রোববার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

সেকশন

 

রাজনীতিতে নতুন কিছু, নাকি পুরোনো ধারা

আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৩

জনগণকে সংঘটিত করার ক্ষমতা বিএনপির আছে। ছবি: আজকের পত্রিকা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে দেশে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া বা দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা আওয়ামী স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্র-জনতার এক দফার আন্দোলনে পরিণত হওয়ার একপর্যায়ে ঢাকাসহ সারা দেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে গত ১৯ জুলাই দিবাগত রাতে দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও কারফিউ জারি করেও শেষরক্ষা হয়নি হাসিনা সরকারের। এক দফার আন্দোলন এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আমাদের দেশে অতীতে একাধিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হলেও এবারের অভ্যুত্থান নানা কারণে ব্যতিক্রমী। সরকারপ্রধানের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে। এত লজ্জাজনকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হবে, এটা অনেকেরই ভাবনায় ছিল না। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের পথ বন্ধ হলে নিয়মের বাইরেই সেটা ঘটে। হাসিনার ক্ষেত্রে তা–ই হয়েছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে যাঁদের অতিরিক্ত আস্থা ছিল, যাঁরা ভাবতেন, যেকোনো সংকট উত্তরণের উপায় শেখ হাসিনার ঝুলিতে মজুত থাকে, তাঁরা এবার হতাশ হয়েছেন। কৌশল যে রাজনীতির খেলায় সব সময় জয়টীকা পরিয়ে দিতে পারে না, সেটা এবার প্রমাণ হয়েছে।  

শেখ হাসিনার বিদায়ের তিন দিনের মাথায় ৮ আগস্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। ড. ইউনূস ও তাঁর টিমের সদস্যরা মানুষের আশা পূরণে কতটা সফল হবেন, তা নিয়ে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হলেও ড. ইউনূসের প্রতি মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কত দিন পর নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ড. ইউনূস বিদায় নেবেন, তা-ও এখনো পরিষ্কার নয়। প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষেই নির্বাচন হবে বলে বলা হচ্ছে। এই সংস্কার শেষ হতে কত মাস বা কত বছর সময় লাগবে, তা কেউ খোলাসা করে বলতে পারছেন না। শেখ হাসিনার বিদায়ের ব্যাপারে দেশে যেমন ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তাঁর বিদায়ের পর এই দেড় মাসেই সেই ঐকমত্য আর আছে বলে মনে হয় না।

রাজনীতিতে দুটি মত এখন প্রবল। একটা মত হলো, ড. ইউনূসের ওপর নির্বাচনের জন্য চাপ না দিয়ে ধৈর্য ধরে সংস্কারকাজ এগিয়ে নেওয়া। আরেকটি মত হলো, সংস্কারের জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা না করে দ্রুততম সময়ে একটি ভালো নির্বাচনের আয়োজন করা। অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যতটুকু সংস্কার করা দরকার ততটুকুই করুক। বাকি সংস্কারের ভার নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের অভাব নেই। অনেক দল। তবে সরকার গঠনের প্রশ্নে মানুষের আস্থা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর। এর বাইরে জামায়াত ও জাতীয় পার্টিরও কিছু জনসমর্থন আছে। তবে শেষোক্ত দুই দল এককভাবে ভোটে জিতে ক্ষমতায় যাওয়ার অবস্থায় নেই। তাই এটা মনে করা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতায় যাওয়ার হক বিএনপির। ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এমন একটা ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে যে তাঁরা বুঝি ক্ষমতায় এসে গেছেন। বিএনপি সে জন্য দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। কারণ তারা মনে করছে ভোট হলে তারা বিপুল জয় পাবে। এটা হয়তো ঠিক যে তিন মাস বা এমন কাছাকাছি সময়ে ভোট হলে বিএনপির জয় ঠেকানো যাবে না। কিন্তু নির্বাচন যদি এক-দুই বছর পরে হয়, তাহলে বিএনপির এই জনপ্রিয়তা অটুট থাকবে কি না, তা বলা যাবে না। দখল, চাঁদাবাজি করে আওয়ামী লীগ যে বদনামের ভাগীদার হয়েছে, বিএনপির বিরুদ্ধেও প্রায় একই অভিযোগ উঠছে। বিএনপি এর মধ্যে বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কারও করেছে। দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার চেষ্টায় বিএনপি কত দিন সফলতা ধরে রাখতে পারে, দেখার বিষয় সেটাই। রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির স্বাভাবিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী। এই দুটি দল বছরের পর বছর একই সুরে কথা বলে এসেছে। একে অপরের বিপদে সরাসরি কিংবা কৌশলে পাশে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে উচ্চারিত নাম। কিন্তু শেখ হাসিনার বিদায়ের পর বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলছে না জামায়াত। তাদের ভিন্ন স্বর অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে তাদের তাড়ার বিষয়টা গোপন থাকছে না। বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা থেকেও এটা বোঝা যাচ্ছে যে দলটি ড. ইউনূসকে অনন্তকাল সময় দেবে না।

জনগণকে সংঘঠিত করার ক্ষমতা বিএনপির আছে। তারা আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলতে না পারলেও ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ড. ইউনূসের দল নেই, তাঁর ক্ষমতার উৎস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিএনপি নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান কী হবে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একমত একপথ হয়ে চলতে পারছে না বলেই খবর শোনা যাচ্ছে।

১৭ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে বক্তব্য দিয়েছেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তার নানা রকম ব্যাখ্যা করছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘গণ-অভ্যুত্থানের ফসল’ মন্তব্য করে তাদের সহযোগিতা করতে নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেছেন, ‘এই সরকারের ব্যর্থতা হবে বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।’

একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে তাদেরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তারেক রহমান। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কার কার্যক্রমে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনার আহ্বানও জানিয়েছেন। এ জন্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

বাজারে নানা রকম কথা চালু আছে। ১/১১-এর সময়কার মাইনাস টু ফর্মুলার কথাও শোনা যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দু-একজন নেতার বক্তব্য থেকেও এটা মনে করা হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে অন্য কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ক্ষমতায় আনা যাবে না। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে তা-ও বিএনপির অনুকূলে নয়। ক্যাম্পাসে সব ধরনের দলীয় ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং অবিলম্বে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তাঁরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে এলে শেখ হাসিনার মতোই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। এটা কি ছাত্রদল বা ছাত্র শিবিরকে লক্ষ করে বলা?

সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিজয় একাত্তর হলের ছাত্র নাফিউর রহমান বলেছেন, ‘ক্যাম্পাসে যদি কেউ দলীয় রাজনীতি করতে আসে, হলগুলো যদি আর কেউ দখল করতে আসতে চায়, তাদের হাসিনার মতোই পালাতে হবে। কেউ ক্যাম্পাস দখলের ষড়যন্ত্র করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এটি প্রতিহত করবে। হল কিংবা ক্যাম্পাসের দলীয়করণ, দলীয় দাসত্ব শিক্ষার্থীরা আর মেনে নেবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শামসুন্নাহার হলের সানজিদা চৌধুরী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আর কোনো দাসত্ব মানব না। এখানে মুক্তচিন্তার ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি না করা হলে আমরা রাজপথেই থাকব। তাই যাঁরা দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন, তাঁদের সতর্ক করছি। দলীয় রাজনীতির লাফালাফি বন্ধ করুন।  বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আর কোনো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে মরে যাব, তবু দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দেব না।’  

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। এই নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কী নতুনত্ব দেখা যাবে তা এখনো কারও কাছে স্পষ্ট নয়। নতুন বোতলে পুরোনো মদ, নাকি সত্যি নতুন কিছু—তা দেখার জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     

    মানুষের উদ্বেগ কাটছে না

    আটকে গেল সালমান-সামিরার প্রেমকাহিনি

    ভিএফএক্সে ভর করে বদলে যাচ্ছে বলিউড

    দুর্গাপূজায় শুভর নতুন গান

    প্রথমবার ওয়েবে রুবেল সঙ্গে পূজা চেরি

    সংলাপে গুরুত্ব পাবে সংস্কার, পোশাকশিল্প ও আইনশৃঙ্খলা

    মানুষের উদ্বেগ কাটছে না

    সাক্ষাৎকার

    ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রচর্চার রাজনীতি চাই

    ব্যবসায় প্রচলিত ৩ অনৈতিকতা

    আটকে গেল সালমান-সামিরার প্রেমকাহিনি

    ভিএফএক্সে ভর করে বদলে যাচ্ছে বলিউড

    এসআই নিয়োগ প্রস্তুতির ১২ পরামর্শ