বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩

সেকশন

 

সুষম সার বিষয়ে কতটা সচেতন কৃষক

বিশ্ব বাজারে সারের সংকট। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের সারের বাজারেও। সরকার বাধ্য হয়েই ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা। ৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। 

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৫

পানিতে মিশিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে ছিটালে ইউরিয়া সার স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম লাগে। ছবি: পেক্সেলস গত শুক্রবারের কথা; ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় আয়োজন করেছিলাম এবারকার ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানের একটি পর্ব। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আড়াই থেকে তিন হাজার কৃষক। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটা প্রত্যক্ষ জরিপ আমরা করি। আমি উপস্থিত কৃষকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারা কারা মাটি পরীক্ষা করে কৃষিকাজ করেন? উপস্থিত কৃষকদের দুজন হাত তুলেছেন। কিন্তু কৃষিকাজের জন্য মাটি পরীক্ষা করে সার প্রয়োগের বিষয়টি এখনো তাঁরা জানেন না। কারণ, আমি যখন প্রশ্ন করলাম, সুষম সার প্রয়োগ করেন কে কে? তখন একজনও পাওয়া গেল না।

কয়েক বছর ধরেই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর অনুষ্ঠানগুলোতে আমি কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন কি না। ১ শতাংশের কম কৃষক বলেছেন, তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন। অথচ এই মানুষগুলোরই জানা দরকার ছিল জৈব পদার্থই হলো মাটির প্রাণ। শস্য উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা রক্ষার্থে প্রয়োজন মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব সার থাকা। এই না জানার ফলে তাঁরা বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। এতে অধিকাংশ এলাকার মাটির জৈব পদার্থ নেমে এসেছে শতকরা ১ ভাগের নিচে, যা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে মাটির ওপর আমরা মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার করে এসেছি। জমিতে প্রয়োগ করতে হচ্ছে রাসায়নিক সার। অধিক কর্ষণে মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা, নষ্ট হচ্ছে জৈবগুণ। আবার সময়ের সঙ্গে বেড়েছে আমাদের ফসল বৈচিত্র্যও। কিন্তু কোন জমিতে কোন ফসল চাষ করলে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে, সে সম্পর্কে কৃষক তেমন ধারণা রাখেন না। কৃষক মনে করেন যত বেশি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হবে, ফলন তত বাড়বে।

মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ফসলের বেশি ফলনের প্রশ্নে সার প্রয়োগের আধুনিক অনুশীলনগুলো নিয়ে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোহেলা আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি গাছ বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে ফল দেওয়া পর্যন্ত জীবনচক্রে মাটি থেকে ১৭টি উপাদান গ্রহণ করে। এর কোনো উপাদান কম হলেই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার কোনো উপাদান বেশি হলেও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি।

কৃষক মাটি পরীক্ষা করে চাষাবাদের বিষয়টিতে সচেতন নন। আবার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার কথা শুনে যাঁরা মাটি পরীক্ষা করাতে চান, তাঁরাও সহজে তা করাতে পারছেন না। অনেকের অভিযোগ, মাটি পরীক্ষার ফল হাতে পেতে পেতে ফসলের মৌসুম চলে যায়। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।

দুই বছর করোনা-তাণ্ডবে বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত, তখন দ্রব্যমূল্যের আগুনে ঘি ঢেলেছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। ৬০টির বেশি দেশে সার রপ্তানি করে বিশ্বের অন্যতম বড় সার উৎপাদনকারী কোম্পানি ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ও সিইও ভেইন টরে হোলসেথার মন্তব্য করেছিলেন, মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোর খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।

সারা পৃথিবীতেই চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে জিনিসপত্রের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে সারের মূল্য। তার প্রভাব পড়েছে আমাদের কৃষি খাতেও। জ্বালানির দাম বেড়েছে, বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম, বেড়েছে লোডশেডিং। ফলে স্বাভাবিক সময় থেকে একটা বাজে সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। দুর্মূল্যের বাজারে হিসাবি হতে হয়। কমাতে হয় অপচয়। সারের ক্ষেত্রেও আমাদের অপচয় কমাতে হবে।

প্রতিবেশী ভারত সার ব্যবহারের দিক থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। সার উৎপাদনে তৃতীয় এবং সার আমদানিতে বিশ্বে প্রথম। ‘দ্য ইন্ডিয়া ফোরাম’-এ একটি আর্টিকেল পড়েছিলাম বর্তমান সারসংকটে ভারতের কার্যক্রম নিয়ে। তারা সারসংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য পলিসি পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হয়েছে। সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমী হচ্ছে।

গত বছর এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে মাটির সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান রয়্যাল আইকোলকাম্প। তারা মাটির সুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে।সেই প্রতিষ্ঠানের তরুণ গবেষক বব বলছিলেন, মাটিতে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে কিংবা আদৌ সার প্রয়োগের প্রয়োজন আছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে তাঁরা কৃষিকাজ করেন না। রাসায়নিক সার বেশি প্রয়োগের ফলে মাটি তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের চর্চা নেই। বব বলছিলেন, জৈব সার ব্যবহারে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কমানো সম্ভব।

‘বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া সার সাশ্রয় করা সম্ভব।’ কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) উদ্যান উন্নয়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন খান।

টাঙ্গাইলের এক খ্যাপাটে কৃষক চাষা আব্দুল আজিজ। নামের সঙ্গে চাষা শব্দটি তিনি নিজেই যুক্ত করেছেন। আমি তাঁকে বলি ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী’। কারণ, কৃষি কৌশল ও কৃষি উৎপাদনের নানান বিষয় নিয়ে নিজের মতো করে গবেষণা করেন তিনি। বছর পনেরো আগের কথা। একদিন আব্দুল আজিজ আমার দপ্তরে এসে বললেন, ‘স্যার, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে না দিয়ে বিঘাতে দুই-তিন কেজি স্প্রে করে ধান চাষ করা সম্ভব। এতে ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করেও বেশি ধানের ফলন ঠিকঠাক পাওয়া যায়।’ সে সময়, ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী সারের ঘাটতি ছিল, কৃষকদের মাঝে সার নিয়ে অসন্তোষ। এর মাঝে যদি কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে ফেলা যায়, তবে সেটি হবে চমৎকার একটি বিষয়। বিষয়টি ভালো করে বুঝতে এবং যাচাই-বাছাই করতে ছুটে গেলাম টাঙ্গাইলের শালিয়াবহ গ্রামে। আব্দুল আজিজ বললেন, ‘স্যার, আমি দেখলাম গাছের পাতায় সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে। যদি পানিতে মিশিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করে দিই, তাহলে গাছ সরাসরি গ্রহণ করতে পারে। সেই ভাবনা থেকে পরীক্ষামূলক ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করে উপকার পেয়েছি।’

বিষয়টি কতটা বিজ্ঞানসম্মত, তা জানতে সে সময় আমি যোগাযোগ করি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল মজিদের সঙ্গে।তিনি ৬টি প্লটে পরীক্ষামূলকভাবে আব্দুল আজিজের পদ্ধতিতে ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে যাচাই-বাছাই করে দেখলেন আব্দুল আজিজের কথাই ঠিক। আমি সে সময় ইউরিয়া সারের প্রয়োগ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। সেই সব প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলাম। আমার তুলে ধরা প্রতিবেদন দেখে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কৃষি গবেষক আরিফ হোসেন খান। দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে তিনি যে ফলাফল পেয়েছিলেন তা হলো, ধানখেতে সরাসরি না ছিটিয়ে পাতায় বিশেষ পদ্ধতিতে (পানিতে মিশিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে) ছিটালে ইউরিয়া সার স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৩০-৩৫ শতাংশ কম লাগে। এতে চাষাবাদের খরচ কমে যায়। বিঘাপ্রতি ধানের ফলনও বাড়ে তিন মণ পর্যন্ত।

ইউরিয়া সার স্প্রে করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। আমার জানা মতে, ১৯৩০ সাল থেকে ফলিয়র স্প্রের মাধ্যমে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী এস এইচ উইটার বিভিন্ন ফসলে ইউরিয়ার স্প্রে ঘনত্বের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করেন। উন্নত বিশ্বে আজ থেকে ১০০ বছরের বেশি ফসলে নাইট্রোজেন স্প্রে করার কৌশল ব্যবহার করছে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইলেকট্রো স্ট্যাটিক বুম স্প্রেয়ার আবিষ্কারের পর ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রে করার বিষয়ে উন্নত বিশ্বে বিপ্লব ঘটে গেছে। বর্তমানে স্প্রের কাজে তারা ড্রোন ব্যবহার করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও দেখেছি সেচের পানির সঙ্গে মিশিয়ে সার প্রয়োগ করতে। আর এমন অতি আধুনিক বা স্মার্ট ফার্মিংয়ের প্রযুক্তিতে তো ইউরোপ, আমেরিকায় দেখেছি সেচের পানির সঙ্গে শুধু সার নয়, ফসলের প্রয়োজনীয় সব নিউট্রিয়েনই মিশিয়ে দেওয়া হয়।

বিশ্ববাজারে সারের সংকট। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের সারের বাজারেও। সরকার বাধ্য হয়েই ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা। ৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।

সার ছিটিয়ে ব্যবহার না করে যদি পানিতে মিশিয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে শতকরা ২৫ ভাগ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়, এই দুর্দিনে আমরা কেন সাশ্রয়ী হচ্ছি না? দ্রুত সময়ে মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা যদি কৃষককে সুষম সার ব্যবহারে উদ্যোগী করতে পারি, তবে সারসংকট থেকে আমরা যেমন বের হয়ে আসতে পারব, তেমনি আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিও জোরদার হবে।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    শিক্ষায় কত অভিঘাত

    পৃথিবী ঠান্ডা রেখে লাভ কী

    কয়েক ছত্র

    জীবনঘনিষ্ঠ

    জীবন অগাধ

    প্রতিবাদ

    মলমূত্র, শিক্ষালয় ও শিক্ষক

    দশাটা চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার মতো বৈকি

    দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে ১৮৫ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন জাবি শিক্ষার্থী

    বিএনপি-জামায়াত রেলকে পরিত্যক্ত করেছিল, শেখ হাসিনা পুনরুদ্ধার করেছেন: রেলমন্ত্রী

    মহম্মদপুরে এনজিও কর্মীর মরদেহ উদ্ধার 

    বগুড়ায় বিদ্যুৎ অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা

    মেসি কেন মিয়ামিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন

    সিলেটে পরোয়ানাভুক্ত চার আসামি গ্রেপ্তার