Ajker Patrika

হাঁসের ডিম কেন বিভিন্ন রংয়ের হয়

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪: ৫১
হাঁসের ডিম কেন বিভিন্ন রংয়ের হয়

ভোলার চরফ্যাশনে একটি দেশি হাঁস কালো ডিম দিচ্ছে। এ নিয়ে পুরো দেশেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে নানা জনে নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে ধোঁয়াশা রয়েই যাচ্ছে। এর বৈজ্ঞানিক কী হতে পারে?

পৃথিবীতে মুরগির বহু জাত থাকলেও ডিমের রং সাধারণ দুটি—সাদা এবং বাদামি। তবে কিছু জাতের মুরগি ক্রিম, পিংক, নীল এবং সবুজ রঙের ডিমও দেয়। তবে হাঁসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। একই জাতের হাঁস হলেও একেক হাঁস একেক রঙের ডিম দিতে পারে।

মুরগির ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোড আইল্যান্ড জাতের মুরগি বাদামি ডিম পাড়ে, আর লংহর্নের ডিম হয় সাদা। আবার আমেরুকানাস জাতের মুরগি নীল রঙের ডিম দেয়। ফলে পালনের জন্য কোনো জাত বাছাই করলে আগে থেকেই জানা যায় সেটি কোন রঙের ডিম দেবে। কিন্তু হাঁসের ক্ষেত্রে কখনোই নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।

একই জাতের ভিন্ন ভিন্ন হাঁস সাদা, নীলচে সবুজ অথবা কালো বা চারকোল ধূসর রঙের ডিম দিতে পারে। অবশ্য পুরো জীবৎকালে একটি হাঁস একই রঙের ডিমই দেয়।

এমনটি কেন হয়? ডিমের খোসার রং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। এটি হাঁস ও মুরগি উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। দেখা যায়, ডিম দেওয়া শুরুর দিকে ডিমের রং বেশি গাঢ় এবং উজ্জ্বল হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রং হালকা হতে শুরু করে। অবশ্য মূল রং অপরিবর্তিতই থাকে।

খোসার রঙের পেছনে একটা সরল বিজ্ঞান আছে। হাঁসদের ডিমের রঙের জন্য দায়ী দুটি জিন। এই দুই জিনই একসঙ্গে বহন করে তারা। হতে পারে, সাদা রঙের জন্য দায়ী জিনটি প্রচ্ছন্ন, আর নীল বা সবুজ রঙের জন্য দায়ী জিনটি প্রকট। অথবা এর উল্টোটা। মিলনের সময় পুরুষ ও স্ত্রী হাঁস একটি করে জিন সরবরাহ করে। অর্থাৎ জাইগোট গঠনের সময় পুরুষ হাঁস থেকে একটি এবং স্ত্রী হাঁস থেকে এটি করে জিন যুক্ত হয়।

যে হাঁসটি নিয়মিত নীল ডিম দেয় অথবা নীল ডিম থেকে জন্ম হয় তার সঙ্গে পরবর্তীতে সাদা জিনের সংমিশ্রণেও শেষ পর্যন্ত নীল ডিম পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

তবে সব সময় এমন হয় না। দেখা যায়, সারা জীবন সাদা ডিম দিয়েছে এমন হাঁসের ডিম থেকে জন্মানো বাচ্চাটিও বড় হয়ে নীল খোসার ডিম পাড়তে শুরু করে। 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, গৃহপালিত সব হাঁসেরই আদি জাত মূলত বুনোহাঁস। এই বুনোহাঁসের ডিম হয় সাধারণত হালকা সবুজ। প্রকৃতিতে নিরাপত্তার জন্যই পাখির ডিমের বিভিন্ন রং হয়ে থাকে বলে বিবর্তনবাদীরা মনে করেন।

এই একটি প্রজাতি থেকে আধুনিক বিভিন্ন জাতের হাঁসের ডিমের বিভিন্ন রং হওয়ার পেছনে ব্রিডার এবং মানুষের নান্দনিকতার আকাঙ্ক্ষাকে দায়ী করা যেতে পারে।

ধারণা করা হয়, হাঁস প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গৃহপালিত পাখিতে পরিণত হয়। ইউরোপে জনপ্রিয় হতে বেশ সময় লেগেছে। সতেরো শতকে হাঁসের প্রজনন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে ইউরোপীয়রা মুরগির প্রজনন শুরু করে। ইউরোপীয়রা হাঁসের সাদা ডিম পছন্দ করত। ‘ব্রিড স্ট্যান্ডার্ড’ বা প্রজননের আদর্শ মান নির্ধারণ হয় ভিক্টোরিয়ান যুগে। মূল ব্রিটিশ পোল্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে।হাঁসের ডিমের রং ইউরোপে জাত উন্নয়নের

ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যায়। যেমন, আইলেসবারি হাঁস প্রাথমিকভাবে সাদা ডিম দিত। ১৮১০ সালে ‘হোয়াইট ইংলিশ’ হিসেবে এ জাত রেকর্ড করা হয়। ১৮৪৫ সালে প্রথম পোল্ট্রি শোতে এই হাঁসই বেশি ছিল। ১৮৭৩ সালে চীনা পেকিন হাঁসের সঙ্গে এর সংকর শুরু হয়। পেকিনগুলো এক বছর পরে আদর্শ মানে পৌঁছায়। যেখানে সাদা পালকযুক্ত সাদা ডিম পাড়া হাঁস আজকের ইউরোপের বাজারে আধিপত্য করছে। 

ভারতীয় রানার হাঁসও এসেছে চীন থেকে। তবে সেটি ইউরোপের ওই ঘটনার অনেক পরে। তারা প্রথম যুক্তরাজ্যে পৌঁছায় ১৮৩৫ সালে। ১৯০০ সালে আদর্শ মানে পৌঁছায়। সেই সময়ে সাদা ডিম ‘বিশুদ্ধ’ জাত হিসেবে বিবেচিত হতো, এখনো এই মানই অনুসরণ করা হয়।

এভাবেই মানুষ বিভিন্ন জাতের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে তাদের পছন্দের জাত উন্নয়ন করেছে। একেক দেশ ও সংস্কৃতির মানুষের রুচি পছন্দ অনুযায়ী হাঁসের চেহারা ও ডিমের রং উন্নয়নে চেষ্টা হয়েছে। যেমন ইউরোপীয়রাই প্রথম সাদা ডিম দেওয়া জাতের উন্নয়ন করে, পরে তারা বিভিন্ন জাতের সংকর থেকেও সাদা ডিম দেওয়া জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়।

বলতে গেলে কয়েক শতক ধরে বিভিন্ন জাত উন্নয়ন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে হাঁস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যান্য বৈশিষ্ট্য উন্নয়নের জন্য এসব সংকর করা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটির প্রভাব পড়েছে ডিমের খোসার রঙে।

তার মানে, কোন হাঁসের ডিমের রং কী হবে সেটি আগে থেকে বলতে পারাটা মুশকিল। একটি হাঁসের প্রজনন ইতিহাস সম্পর্কে জানা থাকলেও ডিমের রং সম্পর্কে হয়তো অনুমান করা যাবে কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

এরপরও আধুনিক জাত বিবেচনায় দেখা গেছে, সাদা ডিম দেওয়া জাতগুলো হলো—পেকিন, স্যাক্সনি, সিলভার অ্যাপল ইয়ার্ড। নীল ডিম পাড়া জাতগুলো—অ্যানকোনা, ম্যাগপাই, ম্যালার্ড এবং রানার। আর কালো বা চারকোল ধূসর রঙের ডিম দেওয়া হাঁসের জাতটি হলো—কাইউগাস। 

কাইউগাস জাতের হাঁস কালো রংয়ের ডিম দেয়। ছবি: সংগৃহীতবলা যায়, হাঁসের ডিমের রং ব্যাখ্যায় সঠিক কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নেই। এটি হতে পারে তার জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে। আবার অনেক সময় খাবার, আবহাওয়া বা শারীরিক সমস্যার কারণেও ডিমের রং নির্ধারণ হতে পারে।

শারীরবৃত্তীয় বিষয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডিমের খোসার মূল উপাদান ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। ডিমের রঙের জন্য দায়ী দুটি রঞ্জক। সবুজ রঞ্জক হলো বিলিভারডিন। আর নীল রঞ্জক ওসায়ানিন—এটি পিত্ত এবং হিমোগ্লোবিন ভাঙনের উপজাত। ডিমের খোসায় বিলিভারডিন অথবা ওসায়ানিনের উপস্থিতি থাকলে তা পুরো খোসায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ডিমের খোসার রং সবুজ বা নীল হয়।

বাদামি এবং লালচে রঙের যে দাগ এবং প্যাটার্ন ডিমে দেখা যায়, এটি খোসা গ্রন্থিতে সংশ্লেষিত প্রোটোপোরফাইরিন থেকে আসে। এটি উৎপাদিত হয় লোহিত রক্তকণিকার ভাঙন থেকে। ডিম উৎপাদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এটি নিঃসৃত ও জমা হয়। এ কারণেই মারান মুরগি ডিম পাড়ার পর সেটি শুকিয়ে যাওয়ার আগে রং ঘষে তুলে ফেলা যায়। আবার কাইউগা হাঁসের ডিমের কিউটিকল (ডিমের ওপরের প্রোটিন স্তর) ঘষে তোলা যায়।

সাদা ডিমের খোসায় শুধু প্রোটোপোরফাইরিন থাকে। এটি নীল এবং সবুজ খোসায়ও বিভিন্ন পরিমাণে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেমিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজে ২০০৬ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এসব তথ্যেরই প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, বেশিরভাগ রঙিন ডিমের ক্ষেত্রে রঞ্জক মূলত ডিমের ওপরের স্তরে প্রলেপের মতো করে ছড়িয়ে পড়ে ডিম্বনালীতে থাকার সময়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভারতের প্রথম জিনগতভাবে পরিবর্তিত ভেড়া এক বছরে পা দিল, কেমন আছে সে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভারতের প্রথম জিনগতভাবে পরিবর্তিত ভেড়াটি সম্প্রতি এক বছর পূর্ণ করেছে। সে ভালোই আছে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।

ভারতশাসিত কাশ্মীরে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ভেড়াটির জন্ম হয়। এর নাম রাখা হয় তারমিম; আরবি ভাষায় যার অর্থ পরিবর্তন বা সম্পাদনা।

শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেড়াটিকে একটি আলাদা খাঁচায় রাখা হয়েছে। সেখানে তার সঙ্গে রয়েছে তার জিনগতভাবে অপরিবর্তিত যমজ বোনটিও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ভেড়াটি পরিবর্তনে তারা ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। এটি ডিএনএ পরিবর্তনের একটি আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি।

সহজভাবে বললে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কাঁচির মতো ডিএনএর এমন অংশ কেটে ফেলতে পারেন, যেগুলো দুর্বলতা বা রোগ সৃষ্টি করে।

গবেষক ড. সুহাইল মাগরে বিবিসিকে বলেন, ‘গর্ভবতী ভেড়ার শরীর থেকে আমরা বেশ কয়েকটি ভ্রূণ সংগ্রহ করি এবং একটি নির্দিষ্ট জিন–যাকে মায়োস্টাটিন জিন বলা হয়, সম্পাদনা করি। এই জিনটি পেশির বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে।’

নিষিক্ত ডিম্বাণু বা ভ্রূণগুলোকে দুই থেকে তিন দিন ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাখা হয়। এরপর সেগুলো একটি স্ত্রী ভেড়ার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়, যাকে ফস্টার রিসিপিয়েন্ট বলা হয়।

ড. সুহাইল মাগরে বলেন, ‘এরপর প্রকৃতি তার কাজ করেছে। প্রায় ১৫০ দিন পর বাচ্চা জন্ম নেয়। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভেড়ার পেশির পরিমাণ বাড়ানো। মায়োস্টাটিন জিন নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে আমরা তা সফলভাবে করতে পেরেছি।’

চলতি মাসের শুরুতে তারমিম এক বছর পূর্ণ করার পর প্রকল্পটির প্রধান গবেষক ও অধ্যাপক রিয়াজ শাহ বিবিসিকে ভেড়াটির বর্তমান অবস্থা জানান।

তিনি বলেন, ‘তারমিম ভালোভাবে বেড়ে উঠছে। এর শারীরবৃত্তীয়, জৈব-রাসায়নিক ও শারীরিক সব সূচকই স্বাভাবিক রয়েছে। প্রত্যাশিতভাবে তারমিমের পেশির বৃদ্ধি তার অ-সম্পাদিত যমজ বোনের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পার্থক্য আরও বাড়তে পারে বলে আমরা মনে করি।’

অধ্যাপক শাহ বলেন, ভেড়াটির স্বাস্থ্য ও টিকে থাকার সক্ষমতা যাচাই করতে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কঠোর নজরদারির মধ্যে নিরাপদ পরিবেশে ভেড়াটিকে রাখা হয়েছে।

তিনি জানান, গবেষণার জন্য সরকারি অর্থায়ন পেতে তারা একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছেন।

গবেষণা ও চিকিৎসার লক্ষ্যে বহু দশক ধরে ভেড়ার জিনগত পরিবর্তন এবং জিন সম্পাদনা করা হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাজ্যের ট্রেসি নামের ভেড়াটি ছিল এর বড় উদাহরণ; যা তার দুধের মাধ্যমে বিশেষ প্রোটিন তৈরি করতে পারত। বর্তমানে ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেশির বৃদ্ধি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও প্রজননক্ষমতার মতো বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।

তারমিমের জন্য ভারতের আট সদস্যের গবেষক দল টানা সাত বছর ধরে কাজ করছে।

অধ্যাপক শাহ বলেন, ‘শুরুর দিকে কিছু ব্যর্থতা ছিল। আমরা একাধিক কৌশল প্রয়োগ করেছি। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সাফল্য আসে। আমরা সাতটি আইভিএফ প্রক্রিয়া চালাই। এর মধ্যে পাঁচটি জীবিত বাচ্চা জন্ম নেয় এবং দুটি গর্ভপাত ঘটে। জিন সম্পাদনা সফল হয়েছে কেবল একটির ক্ষেত্রে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম। এখন পুরো প্রক্রিয়াটি মানসম্মতভাবে স্থির করা গেছে। ভবিষ্যতে সাফল্যের হার অনেক বেশি হবে বলে আমি আশাবাদী।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

২০২৫ সালে যেসব ঐতিহাসিক রহস্যের সমাধান দিল বিজ্ঞান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ডেনমার্কে সংরক্ষিত ২ হাজার বছর আগের হিয়র্টস্প্রিং নৌকা। ছবি: সংগৃহীত
ডেনমার্কে সংরক্ষিত ২ হাজার বছর আগের হিয়র্টস্প্রিং নৌকা। ছবি: সংগৃহীত

দশকের পর দশক কিংবা শতাব্দীকাল ধরে মানবসভ্যতার নানা অধ্যায়ে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বিশ্বজুড়ে এ বছর গবেষকেরা যেন গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব, জেনেটিক বিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজি ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় ২০২৫ সালে উন্মোচিত হয়েছে বহু ঐতিহাসিক রহস্য।

মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে বিদায়ী এই বছরটিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইস্টার আইল্যান্ডের একটি খনিতে পড়ে থাকা অসমাপ্ত পাথরের মূর্তিগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জানতে পেরেছেন, প্রাচীন পলিনেশীয়রা কীভাবে পাহাড় কেটে ধাপে ধাপে বিশাল মোয়াই মূর্তি তৈরি করত।

এদিকে, ইতালির পম্পেই নগরীতে নতুন করে খননকাজ শুরু হওয়ার পর একটি পাথরের সিঁড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হওয়ার আগে শহরটি দেখতে কেমন ছিল তা জানতে সহায়তা করেছে।

পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায় ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫ হাজার ২০০টি গর্ত নিয়েও নতুন ধারণা দিয়েছেন গবেষকেরা। এই গর্তগুলোর নির্মাতা কারা এবং কেন এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল—ড্রোন ফুটেজ ও উদ্ভিদকণা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।

কিছু গবেষণা আবার নতুন প্রশ্নও উসকে দিয়েছে। যেমন—চিকিৎসা নথি না থাকায় বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জেন অস্টেনের মৃত্যুর কারণ জানতে গবেষকেরা তাঁর লেখার ভাষা ও শব্দচয়ন বিশ্লেষণ করছেন।

রহস্যময় এই মমিটির পরিচয় উদ্ঘাটন হয়েছে। ছবি: সিএনএন
রহস্যময় এই মমিটির পরিচয় উদ্ঘাটন হয়েছে। ছবি: সিএনএন

এ বছর ঐতিহাসিক বিষয়ে আলোচিত আবিষ্কারগুলোর একটি হলো, অস্ট্রিয়ার প্রত্যন্ত গির্জায় সংরক্ষিত রহস্যময় একটি মমি। ১৭০০ সাল থেকে ‘বাতাসে শুকানো যাজক’ নামে পরিচিত এই দেহটির পরিচয় দীর্ঘদিন অজানা ছিল। আধুনিক স্ক্যান ও রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা গেছে, তিনি ছিলেন ফ্রাঞ্জ জাভের সিডলার ফন রোজেনেগ নামে একজন অভিজাত ব্যক্তি। পরবর্তীতে তিনি গির্জার যাজক হয়েছিলেন। গবেষকেরা তাঁর দেহ সংরক্ষণের এক অজানা পদ্ধতি ও মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণও চিহ্নিত করেছেন।

এদিকে ডেনমার্কে সংরক্ষিত হিয়র্টস্প্রিং নৌকাটির উৎস নিয়েও রহস্যের পর্দা উঠেছে। ২০০০ বছরেরও বেশি সময় আগের এই নৌকাটি অস্ত্রে ভরা ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় এটি দ্বীপে আক্রমণ করার উদ্দেশে যোদ্ধাদের বহন করছিল। বিশ্লেষণে একটি আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এটিকে তৎকালীন কোনো নাবিকের সরাসরি প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রমাণ মিলেছে—অভিযাত্রী আর্নেস্ট শ্যাকলটনের জাহাজ এইচএমএস অ্যান্ডিউরেন্স ভাঙা স্টিয়ারিং নয়, বরং কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই ডুবে গিয়েছিল।

১৪ হাজার বছর আগের এই দুটি প্রাণীকে ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল। ছবি: সিএনএন
১৪ হাজার বছর আগের এই দুটি প্রাণীকে ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল। ছবি: সিএনএন

১৪ হাজার বছর আগে বরফ যুগের ‘টুমাট পাপিজ’ নামে পরিচিত দুটি সংরক্ষিত শাবককে এত দিন গৃহপালিত কুকুর মনে করা হলেও নতুন জেনেটিক গবেষণায় জানা গেছে, এগুলো আসলে নেকড়ে শাবক ছিল এবং মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

এ ছাড়া ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান নিয়েও নতুন তথ্য মিলেছে। সেই সময়ে নিহত ফরাসি সেনাদের দাঁতের নমুনা বিশ্লেষণ করে টাইফাসের পাশাপাশি প্যারাটাইফয়েড ও রিল্যাপসিং ফিভারের জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা ওই বাহিনীর বিপুল প্রাণহানির অন্যতম কারণ হতে পারে।

সব মিলিয়ে, ২০২৫ সাল বিজ্ঞানের হাত ধরে ইতিহাসের বহু অন্ধকার কোণ আলোকিত করেছে এবং আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে মানবসভ্যতার দীর্ঘ ও জটিল পথচলা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কক্ষপথে স্যাটেলাইট সংঘর্ষের ঝুঁকি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ‘ক্র্যাশ ক্লক’ সতর্কতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট

কোনো বড় ধরনের সৌরঝড় বা প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের কারণে যদি পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলো হঠাৎ নিজেদের গতিপথ পরিবর্তনের সক্ষমতা হারায়, তবে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন এক গবেষণা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব স্যাটেলাইট একযোগে অচল হয়ে পড়লে প্রথম সংঘর্ষ ঘটতে সময় লাগবে গড়ে মাত্র ২.৮ দিন।

গত সাত বছরে পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রায় ৪ হাজার স্যাটেলাইট ছিল, এখন সেই সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজারে পৌঁছেছে। এই বিস্ফোরণধর্মী বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রকল্প। নিম্ন-পৃথিবী কক্ষপথে (৩৪০ থেকে ৫৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়) বর্তমানে স্টারলিংকের স্যাটেলাইটই রয়েছে ৯ হাজারের বেশি।

কক্ষপথে এত বেশি স্যাটেলাইট থাকার কারণে নিয়মিত সংঘর্ষ এড়াতে ‘কলিশন অ্যাভয়ডেন্স ম্যানুভার’ বা গতিপথ পরিবর্তনের কৌশল নিতে হয়। স্পেসএক্স জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে তারা ১ লাখ ৪৪ হাজারেরও বেশি সংঘর্ষ এড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করেছে।

গত মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে নিও সায়েন্টিস্ট জানিয়েছে, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা থিয়েল ও তাঁর সহকর্মীরা স্যাটেলাইটের অবস্থানসংক্রান্ত উন্মুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সংঘর্ষ ঝুঁকি পরিমাপের জন্য নতুন একটি সূচক তৈরি করেছেন। এই সূচকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্র্যাশ ক্লক’।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যদি সব স্যাটেলাইট হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারাত, তবে প্রথম সংঘর্ষ হতে সময় লাগত প্রায় ১২১ দিন। কিন্তু বর্তমানে সেই সময় নেমে এসেছে মাত্র ২.৮ দিনে। এই তথ্য বিজ্ঞানীদেরও বিস্মিত করেছে।

সব স্যাটেলাইট একসঙ্গে অচল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম হলেও ২০২৪ সালের মে মাসে শক্তিশালী সৌরঝড়ে স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলোতে অস্বাভাবিক ঢেউয়ের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী সৌরঝড় হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আগামী বছরগুলোতে স্পেসএক্স, অ্যামাজন ও চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরও হাজার হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে। ফলে কক্ষপথে ভিড় আরও বাড়বে, আর ‘ক্র্যাশ ক্লক’-এর সময়সীমা আরও এগিয়ে আসবে। এই পরিস্থিতি মহাকাশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইতালির পার্কে মিলল ২১ কোটি বছর আগের হাজার হাজার ডাইনোসরের পায়ের ছাপ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ৪৫
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি

উত্তর ইতালির একটি ন্যাশনাল পার্কে ২১ কোটি বছর আগের ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। তাও আবার একটি-দুটি নয়, হাজার হাজার। এই পায়ের ছাপগুলোর কয়েকটির ব্যাস ১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত। আর এগুলো সমান্তরাল সারিতে সাজানো। এসবের মধ্যে অনেকগুলোতে আঙুল ও নখের ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানা গেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এই ডাইনোসরগুলো ছিল ‘প্রোসাওরোপড’ (prosauropod) প্রজাতির। এ প্রজাতির ডাইনোসরের গলা লম্বা ও মাথা ছোট এবং ধারালো নখবিশিষ্ট তৃণভোজী প্রাণী ছিল।

মিলানভিত্তিক জীবাশ্মবিদ ক্রিস্টিয়ানো ডাল সাসো বলেন, ‘কখনো কল্পনাও করিনি, আমি যে অঞ্চলে বাস করি, সেখানেই এমন এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দেখা পাব।’

গত সেপ্টেম্বরে মিলানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কের একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো একজন আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে।

বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০ থেকে ২৫ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক যুগে এই পাহাড়ের অংশটি ছিল একটি সমুদ্র তীরবর্তী সমতল ভূমি, যা পরে আল্পাইন পর্বতমালায় রূপান্তরিত হয়।

ডাল সাসো আরও বলেন, এই জায়গা ডাইনোসরে পরিপূর্ণ ছিল; এটি একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক সম্পদ।

ডাল সাসো আরও যোগ করেন, ডাইনোসরের দলগুলো সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করত এবং সেখানে আরও কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেগুলো থেকে মনে হয়, পশুরা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দলবদ্ধ হয়ে বৃত্তাকারে অবস্থান নিত।

আবিষ্কারকেরা বলছেন, প্রোসাওরোপডগুলো ১০ মিটার বা ৩৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারত। তারা সাধারণত দুই পায়ে হাঁটত, তবে কিছু ক্ষেত্রে পায়ের ছাপের সামনে হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, তারা সম্ভবত মাঝেমধ্যে থেমে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাদের সামনের পা মাটিতে রাখত।

আলোকচিত্রী এলিয়ো ডেলা ফেরেরা এই স্থান আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই আবিষ্কার আমাদের সবার মধ্যে ভাবনার খোরাক জোগাবে এবং আমরা যেখানে বাস করি, আমাদের ঘর, আমাদের পৃথিবী, এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমরা কতটা কম জানি, তা বোঝায়।’

ইতালির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম এবং যাতায়াতের কোনো পথ নেই। তাই গবেষণার কাজে ড্রোনের পাশাপাশি রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

উল্লেখ্য, আগামী বছর ইতালিতে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কটি সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ইতালির সীমান্তবর্তী ফ্রায়েল উপত্যকায় অবস্থিত। মন্ত্রণালয় জানায়, এটি যেন অনেকটা এমন যে, স্বয়ং ইতিহাসই বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ক্রীড়া ইভেন্টকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছে; প্রকৃতি ও ক্রীড়ার মধ্যে এক প্রতীকী সেতুবন্ধনের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানকে এক সুতায় গেঁথেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত