রাহুল শর্মা, ঢাকা

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃতী, মেধাবী ও যশস্বী শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ স্বনামখ্যাত। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা কলেজকেও করেছেন গৌরবান্বিত।
আজ ২০ নভেম্বর ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
সদরঘাটের শরণার্থী
ঢাকা নগরীর বিদ্যারণ্যে এক প্রবীণ বৃক্ষ ‘ঢাকা কলেজ’। ডাকাতিয়ার জলে ধোয়া বুড়িগঙ্গার স্মৃতিসিক্ত ইতিহাসের সদরদ্বার ‘ঢাকা কলেজ’। ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মঝড়ে লণ্ডভণ্ড ঢাকাইয়া গৃহস্থরা আঙ্গিনা ছেড়ে নতুন আলোয় আশ্রয় খুঁজে ফেরেন। শুরু হয় সনাতন রেকর্ডে নতুন সুরের লয়। এরই কাঁধে ভর করে ঢাকাতে বেশ ক’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৫ সালের ‘ইংলিশ সেমিনারি স্কুল’, ‘কলেজিয়েট স্কুল’, ১৮৪৮ সালের ‘পোগোজ’ এবং ১৮৬৮ সালের জগন্নাথ স্কুল মূলত রামমোহন রেনেসাঁরই শ্বাস-প্রশ্বাস।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই বুড়িগঙ্গার তটস্থ ঢাকা নগরীর গায় ‘ইংলিশ সেমিনার স্কুল’-এর জন্ম। অনাবিষ্কৃত দ্বীপের পিছিয়ে পড়া মানুষের মাঝে ইংরেজি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেই তৎকালীন সিভিল সার্জন ড. জেমস টেইলর ও ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রান্টের সহযোগিতায় ‘জনশিক্ষা কমিটি’ ইংলিশ সেমিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অগ্র সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন।
১৮৪১ সালে ইংলিশ সেমিনারি স্কুল পোশাক পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘ঢাকা কলেজ’ নাম ধারণ করে। বুড়িগঙ্গার তট ছোঁয়া সদরঘাট ছিল ঢাকা কলেজের শৈশব ক্যাম্পাস। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও ভবনের নকশা করেছিলেন কর্নেল গ্যাসটিন।
সদরঘাট সংলগ্ন এই ভবন বর্তমানে ব্যাংকের লেনদেনে ব্যস্ত। ব্যাংকের দখলদারিত্ব মেনে নিয়ে কলেজটি ১৯০৮ সালে কার্জন হলে অভিবাসিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজ কার্জন হল ছেড়ে এর পূর্বদিকে বর্তমান ফার্মেসি ও কেমিস্ট্রি বিভাগের দালানগুলোতে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ধুতে ‘ঢাকা কলেজ’ তার ডিগ্রি শ্রেণি হারিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনীত হলেও পুনরায় তা উদ্ধারে সমর্থ হয়।
১৯২১ সালের পর কোনো এক সময় ‘ঢাকা কলেজ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিটেমাটি সর্বস্ব দিয়ে পুরোনো হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট) নীড় বাঁধে। ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেনা তাঁবু গ্রাস করে হাইকোর্ট ভবন। নীড়ভাঙা ঢাকা কলেজ ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবন) দালানে কিছুদিন ডানা ঝাপটালেও শিগগিরই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের মরচে ধরা দালানে আশ্রয় পায়।
সরদঘাটের শরণার্থী ‘ঢাকা কলেজ’ নীড় ভাঙার জোয়ার-ভাটায় ভাসতে ভাসতে ১৯৫৫ সালে আপন গৃহের সন্ধান পায় বর্তমান ‘ঢাকা কলেজ’। ১৯৫৫-এর শরণার্থী অতীতকে ইতিহাসবন্দী করে ১৯৫৫ সালে ১৮ একর জমিনের বিস্তৃত ভুবনে সংসার পাতে। ইতিহাসের এই সদর দ্বারে আপনিও আসতে পারেন মিরপুর রোড ধানমণ্ডি ঢাকা ১২০৫-এ ঠিকানায়।
সেদিন দু’জনে...
‘সেদিন দু’জনে (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ) দিয়েছিনু মোরে বিনে সুতায় গাঁথামালা’ রবীন্দ্র আদলে কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইটপাথরে এখনও শোনা যায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নগরীর অরণ্যায়নে আসে ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উত্তরণের সেবা দিতেই ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) নিজেদের ডিগ্রি শ্রেণি ও গ্রন্থাগারে সঞ্চিত বই মুক্তহস্তে তুলে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগন্নাথ হল’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণে এবং ‘ঢাকা হল’ (যা বর্তমানে ফজলুল হক হল নামে পরিচিত) ঢাকা কলেজ স্মরণেরই অর্ঘ্য।
বর্তমানে কার্জন হলের পূর্বপাশে কলেজ রোড মূলত কৃতজ্ঞতার পাথরে খোদাই করা ঢাকা কলেজেরই স্মৃতিচিহ্ন। বই, ছাত্র দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনত হয়েই ক্ষান্ত হয়নি ‘ঢাকা কলেজ’; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত সিন্ধুতে বিসর্জন দিয়েছে ভিটেমাটি সর্বস্ব! এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরের দেহে মিশে আছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো বুড়িগঙ্গার মোহনায়।
পড়েছি প্রভাত বাসে
১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ জে আর আয়ারল্যান্ড (১৮৪১-৪৩)। বর্তমানে যে অধ্যক্ষের অধিনায়কত্বে ইতিহাসের এই সদরদুর্গ শিক্ষার নিয়ন আলোয় আলোকিত হচ্ছে তিনি অধ্যাপক কে এম ইলিয়াস। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর এই তিন ধরনের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে।
১৯৭২ সালে ৬টি বিষয় নিয়ে অনার্স শুরু হলেও ২০২৪-এর কার্নিশে লাগা ঢাকা কলেজে ১৯টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, পরিসংখ্যান, ভূগোল, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, হিসাববিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা ইত্যাদি।
১৮৪১ সালে ২৬০ জন অভিযাত্রীর ঢাকা কলেজ ১৯১৭-১৮ সালে ৯৯৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। শিক্ষক আছেন ২৫০ এবং কর্মচারী ১২০ জন, অর্থাৎ সব মিলিয়ে ঢাকা কলেজের এক নীড়ে প্রায় সাড়ে ২০ হাজার জনের ঘরবসতি।

কলেজের তানপুরা
জীবনের অবিচ্ছিন্ন গানের সুর তোলা ঢাকা কলেজের তানপুরায় আছে রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, সায়েন্স ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, থিয়েটার, বিজ্ঞান ক্লাব, জিমনেসিয়ামসহ ক্যারিয়ারের সকল নার্সারির সমারোহ। এছাড়াও রয়েছে কাউন্সিলিং সেন্টার, মেডিক্যাল সেন্টার, লিটারেরি ক্লাব ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব।
শান্তিকুঞ্জ ঢাকা কলেজের সবুজ চাদর মাড়িয়ে একটু হাঁটলেই স্মৃতির কাড়ি মোড়ানো পরিচ্ছন্ন ক্যানটিন। ক্যানটিন ঘেঁষেই রয়েছে বিস্তৃত পুকুর। পুকুরের কোলে লাল পদ্ম আর সবুজের একাত্মতা দেখে মুখ ফসকে যে কেউই বলে ফেলতে পারেন, ‘নাফের পানি কী নীল! অনন্য তুমি নাফ তুমি ঝরনা... তুমি সুন্দরী ঝরনার। নাফের সুনীল সিক্ত পুকুরের অপর পাড়ে সুমধুর আজানের ধ্বনি ললিত মসজিদ এবং ৭টি ছাত্রাবাস।
‘পশ্চিম ছাত্রাবাস’ স্থাপিত ১৯৬৪ সালে। এখানে শুধু হিন্দু ছাত্রদের বসতি। এরপর রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’। যার দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ২০৯নং কক্ষ। এ কক্ষটি একটি বিশেষ কারণে বিখ্যাত। কারণ এ কক্ষেই জীবনের ভিত গড়েন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল কাইয়ুম। বাংলা সাহিত্যের খ্যতিমান লেখক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৬-২-১৯৯২ থেকে ৪-১-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই লেখকের স্মরণে স্মৃতির তাজমহল ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস’।
স্মরণের সজনে ডাটায় গড়া ‘শহীদ ফরহাদ ছাত্রাবাস।’ জানা যায়, শহীদ ফরহাদ ছিলেন ১৯৯১-৯২ সেশনে দ্বাদশ বিজ্ঞান শ্রেণির ছাত্র। ২৫-৮-১৯৯২ তারিখে নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটে ঘাতকেরা নির্মমভাবে ফরহাদকে হত্যা করে। অকাল প্রয়াত ফরহাদের প্রতি ছাত্রদের বিনীত মস্তক ওই ছাত্রাবাস।
এছাড়াও দক্ষিণ ছাত্রাবাস, উত্তর ছাত্রাবাস ও দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস সন্তানদের বুকে ধারণ করে আছে গভীর মমতায়।
রাজনীতির ঝড়
সদরঘাটের বিরহবাণে ১৮৩৫-এর মুসাফির নগরীর পান্থজন ‘ঢাকা কলেজ’ যুগে যুগে শাসন-শোষণের স্টিমরোলারকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক ঝড়। কালের ধারাবাহিকতায় ঢাকা কলেজ জন্ম দিয়েছে অনেক বিচক্ষণ, তুখোড় রাজনীতিকের-যারা দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক (সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী) ১৯৫৮ সালে এক রাজনৈতিক স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘সামরিক শাসনের স্টিমরোলার থেকে কীভাবে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা যায় এ ব্যাপারে পথ বের করার জন্য কতদিন যে সন্ধ্যার পর কলেজের মাঠে বসে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।... সেদিন আমার সে বিদ্রোহী সত্তা পরবর্তীকালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। বিদ্রোহের এ বীজ আমার মাঝে রোপিত হয়েছে ঢাকা কলেজেই।’
সমাজবিজ্ঞানী ড. নাজমুল করিমের লেখায় ১৯৩৯-৪১ সালে ঢাকা কলেজের রাজনীতি ছুঁয়ে চৈত্রের দাহ বোঝা যায়। ১৯৪১ সালের ‘আল্লাহু আকবর’ আর ‘বন্দে মাতরম’ দাঙ্গা ঢাকা কলেজের রাজনীতিতে বারুদের গন্ধ মেখে দেয়। ১৯৫৮-৬২ সময়ে ঢাকা কলেজের দুর্বার ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের স্মৃতিপত্রে- ‘আজ যেমন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শাখা হিসেবে ঢাকা কলেজ পরিচিত, তখন তেমন ছিল না। ‘পাইওয়ানিয়ার্স’ ও ‘ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট’ এই দুই ফ্লাটফর্মে মিলেমিশে ভাগ হয়েছিল প্রধান দুই ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমর্থকেরা। বাকি নামে যে সংগঠন মাত্র বছর দুয়েক হলো জন্ম নিয়েছিল, তাদের অনুসারীরা ছিল এই দুইয়ের মাঝে। কোনো বিশেষ সংগঠনের প্রাবল্য ছিল না। এই দুটি প্ল্যাটফর্মের কাছে। তবে অন্তঃস্রোত পরিষ্কার বোঝা যেত।’
স্লোগানের জলছাপ
স্লোগান কখনও হারিয়ে যায় না, কিংবা হয় না কখনও বিস্মৃত। স্লোগানকে বলা হয় রাজনীতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইশতেহার। স্লোগান কথা বলে বারুদ স্টেনগান আর তাঁতানো রাইফেলের ভাষায়। ছাত্র সংসদ হচ্ছে সেই তাঁতানো ছাত্র রাজনীতির বোমার আধার। ১৮৩ বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ ঢাকা কলেজের নথিপত্রে ছাত্র সংসদের শিকড় সন্ধান কঠিন বৈকি।
১৯ শতকের শুরুতে ঢাকা কলেজের গায়ে অগ্নিজ্বর উঠলেও তা ছাত্র সংসদ পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল ৫০ বছর। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আবুদর রাজ্জাক ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের লেখা থেকে অনুমান করা যায়, ১৯৫৮-৫৯ সালের দিকে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালে। ১৮৩৫ সালের স্কুল ও ১৮৪১ সালের ‘ঢাকা কলেজ’ ২০২৪ সালের ভ্যানিশিং স্টেশনে। যাত্রী দলে আছে- ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রসমাজ, ছাত্রশিবির ইত্যাদি। তথাপি কষ্টের নীল জঞ্জাল বুকে একাকীত্বের পাথর চোখে তাকিয়ে ছাত্র সংসদ।
বেদনার নীলকণ্ঠ
দেশ ও জাতির দুর্দিনে ‘ঢাকা কলেজ’ দুঃশাসনের মরণ-যন্ত্রণা আর কষ্ট সংগ্রামকে ধারণ করতে করতে নিজেই যেন হয়ে গেছে বেদনার ‘নীলকণ্ঠ’। বাংলার আকাশে যখনই দুর্যোগ আর অশান্তির মেঘ জমেছে ‘ঢাকা কলেজ’ তখন তার সর্বস্ব নিয়ে, লড়াকু বহ্নি হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রণাঙ্গনে।
১৯৩৯-৪৫ সালের মহাযুদ্ধ, ১৯৪১ সালের দোল দাঙ্গা, ১৯৫২ সালে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ভাষা আন্দোলনে, ১৯৫৩ সালের গোলযোগ, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ কলেজের ছাত্ররা ছিল প্রতিশোধের খড়গহস্ত।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের ছাত্রদের ইস্পাত বাহুতে গর্জন করত ‘৭১-এর হাতিয়ার’, তেমনি এখনও শোনা যায় ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাশ কাঁপানো আর্তনাদ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা কলেজের ৮ জন ছাত্র শহীদ হয়েছিলেন। এই ৮ বীর হলেন- শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ আবদুস শিকদার, শহীদ নাজিবুদ্দিন খান, শহীদ আলী আহসান, শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেন, শহীদ নিজামুদ্দিন সাজ্জাদ, শহীদ আজিজুল ইসলাম বাবুল, শহীদ এম এ কাইয়ুম। এই ৮ বীরকে শ্রদ্ধা ও স্মরণের নকশী কাঁথায় জড়িয়ে রাখতেই মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বাম দেয়ালে লেখা আছে বীরদের নাম অঙ্কিত স্মৃতিফলক।
শেষ কথা
কালের আবর্তে ১৮৩ বছর পেরিয়েছে ‘ঢাকা কলেজ’। মেধাধীদের পছন্দের তালিকায় এখনও শীর্ষে ঢাকা কলেজ। অতীতের মতো এখনও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে এই কলেজের ছাত্ররাই। গৌরবের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে আগামী প্রজন্মও এমনই আশাবাদ।

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃতী, মেধাবী ও যশস্বী শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ স্বনামখ্যাত। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা কলেজকেও করেছেন গৌরবান্বিত।
আজ ২০ নভেম্বর ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
সদরঘাটের শরণার্থী
ঢাকা নগরীর বিদ্যারণ্যে এক প্রবীণ বৃক্ষ ‘ঢাকা কলেজ’। ডাকাতিয়ার জলে ধোয়া বুড়িগঙ্গার স্মৃতিসিক্ত ইতিহাসের সদরদ্বার ‘ঢাকা কলেজ’। ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মঝড়ে লণ্ডভণ্ড ঢাকাইয়া গৃহস্থরা আঙ্গিনা ছেড়ে নতুন আলোয় আশ্রয় খুঁজে ফেরেন। শুরু হয় সনাতন রেকর্ডে নতুন সুরের লয়। এরই কাঁধে ভর করে ঢাকাতে বেশ ক’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৫ সালের ‘ইংলিশ সেমিনারি স্কুল’, ‘কলেজিয়েট স্কুল’, ১৮৪৮ সালের ‘পোগোজ’ এবং ১৮৬৮ সালের জগন্নাথ স্কুল মূলত রামমোহন রেনেসাঁরই শ্বাস-প্রশ্বাস।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই বুড়িগঙ্গার তটস্থ ঢাকা নগরীর গায় ‘ইংলিশ সেমিনার স্কুল’-এর জন্ম। অনাবিষ্কৃত দ্বীপের পিছিয়ে পড়া মানুষের মাঝে ইংরেজি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেই তৎকালীন সিভিল সার্জন ড. জেমস টেইলর ও ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রান্টের সহযোগিতায় ‘জনশিক্ষা কমিটি’ ইংলিশ সেমিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অগ্র সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন।
১৮৪১ সালে ইংলিশ সেমিনারি স্কুল পোশাক পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘ঢাকা কলেজ’ নাম ধারণ করে। বুড়িগঙ্গার তট ছোঁয়া সদরঘাট ছিল ঢাকা কলেজের শৈশব ক্যাম্পাস। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও ভবনের নকশা করেছিলেন কর্নেল গ্যাসটিন।
সদরঘাট সংলগ্ন এই ভবন বর্তমানে ব্যাংকের লেনদেনে ব্যস্ত। ব্যাংকের দখলদারিত্ব মেনে নিয়ে কলেজটি ১৯০৮ সালে কার্জন হলে অভিবাসিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজ কার্জন হল ছেড়ে এর পূর্বদিকে বর্তমান ফার্মেসি ও কেমিস্ট্রি বিভাগের দালানগুলোতে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ধুতে ‘ঢাকা কলেজ’ তার ডিগ্রি শ্রেণি হারিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনীত হলেও পুনরায় তা উদ্ধারে সমর্থ হয়।
১৯২১ সালের পর কোনো এক সময় ‘ঢাকা কলেজ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিটেমাটি সর্বস্ব দিয়ে পুরোনো হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট) নীড় বাঁধে। ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেনা তাঁবু গ্রাস করে হাইকোর্ট ভবন। নীড়ভাঙা ঢাকা কলেজ ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবন) দালানে কিছুদিন ডানা ঝাপটালেও শিগগিরই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের মরচে ধরা দালানে আশ্রয় পায়।
সরদঘাটের শরণার্থী ‘ঢাকা কলেজ’ নীড় ভাঙার জোয়ার-ভাটায় ভাসতে ভাসতে ১৯৫৫ সালে আপন গৃহের সন্ধান পায় বর্তমান ‘ঢাকা কলেজ’। ১৯৫৫-এর শরণার্থী অতীতকে ইতিহাসবন্দী করে ১৯৫৫ সালে ১৮ একর জমিনের বিস্তৃত ভুবনে সংসার পাতে। ইতিহাসের এই সদর দ্বারে আপনিও আসতে পারেন মিরপুর রোড ধানমণ্ডি ঢাকা ১২০৫-এ ঠিকানায়।
সেদিন দু’জনে...
‘সেদিন দু’জনে (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ) দিয়েছিনু মোরে বিনে সুতায় গাঁথামালা’ রবীন্দ্র আদলে কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইটপাথরে এখনও শোনা যায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নগরীর অরণ্যায়নে আসে ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উত্তরণের সেবা দিতেই ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) নিজেদের ডিগ্রি শ্রেণি ও গ্রন্থাগারে সঞ্চিত বই মুক্তহস্তে তুলে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগন্নাথ হল’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণে এবং ‘ঢাকা হল’ (যা বর্তমানে ফজলুল হক হল নামে পরিচিত) ঢাকা কলেজ স্মরণেরই অর্ঘ্য।
বর্তমানে কার্জন হলের পূর্বপাশে কলেজ রোড মূলত কৃতজ্ঞতার পাথরে খোদাই করা ঢাকা কলেজেরই স্মৃতিচিহ্ন। বই, ছাত্র দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনত হয়েই ক্ষান্ত হয়নি ‘ঢাকা কলেজ’; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত সিন্ধুতে বিসর্জন দিয়েছে ভিটেমাটি সর্বস্ব! এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরের দেহে মিশে আছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো বুড়িগঙ্গার মোহনায়।
পড়েছি প্রভাত বাসে
১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ জে আর আয়ারল্যান্ড (১৮৪১-৪৩)। বর্তমানে যে অধ্যক্ষের অধিনায়কত্বে ইতিহাসের এই সদরদুর্গ শিক্ষার নিয়ন আলোয় আলোকিত হচ্ছে তিনি অধ্যাপক কে এম ইলিয়াস। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর এই তিন ধরনের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে।
১৯৭২ সালে ৬টি বিষয় নিয়ে অনার্স শুরু হলেও ২০২৪-এর কার্নিশে লাগা ঢাকা কলেজে ১৯টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, পরিসংখ্যান, ভূগোল, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, হিসাববিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা ইত্যাদি।
১৮৪১ সালে ২৬০ জন অভিযাত্রীর ঢাকা কলেজ ১৯১৭-১৮ সালে ৯৯৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। শিক্ষক আছেন ২৫০ এবং কর্মচারী ১২০ জন, অর্থাৎ সব মিলিয়ে ঢাকা কলেজের এক নীড়ে প্রায় সাড়ে ২০ হাজার জনের ঘরবসতি।

কলেজের তানপুরা
জীবনের অবিচ্ছিন্ন গানের সুর তোলা ঢাকা কলেজের তানপুরায় আছে রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, সায়েন্স ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, থিয়েটার, বিজ্ঞান ক্লাব, জিমনেসিয়ামসহ ক্যারিয়ারের সকল নার্সারির সমারোহ। এছাড়াও রয়েছে কাউন্সিলিং সেন্টার, মেডিক্যাল সেন্টার, লিটারেরি ক্লাব ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব।
শান্তিকুঞ্জ ঢাকা কলেজের সবুজ চাদর মাড়িয়ে একটু হাঁটলেই স্মৃতির কাড়ি মোড়ানো পরিচ্ছন্ন ক্যানটিন। ক্যানটিন ঘেঁষেই রয়েছে বিস্তৃত পুকুর। পুকুরের কোলে লাল পদ্ম আর সবুজের একাত্মতা দেখে মুখ ফসকে যে কেউই বলে ফেলতে পারেন, ‘নাফের পানি কী নীল! অনন্য তুমি নাফ তুমি ঝরনা... তুমি সুন্দরী ঝরনার। নাফের সুনীল সিক্ত পুকুরের অপর পাড়ে সুমধুর আজানের ধ্বনি ললিত মসজিদ এবং ৭টি ছাত্রাবাস।
‘পশ্চিম ছাত্রাবাস’ স্থাপিত ১৯৬৪ সালে। এখানে শুধু হিন্দু ছাত্রদের বসতি। এরপর রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’। যার দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ২০৯নং কক্ষ। এ কক্ষটি একটি বিশেষ কারণে বিখ্যাত। কারণ এ কক্ষেই জীবনের ভিত গড়েন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল কাইয়ুম। বাংলা সাহিত্যের খ্যতিমান লেখক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৬-২-১৯৯২ থেকে ৪-১-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই লেখকের স্মরণে স্মৃতির তাজমহল ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস’।
স্মরণের সজনে ডাটায় গড়া ‘শহীদ ফরহাদ ছাত্রাবাস।’ জানা যায়, শহীদ ফরহাদ ছিলেন ১৯৯১-৯২ সেশনে দ্বাদশ বিজ্ঞান শ্রেণির ছাত্র। ২৫-৮-১৯৯২ তারিখে নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটে ঘাতকেরা নির্মমভাবে ফরহাদকে হত্যা করে। অকাল প্রয়াত ফরহাদের প্রতি ছাত্রদের বিনীত মস্তক ওই ছাত্রাবাস।
এছাড়াও দক্ষিণ ছাত্রাবাস, উত্তর ছাত্রাবাস ও দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস সন্তানদের বুকে ধারণ করে আছে গভীর মমতায়।
রাজনীতির ঝড়
সদরঘাটের বিরহবাণে ১৮৩৫-এর মুসাফির নগরীর পান্থজন ‘ঢাকা কলেজ’ যুগে যুগে শাসন-শোষণের স্টিমরোলারকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক ঝড়। কালের ধারাবাহিকতায় ঢাকা কলেজ জন্ম দিয়েছে অনেক বিচক্ষণ, তুখোড় রাজনীতিকের-যারা দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক (সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী) ১৯৫৮ সালে এক রাজনৈতিক স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘সামরিক শাসনের স্টিমরোলার থেকে কীভাবে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা যায় এ ব্যাপারে পথ বের করার জন্য কতদিন যে সন্ধ্যার পর কলেজের মাঠে বসে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।... সেদিন আমার সে বিদ্রোহী সত্তা পরবর্তীকালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। বিদ্রোহের এ বীজ আমার মাঝে রোপিত হয়েছে ঢাকা কলেজেই।’
সমাজবিজ্ঞানী ড. নাজমুল করিমের লেখায় ১৯৩৯-৪১ সালে ঢাকা কলেজের রাজনীতি ছুঁয়ে চৈত্রের দাহ বোঝা যায়। ১৯৪১ সালের ‘আল্লাহু আকবর’ আর ‘বন্দে মাতরম’ দাঙ্গা ঢাকা কলেজের রাজনীতিতে বারুদের গন্ধ মেখে দেয়। ১৯৫৮-৬২ সময়ে ঢাকা কলেজের দুর্বার ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের স্মৃতিপত্রে- ‘আজ যেমন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শাখা হিসেবে ঢাকা কলেজ পরিচিত, তখন তেমন ছিল না। ‘পাইওয়ানিয়ার্স’ ও ‘ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট’ এই দুই ফ্লাটফর্মে মিলেমিশে ভাগ হয়েছিল প্রধান দুই ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমর্থকেরা। বাকি নামে যে সংগঠন মাত্র বছর দুয়েক হলো জন্ম নিয়েছিল, তাদের অনুসারীরা ছিল এই দুইয়ের মাঝে। কোনো বিশেষ সংগঠনের প্রাবল্য ছিল না। এই দুটি প্ল্যাটফর্মের কাছে। তবে অন্তঃস্রোত পরিষ্কার বোঝা যেত।’
স্লোগানের জলছাপ
স্লোগান কখনও হারিয়ে যায় না, কিংবা হয় না কখনও বিস্মৃত। স্লোগানকে বলা হয় রাজনীতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইশতেহার। স্লোগান কথা বলে বারুদ স্টেনগান আর তাঁতানো রাইফেলের ভাষায়। ছাত্র সংসদ হচ্ছে সেই তাঁতানো ছাত্র রাজনীতির বোমার আধার। ১৮৩ বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ ঢাকা কলেজের নথিপত্রে ছাত্র সংসদের শিকড় সন্ধান কঠিন বৈকি।
১৯ শতকের শুরুতে ঢাকা কলেজের গায়ে অগ্নিজ্বর উঠলেও তা ছাত্র সংসদ পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল ৫০ বছর। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আবুদর রাজ্জাক ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের লেখা থেকে অনুমান করা যায়, ১৯৫৮-৫৯ সালের দিকে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালে। ১৮৩৫ সালের স্কুল ও ১৮৪১ সালের ‘ঢাকা কলেজ’ ২০২৪ সালের ভ্যানিশিং স্টেশনে। যাত্রী দলে আছে- ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রসমাজ, ছাত্রশিবির ইত্যাদি। তথাপি কষ্টের নীল জঞ্জাল বুকে একাকীত্বের পাথর চোখে তাকিয়ে ছাত্র সংসদ।
বেদনার নীলকণ্ঠ
দেশ ও জাতির দুর্দিনে ‘ঢাকা কলেজ’ দুঃশাসনের মরণ-যন্ত্রণা আর কষ্ট সংগ্রামকে ধারণ করতে করতে নিজেই যেন হয়ে গেছে বেদনার ‘নীলকণ্ঠ’। বাংলার আকাশে যখনই দুর্যোগ আর অশান্তির মেঘ জমেছে ‘ঢাকা কলেজ’ তখন তার সর্বস্ব নিয়ে, লড়াকু বহ্নি হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রণাঙ্গনে।
১৯৩৯-৪৫ সালের মহাযুদ্ধ, ১৯৪১ সালের দোল দাঙ্গা, ১৯৫২ সালে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ভাষা আন্দোলনে, ১৯৫৩ সালের গোলযোগ, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ কলেজের ছাত্ররা ছিল প্রতিশোধের খড়গহস্ত।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের ছাত্রদের ইস্পাত বাহুতে গর্জন করত ‘৭১-এর হাতিয়ার’, তেমনি এখনও শোনা যায় ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাশ কাঁপানো আর্তনাদ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা কলেজের ৮ জন ছাত্র শহীদ হয়েছিলেন। এই ৮ বীর হলেন- শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ আবদুস শিকদার, শহীদ নাজিবুদ্দিন খান, শহীদ আলী আহসান, শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেন, শহীদ নিজামুদ্দিন সাজ্জাদ, শহীদ আজিজুল ইসলাম বাবুল, শহীদ এম এ কাইয়ুম। এই ৮ বীরকে শ্রদ্ধা ও স্মরণের নকশী কাঁথায় জড়িয়ে রাখতেই মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বাম দেয়ালে লেখা আছে বীরদের নাম অঙ্কিত স্মৃতিফলক।
শেষ কথা
কালের আবর্তে ১৮৩ বছর পেরিয়েছে ‘ঢাকা কলেজ’। মেধাধীদের পছন্দের তালিকায় এখনও শীর্ষে ঢাকা কলেজ। অতীতের মতো এখনও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে এই কলেজের ছাত্ররাই। গৌরবের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে আগামী প্রজন্মও এমনই আশাবাদ।
রাহুল শর্মা, ঢাকা

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃতী, মেধাবী ও যশস্বী শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ স্বনামখ্যাত। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা কলেজকেও করেছেন গৌরবান্বিত।
আজ ২০ নভেম্বর ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
সদরঘাটের শরণার্থী
ঢাকা নগরীর বিদ্যারণ্যে এক প্রবীণ বৃক্ষ ‘ঢাকা কলেজ’। ডাকাতিয়ার জলে ধোয়া বুড়িগঙ্গার স্মৃতিসিক্ত ইতিহাসের সদরদ্বার ‘ঢাকা কলেজ’। ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মঝড়ে লণ্ডভণ্ড ঢাকাইয়া গৃহস্থরা আঙ্গিনা ছেড়ে নতুন আলোয় আশ্রয় খুঁজে ফেরেন। শুরু হয় সনাতন রেকর্ডে নতুন সুরের লয়। এরই কাঁধে ভর করে ঢাকাতে বেশ ক’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৫ সালের ‘ইংলিশ সেমিনারি স্কুল’, ‘কলেজিয়েট স্কুল’, ১৮৪৮ সালের ‘পোগোজ’ এবং ১৮৬৮ সালের জগন্নাথ স্কুল মূলত রামমোহন রেনেসাঁরই শ্বাস-প্রশ্বাস।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই বুড়িগঙ্গার তটস্থ ঢাকা নগরীর গায় ‘ইংলিশ সেমিনার স্কুল’-এর জন্ম। অনাবিষ্কৃত দ্বীপের পিছিয়ে পড়া মানুষের মাঝে ইংরেজি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেই তৎকালীন সিভিল সার্জন ড. জেমস টেইলর ও ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রান্টের সহযোগিতায় ‘জনশিক্ষা কমিটি’ ইংলিশ সেমিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অগ্র সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন।
১৮৪১ সালে ইংলিশ সেমিনারি স্কুল পোশাক পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘ঢাকা কলেজ’ নাম ধারণ করে। বুড়িগঙ্গার তট ছোঁয়া সদরঘাট ছিল ঢাকা কলেজের শৈশব ক্যাম্পাস। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও ভবনের নকশা করেছিলেন কর্নেল গ্যাসটিন।
সদরঘাট সংলগ্ন এই ভবন বর্তমানে ব্যাংকের লেনদেনে ব্যস্ত। ব্যাংকের দখলদারিত্ব মেনে নিয়ে কলেজটি ১৯০৮ সালে কার্জন হলে অভিবাসিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজ কার্জন হল ছেড়ে এর পূর্বদিকে বর্তমান ফার্মেসি ও কেমিস্ট্রি বিভাগের দালানগুলোতে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ধুতে ‘ঢাকা কলেজ’ তার ডিগ্রি শ্রেণি হারিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনীত হলেও পুনরায় তা উদ্ধারে সমর্থ হয়।
১৯২১ সালের পর কোনো এক সময় ‘ঢাকা কলেজ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিটেমাটি সর্বস্ব দিয়ে পুরোনো হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট) নীড় বাঁধে। ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেনা তাঁবু গ্রাস করে হাইকোর্ট ভবন। নীড়ভাঙা ঢাকা কলেজ ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবন) দালানে কিছুদিন ডানা ঝাপটালেও শিগগিরই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের মরচে ধরা দালানে আশ্রয় পায়।
সরদঘাটের শরণার্থী ‘ঢাকা কলেজ’ নীড় ভাঙার জোয়ার-ভাটায় ভাসতে ভাসতে ১৯৫৫ সালে আপন গৃহের সন্ধান পায় বর্তমান ‘ঢাকা কলেজ’। ১৯৫৫-এর শরণার্থী অতীতকে ইতিহাসবন্দী করে ১৯৫৫ সালে ১৮ একর জমিনের বিস্তৃত ভুবনে সংসার পাতে। ইতিহাসের এই সদর দ্বারে আপনিও আসতে পারেন মিরপুর রোড ধানমণ্ডি ঢাকা ১২০৫-এ ঠিকানায়।
সেদিন দু’জনে...
‘সেদিন দু’জনে (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ) দিয়েছিনু মোরে বিনে সুতায় গাঁথামালা’ রবীন্দ্র আদলে কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইটপাথরে এখনও শোনা যায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নগরীর অরণ্যায়নে আসে ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উত্তরণের সেবা দিতেই ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) নিজেদের ডিগ্রি শ্রেণি ও গ্রন্থাগারে সঞ্চিত বই মুক্তহস্তে তুলে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগন্নাথ হল’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণে এবং ‘ঢাকা হল’ (যা বর্তমানে ফজলুল হক হল নামে পরিচিত) ঢাকা কলেজ স্মরণেরই অর্ঘ্য।
বর্তমানে কার্জন হলের পূর্বপাশে কলেজ রোড মূলত কৃতজ্ঞতার পাথরে খোদাই করা ঢাকা কলেজেরই স্মৃতিচিহ্ন। বই, ছাত্র দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনত হয়েই ক্ষান্ত হয়নি ‘ঢাকা কলেজ’; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত সিন্ধুতে বিসর্জন দিয়েছে ভিটেমাটি সর্বস্ব! এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরের দেহে মিশে আছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো বুড়িগঙ্গার মোহনায়।
পড়েছি প্রভাত বাসে
১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ জে আর আয়ারল্যান্ড (১৮৪১-৪৩)। বর্তমানে যে অধ্যক্ষের অধিনায়কত্বে ইতিহাসের এই সদরদুর্গ শিক্ষার নিয়ন আলোয় আলোকিত হচ্ছে তিনি অধ্যাপক কে এম ইলিয়াস। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর এই তিন ধরনের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে।
১৯৭২ সালে ৬টি বিষয় নিয়ে অনার্স শুরু হলেও ২০২৪-এর কার্নিশে লাগা ঢাকা কলেজে ১৯টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, পরিসংখ্যান, ভূগোল, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, হিসাববিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা ইত্যাদি।
১৮৪১ সালে ২৬০ জন অভিযাত্রীর ঢাকা কলেজ ১৯১৭-১৮ সালে ৯৯৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। শিক্ষক আছেন ২৫০ এবং কর্মচারী ১২০ জন, অর্থাৎ সব মিলিয়ে ঢাকা কলেজের এক নীড়ে প্রায় সাড়ে ২০ হাজার জনের ঘরবসতি।

কলেজের তানপুরা
জীবনের অবিচ্ছিন্ন গানের সুর তোলা ঢাকা কলেজের তানপুরায় আছে রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, সায়েন্স ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, থিয়েটার, বিজ্ঞান ক্লাব, জিমনেসিয়ামসহ ক্যারিয়ারের সকল নার্সারির সমারোহ। এছাড়াও রয়েছে কাউন্সিলিং সেন্টার, মেডিক্যাল সেন্টার, লিটারেরি ক্লাব ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব।
শান্তিকুঞ্জ ঢাকা কলেজের সবুজ চাদর মাড়িয়ে একটু হাঁটলেই স্মৃতির কাড়ি মোড়ানো পরিচ্ছন্ন ক্যানটিন। ক্যানটিন ঘেঁষেই রয়েছে বিস্তৃত পুকুর। পুকুরের কোলে লাল পদ্ম আর সবুজের একাত্মতা দেখে মুখ ফসকে যে কেউই বলে ফেলতে পারেন, ‘নাফের পানি কী নীল! অনন্য তুমি নাফ তুমি ঝরনা... তুমি সুন্দরী ঝরনার। নাফের সুনীল সিক্ত পুকুরের অপর পাড়ে সুমধুর আজানের ধ্বনি ললিত মসজিদ এবং ৭টি ছাত্রাবাস।
‘পশ্চিম ছাত্রাবাস’ স্থাপিত ১৯৬৪ সালে। এখানে শুধু হিন্দু ছাত্রদের বসতি। এরপর রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’। যার দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ২০৯নং কক্ষ। এ কক্ষটি একটি বিশেষ কারণে বিখ্যাত। কারণ এ কক্ষেই জীবনের ভিত গড়েন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল কাইয়ুম। বাংলা সাহিত্যের খ্যতিমান লেখক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৬-২-১৯৯২ থেকে ৪-১-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই লেখকের স্মরণে স্মৃতির তাজমহল ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস’।
স্মরণের সজনে ডাটায় গড়া ‘শহীদ ফরহাদ ছাত্রাবাস।’ জানা যায়, শহীদ ফরহাদ ছিলেন ১৯৯১-৯২ সেশনে দ্বাদশ বিজ্ঞান শ্রেণির ছাত্র। ২৫-৮-১৯৯২ তারিখে নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটে ঘাতকেরা নির্মমভাবে ফরহাদকে হত্যা করে। অকাল প্রয়াত ফরহাদের প্রতি ছাত্রদের বিনীত মস্তক ওই ছাত্রাবাস।
এছাড়াও দক্ষিণ ছাত্রাবাস, উত্তর ছাত্রাবাস ও দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস সন্তানদের বুকে ধারণ করে আছে গভীর মমতায়।
রাজনীতির ঝড়
সদরঘাটের বিরহবাণে ১৮৩৫-এর মুসাফির নগরীর পান্থজন ‘ঢাকা কলেজ’ যুগে যুগে শাসন-শোষণের স্টিমরোলারকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক ঝড়। কালের ধারাবাহিকতায় ঢাকা কলেজ জন্ম দিয়েছে অনেক বিচক্ষণ, তুখোড় রাজনীতিকের-যারা দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক (সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী) ১৯৫৮ সালে এক রাজনৈতিক স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘সামরিক শাসনের স্টিমরোলার থেকে কীভাবে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা যায় এ ব্যাপারে পথ বের করার জন্য কতদিন যে সন্ধ্যার পর কলেজের মাঠে বসে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।... সেদিন আমার সে বিদ্রোহী সত্তা পরবর্তীকালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। বিদ্রোহের এ বীজ আমার মাঝে রোপিত হয়েছে ঢাকা কলেজেই।’
সমাজবিজ্ঞানী ড. নাজমুল করিমের লেখায় ১৯৩৯-৪১ সালে ঢাকা কলেজের রাজনীতি ছুঁয়ে চৈত্রের দাহ বোঝা যায়। ১৯৪১ সালের ‘আল্লাহু আকবর’ আর ‘বন্দে মাতরম’ দাঙ্গা ঢাকা কলেজের রাজনীতিতে বারুদের গন্ধ মেখে দেয়। ১৯৫৮-৬২ সময়ে ঢাকা কলেজের দুর্বার ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের স্মৃতিপত্রে- ‘আজ যেমন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শাখা হিসেবে ঢাকা কলেজ পরিচিত, তখন তেমন ছিল না। ‘পাইওয়ানিয়ার্স’ ও ‘ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট’ এই দুই ফ্লাটফর্মে মিলেমিশে ভাগ হয়েছিল প্রধান দুই ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমর্থকেরা। বাকি নামে যে সংগঠন মাত্র বছর দুয়েক হলো জন্ম নিয়েছিল, তাদের অনুসারীরা ছিল এই দুইয়ের মাঝে। কোনো বিশেষ সংগঠনের প্রাবল্য ছিল না। এই দুটি প্ল্যাটফর্মের কাছে। তবে অন্তঃস্রোত পরিষ্কার বোঝা যেত।’
স্লোগানের জলছাপ
স্লোগান কখনও হারিয়ে যায় না, কিংবা হয় না কখনও বিস্মৃত। স্লোগানকে বলা হয় রাজনীতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইশতেহার। স্লোগান কথা বলে বারুদ স্টেনগান আর তাঁতানো রাইফেলের ভাষায়। ছাত্র সংসদ হচ্ছে সেই তাঁতানো ছাত্র রাজনীতির বোমার আধার। ১৮৩ বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ ঢাকা কলেজের নথিপত্রে ছাত্র সংসদের শিকড় সন্ধান কঠিন বৈকি।
১৯ শতকের শুরুতে ঢাকা কলেজের গায়ে অগ্নিজ্বর উঠলেও তা ছাত্র সংসদ পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল ৫০ বছর। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আবুদর রাজ্জাক ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের লেখা থেকে অনুমান করা যায়, ১৯৫৮-৫৯ সালের দিকে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালে। ১৮৩৫ সালের স্কুল ও ১৮৪১ সালের ‘ঢাকা কলেজ’ ২০২৪ সালের ভ্যানিশিং স্টেশনে। যাত্রী দলে আছে- ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রসমাজ, ছাত্রশিবির ইত্যাদি। তথাপি কষ্টের নীল জঞ্জাল বুকে একাকীত্বের পাথর চোখে তাকিয়ে ছাত্র সংসদ।
বেদনার নীলকণ্ঠ
দেশ ও জাতির দুর্দিনে ‘ঢাকা কলেজ’ দুঃশাসনের মরণ-যন্ত্রণা আর কষ্ট সংগ্রামকে ধারণ করতে করতে নিজেই যেন হয়ে গেছে বেদনার ‘নীলকণ্ঠ’। বাংলার আকাশে যখনই দুর্যোগ আর অশান্তির মেঘ জমেছে ‘ঢাকা কলেজ’ তখন তার সর্বস্ব নিয়ে, লড়াকু বহ্নি হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রণাঙ্গনে।
১৯৩৯-৪৫ সালের মহাযুদ্ধ, ১৯৪১ সালের দোল দাঙ্গা, ১৯৫২ সালে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ভাষা আন্দোলনে, ১৯৫৩ সালের গোলযোগ, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ কলেজের ছাত্ররা ছিল প্রতিশোধের খড়গহস্ত।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের ছাত্রদের ইস্পাত বাহুতে গর্জন করত ‘৭১-এর হাতিয়ার’, তেমনি এখনও শোনা যায় ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাশ কাঁপানো আর্তনাদ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা কলেজের ৮ জন ছাত্র শহীদ হয়েছিলেন। এই ৮ বীর হলেন- শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ আবদুস শিকদার, শহীদ নাজিবুদ্দিন খান, শহীদ আলী আহসান, শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেন, শহীদ নিজামুদ্দিন সাজ্জাদ, শহীদ আজিজুল ইসলাম বাবুল, শহীদ এম এ কাইয়ুম। এই ৮ বীরকে শ্রদ্ধা ও স্মরণের নকশী কাঁথায় জড়িয়ে রাখতেই মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বাম দেয়ালে লেখা আছে বীরদের নাম অঙ্কিত স্মৃতিফলক।
শেষ কথা
কালের আবর্তে ১৮৩ বছর পেরিয়েছে ‘ঢাকা কলেজ’। মেধাধীদের পছন্দের তালিকায় এখনও শীর্ষে ঢাকা কলেজ। অতীতের মতো এখনও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে এই কলেজের ছাত্ররাই। গৌরবের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে আগামী প্রজন্মও এমনই আশাবাদ।

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃতী, মেধাবী ও যশস্বী শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ স্বনামখ্যাত। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা কলেজকেও করেছেন গৌরবান্বিত।
আজ ২০ নভেম্বর ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
সদরঘাটের শরণার্থী
ঢাকা নগরীর বিদ্যারণ্যে এক প্রবীণ বৃক্ষ ‘ঢাকা কলেজ’। ডাকাতিয়ার জলে ধোয়া বুড়িগঙ্গার স্মৃতিসিক্ত ইতিহাসের সদরদ্বার ‘ঢাকা কলেজ’। ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মঝড়ে লণ্ডভণ্ড ঢাকাইয়া গৃহস্থরা আঙ্গিনা ছেড়ে নতুন আলোয় আশ্রয় খুঁজে ফেরেন। শুরু হয় সনাতন রেকর্ডে নতুন সুরের লয়। এরই কাঁধে ভর করে ঢাকাতে বেশ ক’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৫ সালের ‘ইংলিশ সেমিনারি স্কুল’, ‘কলেজিয়েট স্কুল’, ১৮৪৮ সালের ‘পোগোজ’ এবং ১৮৬৮ সালের জগন্নাথ স্কুল মূলত রামমোহন রেনেসাঁরই শ্বাস-প্রশ্বাস।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই বুড়িগঙ্গার তটস্থ ঢাকা নগরীর গায় ‘ইংলিশ সেমিনার স্কুল’-এর জন্ম। অনাবিষ্কৃত দ্বীপের পিছিয়ে পড়া মানুষের মাঝে ইংরেজি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেই তৎকালীন সিভিল সার্জন ড. জেমস টেইলর ও ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রান্টের সহযোগিতায় ‘জনশিক্ষা কমিটি’ ইংলিশ সেমিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অগ্র সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন।
১৮৪১ সালে ইংলিশ সেমিনারি স্কুল পোশাক পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘ঢাকা কলেজ’ নাম ধারণ করে। বুড়িগঙ্গার তট ছোঁয়া সদরঘাট ছিল ঢাকা কলেজের শৈশব ক্যাম্পাস। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও ভবনের নকশা করেছিলেন কর্নেল গ্যাসটিন।
সদরঘাট সংলগ্ন এই ভবন বর্তমানে ব্যাংকের লেনদেনে ব্যস্ত। ব্যাংকের দখলদারিত্ব মেনে নিয়ে কলেজটি ১৯০৮ সালে কার্জন হলে অভিবাসিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজ কার্জন হল ছেড়ে এর পূর্বদিকে বর্তমান ফার্মেসি ও কেমিস্ট্রি বিভাগের দালানগুলোতে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ধুতে ‘ঢাকা কলেজ’ তার ডিগ্রি শ্রেণি হারিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনীত হলেও পুনরায় তা উদ্ধারে সমর্থ হয়।
১৯২১ সালের পর কোনো এক সময় ‘ঢাকা কলেজ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিটেমাটি সর্বস্ব দিয়ে পুরোনো হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট) নীড় বাঁধে। ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেনা তাঁবু গ্রাস করে হাইকোর্ট ভবন। নীড়ভাঙা ঢাকা কলেজ ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবন) দালানে কিছুদিন ডানা ঝাপটালেও শিগগিরই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের মরচে ধরা দালানে আশ্রয় পায়।
সরদঘাটের শরণার্থী ‘ঢাকা কলেজ’ নীড় ভাঙার জোয়ার-ভাটায় ভাসতে ভাসতে ১৯৫৫ সালে আপন গৃহের সন্ধান পায় বর্তমান ‘ঢাকা কলেজ’। ১৯৫৫-এর শরণার্থী অতীতকে ইতিহাসবন্দী করে ১৯৫৫ সালে ১৮ একর জমিনের বিস্তৃত ভুবনে সংসার পাতে। ইতিহাসের এই সদর দ্বারে আপনিও আসতে পারেন মিরপুর রোড ধানমণ্ডি ঢাকা ১২০৫-এ ঠিকানায়।
সেদিন দু’জনে...
‘সেদিন দু’জনে (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ) দিয়েছিনু মোরে বিনে সুতায় গাঁথামালা’ রবীন্দ্র আদলে কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইটপাথরে এখনও শোনা যায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নগরীর অরণ্যায়নে আসে ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উত্তরণের সেবা দিতেই ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) নিজেদের ডিগ্রি শ্রেণি ও গ্রন্থাগারে সঞ্চিত বই মুক্তহস্তে তুলে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগন্নাথ হল’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণে এবং ‘ঢাকা হল’ (যা বর্তমানে ফজলুল হক হল নামে পরিচিত) ঢাকা কলেজ স্মরণেরই অর্ঘ্য।
বর্তমানে কার্জন হলের পূর্বপাশে কলেজ রোড মূলত কৃতজ্ঞতার পাথরে খোদাই করা ঢাকা কলেজেরই স্মৃতিচিহ্ন। বই, ছাত্র দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনত হয়েই ক্ষান্ত হয়নি ‘ঢাকা কলেজ’; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত সিন্ধুতে বিসর্জন দিয়েছে ভিটেমাটি সর্বস্ব! এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরের দেহে মিশে আছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো বুড়িগঙ্গার মোহনায়।
পড়েছি প্রভাত বাসে
১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ জে আর আয়ারল্যান্ড (১৮৪১-৪৩)। বর্তমানে যে অধ্যক্ষের অধিনায়কত্বে ইতিহাসের এই সদরদুর্গ শিক্ষার নিয়ন আলোয় আলোকিত হচ্ছে তিনি অধ্যাপক কে এম ইলিয়াস। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর এই তিন ধরনের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে।
১৯৭২ সালে ৬টি বিষয় নিয়ে অনার্স শুরু হলেও ২০২৪-এর কার্নিশে লাগা ঢাকা কলেজে ১৯টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, পরিসংখ্যান, ভূগোল, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, হিসাববিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা ইত্যাদি।
১৮৪১ সালে ২৬০ জন অভিযাত্রীর ঢাকা কলেজ ১৯১৭-১৮ সালে ৯৯৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। শিক্ষক আছেন ২৫০ এবং কর্মচারী ১২০ জন, অর্থাৎ সব মিলিয়ে ঢাকা কলেজের এক নীড়ে প্রায় সাড়ে ২০ হাজার জনের ঘরবসতি।

কলেজের তানপুরা
জীবনের অবিচ্ছিন্ন গানের সুর তোলা ঢাকা কলেজের তানপুরায় আছে রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, সায়েন্স ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, থিয়েটার, বিজ্ঞান ক্লাব, জিমনেসিয়ামসহ ক্যারিয়ারের সকল নার্সারির সমারোহ। এছাড়াও রয়েছে কাউন্সিলিং সেন্টার, মেডিক্যাল সেন্টার, লিটারেরি ক্লাব ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব।
শান্তিকুঞ্জ ঢাকা কলেজের সবুজ চাদর মাড়িয়ে একটু হাঁটলেই স্মৃতির কাড়ি মোড়ানো পরিচ্ছন্ন ক্যানটিন। ক্যানটিন ঘেঁষেই রয়েছে বিস্তৃত পুকুর। পুকুরের কোলে লাল পদ্ম আর সবুজের একাত্মতা দেখে মুখ ফসকে যে কেউই বলে ফেলতে পারেন, ‘নাফের পানি কী নীল! অনন্য তুমি নাফ তুমি ঝরনা... তুমি সুন্দরী ঝরনার। নাফের সুনীল সিক্ত পুকুরের অপর পাড়ে সুমধুর আজানের ধ্বনি ললিত মসজিদ এবং ৭টি ছাত্রাবাস।
‘পশ্চিম ছাত্রাবাস’ স্থাপিত ১৯৬৪ সালে। এখানে শুধু হিন্দু ছাত্রদের বসতি। এরপর রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’। যার দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ২০৯নং কক্ষ। এ কক্ষটি একটি বিশেষ কারণে বিখ্যাত। কারণ এ কক্ষেই জীবনের ভিত গড়েন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল কাইয়ুম। বাংলা সাহিত্যের খ্যতিমান লেখক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৬-২-১৯৯২ থেকে ৪-১-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই লেখকের স্মরণে স্মৃতির তাজমহল ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস’।
স্মরণের সজনে ডাটায় গড়া ‘শহীদ ফরহাদ ছাত্রাবাস।’ জানা যায়, শহীদ ফরহাদ ছিলেন ১৯৯১-৯২ সেশনে দ্বাদশ বিজ্ঞান শ্রেণির ছাত্র। ২৫-৮-১৯৯২ তারিখে নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটে ঘাতকেরা নির্মমভাবে ফরহাদকে হত্যা করে। অকাল প্রয়াত ফরহাদের প্রতি ছাত্রদের বিনীত মস্তক ওই ছাত্রাবাস।
এছাড়াও দক্ষিণ ছাত্রাবাস, উত্তর ছাত্রাবাস ও দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস সন্তানদের বুকে ধারণ করে আছে গভীর মমতায়।
রাজনীতির ঝড়
সদরঘাটের বিরহবাণে ১৮৩৫-এর মুসাফির নগরীর পান্থজন ‘ঢাকা কলেজ’ যুগে যুগে শাসন-শোষণের স্টিমরোলারকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক ঝড়। কালের ধারাবাহিকতায় ঢাকা কলেজ জন্ম দিয়েছে অনেক বিচক্ষণ, তুখোড় রাজনীতিকের-যারা দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক (সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী) ১৯৫৮ সালে এক রাজনৈতিক স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘সামরিক শাসনের স্টিমরোলার থেকে কীভাবে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা যায় এ ব্যাপারে পথ বের করার জন্য কতদিন যে সন্ধ্যার পর কলেজের মাঠে বসে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।... সেদিন আমার সে বিদ্রোহী সত্তা পরবর্তীকালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। বিদ্রোহের এ বীজ আমার মাঝে রোপিত হয়েছে ঢাকা কলেজেই।’
সমাজবিজ্ঞানী ড. নাজমুল করিমের লেখায় ১৯৩৯-৪১ সালে ঢাকা কলেজের রাজনীতি ছুঁয়ে চৈত্রের দাহ বোঝা যায়। ১৯৪১ সালের ‘আল্লাহু আকবর’ আর ‘বন্দে মাতরম’ দাঙ্গা ঢাকা কলেজের রাজনীতিতে বারুদের গন্ধ মেখে দেয়। ১৯৫৮-৬২ সময়ে ঢাকা কলেজের দুর্বার ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের স্মৃতিপত্রে- ‘আজ যেমন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শাখা হিসেবে ঢাকা কলেজ পরিচিত, তখন তেমন ছিল না। ‘পাইওয়ানিয়ার্স’ ও ‘ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট’ এই দুই ফ্লাটফর্মে মিলেমিশে ভাগ হয়েছিল প্রধান দুই ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমর্থকেরা। বাকি নামে যে সংগঠন মাত্র বছর দুয়েক হলো জন্ম নিয়েছিল, তাদের অনুসারীরা ছিল এই দুইয়ের মাঝে। কোনো বিশেষ সংগঠনের প্রাবল্য ছিল না। এই দুটি প্ল্যাটফর্মের কাছে। তবে অন্তঃস্রোত পরিষ্কার বোঝা যেত।’
স্লোগানের জলছাপ
স্লোগান কখনও হারিয়ে যায় না, কিংবা হয় না কখনও বিস্মৃত। স্লোগানকে বলা হয় রাজনীতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইশতেহার। স্লোগান কথা বলে বারুদ স্টেনগান আর তাঁতানো রাইফেলের ভাষায়। ছাত্র সংসদ হচ্ছে সেই তাঁতানো ছাত্র রাজনীতির বোমার আধার। ১৮৩ বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ ঢাকা কলেজের নথিপত্রে ছাত্র সংসদের শিকড় সন্ধান কঠিন বৈকি।
১৯ শতকের শুরুতে ঢাকা কলেজের গায়ে অগ্নিজ্বর উঠলেও তা ছাত্র সংসদ পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল ৫০ বছর। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আবুদর রাজ্জাক ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের লেখা থেকে অনুমান করা যায়, ১৯৫৮-৫৯ সালের দিকে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালে। ১৮৩৫ সালের স্কুল ও ১৮৪১ সালের ‘ঢাকা কলেজ’ ২০২৪ সালের ভ্যানিশিং স্টেশনে। যাত্রী দলে আছে- ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রসমাজ, ছাত্রশিবির ইত্যাদি। তথাপি কষ্টের নীল জঞ্জাল বুকে একাকীত্বের পাথর চোখে তাকিয়ে ছাত্র সংসদ।
বেদনার নীলকণ্ঠ
দেশ ও জাতির দুর্দিনে ‘ঢাকা কলেজ’ দুঃশাসনের মরণ-যন্ত্রণা আর কষ্ট সংগ্রামকে ধারণ করতে করতে নিজেই যেন হয়ে গেছে বেদনার ‘নীলকণ্ঠ’। বাংলার আকাশে যখনই দুর্যোগ আর অশান্তির মেঘ জমেছে ‘ঢাকা কলেজ’ তখন তার সর্বস্ব নিয়ে, লড়াকু বহ্নি হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রণাঙ্গনে।
১৯৩৯-৪৫ সালের মহাযুদ্ধ, ১৯৪১ সালের দোল দাঙ্গা, ১৯৫২ সালে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ভাষা আন্দোলনে, ১৯৫৩ সালের গোলযোগ, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ কলেজের ছাত্ররা ছিল প্রতিশোধের খড়গহস্ত।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের ছাত্রদের ইস্পাত বাহুতে গর্জন করত ‘৭১-এর হাতিয়ার’, তেমনি এখনও শোনা যায় ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাশ কাঁপানো আর্তনাদ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা কলেজের ৮ জন ছাত্র শহীদ হয়েছিলেন। এই ৮ বীর হলেন- শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ আবদুস শিকদার, শহীদ নাজিবুদ্দিন খান, শহীদ আলী আহসান, শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেন, শহীদ নিজামুদ্দিন সাজ্জাদ, শহীদ আজিজুল ইসলাম বাবুল, শহীদ এম এ কাইয়ুম। এই ৮ বীরকে শ্রদ্ধা ও স্মরণের নকশী কাঁথায় জড়িয়ে রাখতেই মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বাম দেয়ালে লেখা আছে বীরদের নাম অঙ্কিত স্মৃতিফলক।
শেষ কথা
কালের আবর্তে ১৮৩ বছর পেরিয়েছে ‘ঢাকা কলেজ’। মেধাধীদের পছন্দের তালিকায় এখনও শীর্ষে ঢাকা কলেজ। অতীতের মতো এখনও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে এই কলেজের ছাত্ররাই। গৌরবের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে আগামী প্রজন্মও এমনই আশাবাদ।

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃ
২০ নভেম্বর ২০২৪
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃ
২০ নভেম্বর ২০২৪
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃ
২০ নভেম্বর ২০২৪
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃ
২০ নভেম্বর ২০২৪
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে