Ajker Patrika

চীনকে ঘিরে নয়া স্নায়ুযুদ্ধের জটিল গণিত

ফজলুল কবির
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯: ০৬
চীনকে ঘিরে নয়া স্নায়ুযুদ্ধের জটিল গণিত

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ নিয়ে বহু আগে থেকেই আলোচনা চলছিল। বাণিজ্যযুদ্ধ পেরিয়ে একটি আপাত শান্ত দশা এলেও তা শুধু উপরিতলেই। ভেতরে-ভেতরে এই দ্বৈরথ কখনো থামেনি। থামেনি যে, তা গত ১৫ সেপ্টেম্বর অকাস চুক্তিই বলে দিল। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এই নতুন চুক্তিকে একুশ শতকের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বিন্দু হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে এই অকাস চুক্তি গোটা অঞ্চলকে এক জটিল গণিতের ফেরে এনে ফেলেছে। 

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে বাণিজ্য যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার পারদ বেশ উঠেছিল। সে সময়ের পরিস্থিতিকেই অনেকে নয়া-স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু তারপর বিষয়টি প্রকাশ্যে আর বেশি দূর গড়ায়নি। গোটা বিশ্ব এতে একটু হাঁফ ছাড়লেও সে স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে চীনকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া একটি বিশেষ নিরাপত্তা চুক্তির কথা ঘোষণা করেছে গত ১৫ সেপ্টেম্বর। ত্রিদেশীয় এই চুক্তির নাম ‘এইউকেইউএস’, যাকে অকাস চুক্তি হিসেবেই সাধারণভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। 

এই চুক্তি এমন এক সময় ঘটল, যখন সারা বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও সেই প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতায় আবার তালেবানের ফেরা নিয়ে চরম সমালোচনার শিকার হয় বাইডেন প্রশাসন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কংগ্রেস শুনানিতে অংশ নিয়ে বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে—সবখানে এই সেনা প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরাজয় হিসেবেই দেখা হয়েছে।

মার্কিন কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত শুনানিতে সবচেয়ে কঠিন ও অস্বস্তিকর যে প্রশ্নটি অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, তা হলো—চীন ও রাশিয়ার হাতে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল কেন ছেড়ে এল ওয়াশিংটন? স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নের তেমন জোরালো উত্তর তিনি দিতে পারেননি। তবে তারপরই এল ১৫ সেপ্টেম্বরের এই অকাস চুক্তির ঘোষণা, যা পুরো বিশ্বকে রীতিমতো স্তম্ভিত করে দিয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এই পদক্ষেপের সঙ্গে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকট, ১৯৭২ সালের রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর বা ১৯৮৯ সালের বার্লিন দেয়ালের পতনের পূর্বাপর তুলনীয় হতে পারে। এই প্রতিটি ঘটনাই গোটা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর ঘোষিত ত্রিদেশীয় চুক্তিটি ঠিক এমনই এক বদলের আভাস নিয়ে এসেছে, যাকে চীন বর্ণনা করেছে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে। 

কী আছে অকাস চুক্তিতে? এমনিতে বেশ সাদামাটা একটা ভাষ্য দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই চুক্তির ফলে অস্ট্রেলিয়া প্রথমবারের মতো পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন নির্মাণ করতে পারবে। এই চুক্তির আওতাধীন দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি বিনিময় করবে। অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীকে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন বানাতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছেন বাইডেন। আর এই সহায়তার যুক্তি হিসেবে বাইডেন বলেছেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতার কথা। 

যুক্তরাষ্ট্র গত ৬০ বছরে যুক্তরাজ্য ছাড়া আর কারও সঙ্গে নিজেদের সাবমেরিন প্রযুক্তি ভাগ করেনি। কিন্তু এখন এমন কী হলো যে, এই প্রযুক্তি তারা অস্ট্রেলিয়াকে দিচ্ছে? তাও আবার এমনভাবে এই চুক্তি তারা করেছে যে, তা তাদের পরীক্ষিত ও পুরোনো মিত্র ফ্রান্সকে ভীষণভাবে চটিয়ে দিয়েছে। কারণ, এই চুক্তির ফলে ফ্রান্সের নকশা করা একটি সাবমেরিন তৈরির চুক্তি বাতিল করেছে অস্ট্রেলিয়া। ২০১৬ সালে হওয়া ৪ হাজার কোটি ডলার অর্থমূল্যের ওই চুক্তি বাতিলের প্রত্যুত্তরে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে নিজের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে এনেছে ফ্রান্স। তবে লন্ডন থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়নি। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের বক্তব্য—ব্রিটেন এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির শিকার। তাদের মূল ক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার ওপর। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ ইভেস লে দ্রায়াঁ এই দুই দেশের আচরণকে পিঠে ছুরি মারার মতো বলে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এই দেশগুলোর সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক ‘নজিরবিহীন খারাপ’ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছাল। 

চীন অবশ্য এই পদক্ষেপকে ‘সাবেকি স্নায়ুযুদ্ধের শূন্যগর্ভ পদক্ষেপের’ সঙ্গে তুলনা করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা এই চুক্তির কারণে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট হবে বলেও মন্তব্য করেছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। এর সঙ্গে যখন চুক্তির ঘোষণার সময় ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও স্কট মরিসন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মন্তব্যকে যোগ করা হয়, তখন এই চুক্তির অভীষ্ট বুঝতে আর বাকি থাকে না। তাঁরা এই চুক্তিকে ‘শক্তির মহত্তম উৎস মিত্রতায় বিনিয়োগ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফলে এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে এই অঞ্চলে ছড়ি ঘোরানোর নয়া-কৌশল করছে, তাতে কোনো সন্দেহ আর থাকে না। একই সঙ্গে কিছুদিন আগে ব্রিটিশ নৌবহরের দক্ষিণ চীন সাগরসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নৌপথ ঘুরে বেড়ানোও যে অকারণ ছিল না, তাও পরিষ্কার হয়ে যায়। 

চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ অস্ট্রেলিয়াকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আর এই চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা অস্ট্রেলিয়ার নৌবহরে যোগ করছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। মুখে এই ‘পারমাণবিক শক্তিচালিত’ কথাটি বলে তারা বাকিদের আশ্বস্ত করতে চায়। যেন পারমাণবিক শক্তিচালিত হওয়া মানে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত। কিন্তু বিষয়টি মোটেই তেমন কিছু নয়। উপরন্তু অস্ট্রেলিয়া নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতেও সই করেনি। ফলে এমন কোনো অস্ত্র যদি তাদের নৌবহরে যুক্ত হয়, তবে কোনো চুক্তিই ভঙ্গ হবে না।

হোয়াইট হাউস থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সঙ্গে যৌথভাবে অকাস চুক্তির ঘোষণা দেন গত ১৫ সেপ্টেম্বরক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠা চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নাটকীয় পদক্ষেপ। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত তার সামরিক প্রযুক্তি অন্য কোনো দেশের সঙ্গে ভাগ করে না। আর পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের প্রশ্ন এলে তো এটি একেবারে বিরল ঘটনা। গত ৬৩ বছরে একমাত্র যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তারা এমন প্রযুক্তি ভাগ করেছে। আর এখন এ তালিকায় যুক্ত হলো অস্ট্রেলিয়া। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, ‘স্বাধীন ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ বলতে তারা আসলে কী বোঝাচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্র বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চায়। তাদের এই পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই কোয়াডভুক্ত অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান—এই তিন দেশকে আশ্বস্ত করেছে। বলা প্রয়োজন যে, কোয়াডভুক্ত এই তিন দেশ আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিতে তাদের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশল নির্ধারণী আলোচনায় বসছে। ত্রিদেশীয় এই চুক্তির কারণে আসন্ন এই আলোচনার গুরুত্ব এখন বহুগুণে বেড়ে গেল। কাবুল থেকে মিত্রদের রেখে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় যে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই দূরীভূত। বরং যুক্তরাষ্ট্র তার শক্তির খেলাটি এখন কোথায় দেখাবে, তা-ই অনেক বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বুঝিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তার শত্রু ও মিত্র উভয়ের জন্যই আরও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসছে। কিন্তু এই বার্তা আবার বুমেরাংও হয়ে উঠতে পারে। কারণ, এর মাধ্যমে পরীক্ষিত মিত্র ফ্রান্সকে চটিয়েছে ওয়াশিংটন। এটি নিঃসন্দেহে অন্য ফ্রন্টগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রকে বিপদে ফেলবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কথাই ধরা যাক। এই অঞ্চলে ফ্রান্সের রয়েছে ৭ হাজার সৈন্যের সমাবেশ। এই অঞ্চলের ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় রয়েছে ২০ লাখ ফরাসির বাস। ফলে ফ্রান্সকে ক্ষিপ্ত করার মূল্য চোকাতে হতে পারে এই অকাস চুক্তিতে থাকা দেশ তিনটিকে। 

ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে গোটা ইউরোপের এখন সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। তারা তা কিছুটা বুঝতেও পারছে। মূলত ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকেই মার্কিন নির্ভরতার যে অন্তঃসারশূন্যতা সামনে আসছিল, তা বাইডেনের সময়ে খুব একটা উপশমের সুযোগ যে নেই, তা অন্তত পরিষ্কার হলো। 

এ তো গেল ইউরোপের কথা। যে অঞ্চল ঘিরে এই পদক্ষেপ, সেখানে এর প্রভাব কী? এই অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু সিঙ্গাপুরই বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি। তারা এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এরই মধ্যে। বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগর ঘিরে নতুন করে উত্তেজনার পারদ উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে থাকা দেশগুলোও এই পদক্ষেপে বেশ বিস্মিত হয়েছে। আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলো রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এ সম্পর্কিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো, বিশেষত জাকার্তা ও কুয়ালালামপুর মনে করছে, পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আদতে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ সাবমেরিনই। তারা মনে করছে, পারমাণবিক শক্তিচালিত থেকে এই সাবমেরিনের অস্ত্রসমৃদ্ধ হয়ে ওঠাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, এর উন্নয়ন, মজুত, পরীক্ষা বা এর ব্যবহারের হুমকি প্রদান থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর এটিকেই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছে দেশগুলো। যদিও ১৯৭৩ সালে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নিরোধ চুক্তি এবং ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা না করার চুক্তির (এনটিবিটি) প্রতি সম্মতি জানিয়েছিল দেশটি। কিন্তু এ দুটির কোনোটিতেই স্বাক্ষরকারী দেশ না হওয়ায় গত সপ্তাহে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ওপরই গোটা বিশ্বকে এখন নির্ভর করতে হচ্ছে।

যদি পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়টি বাদও দেওয়া হয়, তবুও এই চুক্তি পুরো অঞ্চলে এক নয়া অস্ত্র প্রতিযোগিতার কারণ হবে নিশ্চিতভাবে। কারণ, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিল যে, তারা চীনের সঙ্গে দ্বৈরথে দক্ষিণ চীন সাগরকেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছে। এদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো এই সাগরকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবেই দেখতে চায়। তারা এখানে কোনো বহিঃশক্তির প্রবেশ দেখতে চায় না। ১৯৯৫ সালে এই দেশগুলো ট্রিটি অব সাউথইস্ট এশিয়া নিউক্লিয়ার ওয়েপন ফ্রি-জোন নামের একটি চুক্তিতে সই করে। অবশ্য এতে পারমাণবিক শক্তিধর কোনো দেশ সই করেনি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো একই সঙ্গে এই অঞ্চলে চীন যে তার সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, তাও দেখতে চায় না। এ নিয়েও তারা অতীতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোয়াড ও অকাস চুক্তি মিলিয়ে এশিয়ায় মার্কিন মিত্ররা নতুন করে নড়েচড়ে বসল। চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী ও মার্কিন মিত্র হিসেবে মঞ্চে হাজির হওয়া ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের কৌশলে এখন নতুন করে ঝালাই দিচ্ছে। চীনকে এখন সামরিকভাবে অনেকগুলো দিককে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। 

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশল কতটা কার্যকর হয়, তা নিয়ে সংশয়ও বেশ রয়েছে। কারণ, চীনকে মোকাবিলায় জো বাইডেন প্রশাসনও শেষ পর্যন্ত সামরিক পথেই হাঁটল। আফগানিস্তান এক রকম চীনের প্রভাব বলয়ে তারা আগেই রেখে এসেছে। সেখানে চীনের সঙ্গে রয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার প্রসঙ্গ একটু পাশে সরিয়ে রেখে শুধু চীনের সামরিক শক্তি ও কৌশলের দিকে তাকালেও বিষয়টি সহজ নয়। এর সঙ্গে যখন চীনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বিষয়টি যুক্ত হবে, তখন যুক্তরাষ্ট্র একটু ব্যাকফুটে রয়েছে, মানতেই হবে। বিশেষত এই গোটা অঞ্চলে চীন শুধু অর্থনৈতিক বিনিয়োগ দিয়ে যে পরিমাণ জাল বিস্তার করেছে, তা ছিন্ন করাটা সহজ কিছু হবে না। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত