Ajker Patrika

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন-ভারত ‘নয়া বন্ধুত্ব’ কি এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫: ১৫
ট্রাম্প ভারতকে চাপে রাখতে যে কৌশল নিয়েছেন তা কাটিয়ে উঠতে সির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সফল হবেন কি মোদি। ছবি: সংগৃহীত
ট্রাম্প ভারতকে চাপে রাখতে যে কৌশল নিয়েছেন তা কাটিয়ে উঠতে সির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সফল হবেন কি মোদি। ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ বছর আগে ভারতে অভাবনীয় অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে সময় চীন কড়া ভাষায় এর সমালোচনা করেছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পের সম্মানে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামে এক জনসভার আয়োজন করেছিলেন আহমেদাবাদে। মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদে আয়োজিত ওই জনসভা ছিল ট্রাম্পের প্রথম ভারত সফর। এই সফর দুই দেশের মধ্যে আরও গভীর সম্পর্কের পথ খুলে দেয়। এটি মোদি ও ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্কেরও এক নতুন অধ্যায় শুরুর প্রদর্শনী ছিল।

এর কয়েক মাস পর, ২০২০ সালের জুনে ভারত-চীন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। হিমালয় অঞ্চলের লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে নিহত হয় ভারতের ২০ সেনা। এরপর ভারত টিকটকসহ দুই শতাধিক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে। ভারত ও চীনের সেনারা সীমান্তে মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও কোয়াড জোটের (কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ)—যেখানে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে—সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতা জোরদার করে নয়াদিল্লি।

বিগত পাঁচ বছর চীনকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখেছে ভারত। এমনকি গত মে মাস পর্যন্ত চীনকে কার্যত প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছে। কারণ, ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর চার দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান চীনা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ, বিশেষ করে—ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ কর আরোপ এবং দ্রুত ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে কয়েক দশকে ওয়াশিংটনের গড়ে তোলা কূটনৈতিক ও কৌশলগত অর্জনগুলো ভেস্তে দিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ড্রাগন-হাতির ট্যাঙ্গো

গত সপ্তাহের শুরুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠক করেন। দুই দিনের দিল্লি সফরে ওয়াং ই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গেও বৈঠক করেন। হিমালয় সীমান্তে দুই দেশের চলমান বিরোধ নিয়েই মূলত আলোচনা হয়।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, একে অপরকে ‘বিশ্বাস ও সহযোগিতা’ করা উচিত। বৈঠকে উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থা গড়তে কয়েকটি পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হয়—সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় শুরু, ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও সীমান্ত বাণিজ্যে সুবিধা দেওয়া।

গত জুনে বেইজিং ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের তিব্বতের পবিত্র স্থানে যাওয়ার অনুমতি দেয়। পাশাপাশি, দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধের কিছু অংশে ‘প্রাথমিক সমাধান’ খুঁজে দেখতেও দুই দেশ সম্মত হয়েছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে রূপ নেওয়া এই সীমান্ত সংকটই দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক উত্তেজনার কারণ।

চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মোদিকে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন এই আঞ্চলিক জোটকে অনেক বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবে দেখেন। চলতি মাসের শেষ দিকে চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলনে যোগ দেবেন মোদি। সাত বছরের বেশি সময় পর এটিই হবে তাঁর প্রথম চীন সফর।

চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট সি আহ্বান জানান ভারত-চীন সম্পর্ককে ‘ড্রাগন-হাতির ট্যাঙ্গো নাচের’ রূপ দেওয়ার জন্য। ড্রাগন ও হাতিকে এই দুই এশীয় পরাশক্তির প্রতীক ধরা হয়।

তাইওয়ান-এশিয়া এক্সচেঞ্জ ফাউন্ডেশনের ফেলো সানা হাশমি আল-জাজিরাকে বলেন, ভারত-চীনের বিভেদ দূর করার প্রচেষ্টা বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। গত অক্টোবরেই রাশিয়ার কাজানে মোদি ও সির মধ্যে বরফ গলানো বৈঠক হয়। এর আগে কয়েক বছর ধরে তাঁরা একে অপরকে এড়িয়ে চলছিলেন, এমনকি বহুপক্ষীয় সম্মেলনেও।

হাশমি বলেন, ‘তবে ট্রাম্পের শুল্কনীতি আর পাকিস্তানের প্রতি তাঁর বাড়তি আনুকূল্যের কারণে ভারতের হাতে তেমন বিকল্প ছিল না। তাই তারা প্রতিপক্ষের সংখ্যা কমানোর পথে হাঁটছে, যার মধ্যে চীনও রয়েছে।’

এ বছর ট্রাম্প দুবার পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে ওয়াশিংটনে আতিথ্য দিয়েছেন। এমনকি দীর্ঘদিনের রীতি ভেঙে বিদেশি কোনো সেনাপ্রধানকে তিনি হোয়াইট হাউসে আতিথ্য দেন। ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘটেছে তাঁর মধ্যস্থতায়। যদিও নয়াদিল্লি বলে আসছে, ওয়াশিংটন কোনো ভূমিকা নেয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকে দিল্লির ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ প্রসঙ্গে হাশমি বলেন, ‘বেইজিংয়ের জন্য এই উদ্যোগটা (ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করা) কৌশলগত, কিন্তু নয়াদিল্লির জন্য বিষয়টা এসেছে অনিশ্চয়তা আর পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে।’ হাশমি মনে করেন, হোয়াইট হাউস ‘নিশ্চিতভাবেই ভারতের মতো কৌশলগত অংশীদারকে একঘরে করার চেষ্টা করছে’।

রাশিয়ার তেল আমদানি অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি পণ্যে ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক বসিয়েছেন, যা আগের ২৫ শতাংশ শুল্কের ওপর আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু রুশ তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীনের ওপর তিনি এমন শুল্ক দেননি। বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ বিশ্বজিৎ ধর বলেন, ট্রাম্পের এই শুল্কনীতি এশিয়ায় নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘ভারত-চীন সম্পর্ক উন্নতির গতি গত কয়েক মাসে অনেক বেড়েছে। এবার মনে হচ্ছে সম্পর্কের সত্যিকারের একটা পরিবর্তন ঘটছে, যা স্থায়ী হতে যাচ্ছে।’

নয়া এশীয় বাণিজ্য জোট?

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত-চীন সম্পর্কের উন্নতি হলে দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের ধাক্কা কিছুটা লাঘব করতে পারবে। চীনা বাজারে প্রবেশাধিকার, সীমান্ত বাণিজ্যে সহজতা এবং যৌথ সরবরাহ চেইন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়ক হবে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। মূলত ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি বেড়ে যাওয়া এর জন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। তবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঘাটতি, চীনের সঙ্গে তা প্রায় দ্বিগুণ।

এ বিষয়ে সানা হাশমি বলেছেন, চীন ভারতকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে এবং ভারতীয় পণ্যের জন্য বাজার আরও খুলে দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে শুল্কের প্রভাব কিছুটা কমতে পারে। একই সঙ্গে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক দুর্বলতাও হ্রাস পাবে। চীনের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সহায়তা করবে।

হাশমি আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে পারা চীনের জন্য কৌশলগত দিক থেকেও বড় সাফল্য হবে। তাঁর মতে, ‘নয়াদিল্লি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ফলে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চীনকে প্রমাণ করতে সাহায্য করবে যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং তারাই বেশি নির্ভরযোগ্য।’

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো ও ভারত-চীন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ইভান লিদারেভ বলেন, ভারত ও চীন উভয় দেশেই এখন উপলব্ধি করছে, দ্বিপক্ষীয় টানাপোড়েনের কারণে ভূরাজনীতিতে তারা অনেক কিছু হারিয়েছে।

লিদারেভ বলেন, ‘চীন বুঝতে পেরেছে, তারা ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অনেক বেশি ঠেলে দিয়েছে। আর নয়াদিল্লি বুঝতে পারছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার জন্য বড় মূল্য চোকানোর বাস্তবতা বয়ে এনেছে।’ লিদারেভের মতে, ‘ভারত-চীন সম্পর্ক উষ্ণ হলে এশিয়াকেন্দ্রিক বাণিজ্য জোট গঠনের সুযোগ আরও বাড়বে, যা ওয়াশিংটন থেকে স্বাধীন থাকবে।’

তবে হাশমি সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারতসহ অনেক দেশ সরবরাহ চেইনে ঝুঁকি কমাতে কোনো একক উৎসের ওপর অতি নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কার্যকর জবাব না দিলে সেই চেষ্টার ফল আসবে না। ভারতের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কের কারণে এই চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে।

হাশমি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘সম্পর্কে নমনীয়তা এলেও তা আমূল বদলে দেবে না। প্রতিযোগিতা ও সংঘাত থাকবেই। শুল্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য তাড়াহুড়া করবে। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে চীনের ওপর নির্ভরশীলতাও বহাল থাকবে।’

গুরুত্ব হারাচ্ছে কোয়াড

জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকেই ওয়াশিংটনে ভারতকে চীনের গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছিল। বারাক ওবামার ‘এশিয়ামুখী’ বা ‘pivot to Asia’ নীতিতে বেইজিংয়ের উত্থান ঠেকাতে দিল্লিকে কেন্দ্রে রাখা হয়। এরপর সেটি আরও স্পষ্ট হয় কোয়াড গঠনের মাধ্যমে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে যোগ দেয় জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।

ওয়াশিংটনের কাছে কোয়াড ছিল—এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের মূল কেন্দ্র। এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ, সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা ও গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে বিলিয়ন ডলার ঢালা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোয়াড যুক্তরাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক সামরিক জোটের বাইরে থেকেও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দিয়েছে। একই সঙ্গে ভারতকে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার কাঠামোয় বেঁধে ফেলেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি গড়ে উঠেছে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ ধারণার ওপর। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতা করবে, কিন্তু কোনো সামরিক জোটে যোগ দেবে না, কিংবা অন্য শক্তির বিরুদ্ধে আদর্শিক শিবিরে দাঁড়াবে না।

তবুও ওয়াশিংটনে ধরে নেওয়া হচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি দিল্লি ও বেইজিংয়ের পুরোনো অবিশ্বাস ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে বড় কৌশলগত স্তম্ভে পরিণত করবে। ভারতকে পাশে রাখতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনো দিল্লির মস্কোর প্রতি ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব নিয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করেনি। বিগত অর্ধশত ধরে রাশিয়া ভারতের অন্যতম বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি ধরে রাখে।

কিন্তু এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই সমীকরণ পাল্টে দিতে চাচ্ছে। তিনি চান ভারত স্পষ্টভাবে একপক্ষ বেছে নিক। হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য ও উৎপাদনবিষয়ক কাউন্সেলর পিটার নাভারো ১৮ আগস্ট ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে লেখেন, ‘বাইডেন প্রশাসন এই কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক অযৌক্তিকতার দিকে মূলত চোখ বন্ধ করে ছিল। ট্রাম্প প্রশাসন সেটির মোকাবিলা করছে...যদি ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চায়, তবে তাকে সেভাবে আচরণ করতে হবে।’

অন্যদিকে ভারতীয় কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, দিল্লি তার ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ ছাড়বে না। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) চায়না স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক বি আর দীপক বলেন, ভারত-চীন সম্পর্ক উষ্ণ হলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় একঘরে করার পরিকল্পনা কঠিন হয়ে যাবে।

তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘যদি দিল্লি উন্নয়ন অর্থায়ন, বহুপক্ষীয় সংস্কার, ডি-ডলারাইজেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী গণতন্ত্র-জোট গড়ার বয়ানকে দুর্বল করবে। এতে চীনের বিকল্প বৈশ্বিক শৃঙ্খলা গঠনের প্রচেষ্টায় বৈধতা যুক্ত হবে।’

দীপক আরও বলেন, বেইজিং ও দিল্লির মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হলে ভারত কোয়াডে প্রকাশ্যে চীনবিরোধী অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে। তখন কোয়াড হয়তো কঠোরভাবে চীনের মোকাবিলা না করে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরে জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ নেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগ দেবে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক লিদারেভ বলেন, ভারত-চীন পুনর্মিলন কোয়াডের ভেতরে জটিলতা তৈরি করবে। এতে পারস্পরিক আস্থা ও উদ্দেশ্যের স্পষ্টতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে দীপকের মতে, কোয়াডের ‘কৌশলগত গুরুত্ব’ একেবারেই শেষ হয়ে যাবে না। সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা, উদীয়মান প্রযুক্তি, জলবায়ু সহযোগিতা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তার মতো যৌথ লক্ষ্যে এর প্রাসঙ্গিকতা টিকে থাকবে।

হাশমি মনে করিয়ে দেন, ট্রাম্প প্রথম দফায় কোয়াড শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। অথচ এখন তাঁর পদক্ষেপই এর ঐক্যকে দুর্বল করছে। তিনি বলেন, আপাতত প্রেসিডেন্টের কাছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল অগ্রাধিকার বলে মনে হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি পাল্টালে যুক্তরাষ্ট্র একেবারে নতুন এক আঞ্চলিক বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। তখন ভারতকে কোনো চীনবিরোধী জোটে যুক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে উঠবে।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভাড়াটে চোরদের নিয়ে ষাঁড় চুরি করছিলেন স্ত্রী, বাধা দেওয়ায় স্বামীকে হত্যা: পুলিশ

দীপু চন্দ্র দাসের পরিবারের দায়িত্ব নিল সরকার

হাদি হত্যা মামলা: ফয়সালদের ৮ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

এই মব আক্রমণগুলো হাওয়া থেকে ঘটেনি—জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের ক্ষোভ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভাড়াটে চোরদের নিয়ে ষাঁড় চুরি করছিলেন স্ত্রী, বাধা দেওয়ায় স্বামীকে হত্যা: পুলিশ

দীপু চন্দ্র দাসের পরিবারের দায়িত্ব নিল সরকার

হাদি হত্যা মামলা: ফয়সালদের ৮ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

এই মব আক্রমণগুলো হাওয়া থেকে ঘটেনি—জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের ক্ষোভ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভাড়াটে চোরদের নিয়ে ষাঁড় চুরি করছিলেন স্ত্রী, বাধা দেওয়ায় স্বামীকে হত্যা: পুলিশ

দীপু চন্দ্র দাসের পরিবারের দায়িত্ব নিল সরকার

হাদি হত্যা মামলা: ফয়সালদের ৮ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

এই মব আক্রমণগুলো হাওয়া থেকে ঘটেনি—জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের ক্ষোভ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভাড়াটে চোরদের নিয়ে ষাঁড় চুরি করছিলেন স্ত্রী, বাধা দেওয়ায় স্বামীকে হত্যা: পুলিশ

দীপু চন্দ্র দাসের পরিবারের দায়িত্ব নিল সরকার

হাদি হত্যা মামলা: ফয়সালদের ৮ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

এই মব আক্রমণগুলো হাওয়া থেকে ঘটেনি—জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের ক্ষোভ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভাড়াটে চোরদের নিয়ে ষাঁড় চুরি করছিলেন স্ত্রী, বাধা দেওয়ায় স্বামীকে হত্যা: পুলিশ

দীপু চন্দ্র দাসের পরিবারের দায়িত্ব নিল সরকার

হাদি হত্যা মামলা: ফয়সালদের ৮ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

এই মব আক্রমণগুলো হাওয়া থেকে ঘটেনি—জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের ক্ষোভ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত