Ajker Patrika

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে বিলাসী ভ্রমণ

উপসম্পাদকীয়
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২২, ০৯: ২৬
সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে বিলাসী ভ্রমণ

৫ জুলাই ঢাকার এক জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ‘মসলা চাষ শিখতে বিদেশ যাবেন ১৮ কর্মকর্তা’। ‘মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ শীর্ষক সরকারের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এই সফরের আয়োজন। এই সফরের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। সেই প্রস্তাবে ৬৫ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফর করার কথা বলা হয়েছিল। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে এই সংখ্যা কমিয়ে ১৮ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন এ সফরে মোট ব্যয় হবে ৯০ লাখ টাকা। সম্পূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকের বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। একই সঙ্গে ১৮ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের প্রস্তাবটিও অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে দৈনিক আজকের পত্রিকায় আরও একটি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল গত ২৯ জুন। শিরোনামটি ছিল ‘চর দেখতে কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া সফর’। ‘চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট ব্রিজিং’ নামের এক প্রকল্পের অধীনে এই প্রশিক্ষণ সফরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ কোটি টাকা। এই সফরে মোট ২০ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জন অস্ট্রেলিয়া ও ১১ জন কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভূমিহীন মানুষদের চরে স্থানান্তর করে তাদের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের জন্য এই প্রকল্প নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদের ওপরের কারও এই সফর থেকে নেওয়া জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। অথচ সচিব, মন্ত্রীর পিএস, সচিবের পিএস, ডিপুটি কালেক্টর, অতিরিক্ত ডিপুটি কালেক্টরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই বিলাসী সফরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সফর আয়োজন করতে গিয়ে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা কিছুটা কৌশলেরও আশ্রয় নিয়েছেন। গত ১২ মে সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের তিন দিন আগে তাড়াহুড়া করে ৮ মে দুই দফায় ২০ সরকারি কর্মকর্তার নামে সরকারি আদেশ প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, সহজেই সবার নজর এড়ানোর জন্য এই সফরের সরকারি আদেশ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপন হিসেবে দেখানোর পরিবর্তে মন্ত্রণালয়ের নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, চর থাকা তো দূরের কথা, মরুভূমি কিংবা বিরানভূমি ছাড়া কিছুই নেই যে দেশে, সেই অস্ট্রেলিয়ায় কেন কর্মকর্তাদের পাঠানো হলো, তা বোধগম্য নয়। অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরে আসার পরপর ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন—এমন একজন উপসচিবকে এ সফর থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা এখন তাঁর কী কাজে লাগবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সফরের অভিজ্ঞতা তো অবশ্যই কাজে লাগবে, লাগবে না কেন? অস্ট্রেলিয়ায় চর নেই। মরুভূমি, বিরানভূমি তো আছে।’

অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি ও বিরানভূমি দেখে যদি চর দেখা হয়, তাহলে সুদান এবং ওমানেও তো মরুভূমি-বিরানভূমি আছে, তাহলে সেখানে কেন আপনাদের সফরের ব্যবস্থা করা হলো না? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

এসব সফরের পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকে, তা দেশবাসীর কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তা না হলে অস্ট্রেলিয়া সফর করে এসেছেন এমন দুজন কর্মকর্তা তিন-চার মাসের মধ্যেই অবসরে যাবেন জেনেও তাঁদের সফরসঙ্গী করা হলো কোন যুক্তিতে? আসলে এসব সফরের পেছনে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কিছু স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। এমনও দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়ের কোনো বড় কর্মকর্তার সন্তান যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য অবস্থান করছেন, কাজেই সরকারি একটা সফর ম্যানেজ করে ওই সব দেশে ৮-১০ দিনের জন্য তিনি বেড়িয়ে এলেন। তাতে রথ দেখা আর কলা বেচা হলো, মন্দ কী?

পুকুর কাটার প্রশিক্ষণ নিতে বিমানে বিদেশ ভ্রমণকর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে গত ১২ মে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ‘কোভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার এক্সপোজার ভিজিট, স্টাডি ট্যুর, এপিএ ও ইনোভেশনের আওতাভুক্ত ভ্রমণ এবং ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সকল প্রকার বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ থাকবে।’ আরও একটি পরিপত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করার কথা বলা হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, এ দুটি পরিপত্রে নিষেধাজ্ঞা জারির মধ্যে কিছুটা ফাঁক রাখা হয়েছে, তা হলো—দুটো পরিপত্রেই নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ‘সীমিত’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ব্যাপারে এই ‘সীমিত’ শব্দটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে। যেহেতু ‘সীমিত’, তাই প্রয়োজনীয়তা থাকলে বিদেশ ভ্রমণে যেতেই পারেন। অনেকে আবার দাবি করছেন, পরিপত্র জারির আগে বিদেশ সফরের যেসব সরকারি আদেশ হয়েছে তাতে বিদেশ সফরে বাধা থাকার কথা নয়। ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, বিদেশ ভ্রমণে রাজস্ব খাত থেকে অর্থ না গেলে সমস্যা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের উঁচু মহল কি একবারও ধারণা করেনি যে এই ‘সীমিত’ শব্দটি ব্যবহার করে অনেকেই কোনো না কোনো যুক্তি দেখিয়ে বিদেশ সফরের সুযোগ নিতে পারেন? তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই সীমিত শব্দটি সচেতনভাবেই পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবার অনেক সময় দেখা যায় ঠিকাদারি পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনে বিদেশ সফর নিয়েও কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। এসব সফরের সম্পূর্ণ খরচ ঠিকাদারি কোম্পানিই বহন করে। কাজেই এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। এটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত মনে হলেও ঠিকাদারের টাকায় বিদেশ সফর করা কতটুকু নৈতিকতাবিবর্জিত কাজ, তা কি একবারও ভেবে দেখা হয়েছে? একটি কথা মনে রাখতে হবে, ঠিকাদার নিজের টাকায় কর্মকর্তাদের বিদেশ ঘুরিয়ে আনেন না, যে প্রকল্পের জন্য বিদেশ সফর, সেই প্রকল্প থেকে ঠিকাদার যে টাকা পাচ্ছেন, তারই একটি ক্ষুদ্র অংশ থেকেই এ সফরের খরচ মিটিয়ে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে অন্যান্য বরাদ্দের মধ্যে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের খরচের টাকাও প্রকল্পের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে যেহেতু সরকারের তরফ থেকে এযাবৎ কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাইনি, কাজেই উল্লিখিত দাবি বা ব্যাখ্যা সঠিক বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা হয়তো অচিরেই অবসরে যাবেন, তাঁদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে এ ধরনের বিদেশ সফর দলের সঙ্গে তাঁদের নামও অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা কিছুটা আর্থিক বেনিফিট পান। এ কারণেই আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, অবসর নেওয়ার আগে কেউ কেউ এ ধরনের ‘দিলখুশ’ ট্রিপে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে যান। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যক্তিস্বার্থ দেখতে গিয়ে জনগণের করের টাকা খরচ করার অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? এ প্রসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যহীন’ বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের এ-সংক্রান্ত একটি রিট মামলার বিচার শেষে রায় দেওয়ার সময় কিছু পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। নদী পারাপারের ফেরির জন্য সার্চ ও ফগলাইট কেনার প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করতে বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন বিআইডব্লিউটিসির একদল কর্মকর্তা। বিআইডব্লিউটিসির একটি চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের করা ওই মামলায় বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী জিনাত হক নিয়ে গঠিত বেঞ্চ রায় দিতে গিয়ে পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘এখানে সরকারি কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য কেবল তাঁদের সরকারি অবস্থান এবং কর্তৃত্বের অপব্যবহারই করেননি, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়েছেন।’ অন্য আরেকটি পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সার্বিক অদক্ষতার কারণে ফগ লাইটের গুণগত মান ও কার্যকারিতা সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ফগ লাইট প্রয়োজন হয় শীতকালে। অথচ যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে তাঁরা জুন মাসে ওই লাইট পরীক্ষা করেছিলেন। সরকারি দায়িত্বশীলরা যদি এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন হন, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের যে ক্ষতি হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, কর্মকর্তারা কেবল তাঁদের পদের অপব্যবহারই করেননি, অযোগ্যতা স্বীকার না করে চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ নব্য জমিদারের মতো।’ কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বা ভ্রমণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি আলোচিত খবরের প্রসঙ্গ টেনে আদালত তখন বলেছিলেন, ‘আমাদের খুব শিগগির হয়তো দেখতে হতে পারে যে সরকারি কর্মকর্তারা ফরমাল স্যুট পরা শিখতে যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন। বিষয়টি অযৌক্তিক শোনালেও শিগগিরই তা বাস্তবে পরিণত হতে পারে।’

সরকারি কর্মকর্তাদের এসব অদ্ভুত বিদেশ সফর নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার পরও তা বন্ধ করা যায়নি।

কোনো না কোনো যুক্তি দেখিয়ে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ এখনো জারি আছে। যৌক্তিক কারণে বিদেশ সফর করার প্রয়োজন হলে তা করবে, তাতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ‘চর’ দেখা, ‘মসলার চাষ’ প্রশিক্ষণ, ‘পুকুর কাটা’ শিক্ষা কিংবা ‘নলকূপ বসানো’র কাজ শেখা ইত্যাদি উদ্ভট প্রকৃতির যুক্তি দেখিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের করের টাকায় যখন প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়, তখন আপত্তি না করে পারা যায় না। মাঝেমধ্যে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, যেসব ব্যক্তি এমন বিলাসী ভ্রমণে বিদেশে যান, যাওয়ার আগে নিজ স্ত্রী, সন্তান, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-পরিজনকে তাঁরা কী বলে যান? ‘আমি পুকুর কাটার প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছি! মসলা চাষ কীভাবে করে তার প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছি!! অথবা নলকূপ বসানোর কাজ শিখতে যাচ্ছি!!! মনে মনে ভাবি, এসব বলতে এতটুকুও কি তাঁদের লজ্জা করে না?

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...