শৈশবে সংগীতের প্রতি আইনস্টাইনের প্রবল আগ্রহ দেখে তাঁর মা তাঁকে একটি বেহালা কিনে দেন, যেটি তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শয্যাপাশে রাখেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘ছয় বছর বয়সে আমি হাতে বেহালা তুলে নিই। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত একটানা বেহালা বাজানোর শিক্ষা চলে। তবে জীবনে প্রথম যেদিন মোজার্টের গানের সুর যথার্থ বুঝলাম, খুব ভালো লেগে গেল মোজার্টকে। দেখলাম শিক্ষক যা শেখাতে এত দিন চেষ্টা করছেন, এখন তা আমি অনায়াসে আয়ত্ত করতে পেরেছি। তখনই উপলব্ধি করলাম কর্তব্যপরায়ণতা নয়, ভালোবাসাই হলো সবচেয়ে বড় শিক্ষক।’
তিনি ইউক্লিডের এলিমেন্টস গ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেন, যৌবনে যিনি এই বই পড়ে অনুপ্রাণিত হননি, তিনি তত্ত্বচর্চার জন্য জন্মগ্রহণ করেননি। একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থা তাঁকে রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। তিনি বলতেন, ‘যে শিক্ষা মানুষকে মুক্তভাবে চিন্তা করতে শেখায় না, মুক্তচিন্তার প্রেরণা জোগায় না, তা মানুষের মানসিক বিকাশের পরিপন্থী।’ একবার তিনি বলেছিলেন, ‘কখনো কখনো কেউ কেউ তরুণ প্রজন্মের কাছে সর্বাধিক জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে স্কুলকে গণ্য করেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। স্কুলের উচিত তরুণদের মধ্যে সেই সব গুণ ও দক্ষতা গড়ে তোলা, যা মানবজাতির কল্যাণের জন্য মূল্যবান।’
১০ বছর বয়সে তাঁর ওপর মাক্স টালমুড নামের এক দরিদ্র ছাত্রের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। আইনস্টাইন পরিবারের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে সে একবার খেতে আসত। সে সময় ইহুদি রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় পণ্ডিতদের এভাবে খাওয়ানো হতো। আইনস্টাইন তাঁর পরিবারে এই রীতিকে পরিবর্তন করেছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার খাওয়ানোর জন্য তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের দরিদ্র শিক্ষার্থীকে বেছে নিয়েছিলেন। টালমুডই তাঁকে অ্যারন বার্নস্টাইনের ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত ‘পিপলস বুক অব ন্যাচারাল সায়েন্সেস’ গ্রন্থটি এনে দেন। এটা ছিল বিজ্ঞানের ধারণা জনপ্রিয়করণের একটি বই। এই বইয়ের প্রথম দিকের পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা ছিল তারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের বিস্ময়কর গতি ও মহাশূন্যের ভেতর আলোর গতি সম্পর্কে। তারপর আইনস্টাইন ১৬ বছর বয়সে কতগুলো মানস-পরীক্ষা বা থট এক্সপেরিমেন্ট করেন। অনেকে মনে করেন, ১৯০৫ সালে তিনি যে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন, তা তাঁর এই মানস পরীক্ষার ফল। টালমুডই তাঁকে ইউক্লিডের এলিমেন্টস এবং ইমানুয়েল কান্টের ক্রিটিক অব পিউর রিজন বইয়ের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে ঘিরেই সম্প্রতি সমগ্র পৃথিবীর মানুষ আলোড়িত হয়েছিল। মূলত ভারী বস্তু আন্দোলিত হলেই স্থান-কালের বক্রতায় সুস্পষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আলোর গতিতে মহাবিশ্বে তা বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকটা পুকুরে ঢিল ছুড়লে যে জলতরঙ্গের সৃষ্টি হয়, তার মতোই। আইনস্টাইন অনুমান করেছিলেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ অন্যান্য তরঙ্গের মতোই তার উৎস থেকে দূরবর্তী স্থানে শক্তি পরিবহন করে। ফলে উৎসটির শক্তি ক্রমেই হ্রাস পায়। যেমন পৃথিবীর কথা ধরা যেতে পারে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে বলে পৃথিবী থেকেও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং পৃথিবীর শক্তিক্ষয় ঘটে। এ শক্তি ক্ষয়ের কারণে পৃথিবীর কক্ষপথের পরিবর্তন ঘটে এবং ধীরে ধীরে পৃথিবী সূর্যের কাছাকাছি আসে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শক্তি ক্ষয়ের হার অত্যন্ত অল্প—ছোট্ট একটি ইলেকট্রিক হিটার জ্বালাতে যতটা শক্তি প্রয়োজন, ঠিক ততটা। এ ঘটনাটি আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা দিয়ে ১০০ বছর আগে অনুমান করেছিলেন। কিন্তু সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেল কয়েক বছর আগে লিগো (লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশন অবজারভেটরি) যন্ত্রের মাধ্যমে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সভ্যতা যেন বেতার প্রযুক্তি থেকে মহাকর্ষ প্রযুক্তি সভ্যতার দিকে ধাবিত হলো। বিশ্বরহস্যের উন্মোচন এবং ভিনগ্রহীদের অনুসন্ধানে অনেক বেশি সূক্ষ্মতায় কাজ করতে পারবে এই অগ্রগতি।
আলবার্ট আইনস্টাইনের বেশির ভাগ তত্ত্বই পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণে বর্তমানে প্রমাণিত হচ্ছে। স্মার্টফোন, জিপিএস ব্যবস্থার মতো পৃথিবীর সব আধুনিক প্রযুক্তির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আইনস্টাইনের তত্ত্ব। ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের জন্য তিনি ১৯২১ সালে নোবেল পেয়েছিলেন। অথচ জার্মানিতে শিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, কোনো কিছু হওয়ার যোগ্যতা তোমার নেই। তাঁর প্রশ্ন, ক্লাসরুমের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে, স্কুল থেকে বের হয়ে যাওয়াটাই তোমার জন্য মঙ্গলজনক হবে। হাইস্কুল থেকে বহিষ্কৃত লম্বা চুলওয়ালা ১৬ বছরের আইনস্টাইন বের হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের ঘটনা, তিনি তুসকান গ্রামাঞ্চলে ইতালির প্যাভিয়ার দিকে চলে যাওয়া রাস্তায় কী প্রবল আনন্দ আর স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই সময়কার তাঁর চিন্তার বিষয়গুলো ছিল অতিশৃঙ্খলাপূর্ণ জার্মানির প্রুশিয়ান স্কুলে জোর করে পড়ানো বিষয়গুলো থেকে অনেক দূরের। এই সময়ের চিন্তা তাঁর পুরো জগৎকে বদলে দিয়েছিল। তাঁর এই অসাধারণ চিন্তাধারা ১৯০৫ সালে ‘এনালেন ডার ফিজিকস’ পত্রিকায় চারটি প্রবন্ধের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বিষয়গুলো ছিল—ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট, ব্রাউনিয়ান মোশন, বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব, ভর ও শক্তির সমতুল্যতা। এ বছরটিকে পৃথিবীতে মিরাকল ইয়ার বলে অভিহিত করা হয়।
আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ, জার্মানির উলম শহরে। বাবা হেরম্যান আইনস্টাইন এবং মা পলিন আইনস্টাইন। তাঁর বাবা ছোট একটি রাসায়নিক কারখানার কর্মচারী ছিলেন। বলতে গেলে বাবা হেরম্যানই বিজ্ঞানের ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁকে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের এক বছর বয়সে তাঁর পরিবারে দেখা দিল চরম আর্থিক দুর্দশা। ফলে তাঁদের বাধ্য হয়ে মিউনিখের শহরতলিতে চলে যেতে হয়। তিনি মিউনিখের বাগানঘেরা বাড়িতে একা একা ঘুরে বেড়াতেন এবং আপন মনে ভাবতেন। মা-বাবা তাঁকে নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।
তিনি বোস-আইনস্টাইন সংখ্যা তত্ত্বের মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গেও যুক্ত হয়ে আছেন। ইউক্লিড, আইজ্যাক নিউটন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তাঁকে প্রভাবিত করেছিল, মহাত্মা গান্ধীর ভাবধারা তাঁকে আপ্লুত করেছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গ তাঁকে আনন্দ দিয়েছিল।
১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল ৭৬ বছর বয়সে আইনস্টাইন শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯১৬ সালে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে আইনস্টাইন মহাকর্ষকে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে দেখান। মহাকর্ষ আলোর গতিকে বাঁকিয়ে দেয়, সময়ের গতিকে শ্লথ করে দেয়। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে আমরা যদি নীতিগতভাবে আলোর গতির কাছাকাছি (দশমিক পার্থক্যে) বেগে চলে মহাকাশযানে ভ্রমণ করতে পারতাম, তাহলে সময়ের গতি ভীষণ শ্লথ হয়ে যেত, মাত্র ৫৬ বছর সময় লাগত বিশ্ব ভ্রমণ করতে। ভ্রমণ শেষে আমরা ফিরে এসে দেখতাম এক হাজার কোটি বছর দূরভবিষ্যতের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া পৃথিবী ও তার মৃত সূর্যকে। আপেক্ষিকতাভিত্তিক মহাকাশ ভ্রমণ উন্নত সভ্যতার কাছে অপরিমেয় মহাবিশ্বকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে, কিন্তু শুধু তাদের কাছে, যারা ভ্রমণে যাবে। এমন কোনো পথ নেই যাতে ফেলে আসা পৃথিবীতে আলোর গতি থেকে দ্রুত তথ্য পাঠানো যেতে পারে, আর যে যাবে সে নিজেও সেই পরিচিত পৃথিবী, ভাই-বোন ও প্রিয়জনদের কাছে কখনো ফিরে আসবে না। তারা সবাই তত দিনে কালের অন্তরালে হারিয়ে গেছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বলে সময়ের গতিকে শ্লথ করে দেওয়া সম্ভব, দূরভবিষ্যতেও যাওয়া সম্ভব, কিন্তু সেখান থেকে কোনোক্রমেই ফিরে আসা সম্ভব নয়।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক-মহাবৃত্ত
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে