিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকার উত্তর ও পশ্চিম অংশজুড়ে বিস্তৃত দেশগুলো ক্রমশ চীন–রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও আলোচনার প্রচলিত কাঠামো ভেঙে পড়ছে। পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ পেরিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বিশ্ব একটি বিভাজিত বাস্তবতায় প্রবেশ করছে। হিলের ভাষ্য অনুযায়ীও, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ‘প্যাক্স আমেরিকানার’ সমাপ্তি এবং এক নতুন বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার যুগের সূচনার ইঙ্গিত বহন করছে।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস পরিচালিত এক সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্ব ও অন্যান্য অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ এখন মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটছে। ইউক্রেন যুদ্ধ যদিও গ্লোবাল নর্থ বা বৈশ্বিক উত্তরের (উন্নত দেশ) দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন সংহত করেছে, তবে বৈশ্বিক দক্ষিণে (গ্লোবাল সাউথ) এটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার আরও অবক্ষয় ঘটিয়েছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে চীন।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষের বসবাস উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দেশে। এসব দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ চীনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং ৮৭ শতাংশ রাশিয়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রাখে। কিন্তু বিশ্বের বাকি ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টো।
গ্লোবাল সাউথে ৭০ শতাংশ মানুষ চীনকে এবং ৬৬ শতাংশ মানুষ রাশিয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। একই সঙ্গে, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত ব্রিকস জোটের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এই উত্তর–দক্ষিণ বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করছে এবং বহু মেরু বিশ্বব্যবস্থার পথ প্রশস্ত করছে।
চীন ইতিমধ্যে প্রায় প্রতিটি গ্লোবাল সাউথ দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার, যা তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দাবি প্রত্যাখ্যান করার আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে। কারণ, এসব দেশের নেতারা বিশ্বাস করেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করার সামর্থ্য রাখেন। আবার চীনকে ছাড়াই ভারত একা মার্কিন চাপ প্রতিহত করার নজির দেখিয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে রাশিয়া ও চীন উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছে ভারত।
চীন নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে ভূরাজনৈতিক প্রভাবের কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং ব্রিকস জোটের প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। তবে চীন এককভাবে এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে না। বিশ্বের ৪১ শতাংশ জনসংখ্যা এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্বকারী ব্রিকস এখনো প্রসারিত হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ‘শোষণের’ রেকর্ড আছে, যার মধ্যে রয়েছে—তথ্য যুদ্ধ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং শর্তযুক্ত ঋণ। এসব দেশের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গভীর ক্ষোভ পোষণ করে। তারা দেখেছে, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রিয় মাতৃভূমির সঙ্গে ভয়ানক আচরণ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েলের গাজায় আগ্রাসন, গাজা নিয়ে ট্রাম্পের উদ্ধত পরিকল্পনা—এসবই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সেই অতীত রেকর্ডেরই ধারাবাহিকতা।
ইউক্রেন যুদ্ধ যে বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে বৈশ্বিক দক্ষিণের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধটি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের আলোকে দেখা হয়। হিলের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অহংকার ও ভণ্ডামির কথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিল এবং এত দিন ধরে পরিচালনা করেছে, তার প্রতি আস্থা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।’ মধ্যপ্রাচ্যে দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সামরিক হস্তক্ষেপের পর, যুক্তরাষ্ট্র তার নৈতিক অবস্থান অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ, গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের নগ্ন সমর্থনে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ।
এই পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিক হলো, বৈশ্বিক গণমাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব আর একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের’ লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা গ্লোবাল সাউথে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। চীন, ভারত, তুরস্ক ও রাশিয়ায় অধিকাংশ মানুষ এখন মনে করে—পশ্চিমা বিশ্ব কেবল আরেকটি ভূরাজনৈতিক মেরুরূপে আবির্ভূত হয়েছে।
এর পাশাপাশি, সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের পুনর্মিলন একটি ক্রমেই আকার পেতে থাকা এশীয় ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক পরাগ খান্নার মতে, এশিয়া নিজেকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করছে এবং সেই বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় পুনরুদ্ধার করছে, যা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা ও আমেরিকান আধিপত্যের আগে প্রচলিত ছিল।
মস্কোভিত্তিক আমেরিকান রাজনীতি বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু করিবকো বলেন, ‘গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র আটলান্টিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিকের দিকে সরে যাচ্ছে। এটি সরাসরি দুই জায়ান্টের (চীন ও ভারত) উত্থানের কারণে, বিশেষ করে চীনের। দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বিনিয়োগ গ্লোবাল সাউথের বাকি অংশকেও উত্থানে সাহায্য করেছে। অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব হাত ধরাধরি করে চলে এবং ব্রিকস দেশগুলো বিশ্ব ব্যবস্থার সংস্কার চায়।’
যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে, বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশির ভাগ দেশ চীনকে সরাসরি সামরিক বা নিরাপত্তাগত হুমকি হিসেবে দেখে না। বরং চীন এখন তাদের জন্য অন্যতম প্রধান প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্যিক অংশীদার।
গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো মনে করে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক মেরু ব্যবস্থা কেবল ‘পরাক্রমশালী’ দেশটিরই স্বার্থ উদ্ধার করে। এই ধরনের ব্যবস্থা স্বৈরাচারী। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণাত্মকভাবে তার তথাকথিত ‘নিয়ম’ অন্য সবার ওপর চাপিয়ে দেয়। করিবকো বলেন, ‘এটি অসম। কারণ, পশ্চিমের অর্থনৈতিক উত্থান সম্পূর্ণরূপে গ্লোবাল সাউথের শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে। এটি অন্যায্য। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বিচারে লঙ্ঘন করে। সে অনুযায়ী, ব্রিকস দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও গণতান্ত্রিক, ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়সংগত করার লক্ষ্যে সংস্কার ত্বরান্বিত করছে।’
এটি স্পষ্ট যে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থার কাঠামো আর এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন থাকবে না। দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা নেতৃত্ব ছাড়াই একটি বহু মেরু বিশ্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
গ্লোবাল নর্থ তথা বৈশ্বিক উত্তরের দেশগুলো রাশিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অথচ গ্লোবাল সাউথ ক্রমশ ব্রিকস কেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সম্ভাবনার দিকে ঝুঁকছে। পুরোনো ও নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যকার এই সংস্থানিক ব্যবধান পূরণ করা বিশ্বব্যাপী সংকট এড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ব্রিকসের এই লক্ষ্য সফল হলে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো উপকৃত হবে। তবে প্রত্যাশা সংযত করা উচিত। কারণ, তারা যে পরিবর্তন কল্পনা করছে, তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের বিষয়টি অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ।
তথ্যসূত্র: গ্লোবাল টাইমস, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল গভর্ন্যান্স ইনোভেশন
যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরমহল তো বটেই, বিশ্বজুড়েই এক উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক তথাকথিত এক মেরু আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে আসছে এবং বিশ্ব বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। আবার, অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ। তবে চলতি বছরের মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব এক মেরু ব্যবস্থা থেকে বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং একই সঙ্গে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার এক নতুন যুগেও প্রবেশ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব কমে আসছে বলে দেশটিতে উদ্বেগের সূত্রপাত হয় বারাক ওবামা প্রশাসনের শুরুর দিকে। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার বাস্তব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে, এই উদ্বেগ ওবামার পরে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বশেষ বাইডেন প্রশাসন পর্যন্ত বহাল ছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবারও মহান করে’ তুলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের মাধ্যমে এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে।
২০২৫ সালের মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র–চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্ব একটি বিস্তৃত বহু মেরু ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে কি না—তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ‘বহু মেরুকরণ’ প্রক্রিয়া ক্রমশ গতি পাচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় এক মেরুকরণ, দ্বিমেরুকরণ, বহু মেরুকরণ এবং এমনকি অ-মেরুকরণেরও উপাদান রয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে আরও বেশিসংখ্যক রাষ্ট্রের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা একটি স্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত।’ এতে আরও বলা হয়, ‘স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এক মেরু বিশ্ব গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদ এখন আর একমাত্র প্রভাবশালী শক্তি নয়। এটি অভ্যন্তরীণভাবে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অনেক উদার গণতন্ত্রে জাতীয়তাবাদী জনতুষ্টির রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। এ ছাড়া, এটি বাহ্যিকভাবেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং এই বিষয়টি ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ তথা জলে–স্থলে–অন্তরিক্ষে আমেরিকার একক প্রভাবের সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রাম্প বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে অনুকূল বলে মনে করেন না এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। এই বিষয়টি মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুকরণ থেকে বহু মেরুকরণের দিকে বিশ্বের এই পরিবর্তন নিয়ে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিক এবং গ্লোবাল সাউথের (তৃতীয় বিশ্ব) উদীয়মান শক্তিগুলোর নাগরিকদের মধ্যে ধারণা ব্যাপকভাবে আলাদা। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের এক জরিপে দেখা গেছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭–এর বেশির ভাগ মানুষ এই পরিবর্তনকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই পরিবর্তন বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং বৈশ্বিক চুক্তি সম্পাদনকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। জরিপ অনুসারে, এসব দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, বহু মেরু ব্যবস্থা বিশ্বে শান্তি আনবে না।
অন্যদিকে, ব্রিকস (পশ্চিমের বাইরে বিকল্প অর্থনৈতিক জোট) দেশগুলোর বেশির ভাগ অংশীজন বহু মেরুকরণকে একটি ন্যায্য, সুবিচার ও শান্তিপূর্ণ বিশ্বের পথ হিসেবে দেখেন। জরিপে দেখা গেছে, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের বেশির ভাগ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, বহু মেরু বিশ্ব ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগগুলোকে আরও ভালোভাবে আমলে নেবে এবং সমাধানের পথ বের করবে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ফিয়োনা হিলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যে ধারণা প্রবল হচ্ছে, তা বৈশ্বিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহের জন্ম দিচ্ছে। তাঁর মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংহতির আহ্বানের প্রতি যে প্রতিরোধ তা মূলত ‘বৈশ্বিক বয়ান তৈরিতে সম্মিলিত পশ্চিমা কর্তৃত্ব এবং তাদের নিজেদের সমস্যা অন্য সবার ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে’ এটি বিদ্রোহের ইঙ্গিত।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেনেট পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরো ইউরেশিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকার উত্তর ও পশ্চিম অংশজুড়ে বিস্তৃত দেশগুলো ক্রমশ চীন–রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও আলোচনার প্রচলিত কাঠামো ভেঙে পড়ছে। পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ পেরিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বিশ্ব একটি বিভাজিত বাস্তবতায় প্রবেশ করছে। হিলের ভাষ্য অনুযায়ীও, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ‘প্যাক্স আমেরিকানার’ সমাপ্তি এবং এক নতুন বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার যুগের সূচনার ইঙ্গিত বহন করছে।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস পরিচালিত এক সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্ব ও অন্যান্য অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ এখন মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটছে। ইউক্রেন যুদ্ধ যদিও গ্লোবাল নর্থ বা বৈশ্বিক উত্তরের (উন্নত দেশ) দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন সংহত করেছে, তবে বৈশ্বিক দক্ষিণে (গ্লোবাল সাউথ) এটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার আরও অবক্ষয় ঘটিয়েছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে চীন।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষের বসবাস উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দেশে। এসব দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ চীনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং ৮৭ শতাংশ রাশিয়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রাখে। কিন্তু বিশ্বের বাকি ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টো।
গ্লোবাল সাউথে ৭০ শতাংশ মানুষ চীনকে এবং ৬৬ শতাংশ মানুষ রাশিয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। একই সঙ্গে, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত ব্রিকস জোটের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এই উত্তর–দক্ষিণ বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করছে এবং বহু মেরু বিশ্বব্যবস্থার পথ প্রশস্ত করছে।
চীন ইতিমধ্যে প্রায় প্রতিটি গ্লোবাল সাউথ দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার, যা তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দাবি প্রত্যাখ্যান করার আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে। কারণ, এসব দেশের নেতারা বিশ্বাস করেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করার সামর্থ্য রাখেন। আবার চীনকে ছাড়াই ভারত একা মার্কিন চাপ প্রতিহত করার নজির দেখিয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে রাশিয়া ও চীন উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছে ভারত।
চীন নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে ভূরাজনৈতিক প্রভাবের কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং ব্রিকস জোটের প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। তবে চীন এককভাবে এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে না। বিশ্বের ৪১ শতাংশ জনসংখ্যা এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্বকারী ব্রিকস এখনো প্রসারিত হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ‘শোষণের’ রেকর্ড আছে, যার মধ্যে রয়েছে—তথ্য যুদ্ধ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং শর্তযুক্ত ঋণ। এসব দেশের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গভীর ক্ষোভ পোষণ করে। তারা দেখেছে, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রিয় মাতৃভূমির সঙ্গে ভয়ানক আচরণ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েলের গাজায় আগ্রাসন, গাজা নিয়ে ট্রাম্পের উদ্ধত পরিকল্পনা—এসবই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সেই অতীত রেকর্ডেরই ধারাবাহিকতা।
ইউক্রেন যুদ্ধ যে বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে বৈশ্বিক দক্ষিণের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধটি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের আলোকে দেখা হয়। হিলের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অহংকার ও ভণ্ডামির কথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিল এবং এত দিন ধরে পরিচালনা করেছে, তার প্রতি আস্থা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।’ মধ্যপ্রাচ্যে দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সামরিক হস্তক্ষেপের পর, যুক্তরাষ্ট্র তার নৈতিক অবস্থান অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ, গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের নগ্ন সমর্থনে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ।
এই পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিক হলো, বৈশ্বিক গণমাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব আর একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের’ লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা গ্লোবাল সাউথে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। চীন, ভারত, তুরস্ক ও রাশিয়ায় অধিকাংশ মানুষ এখন মনে করে—পশ্চিমা বিশ্ব কেবল আরেকটি ভূরাজনৈতিক মেরুরূপে আবির্ভূত হয়েছে।
এর পাশাপাশি, সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের পুনর্মিলন একটি ক্রমেই আকার পেতে থাকা এশীয় ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক পরাগ খান্নার মতে, এশিয়া নিজেকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করছে এবং সেই বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় পুনরুদ্ধার করছে, যা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা ও আমেরিকান আধিপত্যের আগে প্রচলিত ছিল।
মস্কোভিত্তিক আমেরিকান রাজনীতি বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু করিবকো বলেন, ‘গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র আটলান্টিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিকের দিকে সরে যাচ্ছে। এটি সরাসরি দুই জায়ান্টের (চীন ও ভারত) উত্থানের কারণে, বিশেষ করে চীনের। দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বিনিয়োগ গ্লোবাল সাউথের বাকি অংশকেও উত্থানে সাহায্য করেছে। অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব হাত ধরাধরি করে চলে এবং ব্রিকস দেশগুলো বিশ্ব ব্যবস্থার সংস্কার চায়।’
যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে, বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশির ভাগ দেশ চীনকে সরাসরি সামরিক বা নিরাপত্তাগত হুমকি হিসেবে দেখে না। বরং চীন এখন তাদের জন্য অন্যতম প্রধান প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্যিক অংশীদার।
গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো মনে করে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক মেরু ব্যবস্থা কেবল ‘পরাক্রমশালী’ দেশটিরই স্বার্থ উদ্ধার করে। এই ধরনের ব্যবস্থা স্বৈরাচারী। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণাত্মকভাবে তার তথাকথিত ‘নিয়ম’ অন্য সবার ওপর চাপিয়ে দেয়। করিবকো বলেন, ‘এটি অসম। কারণ, পশ্চিমের অর্থনৈতিক উত্থান সম্পূর্ণরূপে গ্লোবাল সাউথের শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে। এটি অন্যায্য। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বিচারে লঙ্ঘন করে। সে অনুযায়ী, ব্রিকস দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও গণতান্ত্রিক, ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়সংগত করার লক্ষ্যে সংস্কার ত্বরান্বিত করছে।’
এটি স্পষ্ট যে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থার কাঠামো আর এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন থাকবে না। দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা নেতৃত্ব ছাড়াই একটি বহু মেরু বিশ্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
গ্লোবাল নর্থ তথা বৈশ্বিক উত্তরের দেশগুলো রাশিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অথচ গ্লোবাল সাউথ ক্রমশ ব্রিকস কেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সম্ভাবনার দিকে ঝুঁকছে। পুরোনো ও নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যকার এই সংস্থানিক ব্যবধান পূরণ করা বিশ্বব্যাপী সংকট এড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ব্রিকসের এই লক্ষ্য সফল হলে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো উপকৃত হবে। তবে প্রত্যাশা সংযত করা উচিত। কারণ, তারা যে পরিবর্তন কল্পনা করছে, তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের বিষয়টি অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ।
তথ্যসূত্র: গ্লোবাল টাইমস, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল গভর্ন্যান্স ইনোভেশন
আগামী ২৮ এপ্রিল আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে কানাডা। সংক্ষিপ্ত এই সময়ের মধ্যেই দেশটিতে শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী প্রচারণা। এবারের নির্বাচন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে তার বৃহত্তম অর্থনৈতিক অংশীদার ও প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্র।
৬ ঘণ্টা আগেলাদাখের সংঘর্ষের পর দুই দেশের সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এলেও, দুই দেশের সামরিক বাহিনী উচ্চ-পর্যায়ের সংলাপ চালিয়ে গেছে, যার ফলে অক্টোবরে সীমান্ত টহল পুনরায় শুরুর একটি চুক্তি হয়। মোদি সেই মাসে রাশিয়ার ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন...
১১ ঘণ্টা আগেসাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য বা মিথ্যা তথ্যের বিস্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষকেরা আগে গণমাধ্যম–কেন্দ্রিক ভুল তথ্য বা গুজবের ওপর গুরুত্ব দিলেও, এখন রাজনৈতিক নেতা এবং দলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
১৩ ঘণ্টা আগেমসজিদ নির্মাণে সৌদি আরবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বেশ আলোচনায় আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর তরুণ প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ত্রাওরে। এমনকি বাংলাদেশেও তিনি এখন পরিচিত হয়ে উঠেছেন। অনেকে তাঁর এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
১ দিন আগে