স্কুলে ভর্তির ফরম কিংবা এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় বাবার নাম শিক্ষার্থীকে লিখতেই হবে—এই নিয়মের এখন ব্যত্যয় ঘটেছে। উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে ফরম পূরণে শিক্ষার্থীরা অভিভাবক হিসেবে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লিখতে পারবে। এই রায়ের ফলে অসংখ্য অভিভাবক নিশ্চয়ই স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছেন।
২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের এক শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার ফরম ঠিকঠাক পূরণ করতে পারেনি। কারণ, তাঁর জন্মদাতা তাঁকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই ফরমে বাবার নামটি লেখা হয়নি। পায়নি রেজিস্ট্রেশন কার্ড। দেওয়া হয়নি পরীক্ষাও। বাবার পরিচয় নেই বলে পরীক্ষা দিতে পারেনি ওই শিক্ষার্থী—এমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ২০০৯ সালে রিট করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ। চূড়ান্ত শুনানি শেষ হলে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা প্রশংসনীয় বলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে।
১৪ বছর পরে হলেও এ এক যুগান্তকারী রায় বটে! স্বস্তি ও ভালো লাগার বিষয় এই যে বাবা অথবা মা কিংবা আইনগত অভিভাবক যেকোনো একজনের নাম দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের যেকোনো ফরম পূরণ করা যাবে। আগে ফরমে বাবার নাম থাকাটা বাধ্যতামূলক ছিল। এখন আর সেই বাধ্যবাধকতা থাকল না। এর মানে, বাবার নামের কারণে ঠাকুরগাঁওয়ের ওই শিক্ষার্থীর মতো আর কোনো শিশু শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। এই রায়ের ফলে মা-বাবার পরিচয়হীন যেকোনো শিশুর শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিত হলো।
আমাদের সমাজে এমন অনেক শিশু আছে, যাদের বাবার পরিচয় জানা নেই, কিংবা বাবা মারা যাওয়ায় অভিভাবকত্ব নিয়ে আইনি জটিলতা, আবার বিবাহবিচ্ছেদের কারণে অভিভাবকত্ব নিয়ে আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় অনেককে। এসব জটিলতা কিন্তু শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিরও কারণ। আর ফরমে বাবার নাম না দিতে পারলে একটা শিশু মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেই পারে। শুধু তা-ই নয়, সহপাঠী, বন্ধু, এমনকি আত্মীয়দের বুলিংয়ের শিকারও হতে হয়। আর এসব বুঝতে কোনো মনোবিদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
রায়টির আরও একটি ইতিবাচক দিক হলো, পুরুষতন্ত্রের শিকল ভেঙে মা তথা নারীদের উত্তরণ। জন্মের পর একটি শিশু নিজেই তো নিজের পরিচয় বহন করে। আর জন্ম দেওয়ায় মায়ের নামটিই কি অভিভাবক হিসেবে যথেষ্ট নয়? গাঙ্গুবাই নামের এক যৌনকর্মীর জীবনীর ওপর ভিত্তি করে বলিউডে ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়েছে। যাঁরা সিনেমাটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ওই দৃশ্যটি মনে করতে পারেন, যেখানে গাঙ্গুবাই যৌনপল্লির শিশুদের স্কুলে ভর্তি করতে গেলে প্রধান শিক্ষক তাকে প্রথমে মায়ের নাম জিজ্ঞেস করেন। গাঙ্গুবাই নিজের নামটা বলেন। কিন্তু বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে গাঙ্গুবাই পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘মায়ের নাম যথেষ্ট না?’
আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ফরম পূরণে এখন মায়ের নামই যথেষ্ট, সেই সঙ্গে আইনগত যেকোনো অভিভাবকের নাম। উচ্চ আদালতের এই রায়কে আমরা সাধুবাদ জানাই।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে