Ajker Patrika

দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধ /আমেরিকার মধ্যস্থতায় কেন পাকিস্তানের স্বস্তি, বিরক্ত মোদি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ১৯: ০৪
যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পাকিস্তান খুশি হলেও বিরক্ত ভারত। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পাকিস্তান খুশি হলেও বিরক্ত ভারত। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির দুদিন পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে যে ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে, তিনি মস্ত বড় বিজয় হাসিল করেছেন। তাঁর ভাষণে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। ১২ মের ভাষণে মোদি বলেছেন, কাশ্মীরে গত মাসের সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারতের চার দিনের সামরিক অভিযান এক ‘নিউ নরমাল’ বা ‘নয়া স্বাভাবিকতা’ নির্মাণ করেছে। ওই অভিযান আপাতত স্থগিত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতে পাকিস্তানের আচরণে নজর রাখা হবে।

মোদি আরও বলেন, ভবিষ্যতে ভারত সন্ত্রাসবাদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য করবে না। ‘পারমাণবিক ব্ল্যাকমেলের’ কাছে আত্মসমর্পণ করবে না ভারত। মোদির এই বক্তব্য একদিকে যেমন পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দেওয়া, অন্যদিকে যুদ্ধবিরতিতে ক্ষুব্ধ জাতীয়তাবাদীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা। তবে এর মধ্য দিয়ে আমেরিকার ভূমিকায় ভারতের অসন্তোষও ফুটে ওঠে। কারণ, আমেরিকাই পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র সংঘর্ষ থামানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

মোদি তাঁর ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতার দাবি নিয়ে একটি কথাও বলেননি; বরং দাবি করেছেন, পাকিস্তানই যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করেছে। কারণ, তারা ‘ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির’ মুখে পড়েছে। মোদি এটাও স্পষ্ট করে দেন যে আমেরিকা যতই বড় শান্তি আলোচনা প্রস্তাব দিক না কেন, ভারত আলোচনার বিষয় হিসেবে কেবল সন্ত্রাসবাদ ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভবিষ্যৎকেই বিবেচনায় নেবে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানকে এই ফলাফলে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। দেশটিও দাবি করছে, তারা বিজয়ী। তারা যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করেছে—এমন অভিযোগ অস্বীকার করে আমেরিকাসহ অন্য মধ্যস্থতাকারীদের ধন্যবাদ জানিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান বড় পরিসরের আলোচনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে দেশটি চায়, আলোচনায় ভারতের দখলে থাকা কাশ্মীর, ভারতের স্থগিত করা পানিবণ্টন চুক্তি এবং পাকিস্তানের মাটিতে ভারত-সমর্থিত বিদ্রোহীদের ইস্যু অন্তর্ভুক্ত থাকুক। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘শান্তির প্রতি আন্তরিক অবস্থান’ থেকেই তাঁরা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন। তবে যদি সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হয়, তাহলে তাঁর দেশ সেটি মেনে নেবে না।

এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর আছে বলেই মনে হচ্ছে। ১১ মে দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। পরদিন দুই দেশের সেনাবাহিনীর অপারেশনস প্রধানেরা হটলাইনে কথা বলেন এবং সীমান্তবর্তী ও ফ্রন্টিয়ার এলাকাগুলোতে সৈন্যসংখ্যা কমাতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করেন।

তবে এই মুহূর্তে কে কার চেয়ে বেশি সফল—এই ইস্যুতে প্রচারণায় লিপ্ত দুই দেশ। ২০১৯ সালের সর্বশেষ ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় হোয়াইট হাউসে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন লিসা কার্টিস। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, আমেরিকার হস্তক্ষেপ দুই দেশকেই ‘বিজয়ী দাবি করে যুদ্ধ-পরিস্থিতি থেকে সরে আসার’ সুযোগ করে দিয়েছে।

লিসা কার্টিস মনে করেন, ‘যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে।’ তবে এটাও বলেন, মোদি প্রশাসন ট্রাম্পের কিছু মন্তব্যে বিরক্ত। যদি আমেরিকা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চায়, তাহলে পাকিস্তান-ভারত সংঘাত নিয়ে বড় পরিসরের আলোচনার অঙ্গীকার থেকে সরে আসতে হতে পারে।

মোদির ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণও অবশ্য রয়েছে। ট্রাম্পের প্রথম আমলে তিনি নিজ দেশে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে বড় কৃতিত্ব হিসেবে দেখান। চীনের উত্থান নিয়ে দুই দেশের যে যৌথ শঙ্কা, তার ভিত্তিতেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। পাকিস্তান যেখানে নতুন চীনা যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের ধার পরীক্ষা করেছে এবং দাবি করছে, তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে (যদিও ভারত তা স্বীকার করেনি), সেখানে ভারত আমেরিকার কাছ থেকে দৃশ্যমান তেমন কোনো সমর্থন পায়নি।

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা তাদের আগেভাগে জানানো হয়নি। এতে ভারত প্রথমে যুদ্ধবিরতির বিষয়টিকে ‘পাকিস্তানের অনুরোধে হওয়া’ বলে উপস্থাপন করতে পারছে না। যাহোক, যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতার পর ট্রাম্প ১১ মে কাশ্মীর ইস্যুতেও মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ভারত কাশ্মীর ইস্যুতে বহুদিন ধরে এ ধরনের তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে নারাজ। ভারতীয় কর্মকর্তারা আরও দাবি করছেন, যুদ্ধবিরতি আলোচনার সময় বাণিজ্য নিয়ে কোনো কথা হয়নি। যদিও ট্রাম্প ১২ মে বলেন, তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, যদি যুদ্ধ না থামে, তাহলে কোনো পক্ষের সঙ্গেই ব্যবসা করবেন না।

ভারতের দৃষ্টিতে, প্রথমে আমেরিকা এই সংকট উপেক্ষা করেছে এবং পরে পাকিস্তানের পারমাণবিক হুমকির কাছে মাথা নত করেছে। আমেরিকার কর্মকর্তারা বলছেন, ৯ মে রাতে সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ার পর উদ্বেগজনক গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার ভিত্তিতে তাঁরা হস্তক্ষেপ করেন। যদিও ওয়াশিংটন বিস্তারিত কিছু জানায়নি। ১০ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি নোটিশ পাঠিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে জানায়, তাদের ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটি বৈঠকে বসছে। এই সংস্থা দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। পরে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবশ্য তা অস্বীকার করেন। কিন্তু ভারত বিষয়টি দেখেছে এভাবে যে কম শক্তিশালী দেশ হিসেবে পাকিস্তান আবারও তাড়াতাড়ি পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকির আশ্রয় নিয়েছে, যেমনটা তারা ১৯৯০ ও ১৯৯৯ সালেও করেছিল।

ভারতীয় কর্মকর্তাদের আরও আশঙ্কা, আমেরিকার এই মধ্যস্থতার প্রস্তাব কাশ্মীরের দিকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ফেরাচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগসূত্রের দিকে নয়। ট্রাম্প ২০১৯ সালেও কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে ভারতকে বিরক্ত করেছিলেন। এবারও তিনি ভারতের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের মুখপাত্র প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমরা কি তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার দরজা খুলে দিয়েছি?’

ভারতের সামরিক নেতৃত্বও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছে। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় ভারতের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল ভিপি মালিক। তিনি ভারতের বাহিনীর প্রশংসা করলেও টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন তুলেছেন, ভারত যে ভবিষ্যতের সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে চেয়েছিল, সেটা কি আদৌ হয়েছে?

ভিপি মালিক আরও বলেন, আমেরিকাকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দিয়ে ভারত দীর্ঘদিনের লালিত ‘কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ নীতি বিসর্জন দিয়েছে এবং আবারও পাকিস্তানের সঙ্গে এক কাতারে নামিয়েছে। অথচ ভারত নিজেকে আলাদা এক উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিল। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কি যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে তাড়াহুড়া করে ফেলেছি?’

ভারতের অনেকে মনে করছেন, আমেরিকা দুই দেশের নেতাদের প্রশংসা করে সমান চোখে দেখছেন বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, অথচ ভারত তার সামরিক পদক্ষেপকে কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের হামলার বৈধ জবাব হিসেবেই দেখছে। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী টেলিভিশন উপস্থাপক অর্ণব গোস্বামী এক ভাইরাল ভিডিওতে বলেন, ‘ট্রাম্প কীভাবে পেহেলগামের ঘটনার সঙ্গে পরবর্তী ঘটনাগুলোর তুলনা করতে পারেন? এটা একেবারেই অযৌক্তিক।’

যুদ্ধের ফলাফলের বয়ান নিয়েও ভারতের ভেতর প্রশ্ন উঠেছে। ভারত স্যাটেলাইট চিত্র দেখিয়ে বলেছে, তারা পাকিস্তানের ১১টি বিমানঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে। দাবি করেছে, ১০০ জনের বেশি তথাকথিত ‘জঙ্গি’ ও ৩৫ থেকে ৪০ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছে। তারা বলছে, কয়েকটি ‘উচ্চ প্রযুক্তির’ পাকিস্তানি বিমানও ভূপাতিত করা হয়েছে। অথচ ওপেন সোর্স প্রমাণে দেখা যাচ্ছে, ভারতও কিছু বিমান হারিয়েছে। পাকিস্তান যে ৩টি রাফাল ও ২টি রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে, সেটি ভারত স্বীকার করেনি, অস্বীকারও করেনি।

অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, তাদের কেবল একটি বিমান সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা দাবি করেছে, ভারতের ২৬টি সামরিক স্থাপনার বড় ক্ষতি করেছে, ড্রোন পাঠিয়েছে দিল্লি পর্যন্ত এবং ৪০ থেকে ৫০ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করেছে। তবে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিরোধে পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতটা সফল ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

দুই পক্ষের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি যা-ই হোক না, এই সংকট থেকে একটা শিক্ষা পাওয়া গেল—ভারত চাইলে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানতে পারে, এবং সেটি যুদ্ধ বা পারমাণবিক উত্তেজনা ছাড়াই। তবে এর বিপজ্জনক দিক হলো, ভবিষ্যতে ভারত হয়তো আরও জোরালোভাবে আঘাত করবে এবং পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি দিলেও পিছু হটবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত