বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সুবর্ণজয়ন্তী আজ সোমবার (২১ মার্চ)। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এর জন্ম। শুরুটা হয়েছিল সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত জনপদ শাল্লায়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তখন ভারত থেকে স্বদেশে ফিরে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করত সংগঠনটি।
প্রতিষ্ঠাতার মূলমন্ত্র ছিল—যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি তার কাছেই কার্যকর সমাধানকে নিয়ে যেতে হবে। এভাবেই প্রত্যেক মানুষ পাবে তার সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশের সুযোগ। এই দর্শনকে লালন করেই পথ চলছে ব্র্যাক। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাকই প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রেখেছে। বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার ১০টি দেশের ১০ কোটিরও বেশি মানুষের আত্মনির্ভরতা অর্জনে সহায়তা করে চলেছে ব্র্যাক।
অসংখ্য সাফল্যে গাঁথা মালায় উদ্ভাসিত ব্র্যাকের বহুবিস্তৃত পদচারণ। এর মধ্যে অন্যতম আর্তমানবতার পাশে থেকে বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের নৃশংস সহিংসতায় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলায় পালিয়ে আসে। বাংলাদেশ সরকার তাদের ফিরিয়ে না দিয়ে স্বাগত জানায়। আগতদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল শিশু, যাদের অনেকে এসেছে একা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
আগে থেকেই রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীসহ প্রায় ১৩ লাখ লোকের চাপ পড়ে এই এলাকায়। তাই ব্যাপক সহায়তার প্রয়োজন দেখা দেয়। বাস্তুচ্যুত মানুষের আধিক্যের কারণে কক্সবাজার এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
এই পরিস্থিতিতে জেলাটির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করায় স্থানীয় সম্পদের ওপর আরও বোঝা চেপেছে। বনাঞ্চল বিনষ্ট হয়েছে, হ্রাস পেয়েছে কৃষিজমিও। কাজের সুযোগের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। রোহিঙ্গা ও স্বাগতিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-উত্তেজনাও বেড়ে গেছে। এর ফলে এই জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।
ঠিক তখনই কাজে নেমে পড়ে ব্র্যাক। বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আইএসসিজি এবং দ্বিপক্ষীয় দাতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্র্যাক প্রাথমিক পর্যায় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাড়াদানকারী প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুরক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা এবং জীবিকা, পানি, স্যানিটেশনের উদ্যোগের মাধ্যমে কক্সবাজারের ১৩ লাখেরও বেশি মানুষকে সহায়তা করে চলেছে ব্র্যাক।
ব্র্যাকের ২ হাজার ৩০০-এর বেশি পূর্ণকালীন কর্মী এবং ৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন কক্সবাজারে। এই সেবাদান কার্যক্রম দ্রুত, নমনীয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন এবং সংকটের টেকসই সমাধান বিবেচনা করে ব্র্যাকের কৌশলগত উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করা, স্থানীয় সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্থানীয় জনগণের আত্মনির্ভরশীলতা এবং বয়স, লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধিতানির্বিশেষে সব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
দৈনন্দিন মানবিক সহায়তার পাশাপাশি ব্র্যাক কক্সবাজার ও ভাসানচরের ক্যাম্পেও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমাদের গৃহীত উদ্যোগগুলোর মধ্যে আছে শরণার্থীদের দক্ষতা ও দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্য তৈরি, শিশুদের জন্য শেখার সুযোগ, কিশোর-কিশোরীদের জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং পুরুষ ও নারীদের জন্য কাজের বিনিময়ে নগদ অর্থ প্রদান কার্যক্রম। কক্সবাজারে অবকাঠামোর সার্বিক উন্নয়নেও কাজ করছি আমরা। এলাকা ব্যবস্থাপনাকাঠামো, আশ্রয় অবকাঠামো ও পানি সরবরাহ অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা, অগ্নিকাণ্ড, সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও সাড়াদান পরিকল্পনা উন্নয়নেও কাজ করছে ব্র্যাক।
দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসকল্পে পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন-প্রক্রিয়ার উন্নয়নেও ব্যাপকভাবে কাজ করছে ব্র্যাক। ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে এবং তাদের সক্ষমতা জোরদার করতে ব্যবহার-অযোগ্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সংস্কার, জরুরি প্রস্তুতি ও সাড়াদানের মহড়া বা অনুশীলন, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের দুর্যোগে সাড়াদানের সক্ষমতা জোরদার করা এবং স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে সক্ষম—এমন ডিজিটাল সাপোর্ট সিস্টেম প্রদান প্রভৃতি কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করছি আমরা।
গত চার বছরে ঘূর্ণিঝড় আম্পান, উখিয়া ও টেকনাফের বন্যা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের মতো প্রতিটি দুর্যোগে আমরা প্রথম সাড়া প্রদানকারী হিসেবে কাজ করেছি। আমরা শুধু জরুরি চিকিৎসা, খাদ্য ও সুরক্ষাসহায়তা দিয়ে জীবন বাঁচাইনি, আশ্রয় নির্মাণ করে, জরুরি জিনিসপত্র সরবরাহ করে এবং জীবিকা নির্বাহে সহায়তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনর্বাসনও নিশ্চিত করেছি।
ব্র্যাক বাংলাদেশ সরকারের জেলা উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রেখে চলেছে। স্থানীয় মানুষের জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করা হয়েছে।
গত চার বছরে ব্র্যাক ১৩ লাখের বেশি মানুষকে স্বাস্থ্যসহায়তা, প্রায় ৮১ হাজার পরিবারকে খাদ্যসহায়তা এবং সাড়ে ১৩ হাজার পরিবারকে নগদ অর্থসহায়তা দিয়েছে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১০ হাজারের বেশি আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছে। শিক্ষা নিশ্চিত করেছে ৭০ হাজার শিশুর। মনোসামাজিক চিকিৎসা ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে সাড়ে ৮৬ হাজার শিশুকে।
সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষের কাছে দুর্যোগকালীন সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। প্রায় ৬ হাজার পরিবারকে কৃষি ও অন্যান্য জীবিকা সহায়তা দিয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্র্যাকের এই বিপুল কার্যক্রম এভাবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
ড. মো. আকরামুল ইসলাম, ঊর্ধ্বতন পরিচালক, ব্র্যাক
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে