রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পৃথিবী কোনদিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনার বিরাম নেই। যাঁরা এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি দুর্বল ছিলেন, তাঁরা এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি মৌন সমর্থন জানাচ্ছেন। ভাবছেন না, সে কালের সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আজকের রাশিয়ার মধ্যে নীতিগতভাবে দুস্তর ব্যবধান। অন্যদিকে, যাঁরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সহমত হয়ে ইউক্রেনের পক্ষ নিচ্ছেন, তাঁরাও সমাজে পুঁজিবাদী বিকাশের পথটাকেই মসৃণ পথ বলে মনে করছেন। মার্কিনি মোড়লগিরি তাঁদের চোখে পড়ছে না। তাঁরা দেখছেন না, মার্কিনিদের উসকানিতেই রুশ প্রেসিডেন্ট ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ইউক্রেনের ওপর। পুতিনের পক্ষে এতটা উত্তেজিত না হলেও চলত। এতে লাভ যা হয়েছে, সেটা অস্ত্র বিক্রয়কারীদের, শিল্পপতিদের। আর ক্ষতি হয়েছে সমগ্র বিশ্বের খেটে খাওয়া মানুষের, গরিব দেশগুলোর।
চাই বা না চাই, এই যুদ্ধের গতিবিধির দিকে চোখ রাখতেই হয়। নোয়াম চমস্কি নিজের মতো করেই এই যুদ্ধ নিয়ে ভেবেছেন। বুঝতে চেয়েছেন এই সংঘাতের স্বরূপ। সম্প্রতি তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টাইমস রেডিওর মেট চোর্লি। সাক্ষাৎকারে চম্স্কি এই যুদ্ধের ব্যাপারে যে কথাগুলো বলেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সবকিছু আলোচনার সুযোগ নেই। অল্প কিছু বিষয় নিয়ে আমরা এগোতে পারি।
নোয়াম চমস্কি বলছিলেন, সৃষ্টির আদি থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবী যে সংঘাত ও হানাহানির মধ্য দিয়ে গেছে, তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা এখনকার পৃথিবীর। পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতিকে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তাতে প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। তার ওপর মনুষ্য-সৃষ্ট যুদ্ধের কারণে পৃথিবী ভুগছে আরও বেশি।
এ কথার সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি, ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই ক্ষতির কথা ভোলেনি পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু বর্তমানে পারমাণবিক যুদ্ধের যে শঙ্কা বিরাজ করছে, তা হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞকে মুহূর্তের মধ্যেই ম্লান করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যদি সত্যিই পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হয়, তাহলে পুরো পৃথিবী পরিণত হবে শ্মশানে।
অনেকেই সরল মনে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? ইউক্রেন তো স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, সে দেশ যেকোনো জোটে যোগ দিতে পারে। চম্স্কি প্রশ্নটাকে একটু ঘুরিয়ে দেখেন। তিনি বলেন, ধরা যাক, মেক্সিকো এমন একটি জোটে যোগ দিতে চাইল, যেটির নেতৃত্বে আছে চীন। চীনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিলে মেক্সিকো মহড়া চালিয়ে গেল। তাদের হাতে এল চীনের ভারী ভারী অস্ত্র। আমেরিকা কি সেটা হতে দেবে? মেক্সিকো দেশটাই তখন আর থাকবে না! ধুলোয় মিশে যাবে।
মেক্সিকো আমেরিকার জন্য যেমন, ইউক্রেনও রাশিয়ার জন্য তেমন একটি রেড জোন। ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়বে। গর্বাচেভ, ইয়েলৎসিনও ইউক্রেনের ব্যাপারে সে রকম করেই ভাবতেন, যে রকম করে ভাবছেন পুতিন। একেবারে রাশিয়ার ঘাড়ের ওপর একটা ন্যাটোভুক্ত দেশ নিশ্বাস ফেলবে, তা তো হতে পারে না।
চমস্কি ন্যাটো আর রুশ-চীনকে এক চোখে দেখেন না। তিনি মনে করেন, ন্যাটো অনেক বেশি হিংস্র জোট। তারা যুগোস্লাভিয়ায় অভিযান চালিয়েছে, লিবিয়ায় চালিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ, ইউক্রেন আর আফগানিস্তানে তারা কী করেছে, সেটাও সবাই জানে। পশ্চিমারা ছাড়া সবাই জানে, ন্যাটো একটা ভয়ংকর যুদ্ধ-মোর্চা।
এ বিষয়ে চমস্কির দেখানো পথেই একটু কথা হতে পারে। চমস্কি প্রশ্ন তুলছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেন গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল, ছিন্নভিন্ন করে ফেলছিল বাগদাদ, তখন বিশ্বনেতাদের কেউ কি তার সমালোচনা করেছিলেন? না, কেউ করেননি। এর কারণ হলো, যেখানে মার্কিনি আর ব্রিটিশরা ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে, সেখানে কেউ নিস্তার পাবে না। তারা সবকিছু ধ্বংস করবে। যোগাযোগব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেবে, পরিবহনব্যবস্থা বলে কিছু থাকবে না, জ্বালানিক্ষেত্র ধ্বংস হবে। যেসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে টিকে থাকে একটা স্বাভাবিক সভ্য সমাজ, তার সবকিছুই তারা বন্য জন্তুর মতো গুঁড়িয়ে দেবে। কিন্তু কেউ তার সমালোচনা করতে পারবে না! করবে না।
ইউক্রেনে রাশিয়ানরা সে রকম কিছুই ঘটায়নি। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বাগদাদে মার্কিনিরা যে হিংস্র ব্যবহার করেছিল, সেই ব্যবহার রাশিয়ানরাও কিয়েভের ক্ষেত্রে করতে পারত। গুঁড়িয়ে দিতে পারত কিয়েভকে। পশ্চিম ইউক্রেনের সঙ্গে পূর্ব ইউক্রেনের যোগাযোগ, পরিবহনব্যবস্থা সবকিছু বন্ধ করে দিতে পারত।
চমস্কি বলছেন, কোনো আন্তর্জাতিক নেতা কি ধ্বংসযজ্ঞ চলার সময় বাগদাদে যেতে পেরেছেন? বরং ঘটেছে উল্টো ঘটনা। বাগদাদে অবস্থানরত সব বিদেশি, এমনকি জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা কিংবা শান্তিরক্ষীরাও সেদিন বাগদাদে থাকতে পারেননি। তাঁদের ফিরে আসতে হয়েছে। যে রকমভাবে বোমা মেরে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে বাগদাদের মাটি, সেটা ভয়াল ও হিংস্রতায় মাখামাখি ছিল। সাধারণ মানুষকে সেখানে পিঁপড়ার মতো পিষে মারা হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, ইউক্রেনে মৃত্যুর সংখ্যা ৮ হাজারের মতো। আর ইরাকে কত, মনে আছে আপনার? লেবাননে যখন ইসরায়েল হামলা চালাল, তখন মৃতের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। সুতরাং মার্কিন যুদ্ধ আর রুশ যুদ্ধকে এক পাল্লায় মাপার সুযোগ নেই।
আসলে মিনস্ক চুক্তিই হতে পারত এই যুদ্ধ থামানোর চাবিকাঠি। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলের যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ইউক্রেন, রাশিয়া আর অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ। মধ্যস্থতা করেছিল জার্মানি ও ফ্রান্স। এই চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। বন্দী বিনিময়, মানবিক সহায়তা প্রদান ও ভারী অস্ত্র প্রত্যাহারের কথাও ছিল সেই চুক্তিতে। অবশ্য দুই পক্ষই সেই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছিল; ফলে ২০১৫ সালে মিনস্কেই ২য় মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ সেই চুক্তির অবসান ঘটিয়েছে। আর সাবেক জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল তো বলেইছেন, মিনস্ক চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা; অর্থাৎ পশ্চিমাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ল তাতে।
মেক্সিকো এখন যে অবস্থায় আছে ইউক্রেনের স্ট্যাটাস সেটাই হতে হবে, অর্থাৎ তারা কোনো শত্রুভাবাপন্ন জোটে যোগ দিতে পারবে না। দোনবাস থাকবে ইউক্রেনের মধ্যেই, তবে স্বায়ত্তশাসন নিয়ে। আপাতত ক্রিমের কথা না বলাই ভালো। এগুলো ঠিকঠাকভাবে চললে মিনস্ক চুক্তির অবমাননা হয় না।
এখনো পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এই ভরসা দিয়ে চলেছে যে রাশিয়ার পতন অবশ্যম্ভাবী এবং যেকোনো মূল্যে ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে ইউক্রেন।
আরেকটা কথা এখানে বলে রাখা প্রয়োজন। ফিনল্যান্ড আর সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিল কি দিল না, তা নিয়ে রাশিয়ার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু কেন ইউক্রেন এই জোটে যোগ দিলে রাশিয়া বাধা দেয়, সেটাও তো বুঝতে হবে।
চীন রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে খুব যে পোক্তভাবে দাঁড়িয়েছে, তা নয়। চীন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ‘বস-রাজনীতি’র মূল খেলোয়াড়ে পরিণত হতে চাইছে এবং এ কারণে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তারা সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে। আরব বিশ্বও তার ব্যতিক্রম নয়।
ফলে বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখলে ইউক্রেন আসলে কোনো সুখী ভবিষ্যতের নাগাল পাবে কি না, তার জবাব এখনই পাওয়া যাবে না।
এবার আমাদের কথা বলি একটু। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতিকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। এ বিষয়ে যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেন, তখন আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু তিনি যখন রাশিয়ায়-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে বিপত্তিগুলো আসছে, সে কথা বলেন, তখন সেটা সত্য বলে মনে না করার কোনো কারণ নেই। আমাদের অর্থনীতি গোলমালে পড়ে গেছে। তার বিভিন্ন কারণ আছে বটে। কিন্তু এই যুদ্ধও একটা বড় কারণ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতির দিকে চোখ রাখলে আমরা সেই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারব। পৃথিবীজুড়ে ডানপন্থার যে উত্থান হয়েছে, সেটাই আসলে অস্থির করে রাখছে পৃথিবীর রাজনৈতিক দৃশ্যপট। শুধু আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বকে দোষ দিলেই সংকট থেকে বের হওয়া যাবে না। রাশিয়া বা তার মিত্ররাও যে খেলা খেলছে, সেখানেও চোখে আঙুল দিয়ে দোষগুলো দেখিয়ে দেওয়া যায়।
এই উগ্র ডানপন্থা যত দিন পৃথিবীকে অস্থির করে রাখবে, তত দিন মানবতা লুকিয়ে থাকবে অন্ধকারে।
আপাতত সেই অন্ধকার গ্রাস করে চলেছে আমাদের সবাইকে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে