Alexa
বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩

সেকশন

epaper
 

আবাসনে প্রকল্পে বড় লোকসানে সরকার

আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৩, ১২:২০

ছবি: সংগৃহীত আবাসন প্রকল্পের ২ লাখ বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেসের মধ্যে বেসরকারি ডেভেলপার কোম্পানি পেয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুট; জমির মালিক হিসেবে সরকারি সংস্থা পেয়েছে মাত্র ২০ হাজার বর্গফুট। অর্থাৎ ডেভেলপার ৯০ শতাংশ আর সরকারি সংস্থা ১০ শতাংশ পেয়েছে। আবাসিক বা ফ্ল্যাটে ১৩ লাখ ২০ হাজার বর্গফুটের মধ্যে ডেভেলপার পেয়েছে ৮ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৭ বর্গফুট; সরকার পেয়েছে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ১৩৩ বর্গফুট। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভাগে পড়েছে ৩০ শতাংশের কিছু বেশি। সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের ক্ষেত্রে জমির মালিকেরা গড়ে ৫০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় অবশ্য জমির মালিকের হিস্যা আরও বেশি।

জানা যায়, সরকার এমন বড় লোকসানের কবলে পড়েছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির আওতায় বাস্তবায়নাধীন একটি আবাসন প্রকল্পে। রাজধানীর মিরপুর ৯ নম্বর সেকশনে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) জমিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পটি। ৩০৩ কাঠা জমির ওপর পিপিপির অধীনে এটি দেশের প্রথম পাইলট প্রকল্প। ওই এলাকায় ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেসের বর্তমান বাজারদরের হিসাবে প্রকল্পটিতে সরকারের লোকসান হচ্ছে প্রায় ৩১৫ কোটি টাকা।

এই প্রকল্পে বেসরকারি অংশীদার ট্রপিক্যাল হোমস লিমিটেড। চার বছর আগে চুক্তি হলেও বালু ভরাট আর টিনের বেড়া দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো অগ্রগতি নেই। এরই মধ্যে চুক্তির শর্ত ভেঙে প্রকল্পের জমি ও ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে ট্রপিক্যাল হোমস। 
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মো. শরীফ আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার খুব বেশি কিছু জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে পরে মন্তব্য করব।’

চুক্তিকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বর্তমানে জাগৃকের সদস্য (পরিকল্পনা ও বিশেষ প্রকল্প) বিজয় কুমার মণ্ডল বলেন, ‘এ প্রকল্পটি অনেক যাচাই-বাছাই করে আমরা তৈরি করেছি। বিভিন্ন স্তরে তা অনুমোদন হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাগৃকের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মুনিম হাসান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ট্রপিক্যাল হোমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ রবিউল হক বলেন, ‘এ প্রকল্প এলাকা অনেক নিচু। বেশ কয়েক বছর আগে এখানে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে যা চাওয়া হয়েছে, তা-ই দেওয়া হয়েছে। এখন যদি তারা (জাগৃক) ১০ টাকা চায় তাহলে কীভাবে ৪০ টাকা দেব? সব ধরনের ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) করে এই রেশিও ঠিক করা হয়েছে। এখানে আমাদের কী করার আছে? মন্ত্রণালয়কে প্রশ্ন করুন। যা করা হয়েছে পরিষ্কারভাবেই হয়েছে।’

জাগৃকের লোকসান: এই প্রকল্পে মোট ২ লাখ বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেসের মধ্যে ২০ হাজার বর্গফুট অর্থাৎ ১০ শতাংশ পেয়েছে জাগৃক। ওই এলাকায় অন্যান্য বেসরকারি প্রকল্পের মতো ভূমিমালিক হিসেবে ৫০ শতাংশ হিস্যা পেলে এখানে জাগৃকের ১ লাখ বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেস পাওয়ার কথা। সেই হিসাবে ৮০ হাজার বর্গফুট কম পেয়েছে। এলাকায় প্রতি বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেসের বাজারমূল্য ২০ হাজার টাকা হিসাবে এ ক্ষেত্রে ১৬০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে জাগৃকের। 

নগর-পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যে এলাকায় পিপিপির এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেখানে ছোট জমি হলেও শতকরা ৫০ ভাগ পায় জমির মালিকপক্ষ। সেখানে এমন বড় একটি প্রকল্পে এ ধরনের চুক্তির মাধ্যমে বোঝা গেল গৃহায়ণসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কতটা অদক্ষ।’

১৩ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট আবাসিক স্পেসের মধ্যে জাগৃক পেয়েছে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ১৩৩ বর্গফুট বা ৩০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ভূমিমালিক হিসেবে প্রকল্পে ৫০ শতাংশ হিস্যা নিশ্চিত করা গেলে জাগৃকের পাওয়ার কথা ৬ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট। সেই হিসাবে জাগৃক ২ লাখ ২০ হাজার ৮৬৭ বর্গফুট কম পেয়েছে। প্রকল্প এলাকায় প্রতি বর্গফুট আবাসিক স্পেসের দাম ৭ হাজার টাকা। সেই হিসাবে জাগৃকের লোকসান ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে ট্রপিক্যাল হোমস লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা এ প্রকল্পের কাজ নিয়েছি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে। বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় পিপিপি অথরিটি ও গৃহায়ণ মিলে কাজগুলো করেছে। এখানে সরকারপক্ষ লোকসান করেছে; বিষয়টি সঠিক নয়।’

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আমলে নেওয়া হয়নি: ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এই প্রকল্পের বিষয়ে চুক্তি না করার নির্দেশনা দিয়ে শর্তগুলো আরও পর্যালোচনা করতে বলেছিলেন তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। এরপর কিছুদিন থেমে ছিল কার্যক্রম। নথিপত্রে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত আমলে না নিয়ে ২০২০ সালের ৫ মার্চ জাগৃকের পক্ষ থেকে ট্রপিক্যাল হোমসের কাছে জমি হস্তান্তর করা হয় এবং সে বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়। প্রকল্পের চূড়ান্ত স্থাপত্য নকশা অনুমোদন করা হয় ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর। সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে টেস্ট পাইলের ভেটিংকৃত কাঠামোগত নকশা অনুমোদিত হয় ২০২২ সালের ২৩ জুন।

পরিষেবার দায়িত্ব: প্রকল্পে নামমাত্র অংশীদারি থাকলেও পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহসহ অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট নিশ্চিত করার দায়িত্ব পড়েছে জাগৃকের কাঁধে। এত বড় আকারের প্রকল্পে পরিষেবাসহ ড্রেনেজ ও সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট স্থাপন করতে হলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে। যদিও এসব কাজের খরচ অংশীদারির ভাগ অনুযায়ী বহন করার কথা। এ ছাড়া জাগৃক ভবনের কোন দিকে বাণিজ্যিক ও আবাসিক স্পেস পাবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। ফলে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে। জমি বুঝে পাওয়ার পরই ডেভেলপারের পক্ষ থেকে ব্যাংকঋণ নিতে চাওয়া হয়।

আমমোক্তারনামা গ্রহণের আগে জমিসহ নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট বন্ধক রাখার শর্ত জুড়ে দেয় ট্রপিক্যাল হোমস। জাগৃকের পক্ষে দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ঢাকা সার্কেল) মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল গত বছরের ২৬ জুলাই এসবের নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।

পার্ক বানানোর ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর: গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কালশী ফ্লাইওভার উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের স্থানে ১৫ বিঘা জমিতে একটি পার্ক বানানোর ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণার পরপরই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে প্রকল্প স্থানে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। পরে সেই সাইনবোর্ড সরিয়ে নিজেদের সাইনবোর্ড লাগায় ট্রপিক্যাল হোমস। জাগৃকের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) কাজী ওয়াসিফ আহমাদ ২৩ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিবকে অবহিত করে পরবর্তী নির্দেশনা চান।

এ বিষয়ে জাগৃকের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা ডিভিশন-১) জোয়ারদার তাবেদুন নবী বলেন, ‘সম্প্রতি কালশী ফ্লাইওভার উদ্বোধনকালে এই স্থানে মঞ্চ তৈরি করা হয়। অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখানে একটি পার্ক করার ঘোষণা দেন। এরপর ডিএনসিসি ও জাগৃকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে দাপ্তরিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।’

ট্রপিক্যাল হোমসের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে গৃহায়ণের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, আমাদের প্রকল্পের কোনো সমস্যা হবে না।’

প্রকল্প পুনঃসংশোধন করার পরামর্শ: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের সরকারি প্রকল্পগুলোতে রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা হয় না। যাঁরা সরকারপক্ষে থাকেন তাঁরা ব্যক্তিকে লাভবান করতে মরিয়া থাকেন। তা না হলে এমন একটা প্রকল্পে ১০ ভাগ সরকার আর ৯০ ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে পায়? এভাবে পাইলট প্রকল্প পার করতে পারলে পরে নজির হিসেবে অন্য প্রকল্পেও এমন অবস্থা হবে। তাই এখনই এ প্রকল্প পুনঃসংশোধন করে সরকারের হিস্যা ঠিক করতে হবে।’

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে, সরকারি জমিতে এ ধরনের কাজ হাতে নেওয়া হয় মূলত একটি গোষ্ঠীকে লাভবান করার জন্য। ১০ শতাংশ না নিয়ে জাগৃকেরই সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে প্রকল্প করার। তা না করে কেন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে তুলে দিয়েছে, তা সহজেই বোঝা যায়।’

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    আ.লীগে প্রার্থীজট, নির্ভার বিএনপি

    দেশে এক বছরে কোটিপতি বাড়ল ৮ হাজার

    করপোরেট মহাজনিতে জিম্মি পোলট্রিশিল্প

    সুখীর তালিকায় আরও পেছাল বাংলাদেশ

    মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক, ঢাকায় এলেন ভুট্টো

    পাঁচ পুরুষের ভিটেয়

    স্বর্ণের দাম এক লাফে সাড়ে ৭ হাজার টাকা বাড়ানোর পর কমল ১১০০

    ভাস্কর শামীম শিকদার আর নেই

    ১২ দফা নিয়ে আলোচনার আশ্বাস

    র‍্যাপার ব্যাড বানির বিরুদ্ধে ৪০ মিলিয়ন ডলারের মামলা করল তাঁর প্রাক্তন

    সিঙ্গারের ফ্রি এসি ক্লিনিং সার্ভিস আবারও চালু 

    বাঁশখালীতে হরিণ শিকারের পর জবাই, ৫ জনের কারাদণ্ড