Ajker Patrika

রাশিয়াকে শুধু বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না

বিজন সাহা
রাশিয়াকে শুধু বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না

অনেক দিন আগে বন্ধু পেনকভ বলেছিল, যদি আমেরিকান, ভারতীয়, বাংলাদেশি—এসব ‘তুমি কে’ সেই প্রশ্নের উত্তর হয়, তাহলে রুস্কি—এটা শুধু ‘কে’ নয়, ‘কেমন’ সেই প্রশ্নেরও উত্তর। মানে রুস্কি শুধু জাতি, দেশ—এসবের সাথেই সম্পর্কিত নয়। এটা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। রুস্কি চেলাভেক—রুশ মানুষ; এটা এক ধরনের বিশেষ মনোভাবের মানুষ। এ জন্যই হয়তো বলে রাশিয়াকে বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না। 

আজ দু মাসের বেশি যুদ্ধ চলছে। কিন্তু লোকজনের মধ্যে তেমন উত্তেজনা নেই। সবাই কাজকর্ম করছে। অফিসে এ নিয়ে তেমন কথা হয় না। সাঁতার কাটতে গিয়ে সুইমিং পুলে, সাওনায় অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। তবে যুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো কথা হয় না। রাস্তাঘাট, দোকানপাট—সব একই রকম। তবে হাজার হাজার শরণার্থী আসছে। সবাই যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে। আমি কয়েক ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড়, জুতা, জ্যাকেট—এসব দিয়ে এসেছি। মানে মানুষের অংশগ্রহণ যে নেই, তা নয়। আসলে এ দেশের মানুষ এমনই। সাধারণত কারও ব্যাপারে নাক গলায় না, কাউকে পছন্দ না হলে সেটা বুঝতে দেয়। আমাদের মতো ‘মুখে হাসি মনে বিষ’—এমন নয়। সরকারকে নিয়েও এদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। জানে নিজেরটা নিজেরই করে খেতে হবে। 

তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখব, এরা শক্ত হাত পছন্দ করে। আগেই লিখেছি এরা নিজে থেকেই নভগোরাদের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাজা রিউরিককে ডেকে এনে নিজেদের নেতা করে। পরবর্তীতে এই বংশের পতন ঘটলে নিজেরা পঝারস্কি ও কুজমা মিনিনের নেতৃত্বে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডের হাত থেকে দেশ মুক্ত করে রোমানভ বংশের পত্তন ঘটায়। গণতান্ত্রিক না হলেও কী রিউরিক, কী মিখাইল রোমানভ—জনগণ দ্বারাই নির্বাচিত। আগেই বলেছি, যখনই এ দেশে শক্তিশালী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে—এ দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। এরা শক্ত হাতে ক্ষমতার ভার দিয়ে নিজেদের কাজে নেমে পড়ে। সোভিয়েত আমলেও ভিন্ন কিছু ছিল না। তবে একটা ব্যাপারে এরা এক–দেশ যখন বিদেশি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, এরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সোভিয়েত আমলে চার্চের ওপর শত অত্যাচারের পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চ যুদ্ধে নামে। এরা এসব যুদ্ধকে বলে মহান পিতৃভূমির যুদ্ধ। এরা নেতাদের সব দোষ ক্ষমা করতে পারে; কিন্তু পরাজয় ক্ষমা করতে পারে না। এই দেশের ওপর, এ দেশের নেতৃত্বের ওপর যত বেশি বাইরের চাপ আসে, তত বেশি এরা নেতার পেছনে এককাট্টা হয়ে দাঁড়ায়। সেটা দেখেছি স্তালিনের সময়; ক্যারিবিয়ান সংকটে। আবার কোনো নেতার প্রতি বাইরের দেশ খুব বেশি সদয় হলে এরা তাদের সন্দেহ করে। নিকট অতীতে এমনটা ঘটেছে গর্বাচভের সঙ্গে, ইয়েলৎসিনের সঙ্গে। কিন্তু যখনই প্রিমাকভ আটলান্টিকের মাঝপথ থেকে বিমান ঘুরিয়েছেন বা রুশ সেনারা ন্যাটোর আগে প্রিস্টিনা বিমানবন্দর দখল করেছে; দেশের মানুষ সেটাকে সমর্থন করেছে। রুশদের সাইকোলজি বুঝতে পশ্চিমের ব্যর্থতাই বারবার তাদের নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ ব্যর্থ করে দিচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে যদি পাপ-পুণ্য, পশ্চিমা বিশ্বে আইনসংগত-বেআইনি—এসব ধারণা জনগণের চিন্তায় প্রথম সারিতে থাকে। এদের ক্ষেত্রে সেটা ন্যায়-অন্যায়। আর এ কারণেই হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের মানবতার মুখোশ এরা বারবার খুলে দিচ্ছে, আর সেখান থেকে বারবার বেরিয়ে আসছে মধ্যযুগীয় জানোয়ার।

যুদ্ধ শুরুর পর শিল্পী, অভিনেতাসহ অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রাশিয়া ত্যাগ করেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মত আছে। তবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ডাক ক্রেমলিন খারিজ করে দিয়েছে। আসলে এই যুদ্ধের পর সমাজে মেরুকরণ ঘটেছে, সবার মুখোশ খুলে গেছে। এখানে আমার চিন্তা-ভাবনা এমন। আমি নিজে দেশের বাইরে ১৯৮৩ থেকে। এ রকম অনেক লোককে জানি, যারা দেশের বাইরে থাকেন। কিন্তু এরা সত্যিকার অর্থেই হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ করেন। তারা দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবেন, এর সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী হন। এদের অনেকেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। আবার অনেকেই আছে, যারা দেশে বাস করেন, উপার্জন করেন, আর অর্থ পাচার করেন উন্নত বিশ্বে। এরা আর যাই হোক দেশ নিয়ে ভাবে না, দেশ তাদের জন্য উপার্জনের জায়গা। একইভাবে আজ যারা রাশিয়া থেকে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই এই দেশে উপার্জন করতেন, আর শপিং করতেন মিলান, প্যারিস, লন্ডন ও নিউইয়র্কে। এদের অনেকেই এ দেশের মানুষের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করতেন না। অনেকেই সরকারি অনুদান পেতেন। তাই এদের অনুপস্থিতি রাশিয়া খুব একটা অনুভব করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এরা কি পারবে নিজেদের সেখানে মানিয়ে নিতে? তাদের পণ্যের মূল ক্রেতা ছিল রুশ জনগণ। এসব শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতারা ওখানে কী করবেন? বর্তমানে যুদ্ধের কারণে হয়তো সেসব দেশে ফ্লোর পাবেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তখন? তা ছাড়া এখন যেভাবে রুশোফোবিয়া পশ্চিমা বিশ্বে শেকড় গেড়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ সেখানে তাদের কতটা গ্রহণ করবে সেটাও ভাবার বিষয়।

বর্তমানে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যত কম কার্যকর হচ্ছে, ন্যাটো ততই আগ্রাসী হচ্ছে। নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, নতুন নতুন অস্ত্র পাঠাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধ যত দূর সম্ভব দীর্ঘায়িত করা। তবে এতে যে শুধু রাশিয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। তখন দেখা যাবে, কার সহ্যশক্তি কত বেশি। আর তার ওপরই নির্ভর করবে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র রাখঢাক না করেই স্বীকার করছে, তারা বিগত বছরগুলোতে ইউক্রেনের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার। আজোভ ব্যাটালিয়নের যারা ধরা পড়ছে, নাম শুনে মনে হয় তাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে রুশ। তবে যুদ্ধ না করে যারা আত্মসমর্পণ করছে, তাদের বেশির ভাগই পশ্চিম ইউক্রেনের। কেন? আসলে পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা কখনোই তেমন একটা যুদ্ধ করেনি। তারা সব সময়ই যখন যে রাজা এসেছে, তাদের আনুগত্য স্বীকার করেছে। ফলে তারা পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ইউরোপে।

এমনও শুনেছি পূর্ব ইউক্রেন থেকে যারা পালিয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা তাদের কাছে বাসা ভাড়া দিয়ে নিজেরা ইউরোপের দিকে যাচ্ছে। আর এদের অনেকেই, বিশেষ করে এলিটদের অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করে। এমন অনেকে ধরা পড়েছে হাঙ্গেরি, রোমানিয়ার সীমান্তে। পালিয়ে বাঁচাদের তালিকায় রয়েছে সেসব লোকজন, যাদের কথা ছিল দেশের হয়ে যুদ্ধ করার। এ নিয়ে ইউরোপে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়েছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যৌনকর্মীর খাতার নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছে। এ নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। এ ছাড়া ইউক্রেনের অনেকেই বিভিন্ন দেশে রুশদের ওপর হামলা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মদানকারী সোভিয়েত সেনাদের মনুমেন্ট ভাঙচুর করছে। তাই যুদ্ধ হচ্ছে মূলত রুশদের সঙ্গে রুশদের। এভাবেই পশ্চিমা বিশ্ব এদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লাগিয়ে নিজেদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করছে। আত্মসমর্পণ করা ইউক্রেন সেনারা বলছে, আত্মসমর্পণ করলে ওদের মেরে ফেলা হবে বলে ভয় দেখানো হয়েছিল। এখন তারা বুঝতে পারছে, এটাই জীবন বাঁচানোর একমাত্র পথ। তা ছাড়া মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বলেও অনেকে জানিয়েছে।

পশ্চিমা বয়ানই কি শেষ কথা
আমরা কথায় কথায় স্বাধীনতার কথা বলি, মুক্ত চিন্তার কথা বলি। আচ্ছা আজ কতটি দেশ স্বাধীন? সত্যের কোনো একক রূপ নেই। একজনের দৃষ্টিতে যা সত্য, অন্যের দৃষ্টিতে তা মিথ্যা হতে পারে। তা ছাড়া পশ্চিমা বয়ানই যে শেষ কথা, তার তো কোনো মানে নেই। এখন এই যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে। আমি জানি গতকাল কেউ কোনো ঘটনার প্রতিবাদ না করলেও আজ সে অনুরূপ ঘটনার বিরুদ্ধে বলতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, এর পর থেকে এ ধরনের যেকোনো ঘটনার প্রতিবাদ করা। সবাই জানে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা। যে বাইডেন পুতিনকে খুনি বলছেন, তিনিই ১৯৯২ সালে বেলগ্রাদ আক্রমণের পক্ষে ওকালতি করেন। ইরাক ও লিবিয়ার যুদ্ধেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এর প্রতিবাদ করে আজ জেলের ভাত খাচ্ছেন। আজ যে কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে, তার শতগুণ অপরাধে অপরাধী যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু সব সময়ই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। এটা আমাদের দেশে কিছু কিছু বিশেষ আসামির মতো। ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশিকে দেখি দেশে এমন কিছু ঘটলে বিষ উগরে দেন, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় হজম করে যান, দরকারে হজমি খেয়ে সেটা করেন। এদের দেখে আমি বুঝি, কেন বাংলাদেশের অনেক লোক ভারতে কোনো মুসলমানের ওপর অত্যাচার হলে প্রতিবাদে সোচ্চার হন, অথচ তারাই বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর অত্যাচার দেখেও মুখ খোলে না। ঠিক এর উল্টোটা ঘটে ভারতে; যারা পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে, তারা ভারতে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে। আসলে এটা এক ধরনের মানসিক রোগ, যখন আগে থেকেই ঠিক করা হয় কাদের প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল হব, আর কাদের প্রতি নিস্পৃহ।

আচ্ছা কেউ কি মনে করেন, ব্রিটিশেরা ভারতীয়দের পছন্দ করত? আমার তো মনে হয়, তারা হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষ সমস্ত ভারতীয়দের একই রকম অবজ্ঞার চোখে দেখত। কিন্তু কখনো হিন্দুদের, কখনো মুসলমানদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করত। ফলাফল—দেশভাগ। তবে তার চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। আজ পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের ভালোবেসে নয়, তাদের হাত দিয়ে যত বেশি সম্ভব রুশ হত্যার জন্য। তারা ভালোভাবেই জানে রুশ, বেলারুশ ও ইউক্রেনীয়—এরা প্রায় একই জাতি। এখন তারা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে এদের বিভক্ত করছে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল—এটা তাদের অমূল্য আবিষ্কার।

অনেককেই দেখি, শুধু পুতিন বিরোধিতা থেকে পশ্চিমের সবকিছু জায়েজ করে দেয়। পুতিনের প্রতি বিভিন্ন মনোভাব থাকতেই পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যদি অন্ধ ঘৃণা হয়, তাহলে বিপদ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর অনেক কিছুই অপছন্দ করি। সত্যি বলতে কি আমি কারওই সবকিছু পছন্দ করি না। কারও মধ্যে পছন্দ করার মতো কিছু থাকলে পছন্দ করি, ঘৃণা করার মতো কিছু থাকলে, সেটা করতেও পিছ-পা হই না। আমার কাছে কোনো কিছুর ভালোমন্দ কে করল তার ওপর নির্ভর করে না, কী করল সেটাই বড় কথা।

পুতিনের সবচেয়ে বড় অবদানগুলোর একটি হচ্ছে রাশিয়াকে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যে দাঁড়ানো যায়, সেটা দেখানো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে ওঠে। কেউই তখন তার প্রতিবাদ করতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ছিল আইন। তাই বেলগ্রাদ আক্রমণ থেকে শুরু করে সবাই হজম করতে হয়। করবেই-বা না কেন? যদি ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে অসংখ্য মার্কিন ঘাঁটি থাকে, তবে তার কথা না মেনে উপায় আছে? ঠিক এ রকম এক সময়ে ২০০৭ সালে পুতিন মিউনিখে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেন। সবাই হেসেছিল। কারণ, রাশিয়া তখন তাদের চোখে ছিল পেট্রল পাম্প। পুতিন সবাইকে দেখিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত না হয়েও বেঁচে থাকা যায়। 

এর অনেক পরে ২০১৫ সালে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথায় ইউক্রেন সে দেশের প্রসিকিউটর জেনারেলকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাই শুধু সুযোগ থাকলেই হবে না, সেটা ব্যবহারের মনোবল থাকতে হবে। মতিলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘গান্ধীর সঙ্গে দ্বিমত করার ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি–উই এগ্রিড টু ডিস্যাগ্রি’। আসলে গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র হলো দ্বিমত প্রকাশের অধিকার। কিন্তু এখন আমরা কী দেখি? যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে রাশিয়ার নিন্দা করতে অস্বীকার করছে, তাদের ওপর নেমে আসছে প্রচণ্ড চাপ। এবার সে যে দেশই হোক—চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা যে-ই হোক। এই বিশ্বে কি আমরা বাস করতে চাই? আমার বিশ্বাস যদি এই যুদ্ধে রাশিয়া হারে, তবে যুক্তরাষ্ট্র হবে সেই দানব, যার দুপুরের খাবারের জন্য প্রতিদিন একটা করে দেশ পাঠাতে হবে। তাই এই যুদ্ধ শুধু রাশিয়ার অস্তিত্বের যুদ্ধ নয়, এটা বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারের যুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধে বিজয়ের কোনোই বিকল্প নেই বলে মনে করছে মস্কো।

নিষেধাজ্ঞায় পশ্চিমও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনবরত হুমকি দিয়ে আসছিল। তাদের ধারণা ছিল, কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েই রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামানো যাবে। যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে এক ধরনের প্যানিক যে সৃষ্টি হয়নি, তা নয়। সেই এক দিনে মানুষ এক ট্রিলিয়ন রুবল ব্যাংক থেকে নামিয়ে নেয়। তবে এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সবাই সেটা করতে পেরেছে, কোথাও কোথাও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। একের পর এক বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু জিনিস কেনার হিড়িক লাগে। মনে আছে, ওই সময় মেয়ে বলল ও স্যানিটারি প্যাড খুঁজে পাচ্ছে না (একেবারে নেই তা নয়, ও যে কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করে সেটা নেই)। আমি দোকানে গিয়ে কিছু কিনে আনলাম, ওয়াইল্ড বেরিতে কিছু অর্ডার দিলাম। মাঝে চিনির অভাব ছিল।

পরে ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছে শুনলাম, যেহেতু প্রথম দিকে ডলারের দাম প্রতিদিন বাড়ছিল, তাই অনেক কোম্পানি ইচ্ছা করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেনি। পরে অবশ্য অ্যান্টিমনোপলি সংস্থা এসব ধরে প্রচুর জরিমানা করে। এরই মধ্যে ডলারের দাম কম-বেশি স্ট্যাবল হওয়ায় জিনিসপত্র দোকানে ফিরে এসেছে। তবে এটা ঠিক হাইটেকের অনেক জিনিসপত্রের অভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে, কিছুদিন পর যখন স্টক শেষ হয়ে যাবে। মনে আছে, সোভিয়েত আমলে এ দেশে কম্পিউটার আমদানির ওপর বিদেশি নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে বিদেশি শিক্ষার্থীরা তখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া—এসব দেশ থেকে কম্পিউটার কিনে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিক্রি করত। তাই আমার ধারণা চীন বাদেও অন্য অনেক দেশের মাধ্যমে সেই সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে। মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদ লাভ খোঁজে। তাই নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে পড়ে সরাসরি এ দেশে বিভিন্ন জিনিস রপ্তানি বন্ধ করলেও তারা অলিগলি খুঁজবে। এখনই ইরানের তেলের সাথে রাশিয়ার তেল মিশিয়ে নাকি বিক্রি হচ্ছে!

রাশিয়া এক বিশাল মার্কেট। যেসব কোম্পানি চলে যাচ্ছে, সেসব জায়গা ফাঁকা থাকবে না। ইতিমধ্যে রাশিয়া থেকে চলে যাওয়া প্রায় হাজারখানেক কোম্পানির স্থান দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অনেক দেশি কোম্পানি এত দিন বিদেশি কোম্পানির সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে যাচ্ছিল, হেরে যাচ্ছিল চীনের বিভিন্ন কোম্পানি। এখন এরা সেই জায়গা দখল করবে। তবে রুশ ক্রেতা এখন যেহেতু ভালো জিনিসের কদর বোঝে, তাই এসব কোম্পানিকে বাধ্য হয়েই নিজেদের প্রোডাক্টের মান উন্নত করতে হবে।

নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশে যাতে কোনো পণ্যের অভাব না হয়, সে জন্যে সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। এটাকে এরা বলে আমদানি বিকল্প। আশির দশকের পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্তের মতোই এই ইম্পরতোজামেশেনিয়ে বা আমদানি বিকল্প বর্তমান রাশিয়ায় প্রচণ্ড জনপ্রিয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৪ সাল থেকেই যখন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিচ্ছিল, তখন থেকেই এখানে শুরু হয় স্বনির্ভর হওয়ার প্রক্রিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমস্ত কলকারখানা যখন রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই বেসরকারিকরণের মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশের শিল্প চিরতরে ধ্বংস করা। সেই প্রক্রিয়ার পরিচালক আনাতলি চুবাইস, যিনি কিছুদিন আগ পর্যন্তও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন, আর যুদ্ধ শুরুর পরপর দেশ ছেড়ে চলে যান; বলেছিলেন, ‘আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, সোভিয়েত সমাজ, তার শিল্প—সবকিছু ধ্বংস করা, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর কোনো দিন পুনর্জন্ম নিতে না পারে।’

এর ফল হিসেবে আমরা দেখেছি, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরা বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল রাশিয়া। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে এখানে শুরু হয় নতুন করে সবকিছু ভেবে দেখা। আর এর সূত্র ধরে কয়েক বছর আগ পর্যন্ত শস্যের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল রাশিয়া আজ অন্যতম প্রধান শস্য রপ্তানিকারক দেশ। সোভিয়েত আমলের শক্তিশালী বিভিন্ন জীবাণু ও ভাইরাস রিসার্চ সেন্টার নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করে। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথিবী পায় করোনার প্রথম ভ্যাকসিন। উড়োজাহাজ তৈরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পর। কিন্তু নতুন রাশিয়ায় সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। ২০১৪ সালের পর থেকে শুরু হয় নতুন করে উড়োজাহাজ উৎপাদন। বর্তমানে রাশিয়ার সিভিল এয়ার পার্কের প্রায় অর্ধেক বোয়িং ও এয়ারবাসের দখলে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর তারা এসব উড়োজাহাজের লিজিং স্থগিত রাখে। ফলে প্রায় এক হাজার উড়োজাহাজ এখন মাটিতে বেকার পড়ে আছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার ফলে এদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারছে না। ফলে পশ্চিমা অনেক লিজিং কোম্পানি বন্ধ হওয়ার পথে।

এদিকে এই সমস্যা সমাধানে রাশিয়া নিজেই উড়োজাহাজ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সময় লাগবে। তবে সেটা ভবিষ্যতে যেকোনো নিষেধাজ্ঞায় দেশটিকে বাঁচাবে। বাড়তি পাওয়া হিসেবে এর ফলে তৈরি হবে নতুন কর্মস্থান, উড়োজাহাজ নির্মাণের মতো বিষয়গুলো আবার ফিরে আসবে এদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। তবে এসব যে খুব সহজে হবে, তা কিন্তু নয়।

সোভিয়েত আমলে রাশিয়ায় প্রায় সব ধরনের ফসলের সিলেকশন হতো। দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশ থেকে কম পয়সায় আমদানির কারণে এখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত আগামী মৌসুমের জন্য বীজ সংরক্ষিত আছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বছর দু-এক পর সমস্যায় পড়তে হতে পারে। চীন, ভারত সহায়তা করতে পারে। তবে তবে এরা এখন থেকেই চাইছে জিন পুলের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে। এককথায় যুদ্ধের পাশাপাশি রাশিয়া তার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক—সব ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাচ্ছে। রুশরা বলে, ‘শান্তি ছিল না, অশান্তি সাহায্য করল’। অনেক দিন ধরে ব্যবসা, বিশেষ করে মধ্যমানের পুঁজির জন্য বেশ কিছু জরুরি আইন এদের সংসদ বা দুমায় পড়ে ছিল, এখন সেগুলো পাস হয়ে গেছে।

লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সংযোগ সড়কহীন সেতু

সম্পাদকীয়
সংযোগ সড়কহীন সেতু

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।

সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।

অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।

সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

জাহীদ রেজা নূর
এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’

ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।

রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।

রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’

আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:

— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?

— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।

পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:

— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?

— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।

স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:

নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু

ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।

রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’

কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’

একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’

এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।

এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।

কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে

চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।

দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’

প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’

চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।

বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।

২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।

ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।

নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।

নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।

এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।

আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।

দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।

তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।

চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।

পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।

অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।

২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।

আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।

সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যা করণীয়

সম্পাদকীয়
যা করণীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।

আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত