Ajker Patrika

ইউক্রেন যুদ্ধ: ইসরায়েলের ভারসাম্য রক্ষার কৌশল কি টলে যাচ্ছে

আব্দুর রহমান
ইউক্রেন যুদ্ধ: ইসরায়েলের ভারসাম্য রক্ষার কৌশল কি টলে যাচ্ছে

ইউক্রেন যুদ্ধ প্রায় আট মাস পার করল। কিয়েভে মস্কোর ড্রোন হামলা যুদ্ধের নতুন গতিপ্রকৃতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে জন্ম দিয়েছে একাধিক নতুন সমীকরণের। সবচেয়ে জটিল সমীকরণগুলোর একটি হলো—রাশিয়া, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক। তেল আবিব এত দিন মস্কোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করে এলেও সম্প্রতি সেই সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ইরান থেকে রাশিয়ার ড্রোন ক্রয়, সিরিয়া থেকে রুশ সৈন্য ও সমরাস্ত্র প্রত্যাহার তেল আবিব-মস্কো সম্পর্ক নিয়ে ইসরায়েলি নীতি নির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ের লাপিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা ইউক্রেনে ইসরায়েলি সামরিক সহায়তার বিষয়ে বলেছেন। কুলেবা জানিয়েছেন, তিনি ইয়ের লাপিদের সঙ্গে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও বলা হয়েছে, লাপিদ ইউক্রেনের পরিস্থিতির বিষয়ে অবগত।

ইউক্রেনে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের বিষয়ে ইসরায়েলের আগ্রহ প্রকাশের বিষয়টি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্তেজের অফিসের বিবৃতিতেই স্পষ্ট। বিবৃতিতে অনুসারে, বেনি গান্তেজ ইউক্রেনের কাছে জানতে চেয়েছেন, দেশটি কী ধরনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ইসরায়েল সম্ভবত জনসাধারণের প্রাণ রক্ষার্থে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়ে অগ্রিম সতর্কবার্তা দিতে সক্ষম এমন সিস্টেম সরবরাহ করবে।’ তবে ইসরায়েলে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত এর পরিবর্তে ড্রোন ভূপাতিত করার ব্যবস্থা চেয়েছেন।

সিরিয়ার গামিশলি শহরে রাশিয়ার সৈন্যরা। ইসরায়েল ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করবে কি না তা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে একটি হলো— ইরান। রাশিয়া ইরানের তৈরি কামিকাজ এবং শাহেদ-১৩৬ ড্রোন ব্যবহার করে কিয়েভে বেশ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আবার ইরান-ইসরায়েল পরস্পরের ঘোষিত প্রতিপক্ষ। দুটি দেশের সঙ্গেই রাশিয়ার সম্পর্ক ইতিবাচক। ফলে মস্কো–তেহরান সহযোগিতার সম্পর্ককে উপেক্ষা করে কেবল ইরানের বিরোধিতা করতে চাইলে ইসরায়েলকে রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী হারানোর ঝুঁকিও নিতে হতে পারে।

রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক থাকলেও ইহুদি রাষ্ট্রটির মূল মিত্র কিন্তু পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল তা পরিষ্কারভাবে বলেও দিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিষয়ে আমাদের নীতি পরিষ্কার। আমরা পশ্চিমের পক্ষে। আমরা ইউক্রেনের শরণার্থী এবং হতাহতদের যত্ন নেওয়ার জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখব।’ গত বুধবার ইসরায়েলের কান রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী গান্তেজ বলেন, ‘স্পষ্ট কিছু কারণে আমরা এই যুদ্ধে নিজেদের জড়াতে চাই না। এখনো পর্যন্ত আমাদের নীতি এটাই।’ তবে গান্তেজের সর্বশেষ অবস্থান বলছে, ইসরায়েল ইউক্রেনে আকাশ প্রতিরক্ষা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা সরবরাহ করতে আগ্রহী।

রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ।এটিই সম্ভবত মস্কোকে ভাবিয়ে তুলেছে। ইসরায়েলের উদ্যোগ প্রকাশ্যে আসার আগেই মস্কো বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, সিরিয়ার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল থেকে সৈন্য এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নিয়েছে রাশিয়া। তেল আবিবকে আস্থায় নিতেই মস্কো এমন পদক্ষেপ করে থাকতে পারে। এ বিষয়ে দুই পশ্চিমা কূটনৈতিক ও ইসরায়েলি এক সেনা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, রাশিয়ার এই প্রত্যাহার মূলত সিরিয়ায় ইসরায়েলি বাহিনীকে অভিযান চালাতে আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষক অ্যালেক্স ফিশম্যানের মন্তব্যে। তাঁর মতে, রাশিয়ার কারণেই ইসরায়েল সিরিয়ায় সুবিধা করতে পারছে না। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘রুশরা আমাদের গোলান মালভূমির সীমান্তে অবস্থান করছে। ভূমধ্যসাগরে অবস্থানরত তাদের নৌবাহিনীও যুদ্ধের জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত। ফলে, ইসরায়েল চাইলেও রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে না।’

তাহলে বুঝেশুনেই মস্কোর সঙ্গে পরোক্ষ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিচ্ছে ইসরায়েল? বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েল নিজের স্বার্থেই এমন অবস্থানে গেছে। প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে শায়েস্তা করা তো বটেই সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষাও ইসরায়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাশিয়ার কাছে ইরানের ড্রোন বিক্রির বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি তেল আবিব। কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে ইসরায়েলের সরাসরি মাঠে নামার পক্ষে ওকালতি করেছেন দেশটির মন্ত্রী নাখমান শাই। এক টুইটে তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়াকে ইরানের সামরিক সহায়তা দেওয়ায় এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষ নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটোর সঙ্গে মিলে ইউক্রেনকে ইসরায়েলি সহায়তা দেওয়ার সময় এসে গেছে।’

তবে নতুন ভূরাজনৈতিক খেলায় ইসরায়েলকে খুব বুঝেশুনে পা ফেলতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে একা টিকে থাকতে হলে তাকে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করেই চলতে হবে! ইসরায়েল এখনো কেন ইউক্রেনে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করছে না সে বিষয়ে কথা বলেছেন ইসরায়েলের প্রবীণ কূটনীতিক অ্যালন লিওল। আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সাময়িকী ফরেন পলিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অ্যালন লিওল বলেছেন, ‘যুদ্ধের শুরুর দিন থেকেই ইসরায়েল কেবল নিজের স্বার্থই বিবেচনা করেছে। প্রথম দিকে তারা কেবল সিরিয়া যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবেছে। এরপর ভেবেছে রাশিয়ায় ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বার্থের জায়গা থেকে। সর্বশেষ তারা ইরানের পারমাণবিক চুক্তির জায়গা থেকে বিষয়টি বিবেচনা করেছে।’

সারা দুনিয়ার ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষার অঙ্গীকার নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধে ইসরায়েলের অবস্থান নেওয়ার সঙ্গে ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বার্থও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওয়ার্ল্ড জিউয়িশ কংগ্রেসের এক হিসাব অনুসারে, ২০১৬ সাল ইউক্রেনে অন্তত ৫৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার ইহুদির বাস। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজেও ইহুদি। বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরায়েলি সহায়তা না পেয়ে গত মাসে আক্ষেপ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন জেলেনস্কি। ইসরায়েলের এমন অবস্থানে হতবাক হওয়ার কথা উল্লেখ করে জেলেনস্কি বলেন, ‘ইসরায়েল আমাদের কিছুই দেয়নি। কিছুই না!’

ইউক্রেনের পাশাপাশি রাশিয়ায়ও ইহুদি জনসংখ্যা কম না। বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়ায় অন্তত ১ লাখ ৬৫ হাজার ইহুদির বাস। এর মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর আগস্ট অবধি অন্তত ২০ হাজার ৫০০ জন ইসরায়েলে পাড়ি জমিয়েছেন। ফলে, রুশ ইহুদিদের স্বার্থও ইসরায়েলকে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। ইসরায়েল তা বিবেচনায় নিতে বাধ্য।  ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষক অ্যালেক্স ফিশম্যান বলেন, ‘ইসরায়েলি পররাষ্ট্রনীতির মূল কথাই হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা।’
 
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্তেজ ইউক্রেনকে সাহায্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।এই নৈতিক দায় থেকেই ইসরায়েল ইউক্রেন যুদ্ধে নির্বিকার থাকতে পারেনি। ইসরায়েলি কূটনীতিক অ্যালন লিওল ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘ইয়ের লাপিদ নাফতালি বেনেতের কাছ থেকে গত জুলাইয়ে দায়িত্ব নিয়েই বেশ কিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও হেলমেট পাঠিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করেছিল।’ লিওলের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধে ইসরায়েলের অবস্থান দ্বান্দ্বিক। দেশের অধিকাংশ জনগণই ইউক্রেনের পক্ষে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা নিরাপত্তা ইস্যুতে চাপে আছেন। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর কাছে সিরিয়ার আকাশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

অ্যালন লিওলের মতে, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই ইসরায়েলের সামরিক নীতি নির্ধারকেরা সিরিয়া-ইরানকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। সে অনুসারে ছক কষছে। তবে রাশিয়া সিরিয়ার বেলায় ইসরায়েলকে ছাড় দিলেও ইরানের বিষয়ে কী অবস্থান নেবে তা স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষে যায় তাহলে রাশিয়া যে ভালো চোখে দেখবে না সেটি স্পষ্ট করে বলেছেন সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট ও রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ। মেদভেদেভকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মনে হচ্ছে, ইসরায়েল কিয়েভ সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করবে। এটি খুবই বেপরোয়া পদক্ষেপ। এটি দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ধ্বংস করবে।’

অর্থাৎ মেদভেদেভের হুমকি, ইউক্রেনে আকাশ প্রতিরক্ষা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা সরবরাহে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আগ্রহ, প্রধানমন্ত্রীর নীরব সম্মতি—সব মিলিয়ে আগামী দিনে মস্কো–তেল আবিব সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ থাকবে না, সেটি অনুমান করা যায়।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, ফরেন পলিসি, নিউইয়র্ক টাইমস ও এএফপি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত